www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

দূরত্ব (পর্ব-২)

(প্রথম পর্বের পর)
৫.
পড়ন্ত বিকেল।আবছা আবছা আলোয় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার অপেক্ষায়।ট্রেনের ঝিক ঝিক শব্দে মনে নতুন সুর উঠে।গন্তব্যের স্টেশনে পৌঁছাতে আরো ঘন্টা দেড়েক বাকি।সেই সকাল আটটায় যাত্রা শুরু।ক্লান্তি কাটাতে অপু পায়চারী করে ট্রেনের এক বগি থেকে অন্য বগিতে।মাথায় অনেক টেনশন।কাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা।এই উদ্দেশ্যেই যাওয়া।গত সপ্তাহ থেকে এই ভর্তিযুদ্ধ চলছে তো চলছেই।আজ এখানে তো কাল ওখানে।
সারাদিনে প্যাকেটের সিগারেট সবগুলো শেষ।হণ্য হয়ে অপু বিড়ির খুঁজে ট্রেনের ক্যান্টিনের দিকে যায়! ট্রেনে কল্পনাতীত ভিড়।যে পরিমাণ লোক বসে আছে,তার চেয়ে বেশি দাঁড়িয়ে আছে।লোকাল বাসগুলোতে এমনটা স্বাভাবিক,তাই বলে ট্রেনে।পুরো ট্রেন জুড়েই ভর্তিচ্ছু পরীক্ষার্থী।দু'টো বেনসন কিনে কোন ভাবে লোক ঠেলে ঠেলে সে দু'টো কম্পার্টমেন্টের মাঝখানে ফাঁকা জায়গাটায় গেল সে।ফাঁকা জায়গা তো না,সেখানেও দু'চারজন দাঁড়িয়ে আছে।আর তর সইলো না অপুর।একটা বিড়ি ধরিয়ে সুখটান দিতে লাগলো।এই দু'টো টানের জন্য কতোই না ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হলো।
"ভাইয়া ধোয়াটা অন্যদিকে ছাড়ুন দয়া করে।" এক তরুনীর বিরক্তিকর কন্ঠ শোনে অবাক হয়ে ডান পাশে তাকালো অপু।আরেকটা টান দিয়ে তাকিয়েই রইলো।দেখতে প্রায় তার বয়সীই মনে হলো।উড়না দিয়ে নাক চেপে তার দিকে বিরক্তিকর ভঙ্গীতে কপাল ভাঁজ করে তাকিয়ে আছে। অপু মাথা ঘুরিয়ে আবার সিগারেটে টান দিতে থাকলো। "ভাইয়া সিগারেটের ধোয়াটা এদিকে কি না ছাড়লেই নয়?" মেয়েটার এমন আবদার শোনে অপুর মেজাজ গেল চটে। "আপা,বাতাস যেদিকে যাচ্ছে ধোয়াও সেদিকে,আপনার সমস্যা হলে সরে দাঁড়ান না।(কথাটা বলে অপু লক্ষ্য করে আসলে অন্যদিকে আর সরে দাঁড়ানোর জায়গাও নেই।) ছ'টা টাকা দিয়ে কিনেছি।এর একটা মূল্য...." অপুর মুখ থেকে কথা কাড়ে মেয়েটি।" মূল্যই যদি ধরেন তবে টাকা দিয়ে ছাইপাশ কিনে খাচ্ছেন কেন?" "ছাইপাশ হোক আর যা ই হোক আমার টাকা,আপনার কিসের এতো ক্ষতি?" " ওই যে ধোয়া!"
চক্ষু লজ্জার খাতিরে আরো দু'চারটে টান বাকি থাকতেই সিগারেটটা ফেলে জুতা চাপা দেয় অপু।আর ভিড় ঠেলে ঠেলে নিজের বগিতে ফিরে যায়।

ঘটনাচক্রে মেয়েটার সাথে আবার দেখা হয় অপুর।ভার্সিটির গোল চত্বরে।পরীক্ষা শেষে দুপুরবেলা।সে ও পরীক্ষা দিতে আসছিলো।দু'জন ক্যাম্পাসের টঙ দোকানে চা খেতে খেতে কথা বাড়ে।কথা প্রসঙ্গে জানতে পারে দু'জন একই শহরেরই।যাক বাড়ি ফেরার একজন সঙ্গী তো পাওয়া গেল বলে মেয়েটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

ক্যাম্পাসে বেশ কিছু সময় কাটানোর পর রাতের বাসে রওয়ানা দেয় দু'জন।এর মাঝখানে অনেক গল্প চালাচালি হয়।ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায় নি।
পরীক্ষা ফেরত যাত্রার আট ঘন্টার নির্ঘুম বাস ভ্রমন যেন অন্য এক মাত্রায় দু'জনের মনে দাগ কাটে।মোবাইল নাম্বার বিনিময়, ফেসবুক আইডিতে ফ্রেন্ড হওয়া সবই হয় এক যাত্রায়।

পরীক্ষা দিতে এসে যেন অপু একটা প্রাপ্তিই নিয়ে বাসায় ফিরে- "নিতু"।প্রথম দেখাতে খুব শান্ত স্বভাবের মনে না হলেও বেলা শেষে অপুর কাছে নিতু হচ্ছে মিষ্টি এক মেয়ের নাম।দেখতে শুনতে খুবই সাধারণ।নম্রতা আর বিনয় মন কাড়ে অপুর। অপুও নজর কাড়ে নিতুর।মেয়েদের দেখলে ছেলেরা সাধারণত দরদে উপচে পড়ে।অপু যেন একদমই সেরকম নয়।দু'জনের প্রতি দু'জনের ইতিবাচক মনোভাবই একদিন দু'জনের প্রথম দেখা করার রসদ যোগায়। মাঝখানে হয় কিছু দূর আলাপন।মুঠোফোনে শান্তি খোঁজা কথার ফুলঝরিতে।ফেসবুক,ম্যাসেঞ্জার,হোয়াটস এপ এর কল্যানে এগোয় কাছে আসার গল্প।

সুন্দর এক ঝলমলে সকাল।সাধারণত এতো ভোরে ঘুম থেকে উঠে না নিতু।কিন্তু আজ তো আর আট-দশটা দিনের মতো সাদা-সিধে নয়।বহুল প্রতীক্ষিত এক সকাল।ঘন্টা দুয়েক ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে অবশেষে নীল শাড়িই পড়লো সে।অফ হোয়াইট ব্লাউজ।নীল টিপ আর নীল চুড়িতে একদম নীল পরী।সাড়ে ন'টা বাজে।সাড়ে দশটায় অপুর সাথে দেখা করার কথা।একটা ব্রেড জেলি দিয়ে খেয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়লো নিতু।

আধ-ঘন্টা দেরি করে অপু আসলো।তা ও একটা সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে।একটা জিন্স,চে-গুয়েভারার মুখ আঁকা একটা কালো টি-শার্ট।চোখের নিচে স্পষ্ট কালো দাগ।অগোছালো চুল।একটা মানুষের সাথে প্রথম ডেটে এরকম ছন্ন-ছাড়া হয়ে আসে কেউ! দূর থেকে দেখেই মেজাজ বিগড়ে যায় নিতু।কোথায় নীল শাড়ি,আর কোথায় কালো গেঞ্জি! যেন শোক দিবস পালন করতে আসছে! "তোমার হাতের ঐ ছাইপাশটা ফেলে বসো।" অপু শেষ টানটা দিয়ে সিগারেট ফেলে নিতুর পাশে বসে।নিতু হাত দিয়ে নাক চাপে।সিগারেটের উগ্র গন্ধ। "ধুর,এমন করছো কেন? আমি বিড়ি না খেলে কি আর আমাদের পরিচয় হতো বলো?" নিতু নাক থেকে হাত সরিয়ে মুখ ভেংচি কাটে।অপু মুচকি হাসে।
মফস্বলের একটা কলেজের ভেতর একটা লেইক আছে।ওই লেইকের পাড়ে বসেছে দু'জন।চার পাশে সারি সারি গাছ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে বলে সূয্যি মামার তেজ গায়ে তেমন পড়ছে না।হালকা হাওয়া থাকায় পরিবেশটা বেশ মনোরোম।কলেজ বন্ধ থাকায় লোক সমাগমও কম।আছে কিছু কপোত-কপোতি মধুর কিছু সময়ের অপেক্ষায়।
"অপেক্ষায় যদি না থাকলে,তবে প্রেমের স্বাদ বুঝবে কিসে?
অভিমানের খোলসে গা ঢাকলে, সে প্রেম যে যন্ত্রণায় মিশে।"
অপু নিতুর অভিমান ভাঙ্গায়।দু'জন হারায় প্রথম সাক্ষাতের উন্মাদনায়।সরাসরি প্রপোজ করা হয় নি গত সাত দিনে,তবে ফোনালাপ,চ্যাট,ফেসবুকিং দিয়ে সম্পর্ক পৌঁছে গেছে একটা সীমান্তের ওপারে।শিরোনামহীন সম্পর্কের মাধুর্য স্পর্শ করে দু'জনের আবেগ ইন্দ্রিয়কে।

সপ্তাহ খানেক পর আবার দেখা হয় দু'জনের।স্নিগ্ধ বিকেল।বিষণ্ণতার ধোঁয়ায় ভরে বিকেলের আকাশ।দু'জনের মন খারাপের গল্প একই নদীতে ভাসে। গতকাল ইউনিভার্সিটি ভর্তির রেজাল্ট হয়েছে।নিতু চান্স পায় নি।বিচ্ছেদের আগাম বিষাদে তাই ভারাক্রান্ত দু'জন।কেউ ই চান্স না পেলে এখানের কোথাও দু'জন ভর্তি হয়ে যেতো।একসাথে সারাক্ষণ থাকবে বলে আবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েও ভর্তি হবে না,এমন অবান্তর চিন্তাও অপু করতে পারে না।
ভীষণ মন খারাপের দিন।নিতু অপুর কাঁধে মাথা রাখে।অপু নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে কবিতা বুনে।কবিতার জন্মই যেন বিরহ থেকে, বিষণ্ণতা থেকে।
" মন খারাপের দিনে-
ঢেউ খেলে না অকুল পাথারে,
চর জমে সহসা নদীর বুকে।

মন খারাপের দিনে-
হাওয়া লাগে না হলুদ সরষে ক্ষেতে,
ডানা কাটা পায়রায় মনে দাগ কাটে।

মন খারাপের দিনে-
প্রাণ জাগে না এক ঝাঁক শালিকের দলে
ফাগুনের স্নিগ্ধতায়ও সময়ের আগুন ঝরে।

মন খারাপের দিনে-
উতলা হয় না প্রাণ শিশির সিক্ত ঘাসে,
ভাবনাটা স্তব্ধ হয় নাগরিক সকল কোলাহলে।"
সত্যিই মন খারাপের দিনে যেন সবকিছুই ফ্যাকাসে লাগে।তাই আক্ষেপ ঝরে দীর্ঘশ্বাসে।সময়ের সাথে সন্ধ্যা গড়ায়।গোধূলির আভা মিশে বিষাদময় চেহারায়।দু'জনের ভালোবাসার তীব্রতা তাদের ভাবনাগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অদূর ভবিষ্যতের খুব কাছাকাছি।কিভাবে ওখানে অপু থাকবে,না দেখে থাকতে পারবে কি পারবে না,কতো দিন পর দেখা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি নানান প্রশ্নে জর্জরিত মন। 'চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল' এই ভেবে শঙ্কিত নিতু,আর অপু আস্থা যোগায় এই বলে 'দূরত্বই মানুষ খুব কাছাকাছি নিয়ে আসে।'
ভর্তি আর ক্লাস শুরু হতে হতে মাস তিনেক যায় আরো। পড়ালেখার জন্য অপু পাড়ি জমায় অন্য খানে।এর মাঝে চলে অপু-নিতুর কাছে আসার গল্প।সম্পর্ক নামক বন্ধনে জড়ায় তারা কালের স্রোতে।এর মাঝে কতো চাওয়া-পাওয়ার জন্ম হয়,মান-অভিমানে ভর করে সম্পর্ক গড়ায়। কিছু নতুন স্বপ্নে ভর করে চলতে থাকে জীবনের চাকা।দু'জনের দূরত্ব সম্পর্কে বাঁধা না বরং আরো কাছে আসার মূলমন্ত্র হয়।আর প্রযুক্তির কল্যানে ফেইসবুক,ম্যাসেঞ্জার,হোয়াটস এপ,ভাইবার এর মাধ্যমে যোগাযোগ জীবনের ছন্দপতন রোধ করে। অপু বিশ্ববিদ্যালয়ে পায় নতুন পরিবেশ,কিছু নতুন মুখ তবু মন যেন পড়ে থাকে নিজ শহরে,নিজের মানুষের কাছে।ছুটি পেলেই তাই চলে আসে বাসায় নিতুর কাছাকাছি আর বোনাস হিসেবে মায়ের হাতের রান্না।


৬.
সময়ের সাথে সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে অপু-নিতু'র।বাড়ে প্রত্যাশার সীমা।আর সাথে সাথে বাড়ে চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব।দ্বন্দ্বের শুরু হয় সামান্যতেই আর শেষ হয় হতাশায়।তিলে তিলে জমে কিছু ক্ষোভ।বিস্ফোরিত হয় না তবে ভেতরে চলে এর নীরব উদগীরণ।সম্পর্কের বয়স কেবল ছ'মাস।খুব অল্প সময়ে খুব অল্প কিছু ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে দু'জন দু'জনকে ভালোবাসতে শুরু করে।আর তাই অল্পতেই কষ্ট আবার অল্পতেই তুষ্ট,ব্যাপারটা এরকম আর কি! মুহূর্তেই ঝগড়া শুরু আর মুহূর্তেই আবার ভালোবাসাবাসি।দু'জনের মধ্যে অনেক অমিল কিন্তু তাদের পরষ্পরের তীব্র ভালোবাসার কারণে চলে তাদের প্রেমময় সম্পর্ক।
অপুর অত্যাধিক সিগারেট খাওয়াটাই প্রতিদিন অন্তত একবার করে ঝগড়া হবার কারণ।অপু যখন ছুটিতে বাসায় আসে তখন তো তুমুল যুদ্ধ যেন! আর অপু না থাকলে ফোনে তো আর হয় ই!

সপ্তাহ খানেক অপেক্ষার পর দিনটি আসলো।বেশ ফুরফুরে মেজাজে নিতু।অপু আসছে।প্রায় মাস খানেক হয়ে গেল সে আসে নি।কতো দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রহর যে কেটেছে নিতু ছাড়া আর কে জানে! অপু তো ভার্সিটি গিয়ে দিব্যি ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে।পাবলিক ভার্সিটি।রঙীন জীবন।কতো রকমের মানুষ।
নিতু সকাল থেকেই রান্নায় ব্যস্ত।অপুর সাথে ফোনে কথা হলো একটু আগেই।সকালের ট্রেনেই আসছে।বেশি হলে দশটা বাজবে তার বাসায় পৌঁছাতে।আর দুপুরে আসবে নিতুর বাসায়।নিতু নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবে।মা'কে ফ্রেন্ড আসছে বলে ম্যানেজ করে ফেলেছে।ভাগ্যিস তার বাবা অফিসের কাজে শহরের বাইরে গেছে নতুবা এই সাহস কি আর নিতু করতে পারতো! একদিন মা'কে রান্না থেকে মুক্তি দেয়া আর কি! মা-বাবার একমাত্র মেয়ে বলে কথা! নিতু মনের মাধুরি মিশে রান্না করে। মা এমনিতে বাসন মাজা,তরকারি কাটা এগুলোতে সাহায্য করছে আর কি! সরষে ইলিশ,বেগুন ভর্তা,আর দেশি মুরগীর রোস্ট আর সাথে ডাল।অপুর প্রিয় রেসিপি।এই প্রথম বাসায় আসছে।এমনিতেই উত্তেজনায় তার স্পন্দন বেড়েই চলেছে।

দুপুর দু'টা।আকস্মিক বৃষ্টির কারণে অপুর নিতুর বাসায় আসতে একটু দেরিই হয়ে গেল।কাক ভেজা।প্রথমবার বলে কথা।শ্বশুড় বাড়ি বলে কথা।একদম পরিপাটি হয়েই আসলো।মেরুণ রঙের শর্ট পাঞ্জাবি আর কালো জিন্সের প্যান্ট।আজ তার মুখে গায়ে বিড়ি সিগারেটের গন্ধ করছে না বলে নিতু একটু আশ্বস্ত হলো।এটা নিয়ে বেশ টেনশনেই ছিল সে।কতো দিন পর দেখা।এক মাস!! ভাবা যায়? নিতুর খুশিতে যেন আর ধরছে না।
ড্রয়িং রুমে সুবোধ বালকের মতো বসে মায়ের সাথে গল্প করছে অপু।কি বিনয়!! নিতু মনে মনে হাসে আবার শিহরিত হয়।ভাবে।।ইসসস মা না থাকলে এক দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতো যেন!
নিতুর মা খুব রসিক মানুষ।অপু কিছুক্ষণের মধ্যে পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিলো।প্রথমে সে খুব নার্ভাসই ছিল।ওই জড়তাটা বেশ কেটে গেছে এখন।
"ও মা! অনেক হইছে।চলো এবার খেয়ে নেই।অপুর বোধোয় ক্ষুধা লাগছে।" ওদের গল্পের মাঝখানে ভাগ বসায় নিতু। "না না ঠিক আছে।আমার ক্ষুধা লাগে নি তো!" বিনয়ের সাথে অপু উত্তর দেয়।তবু নিতুর কথায় গল্প ছেড়ে সবাই খেতে বসে পড়ে ডাইনিং এ।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়।চারিদিক আবার অন্ধকার হয়ে আসে।গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির সাথে দমকা হাওয়া।ভরপেট খাওয়ার পর ক্লান্তি কাটাতে মা নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে।ড্রয়িং রুমে বসে রিমোট কন্ট্রোল হাতে নিয়ে চ্যানেল বদলানোয় ব্যস্ত অপু।নিতু দু'কাপ চা করে এনে সোফায় অপুর পাশে বসলো।অনেকক্ষণ পরে অপুকে একা পেলো।অন্তত দু'টো কথা তো বলা যাবে মনের মাধুরী মিশিয়ে।দু'জন মাতে নানান গল্পে।কতো দিন পর।বৃষ্টির বেগ বাড়তে থাকে।দমকা হাওয়া জানালা দিয়ে এসে ঘরকে শীতল করে দেয়।নিতু মায়ের ঘরে গিয়ে জানালাটা আটকে দেয় ঘরে বৃষ্টির পানি আসার আশংকায়।মা দিব্যি ঘুমে মগ্ন।কেবলই বিছানায় গেল অথচ! নিতু ড্রয়িং রুমে ফিরে আসে।মনের অজান্তেই যেন তার শরীর শিহরে উঠে।ঘরে আর কেউ নেই।শুধু দু'জনে।নিতু অপুর খুব কাছাকাছি গিয়ে বসে।অপুর হাতের রিমোট টা কেড়ে নিয়ে টি টেবিলের উপর রেখে অপুর হাতটা ধরে।অপু ইতস্তত বোধ করে।নিতু ইশারায় বোঝায় মা ঘুমে।তা শোনে অপুর হাত পায়ের লোম যেন শিহরে উঠে। সে আরো শক্ত করে নিতুর দু'হাত ধরে।হাত ধরা যদিও এই প্রথম নয়।দু'জন পাশাপাশি।বিকেলের বর্ষণে যেন স্নিগ্ধতা ভাসে দু'জনের চোখে মুখে।নিতু চোখ বন্ধ করে ভাসতে যায় পরম সুখের শিহরে।অপু উষ্ণতার খোঁজে পাড়ি জমায় পরিস্থিতির অনুকূলে।সময় স্রোতে ভাসে দু'জন কিছু স্বর্গ সুখ প্রাপ্তির আশায়। কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত হয়তো ছিল না।তবু সময় পরিস্থিতির কারণে তাদের আবেগ মিশে একাকার হয়।প্রকৃতির নিয়মে শরীর জাগে আর মনও ছোটে সেই টানে। মাত্র সাত মাসের প্রেম মাতে আদিম সুখে।আর তার সাক্ষী হয়ে থাকে এক পশলা বৃষ্টি,উদাস হাওয়া,বিকেলের স্নিগ্ধতা।


৭.
মধুর কিছু সময়ের পর যেন আসে কিছু অচেনা সময়।ভালোবাসার উল্টো পিঠ দেখতেও যেন বেশি সময় গেলো না।গত বিকেলের মধুর স্পর্শে এখনো শিহরে উঠছে প্রাণ।আর গত রাত তো কেটেছে ঘুমহীন।অন্য রকম ভালো লাগায়।তবু নিতু জেদ করে।অপুর মোবাইল ফোনটা হাতে নিতেই যতো বিপত্তি।অপুর এন্ড্রয়েডের গ্যালারিতে যেতেই যেনো মনে আচমকা এক আলোড়ন সৃষ্টি হয় নিতুর।
"তোমরা সবাই ফ্রেন্ড বুঝলাম।কিন্তু এই একটা মেয়ের সাথে তোমার এতোগুলো ডুয়েট ছবি কেন?" অপুর উপর বিরক্ত হয়ে নিতুর জিজ্ঞাসা।অপু তার ক্যাম্পাস চলে যাচ্ছে।অপুকে এগিয়ে দিতে স্টেশন যাচ্ছে দু'জন রিকশা চড়ে।অপু নিতুর রাগ দেখে মুচকি হাসে।ছবি দেখিয়ে একে একে পরিচয় করিয়ে দেয় তুলি,বিথী,তনু,লোপা,টুশি,শংকর,প্রদীপ,নিশোর সাথে।তবু যেন নিতুর মনে উঁকি মারে একই প্রশ্ন।তাহলে ওই একটি মেয়ের সাথে এতো ছবি কেন!! নিতুর কথা শুনতে শুনতে অপুর রাগ হয় হঠাৎ। "প্রেম করি বলে কী আর বান্ধবী থাকতে পারে না?" কে কার কথা শোনে।বেশ কথার বাগবিতন্ডা হয়।ঝগড়ার মাঝে একটা কথা বের হয়ে আসে - 'সন্দেহ'।যা ভূমিকম্পের মতো মুহূর্তেই তোলপাড় করে দিয়ে যায় দু'জনকে।কেন অপু এতোদিন ওদের কথা গোপন করলো,বিশেষ করে তুলির কথা! নিতুর মাথায় হাজার প্রশ্নের জন্ম হয়।অপু চলে যাচ্ছে এখন,এই ভেবে নিজেকে সামলে নেয় নিতু।জিজ্ঞাসাগুলোকে অন্তরে পুঁতে রাখে।স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ট্রেন ছাড়ার সময় হয়।বিষণ্ণ চিত্তে দু'জন দু'জনকে বিদায় জানায়।ট্রেন প্লাটফর্ম ছেড়ে যায়।একে অপরের দিকে অপলক চেয়ে থেকে হাত নাড়ে।বারবার কাছে আসার পরই আবার তৈরি হয় দূরত্ব।আর এই দূরত্বই বাড়িয়ে দেয় কাছে আসার আকুলতা।

(চলবে...)
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১০৫৬ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০১/০৩/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • মোঃ ফিরোজ হোসেন ১২/০৩/২০১৬
    শুভেচ্ছা
  • ভালোই এগুচ্ছে ভাই।
  • অনেক সুন্দর লাগলো।
  • প্রদীপ চৌধুরী. ০২/০৩/২০১৬
    বা সুন্দর প্রকাশ!
 
Quantcast