www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

কৃত্য

রাত প্রায় এগারোটা । কৃষ্ণনগর স্টেশনে ট্রেনটা ইন করতে বেশ দেরিই হয়ে গেল । সঙ্গের লাগেজটা কাঁধে চাপিয়ে ট্রেন থেকে নেমে মেন গেটে এলাম । বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে । মাঝে মাঝে আকাশ জুড়ে বিদ্যুতের চমক । স্টেশনের বাইরের লাইট-পোস্টগুলোয় কোন আলো নেই । দুরের একটি মাত্র লাইটপোস্ট থেকে কিছুটা আলো আসছে । কোন রিক্সাও দেখা যাচ্ছে না । এত রাতে বাড়ি যে কি করে পৌছাব ! বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম । দাঁড়িয়ে সাত-পাঁচ ভাবছি এমন সময় আলো-আঁধারির মাঝে হঠাৎ একটা রিক্সাওয়ালা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো । মাথায় গামছা জড়ানো । রিক্সাওয়ালা আমাকে জিজ্ঞাসা করল – “কোথায় যাবা দিদি ?” আমি বললাম – “নগেন্দ্র নগর ...। আমার কথা শেষ না হতেই রিক্সাওয়ালাটি বলে উঠল – “উঠে পড়ো উঠে পড়ো তাড়াতাড়ি । অনেক রাত হয়েছে”। কৃষ্ণনগরে বর্ষার দিনে একটু রাত হয়ে গেলে রিক্সা পেতে বেশ বেগ পেতে হয় । আর রিক্সা পাওয়া গেলেও ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ গুনতে হয় । এই পরিস্থিতিতে রিক্সাওয়ালা আমার কাছে দেবদূতের সমান । আমি আর কথা বাড়ালাম না । এমনকি ভাড়ার দর কষা-কষিতেও গেলাম না । এই পরিস্থিতিতে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে এটাই যথেষ্ট । ভাড়া যা চাইবে তাই দিয়ে দেব । আমি তার কথামত সুরসুর করে রিক্সায় উঠে পড়লাম । রিক্সা চলতে শুরু করল। বৃষ্টির বেগ একটু কমেছে । বিদ্যুতের ঝলকানিও আগের মত নেই । মেন রাস্তায় সব লাইট-পোস্টের আলো জ্বলছে না । মাঝে মাঝে দু’একটা জ্বলছে । রাস্তায় কোন যানবাহন দেখা যাচ্ছে না। রাস্তা-ঘাট একদম ফাঁকা । প্রায়-অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তা দিয়ে রিক্সা চলছে । এত রাতে রিক্সায় চেপে যাচ্ছি । একটু একটু ভয়ও করছে । প্রায় এক কিলোমিটার যাবার পর হঠাৎ রিক্সাওয়ালাটি বলে উঠল – “কি রে জয়ী , আমাকে চিনতে পারলি না ?” রিক্সাওয়ালার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলাম । অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ থাকাতে রিক্সাওয়ালাকে ভালো করে দেখতে পারিনি । সেই জন্য হয়তঃ চিনতেও পারিনি । আমি বললাম – “ঠিক চিনতে পারছিনা”। রিক্সাওয়ালাটি তখন হাসতে হাসতে বলল – “আরে আমি মধু । আমার মা তোদের বাড়িতে রান্নার কাজ করত । ছোট বেলায় একসাথে কত গুলি খেলেছি তোর মনে নেই ?” এবার মনে পড়ে গেল মধুর কথা । আমাদের পাড়ার নিমতলায় থাকে । ওর মা আমাদের বাড়িতে এক সময় রান্নার কাজ করত । মধু সে-সময় খুব ছোট । ওর মায়ের সাথে আমাদের বাড়ি আসত । আমরা প্রায় একই বয়সী । দু’জনে মিলে গুলি খেলতাম । আমাদের বাড়ির পাশে একটা খেলার মাঠ ছিল । সেখানেও বিকালে অনেক ছেলে-মেয়ে আসত । মধুও আসত । সকলে মিলে আমরা খেলাধুলা করতাম । ছেলেবেলার সেসব দিন আজও মনে পড়ে । আমি উচ্চশিক্ষা এবং চাকরির সুবাদে অনেকদিনই কোলকাতায় । সেজন্য বাড়িতে নিয়মিত না থাকায় পাড়ার অনেকের সঙ্গেই দেখা হয় না । অনেকের চেহারা পরিবর্তনের জন্যও চেনা লোককে অচেনা লাগে । তাদের মধ্যে মধুও একজন । এবার হেসে বললাম – “আরে মধু তুই ! সত্যিই তোকে চিনতে পারিনি । মাথায় যা একটা গামছা চাপিয়েছিস তাতে চিনবার জো নেই”। মধু রিক্সা চালাতে চালাতেই কথা বলতে লাগল – “যাক, তাহলে চিনতে পেরেছিস । আমি ভাবলাম তুই হয়তঃ চিনতেই পারবিনা । সেই কবেকার কথা । স্মরন-শক্তি ভালো না থাকলে চেনার কথাও নয় । তোর সঙ্গে কথা বলতে প্রথমে একটু ভয়ই হচ্ছিল । তুই শিক্ষিত, অনেক লেখাপড়া করেছিস । কোলকাতায় থাকিস । তারপর ভালো চাকরি করিস । আমি একজন অশিক্ষিত । লেখাপড়া বেশিদূর করতে পারিনি । কোনরকমে রিক্সা চালিয়ে সংসার চালাই । তাই মনে সংশয় ছিল তুই আমাকে ঠিক চিনতে পারবি কিনা, আমার সাথে কথা বলবি কিনা !” মধু একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে আর আমি রিক্সায় বসে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে স্মৃতির সরণী বেয়ে চলেছি । মধু আবার বলতে লাগল – “জানিস, ছোটবেলার অভ্যাসটা মুখে লেগে রয়েছে । তোকে তুই বলে ফেললাম । কিছু মনে করলি না তো ?” আমি বললাম – “দুর, মনে করব কেন ? তুই তো আমার ছেলেবেলার বন্ধু । বন্ধুত্বের কোন জাত হয় রে মধু ? তুই কি করিস আর আমি কি করি তাতে কি এসে যায় ? রাখ এসব কথা । এখন বল, বর্তমানে তুই কোথায় থাকিস ? তোর ছেলে মেয়ে ক’টি ?” মধু বলল – “এখন আর নিমতলায় থাকিনা রে । অঙ্গনা-য় থাকি । মা আর আমি । বিয়ে করিনি”।

মধুর সাথে কথা বলতে বলতে প্রায় চার কিলোমিটার পথ পার করে কখন যে বাড়ির গেটে পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারলাম না । এই বৃষ্টির রাতে সারাটা রাস্তা ভিজতে ভিজতে ও আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে এর জন্য আমি ওর কাছে সত্যিই কৃতজ্ঞ । এর জন্য ও নিশ্চয়ই অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ বেশি ভাড়া পেতে পারে । আমি রিক্সা থেকে নেমে মধুকে একটা একশো টাকার নোট দিতে গেলাম । ও রিক্সার মুখ ঘোরাতে ঘোরাতে বলল – “না না, তোর কাছ থেকে আমি ভাড়া নিতে পারিনা । তুই ওটা রেখে দে জয়ী । এই বৃষ্টি-বাদলের রাতে তোকে স্টেশনের বাইরে দেখে আমি বুঝতে পারলাম তুই রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছিস । কিন্তু সে-সময়ে অন্য কোন রিক্সা ছিল না । আমিও অঙ্গনার বাড়িতে ফিরে যাচ্ছিলাম । বাড়িতে অসুস্থ মা চিন্তা করছে । কিন্তু তোর পরিস্থিতি দেখে মনে খুব কষ্ট হল । ছোটবেলার বন্ধুকে এভাবে রেখে আমি চলে যেতে পারলাম না । তোকে তোর বাড়িতে পৌঁছে দিতে পেরে আমি খুশি । আমি চলি । ভালো থাকিস”। কথাগুলো বলেই প্যাডেলে চাপ দিয়ে রিক্সা চালাতে যেতেই আমি রিক্সার ব্রেকটা ধরে ওকে দাঁড় করালাম । ওর মোবাইল নম্বরটা নিয়ে বললাম – “তোর মোবাইলে আমি একটা মিস কল দিচ্ছি । সেভ করে রাখবি । ইচ্ছে হলেই ফোন করবি”। তারপর অনেক জোরাজুরি করে ওর জামার পকেটে একশো টাকার দুটো নোট ঢুকিয়ে দিয়ে বললাম – “মানা মাসির জন্য কিছু দিয়ে দিলাম । পরে ফল কিনে দিবি”। মধু আর দাঁড়ালো না । রাত অনেক হয়ে গেছে । ওদিকে অসুস্থ মা ছেলের পথ চেয়ে বসে বসে আছে । মধু রিক্সা চালিয়ে দিল । ওর যাবার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম । আজ মধু যা করল তা জীবনে মনে রাখার মত । ছোটবেলার বন্ধুর মত কাজ করেছে । বন্ধুত্বের মর্যাদা দিয়েছে । আমার দু’চোখ কখন যে জলে ভরে গেছে টেরও পাইনি ।।


***
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮৭৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২১/০৮/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast