www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

রেবতী

রেবতীর চোখ জলভরা।
কষ্ট মেশানো অনুভূতি ওর সারা শরীরে। কষ্টের তীব্রতা অবশ্য ততটা না। কষ্টটা বিঁধছে অনেকটা এয়ারগানের গুলি গায়ে লাগলে যেমন, সেরকম হালকা হালকা। বন্দুকের গুলিতে যতটা হয়, ব্যথার প্রচন্ডতা তেমন না। মেঘলা আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর মত হঠাৎ হঠাৎ কষ্টটা আসে, ক্ষণস্থায়ী হয়। কিন্তু যতক্ষণ থাকে চমকানোটা সবাইকে স্বগর্বে জানিয়ে দিয়ে যায় - ‘আমি এসেছিলাম।’ রেবতীর কষ্টটাও হঠাৎই আসে, ওকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে যায়। অবশ্য চলেও যায় সহসাই। ব্যথিত মনটা কোহেনের কাছ থেকে চট করে আবার সায়নের কাছে ফেরত আসে। কষ্ট ভাবটা নাই হয়ে যায় আচমকাই। সায়ন রেবতীর ভালাবাসার জন। একান্ত আপন - অতি ‘বিশেষ’ একজন। এর মধ্যেই কোহেন কেমন করে যেন মনের গহীন এক কোঠায় ঠাঁই নিয়েছিল।
রেবতীদের বর্তমান ঠিকানা মিষ্টি পানির জলাটার ধারে। সুন্দরবনের এদিকটা তেমন ঘন না। সুন্দরী গাছ আছে, সাথে গরান আর কেওড়া। কিন্তু গোলপাতা আর গেওয়া তেমন একটা নেই। সুন্দরবনে জলার ধার ঘেঁষে গোলপাতার ঝোপ প্রচুর হয়। অবশ্য এদিকটায় অজানা কারণে ঝোপমার্কা গাছের প্রাধান্য কম। ফাঁকা ফাঁকা জায়গাটা দেখেই রেবতীর বাবা-মা এখানে বাসা বেঁধেছে। সাথে ওর ছোট বোনটি রেনকী - এখনও কিশোরী, চপলা।
তেমন কিছু নেই রেবতীদের ডেরায়। হরিণদের বাসাগুলো কমবেশী এরকমই হয় - সুন্দরী গাছের তলায়। শুধুমাত্র ওদের সর্দার চিয়ামের ওখানেই চালার মত আছে একটা। বাকীদের ছাদ-চালার কোন বালাই নেই। অবশ্য দরকারও নেই তেমন একটা। খোলা আকাশের নীচে গাছের তলায় ঘুমায় ওরা। রোদ-বৃষ্টিতে হরিণদের কোন অসুবিধা হয় না। গোলপাতায় বানানো মাদুর বিছিয়ে শুয়ে থাকে। মানুষদের মত আলাদা কক্ষের নিয়মও এখানে নেই। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আবার কখনো সংঘবদ্ধ হয়ে ঘুমায় ওরা। ওদের দলটা বেশী বড় না, তিরিশ পরিবার হবে। মানুষদের মতই পরিবার প্রথা হরিণদের। প্রত্যেক পরিবারের আলাদা গাছের তলা আছে, ওটাই বাসা। হরিণদের এই দলের নাম জুবান। আর জুবানের দলপতি ঐ চিয়াম। পুরো বনটি নদী-খাল দিয়ে অনেকগুলো এলাকায় ভাগ করা। প্রত্যেক এলাকায় একেকজন সর্দার আছে। সর্দারের বাড়িতে সভা-সমাবেশ হয় তাই সকলে মিলে একটা বড় চালা বানিয়ে দিয়েছে। যাতে সভায় কোন ব্যঘাত না ঘটে।
রেবতীদের বাসায় আসবাব বলতে তেমন কিছু নেই। রান্নাঘরের বালাই নেই। যার যখন ক্ষুধা লাগে নদীর ধার ধরে হেঁটে হেঁটে গাছের কচি পাতা খায়। মাঝে মাঝে ওরা দলবেঁধেও খেতে যায়। দলের প্রায় সকলেই থাকে সে সময়। ছোটবেলায় রেবতীর কী যে আনন্দ হত তখন! অনেক বন্ধু ছিল ওর। একসাথে ঘুরে বেড়ায়, লাফিয়ে লাফিয়ে খেলে আর মনের সুখে পাতা খায়। বিশেষ করে লালমত কী একটা ফল আছে, খেলে জিহ্বা লাল হয়ে যায়। তখন এই লাল জিহ্বা নিয়ে ওরা কত মজা করত! এর চেয়েও মজার ব্যপার ছিল যখন রান্নাবান্না খেলত। কয়েক বন্ধু মিলে গাছের পাতা, ডাল দিয়ে কত কিছু রান্না করেছে। আহারে! কী সব দিন ছিল তখন! এখন বড় হয়ে গেছে ও। আগে যেখানে থাকত সে জায়গা ছেড়ে এসেছে অনেক বছর আগে।
বাসায় আসবাব তেমন না থাকলেও রেবতীর জন্য একটা নির্দিষ্ট জায়গা আছে। সেখানে গাছের সাথে হেলানো একটা বড় আয়না আর সাজগোজের সরঞ্জাম। রেবতী সাজতে বড় পছন্দ করে। আয়নার দিকে তাকায় ও - বড় বড় মায়াভরা দু’টি চোখ। কান দু’টো অন্যদের চেয়ে একটু বড়। মুখটা অত সুচালো না, গোলগাল। ভরাট গাল। গায়ের রঙ গাঢ় বাদামী আর তার মাঝে সাদা ছোপ ছোপ। জায়গায় জায়গায় বাদামী রঙ হালকা হয়ে গেছে। এতে মিশ্রিত রঙের চমৎকার একটা আবহ হয়েছে। ততটা লম্বা না রেবতী, বেঁটে ধরনের কিছুটা। কিন্তু সৌন্দর্য অতুলনীয়। মাথা নেড়ে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যায় রেবতী। বুঝতে পারে, অনেকেই ওর দিকে কেমন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। বিশেষ করে ওদের মহল্লার শেষের দিকে থাকে যে সায়ন, তাঁর মুগ্ধ দৃষ্টি রেবতীকে উতলা করে।
সায়ন লম্বা বেশ। আর শিংগুলোও বড় বড় এবং ছড়ানো। জুবানের সকলের চেয়ে সায়নের শিং সবচেয়ে বড় মনে হয়। সায়নের শরীরটাও বেশ শক্তপোক্ত। মাংসভর্তি পেশী ফুটে বেরোয় শরীর থেকে। রঙটা অবশ্য একটু ময়লা। সারাদিন বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, একটু ময়লাতো হবেই। কিন্তু অসুরের শক্তি যেন গায়ে। বাঘ আসলে সায়ন যে দৌড়টা দেয় তার সমতূল্য জুবানে আর কেউ নেই। বাঘ ওর ধারে কাছেও আসতে পারেনি কোনদিন। জুবান থেকে প্রায়ই বাঘ ছোট-বড় হরিণ ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু সায়নকে? উহু। বাঘের ধরা ছোঁয়ার বাইরে এই শক্তমর্দা হরিণটি।
প্রতি বছর জুবানে নতুন পাতা গজানোর উৎসব হয়। উৎসবের নাম - চিয়ামক। সর্দারের নামে নাম। জুবানে যে সর্দার হয় তার নাম সব সময় চিয়াম। সর্দারের বাড়ির উঠানে সবাই গোল হয়ে নাচগান করে এদিন। মানুষদের বর্ষবরণে যে রকম হয়। তবে এদের বছর গণনা অবশ্য ভিন্ন। চন্দ্র-সূর্য্য দেখে ওরা বছর মিলায় না। সর্দারের বাড়ির কাছে একটা থামে আড়াআড়ি দাগ কাঁটা আছে নীচ থেকে উপর পর্যন্ত। ঐ থামের পাশে ছোট চারাগাছ লাগানো হয়। চারাগাছ বড় হতে হতে যখনি একটা দাগ ছোঁয় এক বছর হয়। পরের দাগ ছুঁলে পরের বছর। নতুন সর্দার আসলে আবার নতুন চারাগাছ লাগানো হয়।
নববর্ষের এই দিনে সব হরিণ মিছিল করে বনে ঘুরে বেড়ায়। চারিদিকে পাহাড়ায় থাকে বাঘ যেন আসতে না পারে। মিছিল শেষে ওরা সংঘবদ্ধ হয়ে গান গায়। সবশেষ হয় নাচ, উদ্দাম সে নৃত্য। সকলে গোল হয়ে বসে বৃত্তের মত। আর মাঝখানে নাচিয়েরা অংগে ঢেউ তুলে নাচে। এসময় গেওয়ার পাতা ছেঁচে লবনাক্ত পানি, বনের মধু, ফলের রস আর বাঘের রক্ত মিলিয়ে একটা পানীয় বানায় ওরা। নাম; শিষম। এই শিষম খেলে বিষম নেশার মতন লাগে। অদ্ভুত সে নেশা। পানীয়টা বানাতে ওদের নানা সমস্যা - বিশেষ করে বাঘের রক্ত যোগাড় করা। অনেক কাঠখর পুড়িয়েই তবে মেলে তা। সারাদিন শিষম খায় ওরা আর সন্ধ্যের পর শুরু হয় নাচ।
সায়ন সর্বাগ্রে নাচের। যেমন গান গায় রেবতী তেমন নাচে সায়ন অদ্ভুত ক্ষীপ্রতায়। নাচের তালে তালে ওর পুরুষ্ঠ পেশী ফুলে ফুলে উঠে। শরীরে আগুন ঠিকরে বেরোয় শিষমের প্রভাবে। চোখ লাল হয়ে উঠে। বড় শিং নাচিয়ে পা ঠুকে ঠুকে সবাইকে মুগ্ধ করে রাখে। ওর মত নাচ জুবানে আর কেউ পারে না। মাঝে মাঝে স্বরচিত কবিতা বলে ছেলেটি। হরিণদের কবিতা নিহন ভাষায় লেখা। বনের সবাই নিহন জানে। তাই কবিতা শুনে সকালেই বাহ বাহ করে উঠে। প্রতি চিয়ামক শেষে সর্দার সুন্দরী পাতা আর বাঘের নখের একটা মালা পড়িয়ে দেয় চ্যাম্পিয়নকে। বরাবর সায়ন চ্যাম্পিয়ন এ উৎসবের।
রেবতী মায়াকাড়া চোখ বড় বড় করে সায়নকে দেখে। সায়নের নাচ দেখে। নিহন ভাষায় লেখা সায়নের কবিতা শোনে মন দিয়ে। কবিতা রেবতীর ভীষণ পছন্দ। সায়ন কেমন হেলেদুলে সুর করে শিং বাঁকিয়ে কবিতা আবৃতি করে। রেবতী মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে যায়। নাচ আর কবিতার ফাঁকে ফাঁকে সায়ন প্রায়ই রেবতীর দিকে চায়। চোখাচোখি হয়ে যায় দু’জনের হঠাৎ হঠাৎ। আরক্ত হয় হরিণীটি। লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয় প্রতিবারই। অবশ্য সায়নকে দেখলেই একরাশ লজ্জা ওকে ঘিরে ধরে। এত লজ্জা নিয়ে কীভাবে কি করবে ও?
হঠাৎ রেবতী দেখে নাচতে নাচতেই সায়ন এগিয়ে আসছে ওর দিকে। একেবারে কাছে এসে পড়ে। মাথাটা উঁচুু করে সামানের পা’টা বাড়িয়ে বলে, ‘রেবতী, আস নাচি।’
রেবতী লজ্জা আর ভয়ে কুঁকড়ে যায়। ভয়ার্ত চোখে আশেপাশে চায়। কপাল! সকলেই কেমন ওর দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আর হাসছে মিটিমিটি। কী হলো সকলের?
‘আমি নাচতে পারি না।’ কোনমতে ঢোক গিলে বলে রেবতী।
‘সমস্যা নাই, আমি শিখিয়ে দিব।’ দৃঢ় সায়নের গলা।
‘না না, আমি পারব না।’ সলজ্জে বলে রেবতী।
‘আহা, লজ্জার কিছু নেই। এসো তো।’ বলেই সামনের পা দিয়ে হ্যাচকা টানে বৃত্তের মধ্যে নিয়ে যায় ওকে।
রেবতী চারিদিকে তাকায় - কাজলকালো চোখে দুনিয়ার সব ভীরুতা এনে, অসহায়ভাবে। বৃত্তের মধ্যে ওরা দু’জনই শুধু। হাত-পা কাঁপতে থাকে সজোড়ে। পড়ে যাবে কী না এরকম মনে হয়। এদিকে সায়নটা যে কী! এসব লজ্জা শরমের বালাই নেই। ঝাকড়া শিং নাচিয়ে দু’পা উঁচু করে রেবতীর সামনে দাঁড়ায়। পরবর্তি আধা ঘন্টা ঝড় বয়ে যায় ওখানে। কখনো সামনে, কখনো পিছনে সমানে চালিয়ে যায় নাচ। শুরুর দিকে রেবতী ঠিক তাল মেলাতে পারেনি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে উদ্দাম হয়ে উঠে ও। মাঝেমধ্যেই রেবতীকে দু’পায়ের উপর নিয়ে শূন্যে উঠিয়ে ফেলে সায়ন।
নৃত্যের তালে তালে একসময় উত্তেজনার চরমে পৌঁছে যায়, আবার পরক্ষণেই নিস্তব্ধতার সাগরে নেমে যায় ওরা। হাঁপিয়ে উঠে রেবতী। ছোপ ছোপ শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়ে ঘামের ধারা। চোখ দু’টো আনন্দে লাফাতে থাকে। ভাললাগার তীব্র অনুভূতি স্নায়ু বেয়ে ওঠানামা করতে থাকে। হরিণদের স্বভাবজাত ধরনে সামনের পা দু’টো মাটিতে ঠুকে আনন্দ প্রকাশ করে রেবতী, বেশ অনেকবার। বড়বড় চোখ দুটিতে রাজ্যের বিস্ময় খেলা করতে থাকে। ভালবাসার পূর্ণ দৃষ্টিতে সায়নকে দেখতে থাকে অনবরত।
‘তুমি এত সুন্দর কেন?’ সায়ন সতৃষ্ণে চেয়ে থাকে ওর দিকে।
‘সুন্দর না কচু।’ রেবতীর কপট রাগ।
‘তুমি কি জান তোমাকে আমি কতটা পছন্দ করি।’
‘পছন্দ কর শুধু। ভালবাসো নাতো?’
‘অবশ্যই ভালবাসি।’ সায়ন আবেগে বলে।
‘সত্যি বলছ?’ রেবতী কাঁপে।
‘তোমাকে মিথ্যা বলব কেন? তুমি কি আমাকে ভালবাস না?’
‘জানি না।’ অস্ফুটে বলে রেবতী। এর বেশী বলতে পারে না। সারা শরীর অবশ হয়ে যায়।
এরপর এখানে ওখানে, ঘন গোলপাতা ঝোপের আড়ালে, শ্বাসমূলের চারিধারে ওদের উদ্দাম প্রেম বাঁধ ভাঙ্গা খেলায় মেতে উঠে। সুন্দরী গাছের উঁচু ডালের সবচেয়ে কচি পাতাটা এনে রেবতীকে দেয় শক্তিশালী সায়ন। রেবতী আরাম করে খায় আর সুখের সাগরে ডুবে থাকে। সৃষ্টিকর্তা এত সুখ ওর কপালে রেখেছিল ভাবতেই কৃতজ্ঞতায় মন ভরে যায়। সুখের আবেশে মাঝেমধ্যেই নিজের গা ঘষে দেয় সায়নের সাথে। এটা হরিণদের মধ্যে ভালবাসা প্রকাশের সাধারণ রূপ।
সর্দারের অনুমতি নিয়ে জুবানে নতুন একটি পরিবার আসে। সবাই আন্তরিকভাবে স্বাগত জানায় ওদের। সুন্দরী গাছের কচি পাতা দিয়ে নতুনদের আপ্যায়ন করায় ওরা। এই পরিবারের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে - কোহেন আর খিতন। সাথে বাবা-মা। খিতন চমৎকার দেখতে, বেশ সুশ্রী। আর কোহেন লম্বা-চওড়া। গায়ের রঙ বেশ ময়লা। শিং ছোট এবং দেখতে সুশ্রী নয় ততটা। সায়নের কাছে তো কিছুই না। কেমন লাজুক লাজুক ভাব মেয়েদের মত। কিন্তু প্রথম দিনেই ছেলেটা কেমন করে যেন রেবতীর দিকে তাকায়। যেন কত দিনের চেনা। কয়েকদিন পার হয়ে যায় এরমধ্যে। রেবতী জলার ধারে কচি পাতা খাচ্ছে একদিন।
‘আমি অনেকদিন থেকেই তোমার বন্ধু হতে চেয়েছি।’ কোহেন মৃদু স্বরে বলে।
রেবতী চোখ তুলে চায়, ‘একথা আমি আগে কখনো শুনিনি।’
‘আমি কিন্তু এখনকার কথা বলছি না। সেই ছোটবেলার কথা বলছি।’ কোহেন কেমন উদাস হয়।
‘ছোটবেলা? মানে?’
‘সেই ছোটবেলা। যখন তোমাকে আমি দু’চোখ ভরে দেখতাম।’ কোহেন আবেগে বলে।
‘আমাকে? কোথায়?’ রেবতী অবাক হয়।
‘তুমি ছোটবেলায় এ পাড়ায় থাকতে না। আগে যেখানে থাকতে সেখানে আমিও থাকতাম।’
‘ও এখন বুঝেছি। তো আমাকে দেখা হোত কেন?’
‘ভাল লাগত। ভীষণ।’
‘তাই বুঝি?’ রেবতী চোখ বড় করে তাকাায়।
‘রেবতী, চল। জলার ঐ দিকে নতুন পাতা গজিয়েছে। তোমাকে পেড়ে দিব।’ সায়ন কোত্থেকে এসে রেবতীকে টানতে টানতে নিয়ে যায়। কোহেন নিস্পলক তাকিয়ে থাকে রেবতীর চলে যাওয়া পথের পানে।
‘ঐ ছেলেটি কে?’ সায়ন রাগত স্বরে বলে।
‘ছোটবেলায় নাকি আমাকে চিনত। আমাদের আগের পাড়ায় থেকেছে।’ রেবতী তাড়াতাড়ি বলে।
‘ও।’ সায়নের ছোট্ট জবাব।
রেবতীর আবার দেখা হয় কোহেনের সাথে। ‘কেমন আছ রেবতী?’ কোহেন মুগ্ধ দৃষ্টিতে বলে।
‘ভাল আছি।’
‘তোমাকে নিয়ে একটা ভাবনা ছিল মাথায়, অনেকদিন থেকেই। বলব?’
‘কী ভাবনা, শুনি?’ রেবতী আগ্রহী হয়।
‘শতস্বপ্ন দেখি আমি, ঘুমে-জাগরণে। নির্জন লেকের ধারে বসে আছি দু’জনে। অত্যধিক শান্ত লেকের সুপেয় পানি। চারিধার জনমানবশূন্য - কোথাও কেউ নেই। লেকের বেশ নিকটে বসেছি আমরা। যাতে দু’জনের ছায়া লেকের টলটলে জলে। গহীন কালো জল যেন প্রকৃতির আয়না সাজিয়ে দিয়েছে। সেখানে ফুটে আছে আমাদের অবয়ব পাশাপাশি, পরিস্কার। আশ্চর্য! আমরা নিজেদের দিকে না তাকিয়ে চেয়ে আছি ঐ জলছায়ার দিকে। চেয়েই আছি শুধু আমরা, কোন কথা নেই দু’জনের। কারো প্রবেশের অধিকার নেই এখানে, এমনকি কবিতা-গানের ডালি নিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরও না। নিঃস্তব্ধতায় শাব্দিক কথনের অনধিকার প্রবেশ নেই কোনক্রমেই। শুধু অনন্ত কথোপকথন চলছে ছায়ার দিকে তাকিয়ে, আপন-ঢঙে নিঃশব্দে।’ কোহেন বলতে বলতে থেমে যায় গলা ধরে আসায়।
রেবতী মোহসিক্ত হয়। অস্ফুট স্বরে বলে, ‘এও কী হয়?’
‘আমি জানি না, রেবতী।’ কোহেন নীরবে বলে।
আবার দেখা হয় ওদের, পরেরদিন। রেবতী চোখ তুলে বলে, ‘আজ কোন ভাবনা এসেছে নাকি?’
‘হা, আছে তো। শুনবে?’
‘বল, শুনি?’
‘বাহ! তুমি বলা শুরু করেছ দেখছি। ভাল।’ কোহেন খুশী হয়।
‘তাই নাকি! এহ না। মিথ্যা, মিথ্যা। আমি বলিনি।’ রেবতী লজ্জা পায়।
‘ভাবনাটা শুনবে না?’
‘আচ্ছা, বল।’
‘আমি তোমাকে নিয়ে সব সময় স্বপ্ন দেখি। অবশ্য বাস্তবে তা কখনো ঘটবে, এ দূরাশা আমি করি না। এবারের স্বপ্নটা বনের ভিতর। জুবান ছাড়িয়ে তুমি আর আমি হেঁটে যাচ্ছি। যেখানে বন একটু গহীন, দৃষ্টি আটকে যায়। পা’য়ে পা লাগিয়ে, ধরাধরি করে হাঁটছি আমরা। হেঁটেই যাচ্ছি অনন্তকাল। তোমার মায়াবী সুন্দর চোখ তুলে আমার দিকে তাকালে। মিষ্টি সুরে গেয়ে উঠলে প্রিয় গানের কলি - “শেষ কোরো না, শুরুতে খেলা শেষ করো না।” মন্ত্র মুগ্ধের মত হেঁটে যাচ্ছি। এ যাত্রার শেষ হয় না, শেষ নেই কখনো। প্রাকৃতিক পানি-চক্রের মত শুধু আবর্তিত হয়। ক্রিস্টাল মেজের এই ধাঁধাঁ উত্তরহীন। শুরু এবং শেষ অনির্ণীত।’ কোহেন উদাস হয়ে যায়।
‘দৃশ্যটা কল্পনা করতে ভাল লাগছে, কোহেন।’ একটু কি আবেশিত হয়ে যায় রেবতী?
‘এই রেবতী, তুমি এখানে কী করছ? আর আমি সারা জুবান খুঁজে বেড়াচ্ছি।’ সায়ন কোত্থেকে এসে রেগে রেগে বলে।
‘এই তো একটু কোহেনের সাথে গল্প করছিলাম।’
‘চল, বেড়িয়ে আসি।’ সায়ন আহ্লাদে বলে।
‘কোথায় যাবে?’ একটু অনিচ্ছা শোনায় রেবতীর গলা।
‘আরে উঠতো, চল।’ হ্যাচকা টানে রেবতীকে উঠিয়ে নেয় সায়ন।
‘রেবতীকে জড়িয়ে ধরে কোহেনের দিকে ফিরে বলে, বাই কোহেন।’
কোহেন ধীরে ধীরে হাত নাড়ে, ‘বাই।’
কিছুদূর গিয়ে সায়ন রেগে বলে, ‘তুমি কোহেনের সাথে এত মাখামাখি করছ কেন?’
‘মাখামাখি করছি কোথায়? একটু গল্প করছি।’
‘গল্প না, তোমরা বেশী বেশী মিশছ।’
‘আরে ধুর! ছেলেটা মনে হয় আমার প্রতি দূর্বল। তাই একটু বাজিয়ে দেখলাম। বুঝো না, একটু ঘুরাই আর কী।’ হাসতে হাসতে বলে রেবতী।
‘বড়শিতে মাছ ধরে খেলাচ্ছ?’ কৌতুক করে বলে সায়ন।
‘অনেকটা তাই।’
এরপর ওরা ভালবাসার আবেশে হারিয়ে যায়। কয়েকদিন পর রেবতীর আবার দেখা হয় কোহেনের সাথে। কেমন যেন একটু কেঁপে উঠে ও। ছেলেটাকে দেখে হৃদয়ের কোণায় যেন একটু সুর বেজে উঠে। কোহেন উৎসাহে বলে, ‘রেবতী কেমন আছ?’
‘ভাল আছি কোহেন। তুমি ভাল আছ?’
‘হা, ভাল। আমি তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম। মনটা বিশেষ ভাল নেই। মনে হল তোমার সাথে কথা বললে ভাল লাগবে।’
‘কেন, মন খারাপ কেন?’
‘আছে একটু। বাদ দাও, ওসব জেনে তোমার কাজ নেই।’
‘না, তুমি বল।’ দৃঢ় রেবতীর গলা।
‘একটা স্বপ্ন দেখেছি কাল রাতে। তাই মনটা খারাপ।’
‘কী স্বপ্ন?’
‘আমি বনের ঐ দিকের পুকুরটার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখি তুমি আর সায়ন পুকুরের পাশে বসে ভালবাসায় মত্ত আছ। প্রকৃতির এই নির্জনতার মাঝে তোমাদের দু’জনকে অপূর্ব লাগছিল। কিন্তু আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল।’
‘কেন, তোমার কষ্ট হবে কেন?’
‘এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না। পারলে তোমাকে জানাব।’
এরপরও ওদের দেখা হয়। কোহেনের ব্যবহার আর মুখের ভাষার কাছে আস্তে আস্তে দূর্বল হয়ে পড়ে রেবতী। ছেলেটা এত সুন্দর করে কথা বলে। শব্দের বিশাল ক্ষমতার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পন করে রেবতী। ‘দুনিয়াতে তোমার চেয়ে সুন্দর আর কিছু পৃথিবীতে নেই।’ এ কথা বললে কোন হরিণী ঠিক থাকতে পারে! খেলার ছলে যা শুরু করেছিল তা আস্তে আস্তে দূর্বলতায় রূপ নেয়। সায়ন কোনভাবেই আর ফেরাতে পারে না রেবতীকে। গান-কবিতা-নাচ কত কিছু করে দুর্দান্ত সায়ন। রেবতীর কিন্তু একটা প্রেম ঠিকই হয়ে যায় কোহেনের প্রতি। যা তীব্র ভালাবাসায় রূপ নেয় ধীরে ধীরে।
জলার ধারে সবাই পাতা খাচ্ছিল একদিন। হঠাৎ চারিদিকে চিৎকার-হট্টগোল। বাঘ এসেছে। ভোঁ দৌড়ে সবাই সটকে পড়ে। রেবতী দৌড়াতে গিয়ে একটা ডালের সাথে পা পিছলে পড়ে যায়। পা আটকে যায় অন্য একটা ডালের খাঁজে। কোনভাবেই পা ছাড়াতে পারে না। বাঘ একেবারে নিকটে এসে পড়ে। এখনি ঝাঁপিয়ে পড়বে ওর উপর। ছিঁড়ে-খোঁড়ে খাবে কোমল সুন্দর দেহখানি। অকস্মাৎ জীবনের শেষ দেখতে পায় রেবতী, শুনতে পায় মৃত্যু নামক অজানা জগতের হাতছানি। চোখ বন্ধ করে ফেলে অজান্তেই। না, কোত্থেকে যেন কোহেন এসে দাঁড়ায় দু’জনের মাছে। আর দৃঢ় স্বরে চিৎকার করে বলে, ‘রেবতী পালাও।’
রেবতী কোনক্রমে আটকে যাওয়া পা বের করেই এক দৌড়ে বাসায় চলে আসে। কোনদিকে খেয়াল থাকে না সেসময়। যখন হুশ হয়, চমকে উঠে। আরে! কোহেনকে ফেলে চলে এসেছে। দৌড়ে কোহেনের বাড়ির দিকে যায়। হাঁপাতে হাঁপাতে কোহেনের কাছে গিয়ে দেখে, ওর বাবা-মা আর বোন অঝোরে কাঁদছে। কোহেনের সামনের ডান দিকের পা’টা নেই। মুখ বিকৃত হয়ে গেছে বাঘের কামড়ে। বাঘের থাবার আঘাত শরীরে রয়ে গেছে কয়েকটি। কোহেনের মা মুখ তুলে তাকায় রেবতীর দিকে। কোন রাগ নেই, অনুযোগ নেই। শান্ত স্বরে মা হরিণটি বলেন, ‘তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে বাছা আমার মরতে বসেছে। বাঘ যখন ওকে কামড়াতে শুরু করে তখন সর্দারসহ আমরা কয়েকজন হামলে পড়ি বাঘের উপর। উপায়ন্তর না দেখে বাঘ চলে যায়। কিন্তু যাবার আগে ওর ডান পা’টা সাথে নিয়ে যায়।’ কেঁদে ফেলেন কোহেনের মা।
রেবতী বাসায় চলে আসে ভীষণ কষ্ট নিয়ে। চোখে সমুদ্রের জলের ধারা। ও এখন কী করবে? একটা পঙ্গু হরিণের সাথে ও কীভাবে সারাজীবন থাকবে। আর চেহারাটও কেমন বীভৎস হয়ে গেছে। কীভাবে তাকাবে এই মুখের দিকে জীবনভর? আহারে! সায়নকেও দূরে ঠেলে দিয়েছে। এখন কী হবে? ওর জীবনটাই বুঝি শেষ হয়ে গেল। না, এই জীবন ও রাখবে না। মন খারাপ করে হাঁটতে থাকে বনের মাঝে। এক সময় মনে হয় পানিতে ঝাঁপ দেয়। কিন্তু কেন? একটা পঙ্গু হরিণের জন্য ও কেন জীবন দিবে? রেবতীর ভাবনায় কোনক্রমেই আসে না যে, কোহেন তার জীবন বাঁচিয়েছে। নিজের জীবন বিপন্ন করেছে। অথচ রেবতী শুধু নিজের হারানোর কথাই ভাবছে।
সায়নের কথা মনে হয়। রেবতী বনের ঘন জায়গাটায় চলে যায় ধীরে ধীরে। যেখানে সায়নের সাথে প্রায়ই দেখা করত। রেবতী জানে সায়ন আশেপাশেই আছে। মুখখানা জলে ভরে এদিক-ওদিক তাকিয়ে আস্তে করে মাথা ঝাঁকায় ও। হরিণদের চিরাচরিৎ নিয়মে সামনের দু’পা মাটিতে ঠুকে একটু। মুহূর্তে ছুটে আসে সায়ন। গায়ে গা ঘষে জাগিয়ে তোলে পুরোনো প্রেম। হাসতে হাসতে বলে, ‘ভালই হয়েছে। আপদটা বিদায় হয়েছে।’
রেবতী ঘাড় কাত করে অভিমানী সুরে বলে, ‘এতদিন কোথায় ছিলে। মাস চলে যায়, আমি কাঁদি তুমি বিহনে হায়।’
সায়ন শিং ঝাঁকিয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে বলে, ‘ঐ বেজন্মাটার জন্যই তো তোমার কাছে আসতে পারি নি।’
‘আর কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না।’ সায়নের গায়ে মুখ লাগিয়ে আহ্লাদে বলে রেবতী।
দু’জনে গায়ে গা ঘেঁষে আবার পাড়াময় হাঁটতে থাকে। হাসি-আনন্দে ঘুরে বেড়ায় জুবানের আনাচে কানাচে। কোহেন একটা ডালে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ওদের দেখে, ‘আহ! কী সুন্দর মানিয়েছে দু’জনাকে। যেন একে অপরের জন্যই, ওরা।’ নিজের না পাওয়ার একটা আক্ষেপ দলা পেঁকে উঠে মনের গহীনে। হাহাকার করে শূন্য হৃদয়। একটা বাস্প উঠে যায় শরীর পাক দিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাসের মত, ‘না, আমার রেবতীতো সুখে আছে। কেমন আনন্দে ঝলমল করছে। এর বেশী আমি কী চাইব?’ ফোঁটা ফোঁটা জল বেরোয় ক্ষতবিক্ষত চোখের দু’কোণ বেয়ে। মনে মনে বলে, বাকী জীবনে ওকে অনেক, অনেক বেশী কাঁদতে হবে; নিঃশব্দে। পুরো জুবান ভেসে যাবে কোহেনের নিঃশব্দ কান্নায়। ততটুকু জল কী ওর চোখে থাকবে?
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৩৪২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৬/০৯/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • সোহরাব রুস্তম ২৮/০৯/২০১৭
    চমৎকার !!!
  • ন্যান্সি দেওয়ান ২৮/০৯/২০১৭
    Nice..
  • ফয়জুল মহী ২৭/০৯/২০১৭
    নিখাদ ভাল লাগা রহিল।
  • রম্য গল্পের অসাধারণ বিন্যাস । ভাল লাগলো ।
    ধন্যবাদ অশেষ ।
  • সমির প্রামাণিক ২৬/০৯/২০১৭
    চমৎকার। চমৎকার। চমৎকার। অতি দীর্ঘ হলেও গল্পটি অত্যন্ত সুখপাঠ্য। হরিণ- হরিণীর প্রেম- বিরহ , গল্প বলার জমাটি ধরন পাঠককে আটকে রাখে শেষ পর্যন্ত। শুভকামনা রইলো লেখকের জন্য।
  • ন্যান্সি দেওয়ান ২৬/০৯/২০১৭
    Lovely..
  • কোহেনের প্রথম সংলাপটা শেষের কবিতার আদলেই হয়েছে লাবণ্যকে অমতি এই কথাগুলোই হয়তো বলা হয়েছিলো।পশু পাখির ভিতরে যে প্রেমটা ফুটিয়ে তুলেছেন তা অনবদ্য।কোহেনের আত্মত্যাগ গল্পটা ট্রাজেডির আকার ধারণ করিয়েছিলো।তবে মূল চরিত্রে রেবতী আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।রেবতীকে যথেষ্ট স্বার্থপর করে উপস্থাপন করেছেন।সবমিলিয়ে আপনার কল্পনা শক্তিকে সাধুবাদ জানাই।পরিপাটি লেখা মনে হয়েছে।
    • আবু সাইদ লিপু ২৭/০৯/২০১৭
      মারাত্মক বিশ্লেষণ
      • লেখক বিশ্লেষণটা মারাত্মক মনে হলো?
        • আবু সাইদ লিপু ০৪/১০/২০১৭
          অনেক ধন্যবাদ। আমি যে লেখক না!!!!
    • >অমিত
  • আজাদ আলী ২৬/০৯/২০১৭
    Valoito
 
Quantcast