www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আমার মা আমার ভাষা

আজ ২১শে ফেব্রুয়ারী । সকাল থেকেই বাংলার আকাশে বাতাসে মুখরিত হচ্ছে “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” । বেজে চলেছে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙালো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি ?” সারা বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষাকে মাথা উঁচু করে তুলে ধরতে, নিজেদের মাতৃ ভাষা বাংলাকে অক্ষুন্ন রাখতে ১৯৫২ সালের এই দিনে রফিক, সালাম, বরকতদের বলিদান ইতিহাসের পাতায় এখনও জ্বলজ্বল করছে । মাতৃভাষার প্রতি তাঁদের উৎসর্গীকৃত প্রানকে মর্যাদা দিতেই প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস হিসাবে পালিত হয় । তাই আজ ভাষা দিবসকে স্মরণে রেখে চারিদিকে চলেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন । বিভিন্ন জায়গায় নানা রঙের দেশী ফুল, মালা, বেলুন দিয়ে সাজানো মঞ্চে চলেছে সমাজের গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের বক্তৃতা, ছোটদের বসে আঁকো প্রতিযোগিতা, কবি ও সঙ্গীত শিল্পীদের বাংলা কবিতা ও গানের ডালি নিয়ে মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান ।

পাঁচ বছর পর লসএঞ্জেলস প্রবাসী রজ্জাক দেশে ফিরেই সোজা মুর্শিদাবাদে নিজের গ্রামে এসেছে । বিদেশিনী স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হলেও জন্মভূমির টান সে সর্বদাই অনুভব  করে । তাই আবার বাংলায় ফিরে আসা । বাংলার বাতাসে অনেকদিন পর নিঃশ্বাস নিতেই তাঁর প্রাণ জুড়িয়ে গেল । একজন খাঁটি বাঙালী হিসাবে সে নিজেকে নতুন করে আবিস্কার করল । বিদেশের মাটিতে থেকেও সে বাংলা চর্চা কোনদিন ছাড়েনি । বাড়িতে তাঁর আমেরিকান স্ত্রীকে বাংলা শিখিয়েছে । তার ছোট্ট ছেলেও বাংলা বলতে শিখেছে । লসএঞ্জেলস প্রবাসী বাঙালী সমিতি তাঁরই হাতে গড়া । সেখানে প্রবাসী বাঙালীদের নিয়ে ঈদ, দুর্গাপূজা, দীপাবলি ইত্যাদি পার্বণের পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও খুব সুন্দর ভাবে পালন করে । এই বছরে ২১শে ফেব্রুয়ারিতে নিজের দেশে থাকতে পেরে রজ্জাকের ভীষণ ভালো লাগছে ।  

সকাল থেকেই রজ্জাক খুব উৎসাহিত । আজ গ্রামের শিমুলতলার মাঠে তাকে একটা কিছু করে দেখাতেই হবে । বাংলা ভাষার জন্য যারা শহীদ হয়েছে, মাতৃ ভাষার প্রতি তাঁদের ভালোবাসার কথা প্রতিটি গ্রামবাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে । গ্রামের কয়েকজন কর্তাব্যাক্তিকে সাথে নিয়ে শিমুলতলার মাঠে মঞ্চ বাঁধার কাজ শেষ করল রজ্জাক । মাঠের চারিদিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হল এরকম অনুষ্ঠানের এটাই আদর্শ স্থল । গ্রামের শেষ প্রান্তে এটাই একমাত্র খেলার মাঠ । মাঠের পাশেই সর্ষে ক্ষেতের সারি । দূরে নদীর ধারে অড়হর ক্ষেত । মাঝে মাঝে খেজুর গাছের সমাহার । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে শিমুলতলার মাঠ এক কথায় অপূর্ব । দুপুরের পরেই শুরু হল অনুষ্ঠান । প্রথমেই গণ্যমান্য ব্যাক্তিরা বক্তব্য রাখল । অনুস্থানের প্রধান অতিথি স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান রাজীব মজুমদার মহাশয় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্থানে বাংলা ভাষাকে অবহেলা করে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে উর্দু ভাষা চাপিয়ে বাঙালিদের কণ্ঠরোধ করার প্রয়াসের বিরুদ্ধে বাঙালিদের লড়াই এবং অকুতোভয় রফিক, সালাম, বরকতদের শহীদ হবার কাহিনী শোনালেন । তাঁদের বক্তব্যে বার বার রজ্জাকের কথা উচ্চারিত হল । এই ধরনের অনুষ্ঠান এর আগে এই গ্রামে কখনও হয়নি । আজ রজ্জাকের প্রেরণায় এ-রকম একটা অনুষ্ঠান করতে পেরে তাঁরা সত্যিই গর্বিত । ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ছবি আঁকা, কবিতা লেখা, গানের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অনুষ্ঠান মনোজ্ঞ হয়ে উঠল । অনুষ্ঠানে উপস্থিত গ্রামের সবাইকে চমকে দিল রজ্জাকের বিদেশিনী স্ত্রী । বাংলার তাঁতের কাপড় পড়ে মেম সাহেব যখন মঞ্চে রজ্জাকের লেখা একটি বাংলা কবিতা আবৃত্তি করল তখন সবাই বিস্ময়ে হতবাক । বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেককেই উপহার দেওয়া হল । সব শেষে রজ্জাকের ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা দিবসে শহীদ ভাইদের স্মরণ করা হল । মঞ্চে উপবিষ্ট এবং দর্শকাসনের সবাই উঠে দাঁড়িয়ে সমবেত কণ্ঠে গেয়ে উঠল – “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙাল একুশে ফেব্রুয়ারি... আমি কি ভুলিতে পারি ...” । তারপর শহীদ ভাইদের আত্মার শান্তি কামনায় এক মিনিট নীরবতা পালন করা হল।   মাতৃ ভাষা সম্পর্কে বলতে গিয়ে রজ্জাক মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরল । মধুসূদন প্রথম জীবনে ইংরাজি কবিতা লিখে সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন । তাঁর মেম-বউ নিয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছিলেন সেখানে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য । সেখানে মধুসূদনের লেখা দেখে ইংরেজ সাহেবরা বলেছিল – যার মাতৃ ভাষা বাংলা সে যদি ইংরাজিতে এত সুন্দর কবিতা লিখতে পারে তাহলে তাঁর মাতৃ ভাষায় লেখা কবিতা কি হবে ভাবা যায় না । ভাগ্যের পরিহাসে ব্যাক্তিগত জীবনে অসুখী মধুসূদন তাই আবার দেশে ফিরে বাংলা সাহিত্যে মন দিলেন । তাঁর লেখা প্রত্যেকটি কবিতা যুগান্তকারী । বাংলা কবিতায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মধুসূদন । তিনি পরে বুঝেছিলেন তাঁর মাতৃ ভাষাই দেবে তাঁর আসল পরিচয় । এই বাংলা সাহিত্যের মাধ্যমেই আমরা পেয়েছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের মত কবি-ব্যক্তিত্ব । আজ সকলেই খুব খুশী । প্রত্যেকেই আজ নতুন করে উপলব্ধি করতে পারল এই অনুষ্ঠানের গুরুত্ব । শহীদ ভাইদের বাংলা ভাষার জন্য লড়াই যেন বিফলে না যায় । এ ভাষা আমাদের সকলের মা । একে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে । রজ্জাক প্রতি বছর হয়তঃ আসতে পারবে না । তাই সে সমবেত সকলের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিল যেন তাদের গ্রামে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান হয় । অনুষ্ঠানের সব ব্যায়ভার সে নিজে বহন করবে । রজ্জাকের ভাষণ শেষ হতেই রজ্জাকের সাথে আবাল বৃদ্ধবনিতা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় গলা মেলাল – “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি” ।  

অবশেষে এসে গেল ২৮শে ফেব্রুয়ারি । রজ্জাকের ফিরে যাবার দিন । রজ্জাককে পরিবার নিয়ে এবার প্রবাসে পাড়ি দিতে হবে ।  মন যেতে চায় না তবুও যেতে হবে । এই বাংলার বুকে সে পৃথিবীর প্রথম আলো দেখেছে । এই বাংলার জলবায়ুতে সে বড় হয়েছে । এই বাংলার সোঁদা গন্ধ তাঁর সারা শরীরে । বাংলা তাঁর মা, তাঁর ভাষা । সে কি করে মুছে দেবে তাঁর জীবন থেকে এই বাংলাকে ? সে চলে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তাঁর মনে প্রাণে সর্বদাই থাকবে এই বাংলা । গ্রামে উপস্থিত সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্ত্রী-পুত্র সহ গাড়িতে উঠে বসল রজ্জাক । গ্রামবাসীদের চোখগুলো তখন ছলছল করছে । নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না রজ্জাক । নিজের অজান্তেই তাঁর চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল । মুহূর্তের মধ্যে গাড়ি ছেড়ে দিল । রাস্তার বাঁক পেরিয়ে গ্রামের পথের ধুলো উড়িয়ে গাড়ি সকলের চোখের আড়ালে মিলিয়ে গেল ।।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮২৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২১/০২/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast