www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

শেকড়

সবারই থাকে শেকড়। সেই শেকড় শুধু অবিরত নিজের দিকে টানে। আমার শেকড়েরা মাগুড়া শহরের কোল ঘেঁষা গ্রাম "পারনান্দুয়ালী"। নামটা অনেকের কাছেই কঠিন লাগে, কিন্তু আমাদের কাছে উচ্চারন করাটা ছিল অনেক সহজ। সেই গ্রামের ধুলা বালি মেখে আমরা বড় হয়েছি । এখন ও চোখ বন্ধ করলে সেই ধুলা বালির গন্ধ নাকে লাগে।


তখন ও সব বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি। যে সব বাড়ির ছেলে মেয়েরা  স্কুল এ যেত সে সব বাড়ির কোন কোন বাড়িতে হারিকেন, কোন বাড়িতে কুপি  জলত। বেশীর ভাগ বাড়িতেই  সন্ধ্যার পরে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ত। আমরা ভাই বোনেরা, চাচাত ভাই বোন সহ পাড়ার আরো দুই তিন বাড়ির ছেলে মেয়ে আমাদের বাসার ঊঠানে চটের বস্তা বিছিয়ে হারিকেনের আলোয় পড়তে বসে যেতাম। আমার আব্বা পি টি আই থেকে আসতেন একটু রাত করে, তখন আব্বা হোস্টেল সুপার ছিলেন। চারদিকে অন্ধকার, রাস্তায় কোন আওয়াজ নেই, শুনশান নীরবতা। এর ভেতরেই আমরা শুনতাম আব্বার সাইকেলের আওয়াজ। আমাদের পড়ার গতি বেড়ে যেত। এমন জোরে জোরে পড়ত সবাই " মন হত আমরা একটু ও দুস্টুমি করিনি, সন্ধ্যা থেকে শুধু পড়ছি আর পড়ছি"।


খুব সকালে ঘুম থেকে ঊঠে আব্বার কাছে পড়ার নিয়ম ছিল। পড়া  শেষ করে সব একসাথে গোসল করতে চলে যেতাম বাড়ির পাশেই নবগঙ্গা নদীতে। সাঁতার তখন ও জানতাম না। আম্মা ছোট্ট একটা সিল্ভারের কলস কিনে দিয়েছিলেন। সেই কলস পেটের তলায় নিয়ে সাঁতার শেখার চেস্টা করতাম। বর্ষার  সময় নদী কানায় কানায় ভরে যেত, নদী ফুলে ফেপে  ঊঠত, তাই কিনারা থেকে গোসল করে চলে আসতাম। কিন্তু গরমকালে চর জেগে উঠত। অনেকদুর হেটে তারপর নদী। দুইপাশে ধানের গাছ, মাঝখানে ছোট্ট একটা পথ, সেই পথ ধরে আমরা নদীতে যেতাম। এত সাবধানে যেতাম যেন ধান গাছে পা না লাগে।


যখন একটু বড় হলাম, প্রতিদিন স্কুল এ যাবার আগে নদীতে  গোসল করতে যেতাম সকালে। নদীর ওপাড়েই থাকত  বান্ধবী আসমা। একদম নদীর ওপাড়েই  ওদের বাড়ী। নদীর  এ পাশ থেকে জোড়ে একটা ডাক দিতাম আসমা  বলে, এক ডাক, দুই ডাক, তিন ডাক, আসমা সহ ওর বোনেরা তড় তড় করে সেই ঢাল বেয়ে নদীতে নেমে  আসতো। এপাড় থেকে ওপাড়ে হত কথা বিনিময়।কত কথা। অথচ একটু পরেই দেখা হবে স্কুল এ। মাঝে মাঝে ওরা এ পাড়ে আসতো। মাঝে মাঝে আমরা যেতাম। সঙ্গে থাকত  আমার ভাই আশরাফ , ভিক্টোরিয়া, সীমা , রাহাদ, ঈসানুর, আরো অনেকে।  প্রথম যেদিন আমি আমার কলস টা বুকের তলায় চেপে  ওই পাড়ে যাব বলে  সাঁতার  শুরু করেছি, নদীর মাঝখানে গিয়ে আমার এত ভয় লাগছিল, আমি শুধু পিছনের দিকে তাকাচ্ছিলাম মনে হচ্ছিল আমি ফিরে যাই, এ জনমে মনে হয় আমি আর বাড়ি ফিরতে পারবনা। এই নদীতেই ডুবে বোধ হয় আমি মারা যাব। নদীর মাঝখান থেকে নদীকে অনেক বিশাল মনে হয়, যেটা কিনারা থেকে মনে হয়না। বহু কস্টে আমার ভাইয়ের সহায়তায় ওই পাড়ে গিয়ে  পউছেছিলাম। ওপাড়ে গিয়ে সে কি কান্না যে আমি আর সাতার কেটে বাড়ি ফিরতে পারব না। শেষে  নদীর উপর দিয়ে হেটে ভেজা গায়ে মেইন রাস্তা দিয়ে বাড়িতে এসেছিলাম।

শুধু সকালে যেতাম তা না, সন্ধার পরে আমার মা , চাচীরা যেত নদীতে গোসল করতে, সেই সম্য ও মাঝে মাঝে ভাগ বসাতাম। সন্ধার পরে গোসল করার মজা ছিল আলাদা, চারিদিকে অন্ধকার, উপরের পানি তখন খুব গরম , আর তলার পানি ঠান্ডা। ঝিড়ঝিড়ে বাতাস বইত নদীতে, কি যা আরাম লাগত। আর  কোথাও গোসল করে আমি এত শান্তি পাইনি, ওই নদীর জলে যা পেয়েছি।  এখন আমার যদি মাথা ধরে মনে হয় " নদীর জলে মাথা ডুবালে মনে হয় মাথা ব্যাথা সেড়ে যেত"।


স্কুল বন্ধ হলেই  নানীবাড়ি চলে যেতাম। আমার নানী বাড়ি ছিল অনেক বড়, চারপাশে ঘর, মাঝখানে বড় ঊঠান । আর ছেলে মেয়েরা ও  বেশী। নদীর পাড়েই ছিল তেতুল গাছ। সেই গাছের তলায় আমরা খেলতাম চি বুড়ি, গোল্লাছুট, দেড়ে কোট। লুকোচুড়ি। সন্ধ্যার আযান  দেবার সাথে সাথে আমরা আর তেতুল তলায় থাকতাম না, আর ওদিকে যেতাম না ভয়ে, সবাই বলত, তেতুল গাছে "ভুত" আছে, সন্ধ্যার পরেই ভুতেরা নেমে আসে। এই ভয়ে সন্ধ্যার পরে কোনদিন  ওই মুখো হয় নি। এখন আমার আর ভয় নেই। এখন বড় হয়ে গেছি। আমি জানি এখন যদি আমি সেই ছেলে বেলায় ফিরে যেতে পারতাম তেতুল গাছ কে আর ভয় পেতাম না। ভুতকে এক হাত দেখে নিতাম।


সন্ধ্যার পরে শুরু হত আরেক খেলা। বড় কচু গাছে পাতা ফুটো করা হত ছোট ছোট করে। আগুনে পোড়ানো হত খড়কূটো, সেই খড়কুটো সেই পাতার ভেতরে ভরা হত , তারপর দড়ি দিয়ে বেধে মাঝখানে  একজন দাড়িয়ে মাথার চারপাশে জোরে জোরে ঘুরাত, কি অদ্ভুত সে  দ্রিসশ, আমি একটু ভীত ছিলাম কোন্দিন আমি নিজে ঘুরায়নি, দূর থেকে শুধু দেখতাম, আর আনন্দে নাচতাম। এই ভাবে কত গুলো যে  "প্রাকৃতিক ফায়ার ওয়ার্ক " আমরা করতাম। আজ এত বড় বড় "ফায়ার  ওয়ার্ক " দেখি কিন্তু আমার কাছে আমার ছেলে বেলার সেই কচু পাতার ফায়ার ওয়ার্ক ই সেরা। আমি চোখ বন্ধ করলেই সেই আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখতে পাই।


মামাদের বড় বারান্দায় সবাই একসাথে বসতাম । ছোট মামা  ছোট খালাকে খেপাত, " নাজমা তোর কার সাথে বিয়ে হবে জানিস, ওই যে কামার খালি ফেরী ঘাটে " এই ডিম, এই ডিম, এই আমড়া আমড়া বিক্রি করেনা তার সাথে"। মামা সুরে সুরে "এই ্ডিম এই ডিম" অভিনয় করে দেখাত, আমরা খুব মজা পেতাম আর হাসতাম , মামাকে বলতাম বেশী বেশী করে করতে। আর ছোট খালা রেগে ঊঠে চলে যেত। সেই  দিনগুলো , কি মধুর আর প্রাণবন্ত ছিল, জীবন নিয়ে কোন ভাবনা ছিল না।


ছোটবেলায় "কুলফি আইসক্রিম"  ছিল সবচেয়ে প্রিয়। আহারে কুলফি, কি তার সবাদ/ কত ধরনের আইসক্রিম  যে জীবনে খেলাম, কিন্তু মুখ থেকে সেই কুলফির সবাদ সরাতে পারলাম না। মুখে লেগে আছে সেই কুলফির রস।


"হিজড়ার " নাচ ছিল আমাদের কাছে আরেকটা আকর্ষণীয় ব্যাপার। কোন বাড়িতে নতুন বাচ্চা হলেই হিজড়া চলে আসতো। ওদের ঢুলি , গান আর কথার শব্দে আমরা দৌড় দিতাম দেখার জন্য। গান শুরু হত হিন্দী, কোন্ সময়  ইসলামিক , ওদের কথা বলার ঢং কেমন জানি ভাল লাগত। পরে আবার সেটা অভিনয় করতাম। আম্মা দিত এক বকা। " আম্মাকে বলতাম আম্মা ওরা এরকম করে কেন? "ওদের বাবা মা নেই, ওদের গলার সর এমন কেন? আম্মা বলতেন ছোট মানুষ এত বুঝতে হবেনা। আম্মা না বললে ও পরে ঠিকই বুঝেই হিজড়া হওয়ার কস্ট।


আসলে আমাদের সবার মনের ভেতরেই থাকে ছোট কোমল একটা শিশু মন, সময়ের প্রয়জনে আমরা আমাদের সেই শিশু মন্ টাকে  হত্যা করি। কিন্তু হত্যা করলেই তো হয়না, ওই শিশুমন মাঝে মাঝে বের হয়ে আসতে  চায়, ঘুরে আসতে চায় ফেলে আসা দিন, মাঠ, ঘাট, পথ। যেমন করে আমি এই মাত্র ঘুরে আসলাম। মনে হয় ফিরে যাই সেই সব দিন গুলোয় , কিন্তু ফিরতে চাইলেই তো ফেরা যাই না, হারিয়েছি সব, পেরিয়েছি দেশ, সীমানার গন্ডি "সময় আর জীবনের" প্রয়োজনে ।


"সেই যে আমার নানা রঙ এর দিনগুলি"।
বিষয়শ্রেণী: অন্যান্য
ব্লগটি ১১০৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৯/১১/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • আবিদ আল আহসান ০৩/১২/২০১৪
    সুন্দর লাগলো
  • সহিদুল হক ০২/১২/২০১৪
    বেশ ভাল লেখা।
  • জাফর পাঠান ০২/১২/২০১৪
    প্রাণবন্ত লেখা । ভালো থাকুন সতত।
  • অহিদুল ইসলাম ২৮/১১/২০১৪
    প্রত্যেক কিছুর পিছু টান রয়েছে । লেখায় তা ফুটে উঠেছে । লেখাটি পড়ে স্মৃতির পাতা গুলো মনের দর্পনে ভেসে উঠেছে ।
  • শওকত আলী বেনু ২৬/১১/২০১৪
    ভাল লাগা রইল লেখায়
  • সময়ের সাথে সবকিছুই বদলে যায়!.....
  • জে এস সাব্বির ২১/১১/২০১৪
    একটু পিছনে তাকানো ,স্মৃতি চারণ আর তা অসাধারণ দক্ষতায় আমাদের সাথে শেয়ার করায় ধন্যবাদ ।
  • মোঃ আবদুল করিম ১৮/১১/২০১৪
    নিজ মাতৃত্ব্য গ্রাম,যে গ্রামে বড় হয়ে উঠা স্মৃতি চারণ অসাধারন,খুবই ভালো লাগলো ।
  • রহিমুল্লাহ শরিফ ১৪/১১/২০১৪
    ভাল লাগার মত লেখা
  • অনেক ভালো লাগলো.....
  • মুনতাসির সিয়াম ০৯/১১/২০১৪
    একদম ঠিক
  • আহমাদ সাজিদ ০৯/১১/২০১৪
    পড়লাম, অনেক কিছু জানলাম
  • একদম তো ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন সেই ছােট্ট আমিতে। আপনার সাথে আমার একটা মিল আছে আমার বাবাও পিটিআইতে ছিলেন। বাই দা ওয়ে আপনি নিয়মিত হচ্ছেন আশা করি সুন্দর সুন্দর এরকম অনেক লেখা পাবো।
    • ইসমাত ইয়াসমিন ১০/১১/২০১৪
      কোন পি টি আই তে ছিলেন উনি। জানিনা কতদিন পারব।একা একা বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত থাক্তে হ্য়। তবে চেস্টা করব। অনেক অনে ধন্যবাদ।
      • আমার বাবা ছিলেন মাদারিপুর পিটিআই তে। আপনার বাবা?
        • ইসমাত ইয়াসমিন ১০/১১/২০১৪
          মাগুরা পি টি আইতে ২০ বছর, তারপর টাঙ্গাইল, যশোর, মানিক্গঞ্জ, পটিয়া পিটি আই থেকে অব্সর নিয়েছেন। নামঃ আবুল খায়ের। আমাদের বাড়িই মাগুরায়।
          • আপনার সম্পর্কে জেনে ভালো লাগলো। আমার বাবার জব মে বি আর দু মাস আছে। আমাদের বাড়ি অবশ্য শরীয়তপুরে বাবা মা সেখানেই আছেন। পড়াশুনার কারনে অনেক ছোট থেকেই ঢাকাতেই থাকতে হচ্ছে আর জবের কারনে এখন আছি গাজীপুরে। এমনি সেধে সেধে নিজের সম্পর্কে একটু বললাম। আমার পাতায় আপনাকে আরেকবার আন্তরিক স্বাগতম জানালাম।
            • ইসমাত ইয়াসমিন ১০/১১/২০১৪
              ভাল লাগল জেনে। আমার আব্বা ১৯৯৮ তে অবসর নিয়েছেন। গত ২০১০ এর জুন মাসে আমাদের কে ফেলে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। আমার দোয়া রইল তোমার বাবা মায়ের জন্য। ভাল থেকো।
  • অনিরুদ্ধ বুলবুল ০৯/১১/২০১৪
    একটানে পড়ে ফেললাম।
    এত সুন্দর করে লিখেন কিন্তু বানানের ব্যপারে উদাসীন কেন ভাই? অনেকগুলো সাধারণ বানান ইচ্ছাকৃত ভুল না উদাসীনতার? ঠিক করে নিন। আরো লিখুন।

    হৈমন্তী সকালের শুভেচ্ছা নিন।
    • ইসমাত ইয়াসমিন ০৯/১১/২০১৪
      Many many thanks vi. Banan thik korbo. ekhon office. ei com Bangla nei. basai giea thik kore dibo. apnar comment pore vabchi, " ze school e Teacher ra konodin amar exam er khatai ekta dag dite parten na, ekdom nirvul, sei amar banan vul hobe" mene neoa jaina. aji thik kore dibo.
 
Quantcast