www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গোপলার কথা - ৫০

আত্ম অভিমান
-------------
প্রত্যেকের মধ্যে আত্ম অভিমান থাকা উচিত। এবং থাকে। সে রাজা উজির শ্রোতা বক্তা সাধারণ অসাধারণ শিক্ষার্থী যুবক বৃদ্ধ নারী পুরুষ যেই হোক না কেন। নিজেকে সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠা করার সোপান হল এই আত্ম অভিমান।
কিন্তু ইদানীং এর বিস্তার বিস্তর ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের সর্বস্তরে। যা খুবই উদ্বেগের কারণ।
নিজের ছেলেমেয়েকে বাবা মা আর একটু বেশি পড়ার জন্য বললে কোন কোন ছেলে মেয়ে ঘুরে উত্তর দিচ্ছে অথবা চুপ করে বসে থাকছে অথবা পড়ছে কিন্তু পড়ছে না অথবা অন্য কিছু করছে। তবে মনে মনে তার আত্ম অভিমান জাগ্রত হয়ে উঠছে - কি? আমাকে বলা। দেখাচ্ছি মজা!
স্বামী স্ত্রীকে কিছু বলার সময় বা স্ত্রী স্বামীকে কিছু বলার সময় কিছু বাক বিতণ্ডা হয়েই থাকে। ফলে দুজনের আত্ম অভিমান ঝরে পড়ল - আচ্ছা। আমাকে বলা। দেখাচ্ছি মজা!
অফিস বসকে ঘুরে কোন কর্মচারী কিছু বলল। ব্যাস, বসের আত্ম অভিমান জেগে উঠল - বেশ। আমিও দেখাচ্ছি মজা!
স্কুলে অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষকের এই রকম আত্ম অভিমানের ভয়ে কিছু বলে না। যদি বাই চান্স কোন শিক্ষার্থী বা অভিভাবক কিছু বলে ফেলে (হয়তো ঠিক হয়তো, হয়তো বা ভুল) ব্যাস, শিক্ষক মহাশয়ের আত্ম অভিমান প্রকট হতে শুরু করল - কে রে? তুই বলার কে রে? তোদের আমি মজা দেখাচ্ছি!
অন্যায় করছে, অন্যায় হল পাড়ার অমুকবাবু একটু প্রতিবাদ করল। ব্যাস সেই অমুকবাবুর উপর শুরু হল পাড়ার দাদাদের আত্ম অভিমান - খুব বাড় বেড়েছে না? দেখাচ্ছি মজা!
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাস চলছে। যাত্রীর চিৎকার। ড্রাইভারের হঠাৎ জোরে গাড়ি চালানোর আত্ম অভিমান রাস্তা খুঁজছে - এবার তোরা বোঝ, কেমন মজা!
গাড়ি সারাই করছিলেন মেকানিক। একটু কি বুঝিয়ে বলার মাঝে না বোঝা এসে গেল। ব্যাস মেকানিকের এটা ওটা ঘেঁটে দেওয়া আত্ম অভিমান জেগে উঠল - কি? আমাকে বোঝানো? এবার বোঝ ঠেলা!
আদেশ পালনকারী তখনকার মত শুনল তারপর বেরিয়ে একটু দূরে ঘুরে দাঁড়াল তার আত্ম অভিমান - বলে কি? আমাকে। আমাকে বলে কি? আচ্ছা আমিও দেখাচ্ছি মজা!
কলিগকে বুঝিয়ে বলতেই সে আত্ম অভিমানে গজ গজ করছে - আমাকে কাজ দেখানো! ও রকম কত দেখেছি!
লেখক লেখিকাদের বলা বা বোঝানো অসাধ্য সাধন। সবচেয়ে বেশি আত্মাভিমান এদের মধ্যেই দেখা যায়। যদি ফ্যামিলির দুজন বা তিনজন লিখিয়ে হয় তো প্রতি মুহূর্তে আত্ম অভিমান বোমার মত ঝরে পড়বে।
লেজেণ্ড সাহিত্য আমলে এমন ছিল কি না অত বিশেষ জানি না, তবে বর্তমান লিখিয়েরা কেবল দারুণ, অসাধারণ, মুগ্ধ হলাম, শেয়ার করলাম, ভাল, খুব ভাল ইত্যাদি শুনতে অভ্যস্ত। এর বাইরে কেউ কিছু মন্তব্য করলেই তাঁর এবং তাঁর সাথে তাঁর গোষ্ঠীর আত্ম অভিমানে ৫০০ ডিগ্রী পারদ চড়ে যায়। রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এই সাহিত্য ভাবনার গোষ্ঠীর মধ্যে এমন আত্ম অভিমান মন্তব্য দেখা যায় যে যেন মনে হয় একে এখুনি অ্যাকাডেমি পুরস্কার না দিলে খুব অন্যায় হবে।
আত্ম অভিমান সবচেয়ে বেশি জাগ্রত প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে। যদি কোন কারণে তৃতীয় নয়ন হাজির হয় কিংবা উপলব্ধি করে তাহলে আত্ম অভিমান কোথাকে কোথায় নিয়ে যায় তা আর বলার নয়।
এখন মজার ব্যাপার হল কে কাকে মজা দেখাচ্ছে বা দেখাবে। এভাবে আত্ম অভিমান জাগ্রত হলে জীবন চলে কি?
যে আত্ম অভিমান জীবনের আদর্শ অনন্ত জীবন যাত্রা হওয়া উচিত ছিল তাই হয়ে উঠল - আচ্ছা, দেখাচ্ছি মজা!
কিছু কাল আগেও এই আত্ম অভিমান ছিল, আচ্ছা বলছে যখন দেখাই যাক না। আরও ভালো কিছু করা যায় কি না। আর এখন, ভালো হবে কি মন্দ হবে, আমি নিজে উঠবো কি নামব ওসব পরে; আগে আমাকে বলেছে, তাই দেখাচ্ছি মজা।
আত্ম অভিমানের এই মজা দেখাতে গিয়ে একেবারে শেষ হতেও আপত্তি নেই। কিংবা চুলোয় যাক বিশ্ব সংসার। যেন যান্ত্রিক চক্রব্যূহে মানবিক অভিমন্যু নিষ্পেষিত।
বর্তমান আত্ম অভিমানের ক্ষেত্রে দুটো ব্যাপার কাজ করে। এক, যে বলছে সে হয়তো ঠিক বলছে না। চাপিয়ে দিচ্ছে। দুই, যে শুনছে সে এভাবে শুনতে চাইছে না। কিছু অন্য অবস্থান চাইছে।
উভয় ক্ষেত্রে একটা ব্যাপার অন্তত স্পষ্ট। তা হল অসহিষ্ণুতা। বলা এবং শোনা দুটো ক্ষেত্রেই ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।
বাবা মাকে শ্রদ্ধা করার যে ভাবনা ছেলে মেয়ের মধ্যে ছিল আস্তে আস্তে তা অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে। স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে আর হুকুমজারি করলে কেউই মানতে চাইছে না। কিন্তু কেন?
সবার উপরে যে ভালোবাসা স্নেহ আছে তাতে পরস্পরের জন্য ঘাটতি পড়ছে বলেই কি? সম্পর্কের সঠিক অবস্থানে সংসার নির্মিত। সেখানে অপ্রাপ্তির জোয়ার এসে যাচ্ছে না তো?
কিংবা বাবা মায়ের ছেলে মেয়ের প্রতি যে নজরদারি আগে ছিল এখন তারা সেটা চাইছে না। বাঁধন আলগা করে জীবন হতে চাইছে। আবার বাবা মা দেখছে এতে ছেলে মেয়ে উল্টো স্রোতে বইছে যা জীবনে থেকেও জীবনের বাইরে।
সবাই জানে পার্থিব অবস্থানের কোন লিমিট নাই তাই তাতে চাহিদার এদিক ওদিক হয়; কিন্তু সম্পর্ক নষ্ট হয় না।
কিন্তু অপার্থিব অবস্থান যেমন দয়া, মায়া, ক্ষমা, স্নেহ, ভালোবাসা, প্রেম, প্রীতি ইত্যাদির কোন আপগ্রেডেশন করা হয় নি। সেই বস্তা পচা অবস্থান। বাবা মায়ের কথা শুনতেই হবে, ছেলে মেয়েকে বাধ্য হতেই হবে, গুরুজনের সঙ্গে লঘু গুরু জ্ঞানে কথা বলতেই হবে, ভদ্রতা বজায় রাখতেই হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
যুগ পাল্টে যাচ্ছে, জমানা নানান খাতে বইছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে এই বাবা মা ছেলে মেয়ে অন্যান্য গুরুজন ও তাদের পারস্পরিক অবস্থানে কিছুটা হলেও মানিয়ে নেওয়া ও স্রোতে চলতে দেওয়ায় চললে মনে হয় এই আত্ম অভিমান কিছুটা তার স্থান বদল করবে। যারা পুরনো তাদেরই স্থান ছাড়তে হবে সবার আগে। সামনের ঘটে যাওয়াকে শুধু শুধু মনের মধ্যে অনাচার অসংস্কার বলে ভাবা চলবে না।
এবং তার ফলে 'না না করা চলবে না' 'এটা হতে পারে না?' 'এসব আমি বরদাস্ত করব না' ইত্যাদি চাপিয়ে দেওয়া মতামত আর কেউ শুনতে চাইছে না।
এই একই বক্তব্য যে শ্রোতা সেও বলতে চাইছে কিন্তু সে হয়তো ঘুরে বলতে পারছে না তাই জমা করছে আত্ম অভিমান।
ফলত লাভ কি হচ্ছে? জেনারেশন গ্যাপে প্রজন্ম ছিটকে যাচ্ছে অথবা ধ্বংস হচ্ছে।
আবার ঘরের এই আত্ম অভিমান রাস্তা ঘাটে অফিসে আদালতে বাজারে ময়দানে ঝরে পড়ছে। ফলে অসহিষ্ণুতা দিন দিন বাড়ছে। এর একমাত্র সমাধান ভালোবাসা। শুধু মানুষে মানুষে ভালোবাসা।
পাশের জন একজন মানুষ। শুধু মানুষ। ওকে সরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবলে তোমাকেও তো অন্য কোন মানুষ সরিয়ে দেওয়ার কথা ভাববে। ভাবতে পারে। তার মানে আমাকে নিরাপদে রাখতে আমাকেই বিপদে ফেলে দিচ্ছি আমি নিজে নিজস্ব আত্ম অভিমানে।
আত্ম অভিমান হোক মানবতার অহংকার। যার বলে আমি উপরে উঠে তোমাকেও হাত বাড়িয়ে দেব। দেখিয়ে দেব কিভাবে তোমাকে কাছে টেনে নিতে হয়।
বড় হতে হলে এ রকম কিছু আত্ম অভিমান অন্যের মত করে নিতে হয়। 'আমাকে বলা। আচ্ছা দেখাচ্ছি মজা' - এ রকম ভাবনা হোক আরও চমকপ্রদ কিছু দেখানোর জন্য।
বিষয়শ্রেণী: সমসাময়িক
ব্লগটি ৬৯৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৩/১১/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • সোলাইমান ২৩/১১/২০১৭
    একদম বাস্তব কথার কবিতায় প্রকাশ।
    ভালো থাকুন কবি।
    আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই প্রিয় কবিকে।
  • গোপালের কথার অর্ধশতক পূর্ণ হলো।কথাগুলো ভাবনাতে ফেলে দেয়।
    • গোপলার..
 
Quantcast