www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সমুদ্র ভ্রমণ ২

পুরীর সমুদ্র দেখেছিলাম বারো বছর বয়সে। পাড়ার টুরিস্ট-এর সাথে গেছিলাম তিনজনে- রাজ্যের বাইরে একা একা যেতে আমাদের মতো বহু লোক সাহস পায় না। কেবল পুরীর সমুদ্র দেখা নয়, সাথে আরো কিছু দেখেছিলাম, সব ভালো ভাবে মনে নেই, যেমন কোনার্ক-এর সূর্য মন্দির, ভুবনেশ্বর শহর, উদয়গিরি, খণ্ডগিরি ও নন্দনকানন- এক কথায় পুরো উড়িষ্যা ভ্রমণ। এক সপ্তাহের টুর।

কোনার্ক-এর সূর্য মন্দিরই দর্শনীয় স্থান। মন্দিরের কারুকাজ দেখতে দেখতেই সময় পেরিয়ে গেছিল, সমুদ্রতীরে আর যাইনি, বাসের জানালা দিয়েই দেখেছিলাম সমুদ্র। মন্দিরের শিল্পকলা দেখে বাবা বলেন, 'আমাদের স্থাপত্য অতুলনীয়। দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। কত দেবদেবীর মূর্তি দেওয়ালে খোদাই করা'। আমি বাবাকে একটার পর একটা প্রশ্ন করে চলেছিলাম। 'সূর্যদেবের কি এটা বাড়ি'? 'না, এখানে তিঁনি রাতে বিশ্রাম করেন, তাঁর বাড়ি আকাশে'। 'তাহলে এটা কি তাঁর বিশ্রামের জায়গা'? 'হ্যাঁ, এটা তাঁর হোটেল'! 'আমরা যেমন হোটেলে উঠেছি'? 'ঠিক'। বাবা আমার সব প্রশ্নের জবাব দিতেন, মা বিরক্ত হতেন, কিন্তু বাবা কখনো বিরক্ত হতেন না। বাবাই পরম বন্ধু, মাকে আমি ছোটবেলায় ভয় পেতাম।

ভুবনেশ্বরের কথা আমার কিছু মনে নেই, ওখানে কি দেখেছিলাম তা খেয়াল নেই। কেবল মনে আছে যে ভুবনেশ্বরে একটা হোটেলে আমরা সকলে এক রাত ছিলাম- তৃপ্তি করে ডাল, আলুভাজা ও ডিমের ঝোল ভাত খেয়েছিলাম।

পুরীতে ছিলাম তিন দিন তিন রাত। সেখানে ধর্মশালাতে আমাদের সকলের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী ছেলেদের এক দিকে থাকতে হয় আর মেয়েদের আরেক দিকে, মাঝখানে উঠোন, সরকারি বাসের মতো। মা বাবাকে সহজেই ছেড়ে দিলেন, সকলেই তাই করলেন, কেবল একজন মহিলা তাঁর স্বামীকে কিছুতেই ছাড়লেন না- সেই নিয়ে কি অশান্তি! সেই মহিলা তিন রাত ছেলেদের সাথেই থাকলেন। আমি ছোট বলে মায়ের কাছেই ছিলাম।

আমরা রোজ সকালে সমুদ্রে নেমে স্নান করতাম আর বিকেলে বালির ওপর হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের ঢেউ গুণতাম। মায়ের মুখে পরপর দুদিন একটা কথাই শুনেছিলাম, 'দিঘার মতো পুরীর সমুদ্র অত রাফ্ না'। কিন্তু যাওয়ার আগের দিন ঠাকুরমা আমাদের বলেছিলেন, 'পুরীর সমুদ্রে বিপদ বেশি'।

ঘটনাটা ঘটলো তিন দিনের দিন সমুদ্রে স্নান করার সময়। মা একজনের সাথে গল্পে মত্ত। সাইড হয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন আর একটার পর একটা ঢেউ এসে মায়ের পায়ের কাছে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো। তবে বেশি তেজ নেই। হঠাৎ একটা বড় ঢেউ উঠলো সামনে থেকে। মা ব্যালান্স হারিয়ে পা মুড়ে বসে পড়লেন, আর পা সোজা করতে পারলেন না, কান্না জুড়ে দিলেন। আমি ও বাবা কাছেই ছিলাম, ছুটে গেছিলাম। বাবা কোনো মতে মাকে তুললেন ও ডান পাটা সোজা করলেন। 'আমাকে ঘরে নিয়ে চলো'। আমি ও বাবা ধরে ধরে মাকে ধর্মশালায় নিয়ে গেলাম। ধর্মশালার একজন লোক বরফের ব্যবস্থা করে দিলেন। বাবা কাকে দিয়ে আর্নিকা আনিয়েছিলেন আমার ঠিক মনে নেই। আমি তখন মাকে বরফ দিতে ব্যস্ত। ব্যথা তখন সহ্যের মধ্যে। বাবা বললেন, 'চলো এবার ডাক্তারের কাছে যাই'। 'কলকাতায় ফিরে আমি সেবাঙ্গনে দেখাবো'। 'মা, বাড়ি ফিরতে তো এখনো তিন চার দিন দেরি। অতদিন ব্যথা সহ্য করবে'! 'তুই চুপ কর, আর্নিকা খেলে ব্যথা কমে যাবে'।

ওই পা নিয়ে মা উদোরগিরি ও খণ্ডগিরিতে উঠেছিলেন। পাহাড় গুলোর মধ্যে কত গুহা। কেউ বলছিল, 'আগে এখানে আদিম মানুষেরা থাকতো'। কেউ বলছিল, 'এই গুহা গুলোতে বহু ঋষি তপস্যা করেছেন'। আমি একটা গুহায় ঢুকেছিলাম। দম বন্ধ হয়ে গেছিল। গুহা গুলো সব প্রকৃতির দান। কিভাবে থাকতো এখানে মানুষ!

উদয়গিরিতে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। একজন মহিলা চপ্পল জোড়া হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে, একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে ওগুলো নিয়ে পাহাড়ে উঠছিলেন। নতুন চপ্পল। নিয়ম হল খালি পায়ে ওঠা কারণ পাহাড়ে অনেক ছোট ছোট মন্দির আছে। দুই পাহাড়েই প্রচুর বাঁদর। প্লাস্টিকে খাবার আছে ভেবে একটা বাঁদর এসে মহিলার হাত থেকে প্লাস্টিকটা নিয়ে দে দৌড়। মহিলাও ছুটছিলেন বাঁদরের পিছনে। সে কি দৃশ্য! যখন বাঁদরটা বুঝলো যে ওটা খাবার নয়, ছুঁড়ে ওটা নীচে ফেলে দিয়েছিল। মহিলা পাহাড় থেকে নীচে নেমে পাদুকা পুরাণ ফিরে পেয়েছিলেন ও হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলেন।

এবার খন্ডগিরির একটা মজার ঘটনা বলি। বিরাট আকারের একটা বাঁদর বসে বসে বাদাম খাচ্ছিলো আর খোসা গুলো একজন লোকের হাতে মুখ থেকে বার করে ফেলছিলো। লোকটার আরেকটা হাত ও দারুণ শক্ত করে ধরেছিল, পালাবার কোনো পথ নেই। আমরা সবাই সেই দৃশ্য দেখে দারুণ হাসছিলাম। লোকটা ভয়ে দু চোখ বুজেছিল।

নন্দনকাননে কথা আমার মনে নেই। মা বলেন, 'তুই নন্দনকাননে একটা বাঘের সাথে গল্প করেছিলিস'।

কলকাতায় ফিরে এসে মাকে সেবাঙ্গনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ডাক্তার সাহা দেখেছিলেন। হাঁটুর লিগামেন্টে আঘাত লেগেছিল, তবে ছিঁড়ে যায়নি। তিনি ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন। ছুরি কাঁচি চালাবার কোনো প্রয়োজন হয়নি। এখনো মাঝে মাঝে সেই ব্যথা জায়গাটা টনটন করে ওঠে।
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ১৭২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০১/১২/২০২৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast