www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সুপ্রিয়র প্রিয় কিছু

সুবাস্তু জেনিম প্লাজার কোন এক ধূসর বিকেল
-------- সুপ্রিয় কুমার চক্রবর্তী

এক
সকালটা শীতের। ঘড়িতে পৌনে আটটা বা তার কিছু বেশী। সাধারণত এতো সকালে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হয় না আমাকে। রশীদ চাচা নটার দিকে আসেন। মুখ ভর্তি পান নিয়ে গার্ডদের সাথে কথা শেষ করেন। ফিচিক করে বারদুয়েক পানের পিক ফেলেন রাস্তায়। এরপর আমার উপর চড়ে বসেন। তবে আজ এতো ভোরে আমাকে কেন ডাকা হল, বুঝলাম না।
মানুষের অজস্র আবিষ্কারের মধ্যে নিজেকে সবসময়ই বিশেষ কিছু একটা ভেবে গর্ব হয় আমার। আমাকে যারা সৃষ্টি করেছে, তারাই আমার পেটে চড়ে এই বিশাল বাড়িটির এ মাথা থেকে ও মাথা যাচ্ছে, ভাবতেই কেমন গা শিরশির করে ওঠে। মানুষের উত্থান পতন যেন আমার হাতেই...
গায়ে সেটে থাকা বাটনে চাপ দিয়েই গন্তব্যের নিশানা খুঁজে নেয় মানুষ। মাঝে মাঝে একটু যে আফসোস হয় না, তা নয়। এই বুকে পাড়া দিয়ে কত মানুষ, প্রয়োজন মিটিয়ে বাড়ি ফেরে কিন্তু এ বাড়ির বাইরে পা ফেলা হয় না আমার। এই শহরেই, নানান ব্যস্ততার একেকটি বাড়ি, সুপার মার্কেট, অফিস পাড়াতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমার বন্ধু, ভাইয়েরা। আমরা একই জাহাজে এসেছিলাম পঞ্চাশ জন, সুদূর দক্ষিণ কোরিয়া থেকে। ধানমণ্ডির সাতাশ নম্বরে সুবাস্তু জেনিম প্লাজায় ঠাই হল আমার।
প্লাজার তিন আর চারতলায় জুড়ে রয়েছে পারসোনা নামে এক রূপ-চর্চা কেন্দ্র। বুঝতেই পারছেন ঢেউ খেলানো চুলের কত লাস্যময়ী মেয়েরা আসে যায় আমার তিন হাত বাই পাঁচ হাত বু্কে ভর দিয়ে, তার কোন গাছপাথর নেই। মাঝে মাঝে মনে হয়, রোবট হয়ে যদি জন্ম হত, তবে কত মজাই না হত! ওদের কারো সাথে যদি থাকতে পারতাম। কিংবা যদি পরজন্মে ‘শায়লা’ বা অনামিকা হয়ে জন্মাতাম, তবে কেমন হত? আমিও এমন সেজেগুঁজে বেরোলে হয়ত সবাই হা করে তাকিয়ে থাকত!
যাবার সময় ওরা যখন নিজেদের সুন্দর লাগছে বলে হাসাহাসি করে, তখন পুলকিত হই। উচ্ছ্বাসে কেউবা গায়ে ঢলে পড়ে। রশীদ চাচাও তখন মাথা নিচু করে মুচকি হাসে, হাসি যে সংক্রামক! ওদের সুগন্ধি আমাকে মোহাবিষ্ট করে রাখে। সবাই নেমে গেলেও মন ভোলানো সৌরভের রেশ থেকেই যায়।
এতক্ষণ যা বললাম, সমস্তই স্বাভাবিক সময়ের কথা। আজ আমাকে চালু করা হয়েছে ঘণ্টাখানেক আগে। কি যেন একটা কাজে অনেকগুলো লোক বারবার ওঠানামা করল। ভারি কি যেন তুলল, বুঝতে পারিনি ঠিক। এর ঘণ্টা দেড়েক পর একটি লাজুক মেয়ে, সাথে আরো চারজন হুড়মুড় করে উঠলো। আঙ্কেল, থার্ড ফ্লোরে দেন... একজন বলল। লাজুক মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে একজন বলল,—
হ্যাঁরে অনিন্দিতা। আজ কি করবি রে? স্ট্রেট করবি না কালার?
ওদের আলাপচারিতার ফাকে নামটা শোনা হল। অনিন্দিতা। মেয়েটা দেখতে দারুণ!

দুই
অনেকটা হঠাৎই আমাকে যে শক্তি জীবিত রাখে, সে বন্ধ হয় গেলো। অমনি পেটের ভেতরে থাকা মেয়েরা ভয় পেয়ে চিৎকার দিল। আমি নির্জীব হয়ে গেলে সচরাচর লোকে এরকমই ভয় পায়, বিশেষত মেয়ে ও শিশুরা। ভয় পাওয়াটা খুব অবশ্য অস্বাভাবিকও নয়, ভেতরে অক্সিজেন প্রবেশের সুযোগ থাকে না তখন। আর ভেতরটা কেমন নিচ্ছিদ্র অন্ধকার, কবরের মত।
রশীদ চাচা অভয় দিয়ে বললেন—
আম্মারা চিন্তা কইরেন না, অহনি চালু হয়া যাইব। জেনারেটর আছে।
ওপাশ থেকে একটা মেয়ে অনিন্দিতাকে বলে উঠলো—
ধ্যাত, তুই একটা কুফা!
আমি কুফা, না? তুই একটা কুফা! তুই আসছিস কেন আজকে?
ঝাঁঝালো উত্তর অনিন্দিতার এক বন্ধুর, এরপর সে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে
কতক্ষণ লাগবে আঙ্কেল, ফ্রাইটেনিং লাগছে...
এই তো আইবো, আইবো। একটু সবুর করে।
রশীদ চাচা হেল্প বাটন চেপে কথা বলার চেষ্টা করে কাউকে পেলেন না! মান্ধাতা আমলের নোকিয়া ১১০০ জাতীয় একটা ফোন বের করে কাউকে ফোন দেবার চেষ্টা করলেন ।
অনিন্দিতা এবারে মুখ খুলল—
আঙ্কেল, আর কতক্ষণ? মাথাটা কেমন ব্যথা করছে!
রশীদ চাচা ফোন চাপছেন।
আমাকে নিয়ে লোকের প্রধান অভিযোগ এটাই। বিদ্যুৎ চলে গেলে শ্মশানের নীরবতা নামে আমার মধ্যে। নিমিষেই আতংক আর মৃত্যুভয়ের পারদ চড়ে। জেনারেটর আছে বলে রক্ষা। না থাকলে নয় নম্বর মহা বিপদ সংকেত! এমনকি চালু হতে দেরী হলেও সব ঘেমে-নেয়ে অস্থির! মজার ব্যাপার কি জানেন, শুধু ওঠা নামাতেই লোকে আমাকে ব্যবহার করে, এর বাইরে এক মুহূর্তও কদর করবার আগ্রহ নেই কারো...
মেয়েগুলোর অস্থিরতা আর আতঙ্কিত কথাবার্তার মাঝেই আলো গুলো জ্বলে উঠলো। লিফট চালু হয়েছে এই সুখে সবার চিৎকার যেন কান ফাটানো। আমিও হেসে উঠলাম, যদিও কেউ টের পেল না। অনিন্দিতারা সব নেমে পড়লো।
আবার অপেক্ষা, কখন আমার গা ঘেঁষে থাকা দেয়ালের বাটনে কেউ চায় দেয়। হয়ত আরও কোন অনিন্দিতা আসবে, সুরভী দিয়ে ভরিয়ে যাবে।
ভাবতে ভাবতেই দু'জন পুলিশ অফিসার উঠল, সঙ্গে আরেকজন লোক। ওদের আলাপ শোনার চেষ্টা করছি!
বিয়ের সাত দিনের মাথায় শ্বশুরবাড়িতে বধূর সুইসাইড, ব্যাপারটা সন্দেহজনক স্যার!
হ্যাঁ, সেই তো কথা!
এমন বিশ্রী ঘটনা! হাই প্রোফাইল ফ্যামিলিতে এমন হলে, সাধারণ পরিবার কি অবস্থা ভাবুন।
আসুন পার্লারের ওনাদের সাথে কথা বলি, ভিডিও ফুটেজ আছে কী না দেখি!
পুলিশের কথা শুনে আমি শিউরে উঠলাম। এমন কথা কালেভদ্রে শুনতে হয়, আর আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। চোখের সামনে ভাসে সেজে-গুঁজে বের হওয়া শায়লা, অনামিকা, রাত্রি, বা নির্ঝরার মুখ। কী মিষ্টি, মায়াবী চাউনি। অথচ ভিতরে বিষের বালি নিয়ে ওরা ঘুরে বেড়ায়। এইতো সেদিনই একটা ছেলে তার প্রেমিকাকে বলতে বলতে উঠছিল উপরে—
বিয়ের এক মাস না যেতেই, নীলাকে ডিভোর্স দিয়েছে ফরহাদ। নীলা অবশ্য আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়নি, স্টুডেন্ট ভিসায় কানাডা চলে গেছে। আবার শুনলাম, বিয়ের দিন প্লেটে চিংড়ি মাছের সাইজ ছোট হওয়ায় কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে বিয়ে ভেঙেছে রিক্তা নামে এক মেয়ের। লোকটা কী মানুষ ?
দুঃখের কথা শুনলে যেমন বুকটা ভারী হয়ে আসে, তেমনি স্বপ্ন, লাজুক ভালোবাসা, আর হাসি আনন্দের আগামীর চিন্তায় বিভোর মেয়েরা, বিয়ের জন্য সাজতে আসে দেখে খুব আনন্দও হয়। জানিনা ওদের কল্পনা আর বাস্তবতার মিলন হয় কি? মাঝে মাঝে খুব কৌতূহল হয় জানতে, মানুষ বিয়ে করে কেন, কি লাভ এতে?

তিন
কদিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। আমার ওপাশের দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে, লিফট সাময়িক বন্ধ। দিন তিনেক ব্যবহার না হওয়ায় ধুলো-ময়লার আস্তর জমেছে। গত পরশু একজন মেকানিক এসে বলে গেছে, অযত্ন আর খামখেয়ালিতে মাদারবোর্ডে সমস্যা হয়েছে। আমি আর বেশিদিন টিকব না। এবারের মত ঠিক করে গেল সে। শরীরের সবগুলো পার্টসের মধ্যে মাদারবোর্ডটা খুবই দরকারি। মানুষের বেলায় যেমন তার হার্ট। কাল কে যেন একজন মার্কেট এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্টকে বলল—
স্যার, লিফটটা ডিস্টার্ব করে খালি। নতুন একটা আনন যায়না।
তার কথা শুনে আমি স্তব্ধ হলাম। আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। মানুষ আমার স্রষ্টা আমি জানি। কিন্তু তবুও এইভাবে শেষ হয়ে যাওয়া কি আমার প্রাপ্য? আর ওই সুন্দর মুখগুলো দেখা হবে না, কানে আসবে না খিলখিল শব্দ। আমার পুরো দেহে লেগে থাকবে না ওদের গায়ের মিষ্টি গায়ের গন্ধ।
রশীদ চাচা পান চিবুতে চিবুতে বাটনে বিসমিল্লাহ বলে স্টার্ট দিলেন। হুড়মুড় করে ঢুকলো কয়েকজন। ওরা কথা বলছে, খুনসুটি করছে। সেদিকে মন নেই আজ। তবু কানে কথা ভেসে আসছে—
বুঝলি ভাবনা, প্রেমজয় থেকে কাল যে শাড়িটা নিলাম, ওটা আরেকটা নিতে হবে, মমের জন্য । মম ওটা পড়লে…
আন্টিকে ও কালারটা না দিয়ে বরং জলপাই কালারের বালুচুরিটা দেখ। ওতে আন্টিকে বেশী ভালো…
আচ্ছা, দোকানে চল, গিয়ে…
আজ মন ভালো নেই বলে সব কথা যদিও পুরোপুরি শুনছি না, তবু কথা তো কানে ভেসে আসেই। রোজই গোটা কতক নাম জানতে পারি। দশ-বারো তলা গন্তব্য হলে অবশ্য অনেক গল্প হত। মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে শুনতাম ওদের কথা। ইদানীং অবশ্য কথা কমে গেছে। ঘাড় কাত করে লোকে মোবাইল চাপে, ফেসবুক দেখে নয়ত ইউট্যুবে গান শোনে। এইতো সেদিন একলোক উপর থেকে নেমে আবার উপরে উঠে গেছে কিন্তু নামেনি। রশীদ চাচা লজ্জার মাথা খেয়ে বললেন, স্যার আপনি কি নামবেন না!
- ওহ সরি! ফিফথ ফ্লোর প্লিজ !
মাঝে মাঝে মজার খবর পাই। গুলশানে এক দম্পতি নাকি লিফটে বিবাহবার্ষিকীর কেক কেটেছে। এটাই নাকি ওদের মজা! কিছু প্রিয়জন নিয়ে টপ টু বটম ক’বার ওঠা-নামা করতে করতে বিবাহ বার্ষিকীর শ্রাদ্ধ। কেন যেন মনে হয়, মানুষের টাকা বেশী হলে মাথা ঠিক থাকে না।
যে কদিন বেঁচে আছি, আরো কত যে কি দেখবো সেটা মানুষই জানে। পৃথিবীতে সাতশ কোটি মানুষ, সাতশ কোটি তাদের আচার প্রথা। আমি আর কজনের কথাই শুনি। গত পরশু লিফটে উঠতে উঠতে গার্গী নামে একজন বলছিলো—
আমি ভাই, হানিমুনের পিছনে বেশী সময় দিতে পারবো না।
ক্লাস শুরু হয়ে যাবে অক্সফোর্ডে, ছুটি নিয়ে এসেছি মোটে দিন পনেরোর।
মনিমালা নামের মেয়েটা উত্তর করল,—বিয়েটা যদি দীপিকা, রনবীরের মতো ইতালিতে করতে পারতাম, আহা!
বিয়ে করতে না পারলেও, ইতালি ঘুরতে তো যেতে পারি, গার্গী বলল।
আমি হেসে উঠি, এ হাসি আনন্দের, কিছু ভাললাগার। মানুষের মন পাখির মত বিশাল আকাশে উড়ে বেড়াতে চায়। স্বপ্ন দেখে, একা একা। কটা স্বপ্নই বা সত্য হয়।

চার
আজ খুব খুশি খুশি লাগছে। কারণটা বলি। দিন কয়েক আগে, পারসোনায় নিজের স্ত্রীকে নিয়ে প্রায়ই আসেন এক লেখক। শুধু যে স্ত্রীর সাজসজ্জায় সঙ্গ দিতে আসা, এমন নয়। আরও কারণ আছে। যাবার সময় স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করছিলেন—
লিফট নিয়ে একটা গল্প লিখলে কেমন হয়?
লেখো না, তোমায় না করেছে কে? আমি না করলেই কি শুনবে? কোনদিন শুনেছ আমার কথা।
লোকটা চুপ করে গেলেন। সেই লোক আমাকে নিয়ে গল্প লিখেছেন জেনেছি। প্রথম আলো পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে গল্পটা। গল্পের নাম ‘সুবাস্তু জেনিম প্লাজায় পুরনো বিকেল’। সেই লেখক আজ আবার এসেছেন। এখন সস্ত্রীক লিফটে। ইচ্ছে করছে একটু ছুঁয়ে দেই লেখককে। মনে মনে তাকে প্রণাম করেছি। অনেকেই আমার গায়ে হেলান দেয়। লেখকের স্ত্রী অনসূয়া হেলান দিলেও লেখক সুপ্রিয় ভট্টাচার্য দিলেন না। অনসূয়া পারসোনার ফ্লোরে চলে গেলে সুপ্রিয় বসে বসে পত্রিকা পড়েন। তিনি স্মার্টফোন ব্যবহারে তেমন স্বচ্ছন্দ নন।
এই ভবনের দোতলায় সিটি ব্রোকারেজের অফিস। অনসূয়ার সাথে এখানে আসা উপলক্ষেই ওই অফিসের দিকে যাবার আগ্রহ হয় লেখক সুপ্রিয় ভট্টাচার্যের। একদিন দুদিন করে অনেক টাকা খাটিয়ে বৈধ জুয়ার আসরে নামে সে। ধরা খেয়েও সুপ্রিয় যেভাবে শক্ত হাতে সবকিছু সামলান, তা বিশ্বাস করতে পারে না রশিদ চাচা। তার মুখে বহুবার শুনেছি, অর্থমন্ত্রী নাকি বলেন—এটা ফটকাদের ব্যবসা।
আমি ঠিক বুঝি না, যেসব কোম্পানি মার্কেটে শেয়ার ছাড়ে তারাও কি ফটকা, ওদের মালিকও কি তাই? তাহলে তো শেয়ার বাজারে ভাল মানুষের আসার কথা নয়, তবু কেন আসে? হয়ত লাভের আশায় অথবা একটু ভালো থাকার আশায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ এ ব্যবসায় নেমে এখন পথের ফকির, সংসার ছাড়া। রশিদ চাচাই গেল বছর সিটি ব্রোকারেজের দুজন কাস্টমারের আত্মহত্যার কথা শুনে খুব আফসোস করছিলেন। যেহেতু লোকটা প্রায়ই আসে, তাই মন চায় জিজ্ঞেস করতে—কিভাবে এমন ধাক্কার পরও কবিতা, গল্প লেখা যায়, এত টাকা লসের পরও স্ত্রীকে নিয়ে আবার এমুখো হন? যদি ভাষা থাকত আমার, তবে সত্যি জিজ্ঞেস করতাম। কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা হয় না। তেমনি সুপ্রিয়’র ভিতরও হয়ত রয়েছে এক আকাশ ভর্তি তারার মতো অব্যক্ত বেদনা। তবে লেখালিখি করেন বলেই লোকটা বোধহয় জানেন কি করে নিজের বেদনা লুকিয়ে সবার আনন্দের উৎস হতে হয়।
সিটি ব্রোকারেজে শেয়ারের পতনে অনেক অঘটনের মধ্যে আরেকটা হল এক পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তির ডিভোর্স। লসের পর সংসারের খরচ কমাতে লোকটা বলেছিল, বাসায় যেন আত্মীয় স্বজন কম কম আসে। এরপর তার স্ত্রী সোজা ভাইয়ের বাসায় আর তারপর ডিভোর্স। এটা জানতে পারি ব্রোকারেজের অপারেটরদের হাসিঠাট্টা থেকে। লোকটি কেমন করে একা এই শীত পার করছে তার খবর নেবার কেউ নেই এখন। কোন রমণী হয়ত তাকে আর বলবে না,—ওগো শুনছ; বাজার থেকে কিছু পাঁচমিশালি গুঁড়ামাছ এনো। পুঁটি, টেংরা, খলশে, সোনালী মাছ যেন অবশ্যই থাকে।
ওসব দুঃখের কথা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ রশিদ চাচার ফোন এলো। সামান্য বেতনের চাকুরে লোকটার কথাগুলো এখনো কানে বাজে—
রাগ কইরেন না আম্মাজান। আল্লায় চাইলে ঈদের সময় তোমার লাইগা সুন্দর একখান লেহেঙ্গা আনুম। এখন খাও আম্মা, তুমি না লক্ষ্মী। মায়েরে ত্যক্ত কইর না। লক্ষ্মী আম্মাজান, আমার দিলের টুকরা!
আচ্ছা রশীদ চাচার বেতন কত, এই প্রশ্নটা কখনো মাথায় আসেনি আগে। পরিবার স্বজন ছেড়ে লোকটা ঢাকাতে থাকে কেন আমি ঠিক বুঝি না! ঢাকায়ই কি সব সুখ। যেই বাইরের জেলা থেকে এই প্লাজায় আসে তারাও ঢাকায় বসবাস করতে চায়। এখানেই কি সারা দেশের মানুষের বড় হবার সকল তন্ত্রমন্ত্র অদৃশ্য এক জাদুর বাক্সে ঢাকা—হোক সে অর্থে-বিত্তে বা শিক্ষায়। এই অর্থ-বিত্ত আর আর একটু খেয়েপরে ভাল থাকার নির্মম প্রচেষ্টায় কত সুখ, স্বস্তি , কত সোনালী রোদ্দুর মাখা স্বপ্ন, কত জোছনা মাখা আবেগ যে ঢাকা পরে যায় তার খবর কে রাখে। সেজন্যই হয়ত শহরের নামও ঢাকা ?

পাঁচ
প্রায় ষোল সতেরো বছর ধরে নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছি এই প্লাজায় আসা মানুষদের। কত হাসি, কত কথার নীরব সাক্ষী আমি। কত নবযৌবনা তরুণী আনন্দের সাজ নিয়ে বের হয়ে গেছে বুকে পা রেখে, তার হিসেব করেনি কেউ। মাঝে মাঝে শুনি, অনেক মেয়েকে বিয়ের আগে তার আত্মীয়দের দেয়া উপদেশগুলো, তেমনি শুনি হতাশায় ভরা যুবকের নীরব গোঙানি।
অনেকতো সুখ দুঃখের কথা বললাম। এবার না হয় কিছু উৎকট অভিজ্ঞতার কথাও বলি। অনেকেই আছেন এসেই কপাল থেকে ঘাম মুছে ছিটকে মারেন আমার শরীরে। সেই ঘাম আমার গায়ে শুকায়। আবার কেউ কেউ নাক খুটে ময়লা লাগিয়ে দেয় রেলিঙে বা দেয়ালে। ঘা ঘিনঘিন করে ওঠে এসবের যন্ত্রণায়। বাধ্য হয়েই সব সইতে হয়। এরা সবাই মানুষ, আমার স্রষ্টার জাতি।
এই যে তরুণীরা খিলখিল হাসিতে ঢলে পড়ে, তাদের ভবিষ্যৎ আনন্দের হোক কামনা করলেও জানতে ইচ্ছে হয় ওরা কেমন আছে। ওদের বিয়ের মেহেদির রং কদিন পর শুকিয়েছিল, নাকি শুকানোর আগেই স্বপ্নের অপমৃত্যু? আবার শেয়ারের কারণে সর্বশান্ত হওয়া যে লোকটি আর আসেনা সে কি বেঁচে আছে? প্রশ্নেরা ভিড় করে মাথায়। শুনেছি, মানুষ নাকি রোবট নামে এক ধরণের যন্ত্র দিয়ে যা খুশি তাই করায়। মানুষের এতো ক্ষমতা। তবু সামান্য লিফটে মিনিট পাঁচেক আটকে থাকলে মরণের ভয়ে অস্থির হয়। তাহলে মৃত্যুর পর কি করবে অন্ধকার-কবরে?
যাক এসব কথা। গতকাল দিনটা ছিল ভীষণ ব্যস্ততার। অগ্রহায়ণ আর মাঘ-ফাল্গুন নাকি বাঙালির বিয়ের মাস। এখন অগ্রহায়ণ তাই ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। লিফটে উঠে কয়েকজন বলাবলি করছিলো—
চেহারা সুরতের যা দশা! এই বুড়ির এত সাজার কি আছে এ্যা, আবার মেকআপ করে?
ঠিকই বলেছিস। বয়স ফিফটিফাইভ আপ। ঢং কত!
এইসব ঢংগীদের জন্যই পুরুষরা বিপথে যায়। ঠিক যেন ...
হতবাক হয়ে এদের কথা শুনি। না, এরা কেউ পুরুষ নয়, সকলেই নারী। অথচ আক্রমণের পাত্রটিও নারী। সেদিন সকালে বয়স্ক মহিলাটি একটি বিয়ের দাওয়াতে যাবেন বলে সাজতে এসেছিলেন। আবার সেদিন বিকেলেই দেখলাম আরেক কিম্ভূত দৃশ্য। বিকেল তখন পড়তির দিকে, চারজনের একটা গ্রুপ এলো। বয়স আঠারো কি বিশ। ওদের একজনের নাম অধরা। তাকেই বাকিদের একজন বলছে—
শোন অধরা, বিয়ে করবি ভাল কথা। কিন্তু কাউকে না জানিয়ে এভাবে হুট করে...
ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না। তোর বাবা পুলিশের কাছে গেলে...
কি যে আবোলতাবোল বলছিস। পুলিশ ঝামেলা করতে আসলে আত্মহত্যার হুমকি দেব। সব লাইনে এসে যাবে। এখন থাম তো..।
এরা পরিবারের কোন শাসন বারণ মানে বলে মনে হয় না। এরা লিফটে ওঠে মোবাইল চাপতে চাপতে একা একা হাসে, ছবিও তোলে। কত মানুষের মোবাইলে আমার ঠাঁই মিলেছে হিসেব নেই। এই টিনেজারদের মনে যে তরুণ বা তরুণী স্বপ্নের জাল বিছিয়েছে তাদের শেষ পরিণতি জানতে বড় সাধ হয়। যে রঙিন চশমায় এরা পৃথিবীকে দেখছে সেই চশমাটা খুলে গেলে বাস্তবতার দগদগে ঘা এরা কতটা সইতে পারবে কে জানে।এই মেয়েগুলোর কথা ভাবতে ভাবতেই রশিদ চাচা মাঝেমাঝে বিড়বিড় করেন --
এই বয়সে আল্লা কি কি যে দেখাইবা, তুমি জানো মাবুদ! দাড়ি-মোছ উঠে নাই পোলাপাইন বিয়া করার লাইগ্যা পাগল । কিয়ামতের বেশী দেরি নাই আর।

ছয়

আর একদিনের কথা। রাত্র তখন দশটার বেশী। নীচের রিসেপশন থেকে জোরে কথা শোনা যাচ্ছে। সেলিম আর জামালকে রশীদ চাচা উচ্চস্বরে কি যেন বলছিলেন। এই সময়টা শুনশান নীরবতার। সবাই ঘরে ফিরে যায়, এমনকি সিকিউরিটির সেলিমরাও। কিন্তু আজ রশিদ চাচার গলা চড়েছে—
হুমকি ধামকি আর মাইরধোর খালি আমগো লগে। লিফটম্যান, রিক্সাওয়ালা এরা য্যান মানুষ না।
আরে রশীদ ভাই, কমপ্লেন দিয়া কিছু হইব না, বাদ দেন।
সেলিম উত্তেজিত রশিদ চাচাকে থামাবার চেষ্টা করে। যদিও তার রাগ মোটেই কমে না, সে আবার বলে ওঠে—
অন্যায়ডা কি কইলাম আমি, তুমিই কও?
বুঝছি তো ভাই।
খালি কইলাম, লিফটের মইধ্যে এমন কইরেন না, এইডা ঠিক না। গুনাহ হইব...
এগুলা বেয়াদপ ফ্যামিলির লোকজন । এগো কথা কইয়া খালিখালি মাথাই গরম হইব
তাই বইলা আমারে মারব? চড় দিয়া কয়, চিনস আমারে!
লিফটের মইধ্যে চুমা-চাট্টি, আর কইলেই চড়-থাপ্পড়। আরে জানোয়ার, ঘরে নিয়া ইচ্ছামতো চুমা গিয়া।
আমারে কয়, তোরে পাইলে জানে শেষ কইরা ফালামু। এইডা কোন কথা ?
সে রাতে ঘুম হয়নি একটুও। রশীদ চাচার কথা ভেবে। পরদিন সকালেও কাজে এসে পাঞ্জাবির এক কোনা তুলে চোখের জল মুছলেন। লোকটার অন্যায় কি, কিই বা অপরাধ? আমি তার রুটি-রুজির জায়গা। এখানে অমন অসভ্যতা তার সহ্য করার কথা না। চাচা যখন রোজ সকালে বিসমিল্লাহ বলে আমাকে স্টার্ট দেয়, তখন আমি নিজেকে ফিরে পাই। আজ তার চোখে জল, এ আমার জন্যে ভীষণ কষ্টের।
ক’দিন ধরেই একটা ফিসফাস শুনছিলাম। আজ সেটা সত্যি হল। হঠাৎ ঘি মাখা কাঁঠাল পাতা আগুনে পড়লে যেমন কুঁকড়ে যায়, আমার অবস্থাও তাই। রশীদ চাচাকে সামনের মাস থেকে ছাটাই করা হয়েছে। আর দিনদশেক পর থেকে সে আর আসবে না। আগামী ঈদে মেয়েটাকে এই মার্কেট থেকে লেহেঙ্গা কিনে দেয়া হবে না আর।
এখন প্রতিদিন লিফটে উঠেই সে বাটনগুলোয় হাত বুলায়, কি যেন খোঁজে। বাটনগুলো যদি আলাদীনের দৈত্যের মতো হাজির হয়ে বলত—কি চান, আমার মালিক। আমি হলফ করে বলতে পারি লোকটা শুধু একটা লেহাঙ্গাই চাইত। কেন বলছি এমন, সেটা স্পষ্ট করি। গত ঈদে ডেকো গ্রুপের ইসমাইল সাহেব এই সুবাস্তু জেনিম প্লাজার সকলকে ঈদের বকশিশ দিতে চেয়েছিলেন। রশীদ চাচা বকশিশের সেই একহাজার টাকা নেননি। শুধু বলেছিলেন—
আমি বকশিশ নেই না স্যার। আপনে আমার পোলাডারে কষ্ট কইরা একটা পিওনের চাকরি হইলেও দেন। স্যার খুব কষ্টে আছি, স্যার।

সাত
আজ প্রায় সপ্তাহ তিনেক হয়ে গেল রশিদ চাচা আর আসেন না কাজে। তিনি কোথায় আছেন এখন কে জানে? হয়ত গ্রামে ফিরে গেছেন। আর না হলে এই শহরেই হয়ত কোন কাজ খুঁজে নিয়েছেন। খুব মিস করছি তাকে। তার চলে যাবার আগে খুব মনে হয়েছিল তাকে বলি, ‘চলে যান এই শহর ছেড়ে। যেখানে আপনার পরিবার, আদরের সন্তান আছে। যেখানে তুচ্ছ কারনে মানুষ মানুষকে অপমান করে না।যেখানে ধানের ক্ষেতের সবুজ ঘ্রাণ বুক ভরিয়ে দেয়।যেখানে স্বপ্নেরা মিথ্যে মেকা-আপে বাঁধাই করা থাকে না।’ বলা হয়নি, আমার যে মানুষের ভাষা জানা নেই।

অবশ্য আমার দুঃখের দিনগুলো কমাবার ব্যবস্থা মার্কেট সমিতি করে ফেলেছে। আগামী মঙ্গলবাদ শরীরের সব পার্টস খোলা হবে, আমাকে বদলে, ঝা চকচকে নতুন একটা লিফট লাগানো হবে। বড় একটা ট্রাকে করে গতরাতেই মালামাল এসে হাজির। অনেক শোরগোল হয়েছিল রাতে, চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। বড় বড় কার্টুনগুলো আমার পাশেই ফাঁকা জায়গাটায় রাখা আছে।
জীবন কি আশ্চর্য তাই না! প্রায় বিশ বছর যেখানে আমি ছিলাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন, দিনদুয়েক বাদেই হয়ে যাব ব্রাত্য একজন। টুকরো যে স্মৃতিগুলো আমাকে হাসাত বা কাঁদাত তারা আর এমন করে আসবে না। আমার শরীর পড়ে থাকবে বাক্সবন্দী হয়ে। স্মৃতিরা ধুলোয় ধুসর হবে। শরীরের পরতে পরতে মরিচা ধরবে। তারপর একসময় এই আমাকে তুলে দেয়া হবে পুরনো জিনিস কেনা-বেচা কোন ব্যবসায়ীর হাতে। তার গোডাউন থেকে সারিয়ে তুলে হয়তো আমার ঠাই হবে অন্য আরেক সুবাস্তু জেনিম প্লাজায় , নয়তো আমার শরীর থেকে সব পার্টস আলাদা আলাদা করে আগুনে গলিয়ে পিন্ড তৈরি করে ফেলে রাখা হবে অন্য কোন রুপান্তরের আশায়। খুবই অনিশ্চিত আমার ভবিষ্যৎ, জানি না কি আছে সামনে।
আজ এই স্মৃতি রোমন্থনের দিনে খুব মনে পড়ছে লেখক সুপ্রিয়কে। তিনি নতুন একটা ফোন কিনেছেন। টাচ স্ক্রিনের একটা দামি স্মার্টফোন। তবে ঠিক বাগে আনতে পারছেন না বিষয়টা। সুপ্রিয় বাবু কার সঙ্গে যেন কথায় কথায় বলেছিলেন রবিঠাকুর নামে এক বিখ্যাত কবি নাকি লিখেছেন ‘একটি রাজপথের আত্মকাহিনী’। তা থেকেই সুপ্রিয় আমাকে নিয়ে গল্প লেখার প্রেরণা পেয়েছেন।
সাধারণত এখানে যারা আসে তারা কেউই সুপ্রিয়’র পাঠক নয়। তবে একবার তার এক পাঠক দেখা করতে এসেছিল তার সাথে। আমার ভেতরে বসেই সুপ্রিয় বাবু তাকে বলছিলেন খুব আগ্রহ নিয়ে—
‘মানুষ একবার জন্মায় গর্ভের মধ্যে, আবার জন্মায় মানুষ হিসেবে। সেইজন্যেই মানুষকে বলা হয় দ্বিজ অর্থাৎ যার দুবার জন্ম হয়... সেরকমই আরেক ভাবনায়, মানুষের একজন্ম যায় নিজেকে নিয়ে, আর জন্ম যায় সকলকে নিয়ে।’
রাজপথের আত্মকাহিনীর মতো আমার জীবনের গল্পটাও কি লোকে মনে রাখবে? কি জানি, ধ্যাৎ এসব কি আবোল তাবোল ভাবছি। ভাবতে ভাবতেই একটা মেয়ে এলো, কানে হেডফোন গোজা। গুনগুন করে গাইছে একটা গান। গানটা ঠিক যেন আমার কথাই বলে উঠল। বিদায়ের আগে গানটা শুনে চোখ বুজে এলো—
‘আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, শুধাইল না কেহ।’
বিকেলের আলো কেমন যেন হেলে পড়েছে। সন্ধ্যা নামছে, শেষ হয়ে আসছে গত বিশ বছরের অভ্যস্ত, পুরনো বিকেল। আজ রাতটা সুবাস্তু জেনিম প্লাজার সাথে আমার সব সম্পর্ক ছিন্নের রাত। বুকের ভেতরটা কেমন ব্যাথায় ককিয়ে উঠছে। কাঁদতে পারলে ভাল লাগত। বুকটা হালকা হত। রাত এগারোটার দিকে একজন ইঞ্জিনিয়ার এল কয়েকজন টেকনিশিয়ান নিয়ে। ওরা আমার শরীর থেকে একে একে পার্টসগুলো খুলতে শুরু করল। বিশ্বাস করুন আমার যতটা না কষ্ট হচ্ছিলো তার চেয়ে বেশি বুক ভেঙে যাচ্ছিল কি এক অজানা দুঃখবোধে। আমি তলিয়ে যাচ্ছিলাম একটু একটু করে। আহা আমার সুবাস্তু জেনিম প্লাজা। আমায় মনে রেখো।
মাদারবোর্ডের স্ক্রু খোলা হচ্ছে... আমার চোখে ভাসছে হাসি হাসি মুখ , খুশির ঝিলিক লাগা উচ্ছ্বাস , আনন্দ বেদনার কাব্য, লাজ রাঙা নববধূর চাহনি, রশীদ চাচা, লেখক সুপ্রিয়...
দূরে কোথাও রবি বাবুর গান বাজছে
‘ এই কথাটি মনে রেখো
তোমাদের এই হাসি খেলায়
আমি যে গান গেয়েছিলেম, জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়
মনে রেখো ...
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৫৫১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৭/০৫/২০১৯

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast