www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

পলাশীর প্রান্তরে

পলাশী বর্তমান ভারতের পশ্চিম বাংলা রাজ্যের নদীয়া জেলায় ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত । অবিভক্ত বাংলার তখনকার রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দক্ষিনে এবং কোলকাতা থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার উত্তরে পলাশীর অবস্থান । পলাশীর বিশাল আম্রকুঞ্জ আজও বাংলার শেষ নবাবের স্বাধীনতার সূর্যাস্ত এবং ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পত্তনের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে । ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন সংঘটিত যুদ্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌলাকে পরাজিত করে এই পলাশীর প্রান্তরে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে । আম্রকুঞ্জের পাশেই ব্রিটিশদের তৈরি বিজয়-সৌধ এখনও বিরাজমান ।

পলাশীর যুদ্ধ ভারতীয় উপনিবেশে ব্রিটিশ শাসনের পত্তন সংঘটিত করেছিল । ব্রিটিশরা প্রথমে কোলকাতায় মোঘল শাসকের অনুমতিতে “ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি”-র ব্যানারে ব্যাবসা-বাণিজ্য শুরু করেছিল । কিন্তু বাণিজ্য করতে আসা ব্রিটিশরা যে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি নিয়ে বাংলা তথা  ভারতের প্রশাসকের ভূমিকায় ধীরে ধীরে অবতীর্ণ হবে সেটা তদানীন্তন দেশীয় প্রশাসকরা আঁচ করে উঠতে পারেনি । ব্রিটিশদের পাশাপাশি অন্যান্য ইউরোপিয়ানদের সাথে দেশীয় প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে “ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি”-র ব্যানারে ফ্রেঞ্চরাও এদেশে বানিজ্য করতে এসেছিল । কোলকাতার কাছে হুগলী নদীর তীরবর্তী চন্দননগর এবং চুঁচুড়া ইত্যাদি জায়গায় এদের উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল । বাংলা তথা ভারতে ব্রিটিশরা শুধু তাদেরই স্বার্থ সিদ্ধি এবং কায়েম করার জন্য অন্যান্য ইউরোপিয়ানদের সাথে ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বিতাড়িত করতে উদ্যত হয়েছিল । তাই তারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল । কোলকাতায় কিছু অনৈতিক কাজ বন্ধ করা এবং কর প্রদানে ফাঁকি না দেবার জন্য ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলার নবাব আদেশ দিয়েছিলেন । কিন্তু ব্রিটিশরা  নবাবের আদেশ অমান্য করে তাদের ক্রিয়াকলাপ চালিয়ে যেতে থাকে । অবশেষে নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌলা ব্রিটিশদের শায়েস্তা করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন । ব্রিটিশরা জানতো যে তারা নবাবের সঙ্গে সম্মুখ সমরে এঁটে উঠতে পারবে না । নবাবের সমর শক্তি তাদের থেকে অনেক বেশী । তাই তারা কূটনীতির দাবার ঘুঁটি সাজাতে শুরু করে দিল । ব্রিটিশরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারল যে নবাবের সভা-পারিষদদের মধ্যে অনেকেরই নবাব সিরাজের প্রতি আনুগত্য নেই । আনুগত্যহীন পারিষদ এবং নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলীকে পরবর্তী নবাবের সিংহাসন পাইয়ে দেবার লোভ দেখিয়ে গোপনে তারা সন্ধি স্থাপন এবং চুক্তি সম্পাদন করে নিল । নবাব সিরাজ যুদ্ধ শুরুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত জানতেন না যে তার প্রধান সেনাপতি তারই সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতার দৃষ্টান্ত রাখতে চলেছে ।  ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌলা এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে যুদ্ধ হয় । এই যুদ্ধে সামরিক শক্তিতে বাংলার নবাব অনেক শক্তিশালী ছিল । গোলন্দাজ, ফ্রেঞ্চ সৈন্য, অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী সব মিলিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৫৩০০০ । অপরদিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীতে গোলন্দাজ, ভারতীয় সিপাই ও ইউরোপিয়ান সৈন্য ছিল মাত্র ৩০০০-এর কিছু বেশী ।  এই যুদ্ধে অল্প সংখ্যক ফ্রেঞ্চ সৈন্যও নবাবের স্বপক্ষে যোগ দিয়েছিল ।  সেদিন মাত্র আট ঘণ্টার মধ্যেই ব্রিটিশরা যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল । নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের বিশ্বাসঘাতকতা এবং ব্রিটিশদের প্রতি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে তার অধীনস্থ অধিক সংখ্যক সৈন্য নিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করার জন্য বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে পরাজয় বরণ করে নিতে হয়েছিল । নবাবের অন্য সেনাপতিদের মধ্যে ইয়ার লুতুফ খান এবং রাই দুর্লভ প্রধান সেনাপতির পদাঙ্ক অনুসরণ করলেও সেনাপতি মোহন লাল এবং সেনাপতি মীর মদন কোনক্রমেই নবাব সিরাজকে ছেড়ে যায়নি । তারা তাদের অধীনস্থ অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে বীর বিক্রমে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল ।  নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌলা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে কোনক্রমে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন । ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর প্রান্তরে উড়ল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম বিজয় পতাকা ।

পলাশীর প্রান্তর তার আম্রকুঞ্জ নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে । স্বাধীন বাংলার শেষ সূর্য, স্বাধীন নবাবের সূর্যাস্তের ইতিহাসের সাক্ষ্য এখনও বহন করে চলেছে । পলাশীর প্রান্তর স্মরন করে যারা বীরত্বের জয়গাঁথা সেদিন এঁকে গিয়েছিল । ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রে যারা উপস্থিত ছিল তাদের মধ্যে কেউ স্মরনে তার বীরত্বের জন্য আবার কেউ তার লোভ-লালসা ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্য । তাই পলাশীর প্রান্তর একদিকে ধন্য এবং অন্য দিকে কলঙ্কিতও ।

                        পলাশীর যুদ্ধ
                       =======

 তারিখ ঃ ২৩শে জুন, ১৭৫৭ সাল ।  স্থান ঃ পলাশী, বাংলা সুবা

ফল ঃ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চূড়ান্ত বিজয়

রাজ্যসম্পর্কীয় পরিবর্তন ঃ  ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে বাংলার যুক্তিকরণ

                       অংশগ্রহণকারীগণ ঃ

১। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি            ১। বাংলা সুবা
                                              ২। ফ্রেঞ্চ ইস্ট
                                                  ইন্ডিয়া কোম্পানি

                        সেনাপতি এবং অধিনায়ক ঃ

১। কলো. রবার্ট ক্লাইভ           ১।  সিরাজ-উদ-দৌলা
২। মেজর কিলপ্যাটরিক             ২।  মোহন লাল
৩। মেজর গ্রান্ট                   ৩।  মীর মদন
৪। মেজর আয়ার ক্যুট              ৪।  মীর জাফর আলী খান (স্বপক্ষ ত্যাগী) 
৫। ক্যাপ্টেন গাউপ                 ৫।  ইয়ার লুতুফ খান (স্বপক্ষ
                                          ত্যাগী)
                                     ৬।  রাই দুর্লভ (স্বপক্ষ
                                          ত্যাগী)
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৯৬৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৫/০৬/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast