www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

অনন্য ভালবাসা

স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে রিনি প্রত্যেক দিন পার্কস্ট্রীট থেকে দমদম পর্যন্ত মেট্রো রেলে আসে । তারপর সারফেস ট্রেন ধরে সোদপুরে নেমে লাইন পার হয়ে রিক্সায় এইচ,বি,টাউনে যায় । পার্কস্ট্রীটের একটা প্রাইমারী ইংরাজি মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষিকা রিনির সংসার তার বিধবা মা আর ছোটভাই অর্ণবকে নিয়ে । বেশ চলছিল তার রুটিন যাতায়াত । কিন্তু অল্প কিছুদিন হল সে বেশ অস্বস্থির মধ্যে পড়েছে । দমদম মেট্রো স্টেশন থেকে বাইরে বেরোতেই একটা লোক তার দিকে অদ্ভুত ভাবে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে । লোকটি লম্বায় প্রায় ছ'ফুট । ফর্সা চেহারা । কপালে সিঁদুরের একটা বিশাল তিলক । চোখদুটো বড় বড় । শার্ট-প্যান্ট পরা লোকটির কাঁধে একটা বড় ঝোলা । তার মধ্যে নিশ্চয়ই ধুপকাঠির প্যাকেট থাকে । কারণ লোকটি যে ধূপ বিক্রেতা সেটা তার হাতে একগুচ্ছ জ্বলন্ত ধূপকাঠি রাখা দেখেই বোঝা যায় । লোকজনের ভিড়ে অপলক দৃষ্টিতে সে রোজ তার দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে । এটা রিনির ভীষণ খারাপ লাগে । মাঝে মাঝে সে খেয়াল করে দেখেছে ঐ লোকটি তার পিছনে পিছনে কিছুটা দূর পর্যন্তও এসেছে ।

এভাবে প্রায় দু'মাস কেটে যাবার পর রিনি সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে দমদম মেট্রো স্টেশনের বাইরে ঐ লোকটিকে দেখতে পেল না । রিনি বেশ নিশ্চিন্ত মনে সারফেস ট্রেনে উঠল । সোদপুর ষ্টেশনে নেমে লাইন পার হয়ে রিক্সায় উঠতে যাবে - এমন সময় পেছন থেকে ভারী এক পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এল - " একটু শুনবেন ?" পিছনে তাকাতেই চমকে উঠল রিনি । দমদমের সেই লোকটি । বেশ বিরক্তির সঙ্গে রিনি বলল -
- " এতদূর আপনি এসেছেন ? আমার সাথে আপনার কি দরকার ?"
- " সে রকম কোন দরকার নেই ম্যাডাম । শুধু একটা কথা ছিল ।"
- " দেখুন, যদি ভালো চান, আমার পিছন ছাড়ুন । ষ্টেশন চত্বরে আড়ং-ধোলাই দেবার লোকের অভাব হবে না ।"
- " প্লিজ ম্যাডাম, আমার কথাটা শুনুন । আমি আপনার কোন ক্ষতি করতে আসিনি ।"
কথাগুলো বলতে বলতে লোকটি কেঁদে ফেলল । রাস্তার মধ্যে লোকটির এরকম কান্না দেখে রিনি হতবাক । তার মনটা একটু নরম হল । বেশ কৌতুহলও হ'ল তার । কি বলতে চায় লোকটি ?
- " তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন ।"
রিনির কথা শুনে লোকটি একটু আস্বস্থ হল । চোখের জল হাতের তালুতে মুছতে মুছতে বলতে শুরু করল -
- " আমার নাম রাজ । বাড়ি বিহারের মুঙ্গেরে । প্রায় দশ বছর বাংলায় আছি, তাই বাংলা ভালই বলতে পারি । এখানে একটা কারখানায় কাজ করি । বিকালে একটু সময় পাই, তাই দমদম মেট্রো ষ্টেশনের বাইরে ধূপ বিক্রি করি । আপনাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম, বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, আমি চমকে উঠেছিলাম । কেন চমকে উঠেছিলাম জানেন ? আমার হারিয়ে যাওয়া একমাত্র বোন রানীকে দেখে । সে ছিল অবিকল আপনার মত দেখতে । নতুন করে আমার হারিয়ে যাওয়া বোনকে ফিরে পেয়ে আজ আমি তৃপ্ত । আমাকে ভুল বুঝবেন না । আগামী কালই আমি অনেক দূরে চলে জাব, মুম্বাই-এ । সেখানে একটা ভালো চাকরি পেয়েছি । আর হয়তঃ কোনদিনই আপনার সাথে দেখা হবে না, তাই বিদায় বেলায় আমার বোনের সাথে দেখা করে গেলাম ।"

রিনি মন্ত্রমুগ্ধের মত রাজের কথাগুলো শুনছিল । বিস্ময়ে সে ভেবে পায় না এই মুহূর্তে সে কি করবে ? নিজেকে তার ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে । এতদিন সে যা ভেবে এসেছে তা খুবই নিম্ন মানসিকতার পরিচয় । তার মনে হল মানুষের সাথে কথা না বললে, না মিশলে তার আসল পরিচয় সত্যিই বোঝা যায় না । রাজ নামের লোকটি এতদিন তাকে বোনের মতই ভেবে এসেছে । আর সে ভুল বুঝেছে । নিজেকে সামলে রিনি শান্ত ভাবে লোকটিকে জিজ্ঞাসা করল -
- " দাদা, আপনার বোনের কি হয়েছিল ?"
- " আমার মা-বাবা খুব ছোটবেলায় মারা যান । আমার বয়স তখন বারো আর বোনের দুই । সেই থেকে অনেক কষ্টে কোলে-পিঠে বোনকে বড় করেছিলাম । রানী তখন ক্লাস নাইনে পড়ত । একদিন স্কুলে গিয়ে আর বাড়ি ফিরল না । অনেক খোঁজ করলাম, এমনকি থানা-পুলিশও করলাম । কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না । কোন খোঁজই পেলাম না তার ।"

লোকটির কথা শুনে রিনির খুব কষ্ট হল । সে এখনও তার হারিয়ে যাওয়া বোনকে খুঁজে চলেছে, এটা সত্যিই এক দৃষ্টান্ত । বোনের প্রতি ভাইয়ের ভালবাসা । রিনি তার হাতের ব্যাগ খুলে একটা ছোট্ট কাগজ বের করে তার নিজের মোবাইল নাম্বারটা লিখে রাজের হাতে দিয়ে বলল -
- " যখনই বোনকে মনে পরবে, ফোন করবেন ।"
রাজ চিরকুটটা নিয়ে তার জামার পকেটে রেখে দিল । তারপর তার কাঁধের ঝোলা থেকে একগোছা ধূপের প্যাকেট রিনির হাতে দিয়ে বলল -
- " এক একটা ধূপের কাঠি যখন জ্বালাবে, এই দাদার কথা মনে পড়বে তো বোন ?"
কথাগুলো বলে আর অপেক্ষা না করে রাজ ষ্টেশনের দিকে পা বাড়াল।হাত নাড়াতে নাড়াতে বলল - " চলি বোন, ভালো থেকো ।"
রিনি একদৃষ্টিতে লোকটির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল । রেল লাইন পার হয়ে ষ্টেশনে মানুষের ভিড়ে সে মিশে গেল । রিনির দু'চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দু'ফোঁটা জল ।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১০২৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৪/০৯/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • suman ২৫/০৯/২০১৩
    অনেক ভালো লাগায় মন ভরে গেলো
  • সালমান মাহফুজ ২৫/০৯/২০১৩
    তোমার প্রতিটি গল্পই অসামান্য মহিমায় উদ্ভাসিত । এটাও তার ব্যতিক্রম হয় নি ।
    • জয়শ্রী রায় ২৫/০৯/২০১৩
      এটা সত্যি আমার প্রতিটি গল্পের থিম প্রায় কাছাকাছি । তবে আমি চেষ্টা করি থিম গুলোর শাখা প্রশাখা যদি বিস্তার করা যায় । আমার পাশে থাকবার জন্য অশেষ ধন্যবাদ সালমান ।
  • Înšigniã Āvî ২৫/০৯/২০১৩
    এরকম ঘটনা রোজ ঘটেনা... তাই রেয়ার,
    কিন্তু মন ছুঁয়ে যায়...

    আর একথাতো সম্পুর্ন ঠিক যে আমরা একেক জনকে দেখে এক ধারনা তৈরী করি... অনেক সময় তা মেলেনা ।
    • জয়শ্রী রায় ২৫/০৯/২০১৩
      আপনি সত্যিই বলেছেন এরকম ঘটনা একটু বিরলই বটে । মন ছুঁয়ে যাবার জন্য অশেষ ধন্যবাদ ।
  • ভালো
  • Shubhajit majumdar ২৫/০৯/২০১৩
    O darun khub valo likha6o sona my sweet @jaya
  • subhendu das ২৫/০৯/২০১৩
    somporker suto sotti i shokto hoy.....
 
Quantcast