www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

পরিচয়

চয়নের সাদা এম্বাসেডর টা দু চোখ বন্ধ করল নিষিদ্ধ পল্লিতে এসে। এখন মধ্যরাত, চয়ন গাড়ির বাইরে পা রাখতেই মুন্না জোর হাত করে চয়নের দিকে এগিয়ে এলো। গাড়ি থেকে সুটকেস টা বের করে হাতে নিল মুন্না, একটা সিগারেট জ্বালিয়ে চয়ন মুন্নার সাথে হাঁটতে থাকল ৫ নম্বর বাড়ির উদ্দেশ্যে। ওই ৫ নম্বর বাড়ির তেতলায় থাকে বিজলি (রুপে অপ্সরা), চয়ন সেখানে পৌঁছে দেখে দরজা বন্ধ। পাস থেকে আম্মা এসে বলে তাকে অপেক্ষা করতে, বিজলির ঘরে খোদ্দের আছে। সামান্য রাগ হল বটে তারপর নিজেকে সামলে চয়ন আর একটা সিগারেট জ্বালিয়ে রেলিং এ ভর দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। খানিকক্ষণ বাদে দরজা খুলতে একটা বছর ৩৫ এর ফিনফিনে চেহারার লুঙ্গি পরা কালো লোক বেরিয়ে এল। চয়ন হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করে রিতিমত বিজলির ওপর চড়াও হল, সে কেন ওই ছোটলোক মানুষ গুলোকে ঘরে ঢুকতে দেয় একথা বলতেই বিজলি বলে ওঠে এটা ওর ব্যবসা সে জানায় সকল খোদ্দের তার কাছে লক্ষী। ওই নোংড়া লোকগুলো বিজলির শরীরটা ছোঁয় এটা চয়ন একদমই চায় না। সে বিজলিকে ভালোবাসে, না এ ভালোবাসা সে ভালোবাসা নয় চয়ন বিজলিকে যথেষ্ট স্নেহ করে। (চয়ন বিবাহিত, স্ত্রী অপর্ণাকে নিয়ে বেলঘড়িয়ার এক ফ্ল্যাটে থাকে সেন্ট্রাল এভিনিউতে তার চেম্বার, চয়ন তার স্ত্রীকে প্রানের চেয়েও বেশি ভালোবাসে।) প্রায়ই ফেরার পথে বিজলির কাছে আসে চয়ন। আজও এসেছিল সে, কিন্তু এমন ঘটনার পর তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। সে  কথা বুঝতে পেরে বিজলি প্রসঙ্গটা পালটে তাকে বিছানা থেকে নামিয়ে দিতে বলে। বিজলির দুটি পা অচল নিজে পায়ে দাঁড়াতে পারেনা সে, তাই কোনও ভালো খোদ্দের তার ঘরে আসে না যারাই আসে সবাই রিকশা চালক, কুলি, মুচি, মেথর এসব একমাত্র চয়নই যে ওই ৫ নম্বর বাড়ির তেতলায় যায় তবে খোদ্দের হিসেবে নয় বিজলির ডাক্তার হিসেবে।

বিজলি একসময় হাঁটতে পারত, গরিব ঘরের মেয়ে ছিলো বিজলি, মা নেই বাবা সনাতন মন্ডল ছিলো আদি সপ্তগ্রামের এক কৃষক। সনাতন মেয়েকে খুব ভালোবাসতো অভাবের তাড়নায় মেয়েকে লেখাপড়া শেখাতে পারেনি ঠিকই কিন্তু মায়ের অভাব কখনও সে বুঝতে দেয়নি। বিজলির আসল নাম রত্না মন্ডল, রত্নার যখন ১৭ বছর বয়স সে বাবার সাথে কোলকাতায় আসে। এক ট্রেন দুর্ঘটনায় বাবা প্রাণ হারায় এবং রত্না এসে পরে এই নিষিদ্ধ পল্লিতে অত্যন্ত পাশবিক নির্যাতন হয় তার ওপর, এক রাতে রত্না পালানোর চেষ্টা করে এবং সিঁড়ি থেকে পরে তার পা দুটো অকেজো হয়ে পরে। তার পর থেকে সে রত্না থেকে হয়ে ওঠে এই নিষিদ্ধ পল্লির বিজলি। নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে বিজলি এখন এটাই তার বেঁচে থাকার ঠিকানা, চয়ন আসে তার চিকিৎসা করতে ৭ মাস হল। এই ৭ মাসে চয়ন বিজলিকে অনেকটাই নিজের বন্ধু হিসেবে ভালোবেসে ফেলেছে, তাই তার এই কাজকর্ম একদমই সহ্য করতে পারে না। বিজলি চয়নকে মনে মনে ভালোবাসে কিন্তু তার দাম্পত্য জীবনে যাতে কোনো কলহ না হয় তাই কোনোদিন প্রকাশ করেনি সে।

চয়ন বিজলিকে কোলে তুলে একে অপরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর একটা চেয়ারে বিজলিকে বসিয়ে তার চিকিৎসা করতে থাকে চয়ন। যতক্ষন চয়ন চিকিৎসা চালায় ততক্ষণ পর্যন্ত বিজলি তাকিয়ে থাকে চয়নের মুখের দিকে। চিকিৎসার পর চয়ন আরো কিছু ওষুধ  লিখে বিজলির থেকে বিদায় নেয়, প্রতিবার ঠিক এই সময়টায় বিজলির মনে হয় তার জীবন থেকে কি একটা যেন হারিয়েযাচ্ছে। চয়ন তার সাদা এম্বাসেডরের কাছে এসে মুন্না কে বলে সে যেন বিজলির খেয়াল রাখে আর কোনো সমস্যা হলে ফোন করে এই বলে চয়ন মুন্নাকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে ওঠে। চয়নের সাদা এম্বাসেডরটা রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যায় সহরের বুকে, গাড়ি এসে দাড়াল বেলঘড়িয়ার ফ্ল্যাটের নিচে, গাড়ির শব্দ শুনে অপর্ণা বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। চয়ন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে রোজকারের মত অপর্ণা দরজায় এসে দাঁড়ায় চয়নের হাত থেকে সুটকেস নিয়ে ওকে ফ্রেশ হয়ে নিতে বলে। অপর্ণা কেন যানি কদিন ধরে চয়নের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য  করে, আগে যখন বেলকনিতে দাঁড়াতো চয়ন গাড়ি থেকে নেমে একটা মিষ্টি হাসি হেসে হাত নাড়তো, সিঁড়ি থেকে উঠে দরজায় যখন আসতো আলিঙ্গন করতো তা কিছুই এখন সে করেনা সব সময় মোবাইলে ব্যস্ত। অপর্ণার দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে একদিন একটি ফোনে জানতে পারে চয়ন নিষিদ্ধ পল্লিতে যাতায়াত করছে বিজলি নামের কোন মেয়ের কাছে, তৎখনাত সে চলে যায় বাপের বাড়ি। চয়ন হাজার বোঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু অপর্ণা কোন কথা শুনতে চায়না স্পষ্ট জানিয়ে দেয় সে আর ফিরবে না।

শুরু হয় চয়নের একাকীত্ব জীবন, কিন্তু এসবের মধ্যেও যাকে নিয়ে এতকিছু সেই বিজলির চিকিৎসা চয়ন ঠিকই চালিয়ে গেছে কারণ সে ডাক্তার এটাই তার ধর্ম। বিজলি লক্ষ্য করছে চয়ন আগের মত নেই, কেমন যেন চুপচাপ মনমরা ভাব, কি হয়েছে সেকথা তাকে জিজ্ঞেস করে কোন  ফল হবে না তাই মুন্নার কাছ থেকে সব কথা শুনে বিজলি মনে মনে খুব কষ্ট পায়। এরপর সপ্তাহ খানেক পার হওয়ার পর একদিন চয়নের কাছে খবর আসে বিজলি নিষিদ্ধ পল্লিতে নেই তাকে কেউ মোটা টাকা দিয়ে ওখান থেকে নিয়ে গেছে। চয়নের একাকীত্ব আরো বেড়ে যায় স্ত্রীর পর বিজলিই ছিল তার সবথেকে কাছের বন্ধু তাকেও হারাল।
এখন তার জীবন বাড়ি আর চেম্বার করেই কাটছে, শরীর টাও ভেঙ্গে পরেছে আগের থেকে। মুখ ভরা দাড়ি, ইদানীং চশমাও নিতে হয়েছে তাকে রাত জেগে জেগে। এভাবেই বছর ২ কেটে যাওয়ার পর হঠাত একদিন ছুটির দিনে অপর্ণা এসে হাজির হয় চয়নের ফ্ল্যাটে, সেই দরজায় দাঁড়ানো অপর্ণা তবে এবার উলটো, চয়ন দরজার ভেতরে অপর্ণা বাইরে দুজন দুজনকে একদৃষ্টে দেখতে থাকে কিছুক্ষণ দুজনেরই চোখে জল দুজনে লিপ্ত হয় আলিঙ্গনে এবার চয়নের নজরে পরে সিঁড়ির কাছে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে খুব যেন চেনা লাগছে তাকে কে সে, অপর্ণা বলে ওঠে "চিনতে পারছো, এ সেই বিজলি"। চয়ন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অপর্ণা ফিরে আসাতে তার এতটাও আনন্দ হচ্ছেনা যতটা হচ্ছে এটা দেখে যে বিজলি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপর্ণার হাত ধরে একটানে ভেতরের দিকে সরিয়ে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে বিজলির কাছে গেল চয়ন তার হাত দুটো ধরে আনন্দের সাথে জানতে চাইল এসব কি ভাবে হল অপর্ণার সাথে কি করে এল এসব অজস্র প্রশ্ন এক নাগাড়ে করতে থাকল। বিজলি কোন মতে চয়নকে থামিয়ে ঘরে নিয়ে এসে বলল একদিন সে মুন্নার কাছে জানতে পারে তাদের পারিবারিক সমস্যার কথা এবং তার পর মুন্নাকে পাঠায় অপর্ণার বাপের বাড়ি খুঁজতে। মুন্না অপর্ণার বাপের বাড়ি খুঁজে সেখানে যায় এবং সব কথা খুলে বলে অপর্ণাকে। সব কথা শোনার পর অপর্ণার বাবা মোটা টাকার বিনিময়ে বিজলিকে নিয়ে আসে তাদের বাড়ি। (বিয়ের আগে অপর্ণা মেডিকেল স্টুডেন্ট ছিল এবং সেও ছিল চয়নের মত হাড় বিশেষজ্ঞ) অপর্ণার চিকিৎসার কারণেই আজ বিজলি সুস্থ হয়ে উঠেছে। এরপর নিষিদ্ধ পল্লির ৫ নম্বর বাড়ির তেতলার বিজলি আবার হয়ে উঠল রত্না হয়ে তবে এবার রত্না মন্ডল নয় রত্না সাহা, অপর্ণার বাবা কোলকাতার শিল্পপতি অনির্বাণ সাহার ছোট মেয়ে।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ২৫০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৫/০৬/২০২২

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast