www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

বন্ধুত্ব

বন্ধুত্ব
- জয়শ্রী রায় মৈত্র

ফাল্গুন মাস । বসন্তের ছোঁয়া । পলাশ ফুলে লালে লাল । দখিনা বাতাসে খুশি খুশি ভাব । পুবের জানালা দিয়ে একফালি রোদ এসে ভিজিয়ে দিল সারা শরীর । ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল হরিহর । অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে । ভোরের বাসটা অনেক আগেই চলে গিয়েছে । পরের বাস ধরে কাজে গেলে বেশ দেরি হয়ে যাবে । মালিকের গালমন্দ শুনতে আর কত ভালো লাগে ? আজ আর কাজে যাওয়া হবে না । চোখে মুখে জল দিয়ে কলঘর থেকে বেরিয়ে এল হরিহর । গায়ে ফতুয়াটা চাপিয়ে ঘরের দাওয়ায় বসে বউ পদ্মকে বলল – ‘আজ আর কাজে যাব না গো । বড্ড দেরি হয়ে গেছে’। পদ্ম জানে তার স্বামী এ-রকম সাধারনতঃ করেনা । প্রতিদিন সে ভোরের বাস ধরেই কাজে যায় । আজ নিশ্চয়ই শরীরটা ভালো নেই । পদ্ম স্বামীর কথার উত্তর না দিয়ে ঘরের কাজে মনোনিবেশ করে । হরিহর ঘরের দাওয়া থেকে নামতে নামতে বউকে বলে – ‘আমি একটু আসছি গো । তুমি রান্না-বান্না সেরে নাও”।

হরিহর বাড়ি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তার দিকে পা বাড়াল । বড় রাস্তার মোড়ে বাস-স্টপেই মধুদার চায়ের দোকান । হরিহর ভালো করে একটা চা বানাতে বলে দোকানের সামনে বাঁশের বেঞ্চিতে বসল । হরিহরকে এই সময়ে দেখে মধু একটু অবাকই হল । হরিহর তো এই সময়ে আসেনা । সে তো আরও সকালে আসে । এক কাপ চা খেয়েই কৃষ্ণনগর যাবার প্রথম বাস ধরে । চা বানাতে বানাতে মধু বলে – ‘কি রে হরি, আজ কাজে গেলিনা ?’ হরিহর উদাস ভাবে বলে – ‘না গো মধুদা, আজ আর গেলাম না । ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছে । আজ শরীরটা একটু খারাপ’। মধু আর কথা না বাড়িয়ে চা বানাতে লাগল । ইতিমধ্যে কলকাতা – মালদা রুটের এক স্টেট বাস বাস-স্টপে এসে দাঁড়াল । কিছুক্ষণের জন্য যাত্রীদের কোলাহলে ভরে গেল বাস-স্টপ । কয়েকজন চায়ের অর্ডার দিয়ে ধুপধাপ বসে পড়ল বেঞ্চিতে । হরিহর চুপচাপ বসে বাসের আসা-যাওয়া, যাত্রীদের ওঠা-নামা এ-সব লক্ষ্য করছিল । হরিহরের এ-সব দেখতে বেশ ভালই লাগছিল। প্রতিদিন তো আর সে বাস স্টপের এ-রকম পরিবেশ চাক্ষুস করেনা । এই গোবিন্দপুর গ্রামের এই বাস-স্টপ ছাড়া আর কি-ই বা আছে । শহরে কত দেখবার জায়গা আছে । বড় বড় রাস্তা, উঁচু উঁচু বাড়ি-ঘর, পার্ক, কত স্মৃতিসৌধ । এখানে সারা দিন মাঠে-ঘাটে খাটা আর খাওয়া-দাওয়া করে রাতে শোয়া । হরিহর এ-সব ভাবতে ভাবতে কেমন যেন ভাবালু হয়ে পড়ে । হঠাৎ তার কাঁধের উপর এক হাতের স্পর্শে তার ভাবালুতায় ছেদ পড়ল । পিছনে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল কালো কোট-প্যান্ট পরা এক মাঝবয়েসী সুদর্শন ভদ্রলোক তার ঘাড়ে হাত রেখে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বেশ থতমত খেয়ে হরিহর ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে তার আপাদ মস্তক নিরীক্ষণ করতে লাগল । ভদ্রলোককে দেখে তো বেশ শিক্ষিত মনে হচ্ছে । অচেনা হলেও মুখটা কিছুটা চেনা চেনা লাগছে । কিন্তু কিছুতেই সে বুঝে উঠতে পারেনা কে ভদ্রলোক ? এক গাল হেসে ভদ্রলোকই মুখ
-২-

খুললেন – “ কি রে হরি, চিনতে পারছিস না ?” ভদ্রলোকের কথায় হরিহর মাথা চুলকে বলল – “চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু ঠিক চিনতে পারছি না”। ভদ্রলোক এবার হো হো করে হাসতে হাসতে বলল – “যা বাব্বা, সব ভুলে গিয়েছিস দেখছি । মনে পড়ে ছেলেবেলার সেই পেয়ারা চুরির কথা ? বঙ্কু কাকার কাছে ধরা পড়তে পড়তে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ? পালাতে গিয়ে ঝোপের গাছের ডালে হাত কেটে যাওয়ার কথা ? গাঁদা ফুল ছিঁড়ে এনে ঘসে রক্ত বন্ধ করার কথা?” কথাগুলো বলেই ভদ্রলোক তার ডান হাতের উপরে থাকা কোট এবং শার্ট তুলে হরিহরের সামনে তার হাতের উপর থাকা একটা কাটা দাগ দেখাল । মুহূর্তের মধ্যেই হরিহরের স্মৃতিচারণ সম্পন্ন হয়ে গেল । তার আর বুঝতে বাকী রইল না ভদ্রলোকটি কে । হরিহর হেসে বলল – “আপনি ... মানে...তুমি...”। ভদ্রলোক হরিহরকে থামিয়ে দিয়ে বলে – “আপনি ... মানে...তুমি...- এসব কি হচ্ছে হরি ? আমি তোর সেই ডাণ্ডাগুলি খেলার সাথী, তোর প্রিয় বিশু ... বিশ্বনাথ”। কথাগুলো একনাগাড়ে বলেই ভদ্রলোক জড়িয়ে ধরলেন হরিহরকে । ইতিমধ্যে মধুদা এক গ্লাস চা নিয়ে হাজির । চায়ের গ্লাস হরিহরের দিকে এগিয়ে দিতেই হরিহর মধুদাকে বলল – “মধুদা, তুমি কি রকম লোক গো ? এক গ্লাসে হবে ? সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে চিনতে পারছ ? আরও এক গ্লাস চা নিয়ে এস । সঙ্গে নোনতা বিস্কুটও”। হরিহরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকটিকে দেখে মধুদা বলল – “চেনা চেনা মনে হচ্ছে । কিন্তু ঠিক চিনতে পারছি না”। এবার ভদ্রলোক মধুদার দিকে তাকিয়ে বললেন – “সে কি মধুদা, তুমিও চিনতে পারছ না । তুমিও বিশুকে ভুলে গেলে”? এবার মধুদার চিনতে আর কোন অসুবিধা হল না । বিশু মানে বিশ্বনাথ তো এই গাঁয়েরই ছেলে । অনেক বছর ধরেই কলকাতায় থাকে । সেখানে সে একজন নামকরা উকিল বলেই সে শুনেছে । এতদিন পর তাকে দেখে মধুদাও খুব খুশি । মধুদা বিশুকে বলে – “ওহ বিশু! নারে বিশু তোকে কখনও ভুলতে পারি ? আজ না হয় তুই কত বড় উকিল । কত মান্যিগন্যি মানুষ । কিন্তু তুই তো এই গাঁয়েরই ছেলে । তোকে অনেকদিন পর দেখলাম । যাক তুই এসেছিস, খুব ভালো লাগছে । শহরে থেকেও যে নিজের গাঁ-কে ভুলে যাসনি এটা দেখে ভীষণ লাগছে”। বিশু বলে – “মধুদা ভুলেও এসব বোলনা । আমি তোমাদের সেই বিশুই । মান্যিগন্যি সেই শহরের কোর্টে”। বিশুকে বেঞ্চিতে বসতে বলে মধুদা আরও এক গ্লাস চা তাড়াতাড়ি নিয়ে এল । হরিহর বিশুর হাত ধরে বাঁশের বেঞ্চিতে বসিয়ে নিজেও বসল । হরিহর বলল – “ তারপর তোর খবর কি বল ? এতদিন পর আমাদের মনে পড়ল”? বিশু হাসতে হাসতে বলে – “না রে হরি, তোদের এখনও ভুলিনি । ছেলেবেলার সেই সব দিনগুলো কি কখনও ভোলা যায় ? বছর চারেক আগে কয়েক ঘণ্টার জন্য একবার এসেছিলাম । তোর সাথে তখন দেখা হয়নি”। হরি বিশুর কথায় খুব খুশি হয় । বিশু তার সেই ছেলেবেলার বন্ধু । সে এখন কলকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত উকিল বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় । উকিল মহলে



-৩-

বিশাল ব্যাক্তিত্ব । খ্যাতির বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন করে সে যে তার মত নগন্য একজন দিনমজুরের সঙ্গে কথা বলছে এটাই তার কাছে বিরাট ব্যাপার । সত্যিই বিশু সেই ছেলেবেলার বন্ধুত্তের মুল্য দিতে জানে । দুজনে চা আর বিস্কুট খেতে খেতে গল্প জুড়ে দেয় । হরি বিশুকে বলে – “এবার কয়েকটা দিন থাকবি তো”? বিশু চায়ের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলে –“এবার দুদিন থাকবো । না থাকলে জ্যেঠিমা খুব রাগ করবে । ওনার শরীরটা বিশেষ ভাল যাচ্ছে না । তারপর বল তোর কি খবর ? তোর ছেলেমেয়েদের খবর কি”? হরি বলে – “বড় মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করতেই ভাল পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি । ওর শ্বশুর বাড়ি কৃষ্ণনগরে । ছোট মেয়ে বি,এ, পড়ছে । আর ছেলে এবার বি,কম, দিয়েছে । ও আরও পড়বে বলছে”। বিশু হরির কথায় খুশি হয়ে বলে – “তোর ছেলেমেয়েরা তো খুব ভাল । আমার তো একটি মাত্র ছেলে । ক্লাস টেনে পড়ে”। দু’জনে গল্প করতে করতে কখন যে চায়ের গ্লাস শেষ হয়ে গিয়েছে তাদের কারোই খেয়াল নেই । হরি এবার দাঁড়িয়ে পড়ে । বিশুর হাত ধরে বলে – “ওঠ, এবার রাজমিস্ত্রি হরির নতুন বাড়িতে যেতে হবে । আগের বাড়িটা ভেঙ্গে যাবার পর নতুন বাড়ি করেছি”।

মধুদাকে বিদায় জানিয়ে হরি ও বিশু এবার গাঁয়ের পথ ধরে । গাছগাছালি ঘেরা গাঁয়ের পথ দিয়ে যেতে যেতে আর পাখিদের কিচিরমিচির কলকাকলিতে এক অনাবিল আনন্দে আনন্দে মন-প্রাণ ভরে উঠল বিশ্বনাথের । সে যেন নতুন করে গ্রামের প্রাণবায়ু আস্বাদন করল । পাঁচ সাত মিনিট হাঁটার পর ছোট্ট এক পাকা বাড়ির সামনে এসে হরি দাঁড়িয়ে পড়ল । বিশু দেখল বাড়িটা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা । বাড়ির সামনের দিকে সুন্দর করে নিকানো উঠোন । উঠোনের এক পাশে তুলসী মঞ্চ । অন্য পাশে কয়েকটা জবা ও টগর গাছ । কয়েকটা লঙ্কা গাছ, লাউ গাছ, কুমড়ো গাছও রয়েছে । বেড়ার গেট খুলে হরি বলল – “এই হল আমার বাড়ি । আয় বিশু ভেতরে আয় । দেখিস গেটের কুঞ্চিতে যেন কোথাও না লাগে”। বিশু ঢুকতে ঢুকতে বলল – “এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন হরি ? আমারও জন্ম এই মাটিতেই সেটা কি তুই ভুলে যাচ্ছিস ? গাঁয়ের মাটির টান বড় টানরে হরি”। হরি বিশুর কথায় খুব খুশি হল । হরি বলল – “তোর মত সবাই যদি বুঝতো তা হলে তো দুনিয়াটাই পাল্টে যেত”। হরি উঠোনে পা রেখেই হাঁক পাড়ল – “কই গো কোথায় গেলে ? কমল, লক্ষ্মী তোরা কোথায় ? তাড়াতাড়ি আয়”। হরির হাঁক-ডাকে তিনজনই বেরিয়ে এল । একজন মাঝবয়সী গৃহবধু, বছর বাইশের এক শক্ত সমর্থ যুবক আর উনিশ কুড়ি বছরের একটি মেয়ে । বিশুর মত একজন সুবেশী সুপুরুষ দেখে ওরা হকচকিয়ে গেল । হরির বউ তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা টানল । বউ-এর দিকে তাকিয়ে হরি গর্বিত মুখে বলল – “এ-কে জান ? আমার ছোট্ট বেলার বন্ধু বিশু । কলকাতার মস্ত বড় উকিল”। বিশু হাত জোড় করে নমস্কার করল । প্রত্যুত্তরে হরির বউও হাত জোড় করে নমস্কার করল । লক্ষ্মী কমল তাড়াতাড়ি বিশুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল । হরির বউ এবং ছেলেমেয়েদের আচরণ বিশুর খুব ভাল লাগল । বিশু অনেকদিন গ্রাম্য জীবনে নেই । কিন্তু


-৪-

গ্রাম্য জীবনের সহজতা সরলতা তাকে এখনও মুগ্ধ করে । সে তো শহরে থাকা লোক, নামকরা উকিল । তাতে কি যায় আসে ? হরি তার বাল্য বন্ধু । তাই এখনও তার বাল্য বন্ধুকে সন্মান জানাতে তার নিজের স্ট্যাটাসকে সে দূরে সরিয়ে রাখে । হরির বারণ সত্ত্বেও বিশু জুতো খুলে ঘরে ঢোকে । ঘরে সাধারন সব জিনিষপত্র । কিন্তু বেশ পরিপাটি করে গোছানো । বিশু চেয়ারে বসতে না বসতেই হরির মেয়ে এসে বলল “কাকু, কুয়োর পাড়ে তোমার জন্য জল তুলে রেখেছি । হাত মুখ ধুয়ে এস” । কুয়োর পাড়ে বিশু হাত মুখ ধোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হরির মেয়ে একটা পরিস্কার গামছা এগিয়ে দিল । হাত মুখ মুছে বিশু ঘরে এসে হরির পাশে বিছানায় বসল । ইতিমধ্যে হরির বউ ঘরে ঢুকল । কুশল বিনিময় করার পর হরির বউ একটা বালিশ বিশুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল – “আপনি বিছানায় আরাম করে বসুন । আমি চা নিয়ে আসছি”।

শুধু চা নয়, হরির বউয়ের হাতের গরম গরম রুটি আর তার সাথে আলুভাজাও খেল বিশু । এরপর হরি এবং তার বউ-ছেলে-মেয়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প-গুজব করে উঠল । বাড়ির প্রত্যেককে বিদায় জানিয়ে বিশু তার নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিল । হরি তার বাড়ির গেট পর্যন্ত পৌঁছে বিশুর সঙ্গে করমর্দন করে বিদায় জানাল । আজ হরি অভিভূত। তার ছেলেবেলাকার বন্ধু বিশু তাকে এখনও ভোলে নি । হতে পারে সে কলকাতায় থাকা শিক্ষিত শহুরে লোক, নামকরা উকিল । বিশুর মত লোকের কাছে সে সত্যিই নগণ্য । তবুও সে ছেলেবেলার সেই বন্ধুত্বকে অস্বীকার করেনি । বাল্য-বন্ধুত্বের মর্যাদা রেখেছে । বিশুই দেখিয়ে দিল বন্ধুত্বের কাছে ছোট-বড়, ধণী-গরীব কিছু নয় । বন্ধুত্বই আসল ।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৪৪১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৪/০২/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast