www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সংসার - (শেষ অংশ)

... ক্রমশ...

ছুটলাম বড় রাস্তার দিকে। মানুষ জন এমন কি একটা পক্ষী পর্যন্ত রাস্তায় নেই। এইটুকু রাস্তা হেটে দেখি মাথা থেকে ঝর ঝর করে ঘাম ঝরছে। লতিফের দোকানের কাছাকাছি যখন পৌঁছলাম, খোলা বারান্দায় বেঞ্চিতে মাথাটা উস্কো খুস্কো চুলে ভর্তি একটি ছেলে এই গরমেও বিড়ি টেনে টেনে আকাশের দিকে ধোঁয়া ছাড়ছে। পকেটের চশমাটা চোখে দিয়ে লক্ষ্য করে দেখলাম, এতো আমাদের ভরত দাদার ছেলে।

নাম মনে আছে ‘উজ্জ্বল’। কারণ এক সময় ও আমারই ছাত্র ছিল। পঞ্চম শ্রেনীতে বৃত্তি পেয়েছিলো ছেলেটি। তারপরও কয়েকবার ওকে ভরত দাদার সঙ্গে মেলান্দ বাজারে দেখেছি। কি ফুটফুটে চেহারা আর বড় নম্র ভদ্র। ভালো ছাত্রদের কথা শিক্ষকরা কখনও ভুলতে পারে না। দাদার মুখে তার আরো কত গল্প শুনেছি, কোন বদভ্যাস নেই ওর। যখন কলেজে বি,এ পাশের রেজাল্টে প্রথম দশ জনের সেও একজন হয়েছিল, বৌদি সুভদ্রা সহ আমাদের বাড়ি এসেছিল; তাও বছর চারেক হয়ে গেছে। এর পর আর ভরত দাদার সঙ্গে আমার দেখা নেই।

-’সে কি , তুমি কি ভরত দাদার ছেলে, উজ্জ্বল’ ? কথাটিও শেষ করতে পারলাম না; ভ্যাবাচেকা খেয়ে জলন্ত বিড়িটি পায়ের নীচে পিষে ফেল্ল। যেন আমি দেখতেই পাই নি। আমার চেহারার অনেক বিকৃতি হয়েছে, তাও আরো এই রোদে, আমাকে কেউ আর আজ সুধীর বাবু বলবে না। তবু ছেলেটি থতমত খেয়ে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে ভুলেনি। আমি আশ্চর্য, আমার গলা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো।

-’কি হয়েছে বাবা, বলবে তো ! দোকানদার লতিফ বল্ল: ‘দুই মাস হলো ভরত কাকা হার্ট এটাকে মারা গেছেন’। আমার শরীরে যেন কম্পন অনুভব করলাম।

-’বলো কি ! আমার এমন কপাল, দাদার মৃত্যু সংবাদটি আমি পেলাম না’। চোখ দিয়ে আমারও জল গড়িয়ে পড়লো। তিনি আমার শুধু দাদা নন, বড় কাছের মানুষ; একজন বন্ধুর মত। আমরা তো প্রায় একই বয়সের ছিলাম। তবে মাথায় সাদা চুল না থাকলে কেউ ভাবতেই পারবে না তিনি ছেলে মানুষ না বুড়ো। তার গায়ে ছিল এই বয়সেও যেন সোনার রং। সংসারের দুঃখ দৈন্য মোটেই কাবু করতে পারে নি দাদাকে।

-’চলুন না কাকা বাবু, মাকে একটু শান্তনা দিয়ে যাবেন। মার না নাওয়া, না খাওয়া, না মুখে একটু হাসি, সেই দিন থেকে । আমি বার বার বলি, মা তুমি ভেঙ্গে গেলে আমি যাবো কোথায়’?

- ‘তুমি না বল্লেও আমি বৌদিকে না দেখে যাবো, ভাবছ’ ?

দোকানের ঠিক পিছনেই ক্ষেতের আলপথ ধরে আমি আর উজ্জ্বল হাটছি। প্রায় মিনিট পাঁচেক হেঁটে ওদের বাড়ি পৌঁছলাম। ছনের চোট্ট একটি ঘর। বাঁশের বেড়া। অবিকল আমাদের ঘরটির মত। বাইরে একটু উঠোন। উঠোনে দুইটি গরু বাঁধা। তাও এই ভর দুপুর রোদে। এই কাঠ ফাটা রোদে ওরা হয়ত পুড়ে যাচ্ছে। বোবা বলেই কাঁদতে পারছে না। কিন্তু দাদাকে আমি চিনি। খুবই নরম, দয়ায় ভরা মনটি। তিনি বেঁচে থাকলে এমনটি হতে পারত না। আগে বিরাট একটি কাঁঠাল গাছ ছিল এখানে। রোদে অন্তত একটু ছায়া পেতো গরুগুলো। অভাবের তাড়নায় হয়ত বিক্রি করতে হয়েছে। গাছের মুথোটি দেখে বুঝতে পারলাম, গাছটি সদ্য কাটা হয়েছে। বৌদি বরাবরই আমাকে সুধীর আর মালতিকে ‘সোনা দিদি বলে ডাকতেন। আমাদের পদ শব্দে শুনেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বৌদি।

-’ও, সুধীর’। আর কিছুই বলতে পারলেন না। শাড়ির আঁচলে মুখখানি চেপে ধরেছেন। আর চোখে যেন জল উপচে উঠেছে। আমার সবচেয়ে খারাপ অভ্যেসটি হলো, কারও দুঃখ অশ্রু দেখলেই ঠোঁট আর জিভ তাদের শক্তি হারিয়ে ফেলে। যেন বাকরুদ্ধ হয়ে যায় আমার। জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। টেনে নিয়ে ঘরে বসালেন। এতক্ষনে উজ্জ্বল ঐ কাঁঠাল গাছের মুথোর উপরে দাঁড়িয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে কাঁদছে।

-’আমি বিন্দু বিসর্গ কিছুই জানতে পারি নি, বৌদি। আজকেই জানলাম’। অন্যদিকে তাকিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বল্লেনঃ

-’কেন জানি তিন চার মাস যাবত প্রায় প্রতিদিন তোমাদের কথা বলতেন; সুধীরটাকে বহুদিন দেখি না। আগে বাজার টাজারে আমার দোকানে এসে বসত। যেন ভুলে গেছে আমাদের, ইত্যাদি’।

-’চাকরী শেষ হওয়ার পর, আমি আর কোথাও যাই না, বৌদি। তোমাদের কথা বার বার মনে হয়েছে। তা ছাড়া তোমার সোনা দিদির শরীর বর্তমানে খুব খারাপ। বিছানায় পড়ে গেছে। বছর আগে তো অসুখে বাম হাতটাই অবশ হয়ে গিয়েছিল’।

-’কবে হলো এমন দিদির, কিছুই জানতে দিলে না গো, সুধীর !’

ছেলেটা রৌদ্র দাঁড়িয়ে কাঁদছে, ওকে আমি গিয়েই ঘরে টেনে নিয়ে আসলাম। আমার বুকের ভেতর হটাত করেই চিন চিন করে উঠলো। মেয়ের বাড়িতে যাওয়ার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলছি। আর শ্বাসকষ্ট তো অনেক দিনের। যখন মনে একটু অশান্তি নেমে আসে শ্বাস কষ্টটাও বেড়ে যায়। ঘরের কোণায় দেখলাম, দাদার ভ্রাম্যমান দোকান; বাঁশের বেতিতে বানানো খাঁচা। এই বয়সেও মাথায় করে নিয়ে যেতেন ঐ ওষধি দোকান, গ্রাম জনপদের সাপ্তাহিক ছোট ছোট বাজারগুলোতে। খবর কাগজে তৈরি হাজারো পুটলা রাখা ওখানে; কোনটায় সোহাগা, কোনটায় এক চিলতে কর্পূর, কোনটায় পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট,আরো কত কি। গ্রামেগঞ্জে কই ডাক্তার ? কবিরাজি ঔষধ আর এ রকম সৎ হৃদয়বান কর্মী ছাড়া আর কে বা আজকাল গরীবের পাশে থাকে। এ জন্যে ব্যবসাটা চলত ভালোই এবং ছোট তাদের সংসারটি কেটে যেত কোনভাবে। আর ছেলেটাও ছিল বড়ো মেধাবী। বৃত্তির পয়সা কড়ি যা পেতো, তাতে তো গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করতে পেরেছে কৃতিত্বের সাথেই। বৌদিকে আর ছেলেটিকে কি ভাবে যে প্রবোধ দেব বুঝতে পারছি না।

-’বৌদি, তুমি যদি ভেঙ্গে পড়, ছেলেটির কি দশা হবে, ভেবে দেখেছো’ ?

-’’সুধীর ! জানো, উজ্জ্বল চার পাঁচ জায়গায় লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছে। মৌখিখ পরীক্ষার ডাকও এসেছে। ব্যাস, ঐ পর্যন্তই। সার্টিফিকেটের আজকাল আর যেন দাম নেই। মামা কাকা থাকলে আর সার্টিফিকেটের দরকার হয় না। আমাদের কি গতি হবে, একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া কেউ জানে না’।
উজ্জ্বল ঠুকরে তখনও কাঁদছিল। আমি নিস্তব্ধ নির্বাক হয়ে গেলাম। কোন কিছুই আর বলতে পারলাম না। বৌদিকে বল্লামঃ

- ‘আমার একটু উঠতে হয়, বৌদি !’
-’সে কি, গরীব হয়েছি বলে, এক মুঠো ভাত খাওয়াতেও পারবো না, সুধীর ?’
- ‘ মেদেনীপুর যাবো। উমা মেয়েটা নাকি অসুস্থ। মালতির আবদার একবার যাই ওখানে’।
উজ্জ্বল বল্লো আজ নাকি বাস সমিতির ধর্মঘট। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত। আমার শরীরটা আরও নিস্তেজ হয়ে গেল যেন। মালতিকে তবে কি বলবো ? ওতো কাঁদতে কাঁদতে মরেই যাবে। আমার শ্বাসকষ্ট ও স্বাস্থের অবনতিতে ভয় পেয়েই উজ্জ্বলকে বল্লেনঃ

-’তোর কাকাকে পৌঁছে দিয়ে আয়, খোকা’।

তখন গোধূলি বেলা। অন্ধকার হতে বাকি নেই। আমাকে যেন শিশুর মতই হাত ধরে ধরে হাঁটছে উজ্জ্বল। ফিরছি আর ভাবছি, কোনদিন মালতিকে মিথ্যে বলি নি, আজকে ঐ টুকু মিথ্যে ‘উমা ভালোই আছে’ বল্লে পাপ হবে না। ছমছম অন্ধকার ছেয়ে গেছে ততক্ষণে। বৌদি ছেলেটিকে সঙ্গে না দিলে রাস্তায়ই পড়ে থাকতাম হয়ত।

ঘরটির যখন কাছাকাছি, দেখলাম ঘরে আলো নেই। মনে প্রশ্ন জাগলো, তাহলে কি পারুলকে আসতে দেয় নি ওর বড় ভাই ? ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার ভয়ে নিঃশব্দে আমরা দুইজন ঘরে ঢুকে আমি কুপি বাতিটা জ্বালাতেই দ্যাখি, মালতি তাকিয়ে আছে। খাবার ঐ ভাবেই পড়ে আছে। জলের গ্লাসটা কাত হয়ে পড়ে রয়েছে। বিছানা, বালিশটা ঐ জলেই সিক্ত। উজ্জ্বল দুই হাতে প্রণাম বল্ল। তবু নিরুত্তর মালতি। আমার দিকে পলকহীন দৃষ্টি।

-’মালতি, উমা ভালোই আছে। চিন্তা করো না’।
উজ্জ্বল হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আমি জড়িয়ে ধরে বল্লাম, মালতি, শেষে তুমিও আমাকে ছেড়ে গেলে।

*** সমাপ্ত ***
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৭৯৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৫/০২/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast