www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গল্প “জ্বীনেরও অনুশোচনা হয়”

গল্প
“জ্বীনেরও অনুশোচনা হয়”

“আমি কথা গুলো শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলামনা। একজন জ্বীন আমার সামনে দাঁড়িয়ে তার অপরাধবোধের জন্য ক্ষমা চাচ্ছে। এ কি করে সম্ভব? আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।”

গল্পের শুরু এখান থেকে…

(০১)
তহুরা অভিমান করেছে। বেশ অভিমান। অভিমান করে অন্যদিকে ফিরে আছে। ইদানীং দেখছি হুটহাট করে অভিমান করে বসে তহুরা।
যাহোক আমি চেষ্টা করছি অভিমান ভাঙ্গানোর। আমার কাছে পৃথিবীতে সবচেয়ে বিরক্তিকর এবং কষ্টসাধ্য কাজ হচ্ছে অভিমান ভাঙ্গানো। তবুও নিয়মিত চেষ্টা চালিয়ে যাই। জানিনা চেষ্টা কতটুকু সার্থক হয়। কারণ একটা নির্দিষ্ট সময় পর তহুরা অভিমান ভুলে গিয়ে আমাকে বলে,
“সরি মাহমুদ। আর করবোনা।”

কিন্তু আজ সেই নির্ধারিত নির্দিষ্ট সময়টা ইতমধ্যে শেষ হয়ে গেছে, অথচ তহুরার অভিমান ভাঙ্গেনি এখনো।
একপ্রকার জোর করে ওকে আমার দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম। ও তাকালো এবং কি বিভৎস এক হাসি দিল, যা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তহুরাকে আমি অনেক বছর ধরে চিনি, কিন্তু কখনো ওকে এমন করে হাসতে দেখিনি। ও হেসেই যাচ্ছে। থামছেনা। আমি থামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। এত সুন্দর একজন মানুষ এত ভয়ঙ্কর ভাবে হাসতে পারে, এটা আমার কল্পনায়ও ছিলোনা। কি ভয়ঙ্কর হাসি! হাসিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো যে, ওর দাঁত গুলো কেমন যেনো গোল হয়ে মাড়ি থেকে আলাদা হয়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। এবার আমি ভয় পেয়ে গেলাম। দোয়া পড়া শুরু করলাম।

হঠাৎ খেয়াল করলাম সূর্যের আলোয় মাটিতে শুধু আমার ছায়া দেখা যাচ্ছে, তহুরার ছায়া দেখা যাচ্ছেনা। অথচ দুজন একই সমতলে সূর্যের একই পাশে আছি। এবার আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে , এই বিভৎস হাসি আমার তহুরার নয়। ওর উপর খারাপ কিছু আছর করেছে। তাই আমি খুব জোরে শব্দ করে ‘আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইত্বনির রাজিম’ পড়তে লাগলাম। তবুও হাসি থামছিলোনা। আমিও ‘আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইত্বনির রাজিম’ পড়া বন্ধ করছিলাম না। বেশ কয়েকবার পড়ে ওর গায়ে ফুঁ দেয়ার পর হঠাৎ হাসিটা থেমে গেলো, সাথে সাথে ও আমার গায়ের উপর ঢুলে পড়লো।
ওর কপালে হাত দিয়ে দেখলাম, এই শীতের মাঝেও পুরো ঘেমে গেছে।
তহুরাকে বাসায় পৌছে দিয়ে আমি বাসায় ফিরছিলাম। তখন গৌধুলি সময়। পশ্চিমাকাশে সূয্যিমামা লাল আভা ছড়িয়ে দিয়ে ডুবে যাচ্ছিলো।
রিকশা পাইনি তাই হেটে যাচ্ছিলাম। এই রাস্তায় সবসময় অল্প কিছু হলেও মানুষ থাকে। কিন্তু আজ কোনো মানুষ জন চোখে পড়ছেনা। হাঁটতে হাঁটতে যখন কবিরাজ বাড়ির কবরস্থানের কাছাকাছি এলাম, দেখলাম পশ্চিম দিক থেকে কয়েকজন যুবক ছেলে অদ্ভূত এক ভাষায় কথা বলতে বলতে কবরস্থানের দিকে আসছিলো। এমন ভাষা আমি জীবনেও শুনিনি। আমি আসছিলাম দক্ষিণ দিক থেকে। ছেলেগুলো পশ্চিম দিকে থেকে। আর কবরস্থান হলো পূর্ব দিকে। ছেলেগুলো আমাকে ঘেসেই কবরস্থানের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো। আমি খেয়াল করলাম, কবরস্থানের লোহার গেটের ছিটকানি লাগানোই ছিলো। ওরা কিভাবে ছিটকানি না খুলেই সোজা কবরস্থানের ভিতর ঢুকে গেলো তা দেখার জন্য একটু পিছনে এসে কবরস্থানের লোহার গেটে দিয়ে ভিতরে তাকিয়ে ছেলেগুলোকে দেখতে পেলামনা। মুহূর্তের মধ্যেই ছেলে গুলো হাওয়া হয়ে গেলো। পুরো শরীরে কেমন যেনো কাঁটা দিয়ে উঠলো আমার। লোম গুলো দাঁড়িয়ে গেলো। আমি বোধহয় খুব ভয় পাচ্ছিলাম। ভয় না পেলে, শিহরিত না হলো গায়ের লোম দাড়ায়না।



(০২)

: তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?
: কেমন?
: অসুস্থ অসুস্থ দেখাচ্ছে তোমাকে। কি হয়েছে?

গতকাল অস্বাভিক আচরণের পর আমি ওকে বাসায় পৌছে দিয়ে এসেছিলাম। তখনো ওর চেহারাটা বেশ প্রাণবন্ত ছিলো। এখন উসকো খুসকো কেমন যেনো বিধ্বস্ত দেখোচ্ছে তহুরাকে। চোখের নিচে কালো হয়ে গেছে। চুলগুলো এলোমেলো, তবে উড়না দিয়ে ঢেকে রেখেছে।

: তোমার এই অবস্থা কেনো ? কি হয়েছে বলো?
: কাল তুমি বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসার পর আমি গোসল করে আমার রুমে শুয়েছিলাম। শরীরটা ক্লান্ত থাকায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমের মাঝে হঠাৎ আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো, আমি শ্বাস নিতে পারছিলামনা। চোখ খোলার চেষ্টা করে চোখ খুলতে পারছিলামনা। চিৎকার দিতে গিয়ে মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করতে পারছিলামনা। খুব কষ্ট হচ্ছিলো। নড়তে পর্যন্ত পারছিলামনা। মনে হচ্ছিলো অনেক বেশি শক্তিশালী কেউ একজন আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। আমি মনে মনে তোমার শিখেয়ে দেয়া দোয়া ‘আউযুবিল্লাহ, চার কুল ও আয়াতুল কুরসি’ পড়তে পড়তে হাত পা নাড়ানো এবং চোখ খোলার চেষ্টা করলাম। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর হাত পা নাড়াতে পারলাম। এবং চোখ খুলে অস্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম ধবধবে সাদা কিছু একটা জানালা পর্যন্ত গিয়ে গায়েব হয়ে গেলো। ”কে ওখানে বলে” আমি চিৎকার করে উঠলাম। চিৎকার শুনে আম্মু আর আপু আমার রুমে এল। এরপর সারারাত আমি আর ঘুমাতে পারিনি। ফজরের পরে একটু ঘুমিয়েছিলাম। না ঘুমাতে পারার কারণে আমাকে এমন দেখোচ্ছে।
: হুম। ভয়ানক অবস্থা দেখছি। এর আগেও কি তোমার সাথে এমন হয়েছিলো?
: আমার মনে নেই। তবে আম্মু বলেছে ছোটো বেলায়ও নাকি আমি এমন অদ্ভূত আচরণ বেশ কয়েকবার করেছি। পরে হুজুর ঝাড় ফুঁক ও তাবিজ দিয়েছিলো।
: এখন কেমন বোধ করছো?
: আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
: চলো কোথায়ও গিয়ে বসি।
: কোথায় যাবো?
: তোমার পছন্দের জায়গায়।

এই যান্ত্রিক শহরেও আমাদের বিশেষ করে তহুরার খুব পছন্দের একটি যায়গা আছে। যেখান থেকে গাড়ি ও ট্রেনের চলাচল দেখা যায় কিন্তু শব্দ কানে আসেনা। যেখান থেকে উঁচু উঁচু সব বিল্ডিং দেখা যায়, কিন্তু কোনো কোলাহল নেই। দু’পাশে পানি। এক পাশে সরু কাঁচা রাস্তা অন্য পাশে নার্সারি, যেখানটায় হরেক রকম ফল-ফুলের গাছ সহ অগনিত ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির গাছে সুসজ্জিত। যতদূর চোখ যায় সবুজে ছেয়ে গেছে। মনোমুগ্ধকর একটা পরিবেশ। ওখানে বেশ কয়েকটা বাঁশের মাচাং/বাঁশ দিয়ে তৈরি বসার স্থান রয়েছে। বাঁশের মাচাংয়ে বসে তহুরা জুতা খুলে ফেলে এরপর একপায়ের উপর অন্য পা তুলে পা দুলাতে থাকে। আর ওর এলোকেশি মাথাটা থাকে আমার গাড়ে। বাতাসে ওর চুলগুলো এলোমেলো ভাবে উড়তে থাকে, আমার নাকে মুখে চোখে মিশে যায়। ওর চুলে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ আছে,যা প্রতিবারই আমাকে পাগল করে। এই পাগল করা সুখটা আমার কাছে অনেক দামী অক্সিজেন মনে হয়। যেদিন এই অক্সিজেনটা গ্রহন করি তিন চারদিন শহরের দূষিত বায়ূ আমার ক্ষতি করতে পারেনা। চারদিন পর থেকেই আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়, এরপর কষ্টে কাটে দুটো দিন। তাই প্রতি সপ্তাহেই পাগল করা সুখটা কিংবা সবেচেয়ে দামী অক্সিজেনটা গ্রহণ করার জন্য তহুরাকে নিয়ে আমার এখানে আসা হয়।
কয়েকটা সপ্তাহ পেরুলেই আমার আর তহুরার বিয়ে । পারিবারিক ভাবেই ঠিক হওয়া। তখন আর দামী অক্সিজেন গ্রহণ করার জন্য দিন গুনতে হবেনা।

একটা রিক্সা ডেকে আমি আর তহুরা উঠে পড়লাম। রিক্সায় উঠার আগে তহুরা দশ টাকার বাদাম কিনে নিলো। তহুরা অন্য দশটা মেয়ের মত নয়। ও খুব লক্ষি একটা মেয়ে এবং মিতব্যায়ী স্বভাব ওর। অহেতুক খরচ করাটা ও পছন্দ করেনা। যেখানে বর্তমানের মেয়ে গুলো ডেটিং বলতেই বুঝে যে, নামীদামী কোনো রেস্টুরেন্ট এ বসে দামী দামী ডিসের অর্ডার করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে তা ফেবুতে আপলোড করা, তার এক চতুর্থাংশ খেয়ে বাকীটুকু অপচয় করা এবং বয় ফ্রেন্ড এর হাতে বিলটা ধরিয়ে দেয়া।
তহুরা আমাকে দিয়ে কোনো খরচই করাতে চায়না। ওকে কফি খেতে বললে, ও বলে “কফিতো বাসায় খাই ই। তার চেয়ে চলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টংয়ের দোকানে চা খাই।” তহুরা প্রায়ই বয়স্ক হকার এবং প্রতিবন্ধী হকারদের থেকে এটা সেটা কিনে এবং দুজন মিলে তা খেয়ে থাকি।
রিক্সা চলছে। ও আমার বা’হাতটা ধরে আছে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ও বললো,
: আচ্ছা মাহমুদ, আমাদের বিয়ে কবে হচ্ছে?
: হঠাৎ এই প্রশ্ন? তুমি জানো না বিয়ে কবে হচ্ছে?
: হুম জানি যে, কয়েক সপ্তাহ পরে বিয়ে কিন্তু তারিখটা তো জানিনা।
: দু’একদিনের মাঝেই জেনে যাবে।
: প্লিজ তারিখটা এগিয়ে নিয়ে আসো।
: হঠাৎ? সবতো ঠিক হয়েই আছে।
: না মানে......
: কোনো সমস্যা?
: আমার না ইদানীং খুব ভয় হয়। রাতে একা ঘুমাতে পারছিনা।
: কবে থেকে এই ঘটনা?
: চার-পাঁচদিন হলো কেনো যেনো রাতের বেলা লাইট অফ করে দিলেই খুব ভয় লাগে। ঘুমাতে পারিনা।
: আরতো বলোনি।
: ইচ্ছে করেই বলিনি। ভেবেছিলাম ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু গতকাল রাতে যা ঘটেছে তাই আর ভয়টা চেপে রাখতে পারছিনা। প্লিজ খুব দ্রুত কিছু একটা করো।



(০৩)

মোবইলটায় ভাইব্রেশন হচ্ছে। হয়েই যাচ্ছে। মাত্রই ঘুমটা এলো। বিরক্ত হয়েই মোবাইলটা হাতে নিলাম। ডান হতে মোবাইল, বাম হাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে মনে হলো, এতো রাতে আমাকে কল দিবে কে? তাছাড়া মাঝ রাতে কল এলে বিপদের সংবাদই বেশি শুনতে হয়। কেমন যেনো ভয়ে শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো। এর আগে শেষবার যখন মাঝরাতে কল এসেছিলো, জানতে পারলোম এলাকার এক বড় ভাই বাইক দূর্ঘটনার শিকার হয়ে মূমুর্ষূ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আমাকে 'A-' (এ- নেগেটিভ) রক্ত দেয়ার জন্য কল করেছিলো। আমি শোয়া থেকে উঠে রক্ত দেয়ার জন্য হাসপাতালে গিয়ে দেখি ভাই আর বেঁচে নেই। এর পর থেকে রাতে কল এলে খুব ভয় লাগে।


ভয়ে ভয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি তহুরা ফোন করেছিলো এতক্ষণ। বুঝতে পারছিলাম না এতো রাতে তহুরা কেনো ফোন করেছে। ও তো এতো রাতে কখনো ফোন দেয়নি। তাছাড়া ঘুমানোর আগেই ওর সাথে প্রায় ৩৭ মিনিট কথা বলেছিলাম।
ভয়টা বেড়ে গেলো। ওকে ফোন দিলাম। রিং হচ্ছে। একবার দুবার তিনবার, অনেকবার রিং হচ্ছে, কিন্তু তহুরা রিসিভ করছেনা। কেটেও দিচ্ছেনা। আমি নিশ্চিত তহুরা ইচ্ছে করে এমন করছেনা। নিশ্চয় কোনো সমস্যা হয়েছে। কারণ, তহুরার সাথে তিনবছরের রিলেশনে ও কোনোদিনই আমার সাথে রাগ করেনি।


তহুরা ফোন ধরছেনা দেখে ভয়টা বহু গুণে বেড়ে গেলো। আমি বুঝতে পারছিলামনা যে কি করবো। হঠাৎ মনে পড়লো ওর বাবার মোবাইল নম্বরতো আছে আমার কাছে। লাজ লজ্জা ভুলে রাত তিনটায় হবু শ্বশুরকে ফোন করলাম। কিন্তু আমি ব্যার্থ হলাম, হবু শ্বশুরের ফোনটা বন্ধ। খুব অস্থির লাগছে। কি করবো বুঝতে পারছিনা।
ভাবনায় এলো আম্মুকে জেগে তুলি। আম্মুর সাথে শেয়ার করি বিষয়টা।
আম্মুর রুমের সামনে গিয়ে দরজায় নক করে আম্মুকে ডাকলাম। আম্মু জেগেই ছিলো। তাহজ্জুদের নামাজ পড়বে বলে উঠেছিলো। আমার ডাক শুনে রুমের বাহিরে এলো, আমকে জিজ্ঞেস করলো,
: এত রাত হলো এখনো ঘুমাওনি? শরীর খারাপ করছে?

আমি মাকে সব বুঝিয়ে বললাম। শুনার পর আম্মুর মুখোয়াব দেখে মনে হলো উনি খুব বিরক্ত হয়েছেন। কিছু না বলে উনি রুমে ঢুকে যাচ্ছে দেখে আমি অনুরোধের সুরে বললাম,
: আম্মু চলোনা ওদের বাসায় গিয়ে দেখে আসি কি হয়েছে?
: পাগলমি করছিস কেনো?

আম্মু আমকে সচরাচর তুই তুকারি করেনা। আমাকে নিয়ে যখন শঙ্কায় থাকে, দুশ্চিন্তায় থাকে কিংবা ভয় পায় তখনই শুধুমাত্র আম্মুর অজান্তেই আম্মু আমাকে তুই তুকারি করে।

: আম্মু আমি পাগলামি করছিনা। তহুরার জন্য খুব ভয় হচ্ছে। ওদের বাসায় নিশ্চয় কোনো সমস্যা হয়েছে।
: তোর জন্যও আমার খুব ভয় হচ্ছে।
: আম্মু আমি এখন কি করবো? তহুরাকে দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।
: ঘুমাতে যা। সকাল সকাল গিয়ে দেখে আসবো ওদের বাসায় কি হয়েছে।


আম্মু নামাজে দাড়ানোর পর লুকিয়ে আমি বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম তহুরাদের বাসায় যাবো বলে।


মাঝরাতে ল্যাম্পোস্টের আলোয় নিজেকে খুব অপরিচিত লাগছে। ল্যাম্পোস্টের নিয়ন আলোয় ফুটপাত ধরে আমি একা হাঁটছি। যতদূর চোখ যাচ্ছে চারিপাশটা কেমন যেনো ভূতুড়ে মনে হচ্ছে। রাস্তায় কোনো মানুষ নেই। কুকুরের রাজত্ব মনে হচ্ছে। অনেক রংয়ের অনেক গুলো কুকুর ইচ্ছে মতো খেলা করছে। এত কুকুর দেখে প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভয়টাকে কন্ট্রোল করে লক্ষ করলাম কুকুর গুলোর ছায়া আছে কিনা। সব গুলো কুকুরের ছায়া আছে নিশ্চিত হতে পেরে ভয়টা কেটে গেলো। ছোটো বেলায় কোনো মুরুব্বিকে বলতে শুনেছিলাম যে, রাত বিরাতে যদি কোনো প্রাণী দেখে সন্দেহ হয়, তাহলে সেগুলোর ছায়া খেয়াল করতে হয়। যদি ছায়া দেখা যায়, তাহলে ভয় পাওয়ার কারণ নেই, ওগুলো সাধারণ প্রাণী। আর যদি ছায়া দেখা না যায়, তাহলে ওগুলো সাধারণ কোনো প্রাণী নয়। এমনটি দেখলে দোয়া দুরূদ পড়ে ওই স্থান ত্যাগ করা উত্তম।

দ্রুত পায়ে হাঁটছি। মনে হাজারো ভাবনা নাড়া ‍দিচ্ছে তহুরাকে ঘিরে। খুব ভয় হচ্ছে তহুরার জন্য। এত রাতে আমি কখনো রাস্তায় বের হইনি। আজই প্রথম। আমার খুব ভয় পাওয়ার কথা , কিন্তু ভয় পাচ্ছিনা। কারণ আমি আমার ভয়ের কথা ভাবছিনা। আমার ভাবনা জুড়ে শুধুই তহুরা। মানুষ যে বিষয়টাকে বেশি প্রাধান্য দিবে, তার মস্তিষ্কি সেটা নিয়েই কাজ করবে। একটা বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া অবস্থায় একই সময় যদি এর চেয়ে অধিকতর প্রাধান্য দেয়ার বিষয় চলে আসে, সেক্ষেত্রে মস্তিষ্ক আগের বিষয়টা নিয়ে কাজ করা একদমই বন্ধ করে দিয়ে এর চেয়ে অধিকতর প্রাধান্য দেয়া বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করে দেয়। আমার বেলায়ও এমনটাই হয়েছে মনে হচ্ছে।

হাঁটতে হাঁটতে যখন কবিরাজ বাড়ির সামনে এলাম, মনে পড়ে গেলো সেদিনকার কিছু অপরিচিত মানুষের কবরস্থানে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কথাটা। হঠাৎ গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। সামনে এগোনোর সাহস পাচ্ছিলামনা আর। আমি আমার ভয়টাকে প্রাধান্য না দিয়ে তরুর বিষয়টা প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করে ভয় থেকে বাঁচার চেষ্টা করলাম। এই থিওরির কার্যকারিতা দেখে অবাক। আমার ভয় কেটে গেলো। আমি আবারো হাঁটা শুরু করলাম। হঠাৎ সামনে অনেক দূরে চোখ আঁটকে গেলো। কবরস্থানের ঠিক কাছাকাছি রাস্তায় মসজিদের সামনে বিশাল আকৃতির, সাদা কাপড়ে শরীর পেছানো, দেখতে মানুষের মত চৌদ্দ পনেরজন হবে, কারা যেনো দাড়িয়ে মিটিং করছে। আমার মস্তিষ্ক ভয়টাকে আবারো প্রাধান্য দেয়ার শুরু করলো। আমি দোয়া দুরূদ পড়তে লাগলাম। সামনের দিকে তাকালে ভয়ে হাঁঠতে পারছিনা। আমার সিক্স সেন্স বলছে চোখ বন্ধ করলে হাটতে পারবো। তাই চোখ বন্ধ করে হাটার চেষ্টা করছি। কিছুক্ষণ হাটার পর সামনের দিক থেকে আসা কারো সাথে ধাক্কা খেলাম। ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠবো, এমন সময় মানুষের কন্ঠ কানে এলো, স্বস্তি পেলাম। চোখ খুলে দেখি মসজিদের ইমাম সাহেব উনার বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমার সাথে ধাক্কা লাগলো।

আমি হুজুরকে বললাম,
: হুজুর মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে যে, ওনারা কারা?
: কই কাউকে তো দেখা যাচ্ছেনা।
আমি হুজুরকে সব বললাম। শুনে হুজুর বললো,
: আপনি যাদের দেখেছেন, ওনারা মানুষ নয়। ওনারা জ্বিন।
: কিন্তু জ্বিনেরা এখানে কি করছিলো ?
: মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হচ্ছিলো তখন।
: কিন্তু আমি যতদূর জানি জ্বিনদের নাকি মানুষ দেখতে পায়না। জ্বিনরা অদৃশ্য হয়।
: হুম তা ঠিক। তবে জ্বিনেরা মানুষের বেশ যখন ধরে তখন মানুষ জ্বিনদের দেখে।
হুজুরের সাতে কথা বলতে বলতে হাটছি। এমন সময় আজান শুনা গেলো। আমি অবাক হয়ে হুজুরের কাছে জানতে চাইলাম,
: এত রাতে কিসের আজান?
: এতো রাত কোথায়? ভোর হয়ে গেছে । এটা ফজরের আযান।





(০৪)
তরুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। ওদের বাসায় আসা যাওয়ার পথে ভয় না পাওয়া এই আমি একটু হলেও ভয় পেয়ে যে স্থানটায় দাঁড়িয়ে যেতাম এবং ভয়ে ভয়ে পার হতাম, আজ সেখানেই তরুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।

তিনদিন আগে মাঝরাতে যখন একা বাসা থেকে বের হয়েছিলাম তরুকে দেখতে, সেদিন ত্রিশ মিনিটের রাস্তা পার হতে আমার ২ ঘন্টা সময় লেগেছিলো। মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে দেখা হওয়ার ফলে তরুদের বাসায় যাওয়ার আগে ফজরের নামাজটা পড়ে নিলাম মসজিদে।
নামাজ পড়ে যখন মসজিদ থেকে বের হলাম, দেখতে পেলাম আমার মা তরুদের বাসার দিকে যাচ্ছে। আমি দৌড়ে গিয়ে মাকে বললাম,
: আম্মু কোথায় যাচ্ছো?
: তোমার শ্বশুর বাড়ি।

আম্মুর কথা শুনে বুঝা গেলো যে, ওনার অবাধ্য হয়ে মাঝ রাতে বাসা থেকে বের হওয়াটা উনি টের পায়নি। আমি প্রায়ই ফজরের নামাজ পড়তে বের হই, এইটা আম্মু জানে, তাই মনে হয় দরজা খোলা দেখেও আম্মু বিচলিত হয়নি। যাক বাবা বাঁচা গেলো। আম্মু বুঝতে পারলে খুব কষ্ট পেত এবং রাগ করতো। আম্মু সহজে রাগেনা। রাগলে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। আম্মু কষ্ট পেলে এবং রাগ করলে আমার কাছে পৃথিবীটা অভিশপ্ত মনে হয়।

: ছেলেকেতো এখনো বিয়ে করাওনি। তাহলে ছেলের শ্বশুর কোথায় পেলে?
: কেনো ছেলের বিয়ের কথাতো পাকাপোক্ত।
: আচ্ছা আম্মু তুমি কি কিছু অনুমান করতে পারছো যে, কি ঘটেছিলো ওদের বাসায় কাল রাতে?
: না।

আমি আর আম্মু কথা বলতে বলতে তরুদের বাসার সামনে এসে পড়লাম।
তরুদের বাসার আশেপাশে বড় কোনো বিল্ডিং নেই। যেগুলো আছে সেগুলোও কয়েকটা ফাঁকা ফ্লটের পরে। তরুদের বাসাটাও এক তলা বিশিষ্ট। বাসার চারপাশটা দেয়ালে আবৃত। দেয়ালের ভিতরে ঘরের চার পাশে বিভিন্ন ধরনের ফুল ও ফলের গাছ আছে। ঘরের ঠিক সামনে তহুরার হাতে গড়া ছোটখাটো একটা ফুলের বাগান আছে।
নিরব নিস্তব্ধ ভোর বেলা আমি আর মা যখন ওদের বাসার মেইন গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম, আমার মনটা ভরে উঠলো তহুরার ফুল বাগানে বাহারি রংয়ের ফুটন্ত সব ফুল দেখে। পূব আকাশের নিম্নভাগ থেকে উকি দেয়া সূয্যি মামার সতেজ কিরণ এসে পড়েছে তহুরার ফুল বাগানে। ফুলের পাতায় আর পাপড়িতে জমে থাকা শিশির বিন্দুতে যখন সবে উদিত সূর্যের কিরণ এসে পড়লো খুবই সু এক দৃশ্যের অবতারণা ঘটলো। খুবই মনোরম চিক চিক করা দৃশ্যটি।
আমি আশা করেছিলাম, তহুরাকে ফুল বাগানেই দেখতে পাবো, বাগান পরিচর্যারত অবস্থায়। তহুরা প্রতিদিনই ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে যায় শুধু তার ফুল বাগানটার মায়ায়। কিন্তু আজ ওদের বাড়ির আঙ্গিনা কেমন যেনো ফাঁকা মনে হচ্ছে, যদিও এর আগে ভোর বেলা কোনোদিনও ওদের বাসায় আসা হয়নি। ওর বর্নণানুযায়ী মিল পাচ্ছিনা বলেই ফাঁকা লাগছে হয়তো।

ফুল বাগান পেরিয়ে বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় যখন নক্ করতে যাবো, নক্ করার আগেই তহুরার বাবা দরজা খুলে আমাদের দেখতে পেল। সালাম বিনিময়ের পর উনি আমাদের ভিতরে ঢুকতে বললো।
উনাকে দেখে মনে হলো, উনি জানতো যে, আমরা আসবো, আমাদের দেখে মোটেও বিস্মিত হননি।
আমরা ভিতরে ঢুকার পর ড্রয়িং রুমে বসলাম। উনি ড্রয়িং রুমে লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে ভিতরে চলে গেলো। তের মিনিট পর তহুরার মা চা নিয়ে এল। চা টেবিলে রেখে আম্মুকে জড়িয়ে ধরলো তহুরার মা। মনে হলো ওনারা কত জনমের পরিচিত। তহুরার মায়ের চোখ থেকে পানি পড়তে দেখলাম।
আমার কাছে অস্বস্তি লাগছিলো খুব, বিশ মিনিট হয়ে গেলো এখনো তহুরা আসছেনা দেখে।
আমি তহুরার বিষয়ে জানতে চাইবো, এমন সময় আম্মু আমাকে থামিয়ে তহুরার মাকে বললো,
: তহুরা মামনিকে দেখছিনা। ও কি উঠেনি এখনো?
: ও রাতে খুব ভয় পেয়েছিলো। ফজরের কিছুক্ষন আগে ঘুমিয়েছে।

আমি বিস্তারিত জানার জন্য বললাম,
: কাল রাতে প্রায় আড়াইটার দিকে তহুরা আমাকে অনেকগুলো কল করেছিলো। আমি রিসিভ করতে পারিনি। এরপর আমি অনেকবার কল করেছিলাম, ও ধরেনি। পরে আমি আঙ্কেলের নম্বরেও ফোন করেছিলাম। আঙ্কেলের ফোনটা বন্ধ ছিলো। এরপর থেকে আমি খুব দুশ্চিন্তায় রাতে আর ঘুমাতে পারিনি। কি হয়েছিলো আন্টি তহুরার?

: রাত প্রায় তিনটার ‍দিকে তহুরার চিৎকার শুনে আমি আর ওর বাবা ওর রুমে গিয়ে দেখি, ওর বিছানা এলোমেলো। ওর চুলগুলো উসকো-খুসকো। চোখে রাজ্যের ভয়, চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। ও খাটের এক কোনায় গুজো হয়ে বসে আছে। আমাদের দেখে লাফিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
"ওরা আমাকে মেরে ফেলতে চায় আম্মু! আমার চুল ধরে টেনে নিয়ে যেতে যাচ্ছিলো, আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে উঠে বসি। লাইট জ্বালিয়ে দেখি রুমে কেউ নেই। তবে ভয়ংকর একটা গন্ধ লেগেছে নাকে। আমি দোয়া পড়ে নিজেকে ফু দিলাম এবং মাহমুদকে অনেকবার কল করলাম। ও ঘুমিয়ে পড়েছে তাই হয়ত রিসিভ করেনি। এরপর আমি আবার শুয়ে গেলাম। লাইট বন্ধ করে শোয়ার কয়েক মিনিট পর শুনলাম, মাহমুদ আমাকে ডাকছে। আমি চোখ খুলে দেখি ৫জন মাহমুদ আমায় ঘিরে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকছে। মাহমুদ গুলো যখন আমার দিকে এগুচ্ছিলো আমি প্রচন্ড ভয়ে চিৎকার করা শুরু করলাম। এর পর তোমরা রুমে এলে। মা ওরা আমাকে মেরে ফেলবে, আর যদি না ও মরি আমি নিশ্চিত পাগল হয়ে যাবো। আমি একা থাকতে পারছিনা আর। প্লিজ মা কিছু একটা করো।"
এরপর আমি আর ওর বাবা ওর পাশে বসে ছিলাম সারারাত। ও ফযরের কিছুক্ষন আগে ঘুমিয়েছে। ও ঘুমানোর পর আমি আর ওর বাবা ফজরের নামাজ পড়ে শুলাম কিছুক্ষণ আগে।

আম্মু কি জেনো বলতে যাবে, এমন সময় আম্মুকে বাঁধা দিয়ে তরুর আম্মু অনুরোধের সুরে আম্মুকে বললো,

: আপু যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে আজই মাহমুদ আর তরুর বিয়েটা সেরে ফেলি!

: বিয়েতো অবশ্যই হবে, ইনশাআল্লাহ। তার আগে প্রয়োজন তরু মামনির সমস্যাটার সমাধান করা।

: অনেক চেষ্টাইতো করলাম আপু। কোনো কাজ হচ্ছেনা। ডাক্তার এবং হুজুরেরা বলেছে যে, ওকে রাতে একা রাখা যাবেনা।

: আচ্ছা! ওর এই ভয় পাওয়ার সমস্যাটা হঠাৎ করেই শুরু হল নাকি আগে থেকেই এই সমস্যা ছিল?

: সত্যি কথা বলতে কি, ওর যখন ৪বছর বয়স তখন একবার ও হারিয়ে গিয়েছিলো। কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলামনা। ৫ঘন্টা পর অজ্ঞান অবস্থায় বাসার সামনে পাওয়া গিয়েছিলো। অথচ পাঁচ ঘন্টার মাঝে বাসার সামনে আমরা অগণিত বার হেঁটেছি, ওকে দেখিনি। এরপর ওর বাবার বন্ধু উনার এক হুজুর বন্ধুকে দিয়ে ওকে ঝাঁড়-ফুঁক দিলো, তাবিজ দিলো, বাসা বন করলো। এবং সতর্ক করে বলেছিলো যে, ”সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত ইনশাআল্লাহ আর কোনো ঝামেলা নেই, সব সময় চুল বেঁধে রাখতে হবে এবং বাহিরে গেলে অবশ্যই মাথায় কাপড় দিয়ে চুল ডেকে বের হতে হবে। সাবালিকা হওয়ার সাথে সাথে বিয়ে করিয়ে দিলে আল্লাহর রহমতে আর কোনো সমস্যায় পড়তে হবেনা।”

কথাগুলো শুনে আম্মুর কপালে ভাঁজ পড়তে দেখলাম। আম্মু গম্ভির হয়ে জানতে চাইলো,
: আপনারা সব জেনে শুনেও কেনো ওর ব্যাপারে সতর্ক হননি?

তহুরার মা আমার আম্মুর প্রশ্নের উত্তর দিতে যাবে, এমন সময়, তহুরার বাবা ভিতর থেকে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলো,
: তহুরার মা, জলদি এদিকে আসো, দেখে যাও আমার মেয়ে কথা বলছেনা কেনো?

আঙ্কেলের চিৎকার শুনে আমার পৃথিবীটা কেমন যেনো একটা ‍বড়সড় ধ্বাক্কা খেলো। বসা থেকে নেনো সেকেন্ডের মাঝে উঠে তহুরার রুমে এসে দেখি, তহুরা নিরব শুয়ে আছে, কোনো শ্বাস নিচ্ছেনা, একটুও নড়ছেনা। তহুরার মা তহুরাকে হাত ‍দিয়ে স্পর্শ করে বললো, “আমার মেয়ের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। ও আর আমাদের মাঝে নেই।” একথা বলে তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

তহুরাকে কবিরাজ বাড়ির কবরস্থানেই কবর দেয়া হলো। ওর দাফন কাফন সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত নিজেকে অনেক কষ্টে সংযত রেখেছি। কবর দেয়ার পর ধীরে ধীরে সবাই চলে গেলো, আমি একা ওর কবরের পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসে আছি। ওকে এখানে একা রেখে আমি যেতে পারছিলাম না। আমি আমার জীবনে দিনের আলোয় কখনো কাঁদিনি। আজো কাঁদছিনা। চোখ গড়িয়ে জল এমনিতেই পড়ছে, আমার চোখ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে।
কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ওর আত্মার মাগফিরাত কামনা করে পবিত্র কুরআন পড়লাম, কুরআন পড়া শেষে মোনাজাত করলাম, এরপর পিছনে ফিরে দেখি তহুরার বাবা দাঁড়িয়ে আছে। উনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। অনেক্ষন কাঁদলো।

তিনদিন হলো তরু আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। এই তিনদিনের প্রতিদিনই আমি তরুকে দেখতে এসেছি। আমার ভিতর থেকে আমার আমিটা আমাকে ধ্বিক্কার দিয়ে বার বার বলছে, তহুরার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। আমি যদি সেদিন রাতে তহুরার ফোনটা রিসিভ করতে পারতাম, তাহলে তহুরা ভয় পেতোনা। প্রয়োজনে সারারাত কথা বলতাম।

তহুরার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তহুরার আত্মার মাগফিরাতের জন্য দোয়া ও কোরআন পড়ুছি প্রতিদিন এসে। সেই সাথে আমিও ক্ষমা চাচ্ছি , তহুরা যাতে আমাকে ভুল না বুঝে।
এক সাথে সুখে দুখে সারাটা জীবন কাটানোর কথা ছিলো আমাদের। কি হতে কি হয়ে গেলো। যতদিন বাঁচবো তহুরাকে হারানো যন্ত্রণা এবং একটা অপরাধ বোধ নিয়ে নিজের সাথে নিজেকে যুদ্ধ করে বাঁচতে হবে।

আমি এই তিনদিনে যতবার কবরে এসেছি, কবরে ঢুকার সময় কাউকে দেখিনি, কিন্তু বের হওয়ার সময় প্রতিদিন কবরের দক্ষিন পাশে সাদা জুব্বা পড়া লম্বা কেউ একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। তার চেহারাটা দেখিনি। কারণ প্রতিদিনই সে উল্টো দিকে ফিরে ছিলো।
আজ কবর যিয়ারত করে বের হওয়ার সময় সেই লোকটা আমার সামনে এলো, রুমাল দিয়ে ঢাকা থাকায় তার চেহারাটা দেখতে পাচ্ছিলামনা। লোকটা আমাকে সালাম দিল। আমি সালামের জবাব দিয়ে জানতে চাইলাম,
: আপনি কে? আপনি কি আমাকে চেনেন?
: আমার পরিচয়টা দেয়ার আগে আপনাকে কিছু কথা বলা জরুরী। আর হ্যাঁ আমি আপনাকে চিনি। কিন্তু আপনি আমাকে চিনবেননা।
: আচ্ছা ঠিক আছে, কি বলবেন বলুন।
: তহুরার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী।
: কি বলছেন আপনি? তহুরার মৃত্যুর জন্য তো আমি দায়ী।
: আপনি মোটেও দায়ী না এর জন্য। সম্পূর্ণ দায়ভার আমার। আর এ জন্য আমাকে আমার সমাজ মেনে নিচ্ছেনা।
: আমি আপনার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছিনা।
: তহুরার জন্মের পর থেকেই আমি ওকে অনুসরণ করছিলাম। ওর বয়স যখন চার বছর ছিলো, তখন আমি ওকে কিছু সময়ের জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম আমার বাবাকে দেখানোর জন্য। বাবা বলেছিলো ওর প্রাপ্ত বয়স হওয়া পর্যন্ত আমি যাতে ওকে আর বিরক্ত না করি। প্রাপ্ত বয়স্ক হলে, ওর আর আমার বিয়ে করিয়ে দিবে। তাই বাবার আদেশে আমি ওকে আবার ওর বাসায় রেখে গিয়েছিলাম। এরপর তহুরা যখন সাবালিকা হলো, আমি আবারো ওকে অনুসরন করা শুরু করলাম। কিন্তু কখনো সামনা সামনি এসে ওকে বিরক্ত করতামনা। যেদিন থেকে দেখলাম, আপনি ওকে পছন্দ করেন, তহুরাও আপনাকে পছন্দ করে সেদিন থেকে হিংসায় আমি জ্বলে যাচ্ছিলাম। আমি তিনবার ওর সামনে গিয়ে ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি। ও আমাকে পাত্তাই দেয়নি। আমি ভাবলাম প্রতিশোধ নিবো। আমি তহুরাকে বিরক্ত করছি এবং প্রতিশোধ নেবার জন্য মনস্থির করেছি যে, তা আমার বাবা জেনে যায় এবং অনেক অপমান করে আমাকে। ফলে প্রতিশোধের আগুন আরো ধাউ ধাউ করে জ্বলে উঠলো।
: তহুরাকে অন্য কেউ পছন্দ করতো, তাতো আমি জানতামনা!
আপনার নাম কি? বাসা কোথায়?
: সব বলে নেই । তার পর পরিচয় দিবো।
: আচ্ছা বলুন।
: আপনার মনে আছে, একদিন দুপুর বেলা, আপনি আর তহুরা
পার্কে বসে ছিলেন, হঠাৎ করে তহুরা অদ্ভূতভাবে হাসা শুরু
করলো এবং চেহারা ভয়ঙ্কর করে ফেললো?
: হুম মনে আছে।
: তহুরা প্রায় আপনাকে বলতো যে, ও যখন ঘুমাতে যেত, খুব ভয়
পেতো!
: হুম বলতো। কিন্তু, আপনি এসব কি করে জানেন?
: বলছি।
: বলুন।
: তহুরা যেদিন মারা যায়, সেদিন রাতে তহুরা ভয় পেয়ে
আপনাকে অনেকবার ফোন করেছিলো। কিন্তু আপনি রিসিভ
করতে পারেননি। তাই ও নিজেকে সামলে নিয়ে আবারো
ঘুমানোর চেষ্টা করলো। এরপর ও শুনতে পেলো, আপনি ওকে
ডাকছেন, ও চোখ খুলে দেখলো, আপনার চেহারার পাঁচজন
মাহমুদ ওকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে। সবগুলো মাহমুদ মিলে ওকে
খুব ভয় দেখাচ্ছিলো।
: আপনি এত্ত সব কিভাবে জানেন? দয়া করে আপনার পরিচয়টা
দিন।
: দিচ্ছি।
: হুম দিন।
: তহুরা মারা গিয়েছিলো ফজরের একটু আগে। মাহমুদ সেঁজে
ওকে আবারো ভয় দেখানো হয়। ভয়ানক ভয়। ভয় সহ্য করতে
না পেরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়।
: সত্যি করে বলুনতো আপনি কে? এত কিছু কিভাবে জানেন?
: কারণ এ সমস্ত কিছু আমি ই করেছি। সেদিন রাতে যখন আপনি তহুরাদের বাসার দিকে যাচ্ছিলেন, মসজিদের সামনে কিছু দেখে ভয় পেয়েছিলেন, তাও আমিই করেছি। যাতে করে আপনি ফজরের আগে তহুরাদের বাসায় পৌঁছাতে না পারেন। আর আপনি সেঁজে তহুরাকে ভয় দেখানোর মানে হলো, তহুরা যেনো আপনাকে ভুল বুঝে ঘৃণা করতে শুরু করে। আমার উপস্থিতিতেই আমার দেখানো ভয়ে আমার ভালোবাসার তহুরা মারা গেলো। ও যখন মারা গেলো ঠিক তখনই আমি বুঝতে পারলাম, জঘন্য একটা কাজ করে ফেললাম আমি। আমার সমাজের প্রত্যোকে জেনে গেলো আমি মানুষ খুন করেছি। আর সাথে সাথেই আমার সমাজে আমাকে অবাঞ্চিত ঘোষনা করলো। আমি অভিশপ্তদের দলে চলে গেলাম। বিশ্বাস করুন মাহমুদ। আমি অভিশপ্তদের দলে থাকতে চাইনা। আমি তাওবা করে আমার সমাজে আগের মত থাকতে চাই। তহুরা থেকেতো ক্ষমা চাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। তহুরার মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি অন্যায় করা হয়েছে আপনার সাথে। আমি অপরাধি। আমাকে ক্ষমা করে দিন। আপনি ক্ষমা না করলে আমার সমাজ আমাকে আর কোনো দিন মেনে নিবেনা। বাকি জীবন আমাকে অভিশপ্তদের সাথে কাটিয়ে দিতে হবে। আপনি যতদিন না আমাকে ক্ষমা করতে পারছেন, ততদিন আমাকে আপনার আদেশের গোলাম বানিয়ে নিন। আপনি যখনই আমাকে স্মরণ করবেন, আপনার উপকারে আমি হাজির হব, ইনশাআল্লাহ।

আমি কথা গুলো শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলামনা। একজন জ্বীন আমার সামনে দাঁড়িয়ে তার অপরাধবোধের জন্য ক্ষমা চাচ্ছে। এ কি করে সম্ভব? আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। জ্বীনেরাও যে, মানুষের প্রেমে পড়ে এটা আমার জানা ছিলোনা। একজন জ্বীন আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, আমার অনেক ভয় পাওয়ার কথা। কিন্তু আমি মোটেও ভয় পাচ্ছিনা। আমি এই অনুতপ্ত জ্বীনকে ক্ষমা করে দিবো নাকি গোলাম বানিয়ে নিবো তাও বুঝতে পারছিলামনা।
আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে খোঁচা দিয়ে বললো, জ্বীনকে গোলাম বানিয়ে নতুন করে ঝামেলা পাকানোর কোনো প্রয়োজন নেই। তহুরাকেতো আর ফিরে পাবোনা। তাছাড়া নিজের ভুল এবং অপরাধের জন্য অনুতপ্ত এই জ্বীনকে ক্ষমা না করলে সে অভিশপ্ত জ্বীনদের সাথে মিশে গিয়ে মানুষের অনিষ্ট করা শুরু করবে। তার চেয়ে বরং ক্ষমা করে দেই। তাই জ্বীনকে বললাম,
: ক্ষমা করার মালিকতো আল্লাহ তায়ালা। আল্লাহ সবাইকে মাফ
করে দিক। আপনার উপর আমার কোনো রাগ নেই। আমার
তহুরার জন্য দোয়া করবেন।
: আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুক। তহুরার জন্য আমি সারাজীবন
দোয়া কররবো। আপনি কি জানেন একজন জ্বীন কত বছর পর্যন্ত
বাঁচে?
: না।
: পাঁচশত বছরের বেশি বাঁচে একেকজন জ্বীন। আমার বয়স এখন তিনশত আশি বছর। আমি আমার বাকি জীবনে যতদিন বাঁচবো, আমি তহুরার সাথে যে অন্যায় করেছি তার জন্য মহান আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইবো এবং তহুরার জন্য দোয়া করতে থাকবো। আমাকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ হাফেজ।

চোখের পলক ফেলতেই দেখি মানুষের বেশ ধরা জ্বীনটি আমার সামনে আর নেই।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৫৪৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২১/০৩/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast