www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

নিঃস্বার্থ ভালবাসাঃ

২০০৬ সাল। আমার ছেলে আবীরকে বাংকক এর রামকামহাং এডভেন্ট স্কুল এ ভর্তি করলাম, আর সে জন্যই বাসা চেঞ্জ করে আমরা প্রাতুনাম থেকে রামকামহ্যাং মুভ করলাম। আবীরের যাতে স্কুলে যেতে একটু ও কস্ট না হয় সেই জন্য। তখন ওর বয়স মাত্র চার। নতুন জায়গা, আমি কাউকে চিনি না, ওর  পাপা তো সেই সকালে বেরিয়ে যায়, বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে আমি একা একা বাসায় থাকি। কারো সাথে একটু কথা বলতে পারিনা, কারন নতুন জায়গা , কাউকে চিনিনা, আবার কেউ ইংরেজি ও বলতে পারেনা। একটু কথা বলার জন্য ছটফট করতাম আমি।
একদিন আবীরকে স্কুলে দিয়ে বাসায় ফিরছি, এক থাই মহিলা বয়স পঞ্চাশ এর উপর হবে, আমকে দেখে বললেন  “গুড মর্নিং”। আমি ও হেসে গুড মর্নিং বললাম। বললেন তোমাকে কয়েকদিন ধরে দেখছি, তাই ভাবলাম আলাপ করি। তোমার ছেলেকে এই স্কুলে ভর্তি করেছ? খুব সুইট তোমার ছেলে। আমি থাই স্টাইলে ধন্যবাদ জানালাম।তারপর  উনার বাসাটা দেখিয়ে বললেন এটা আমার বাড়ী। চার তলা একটা বিল্ডিং। উনি আমাকে উনার ঘরে ডাকলেন এবং বসতে  বললেন। তারপর ছোট ছোট ইংরেজীতে আমার সাথে কথা বলতে লাগলেন। আমি বললাম বাহ!  তুমি তো ভালই ইংরেজী জান, আমি এখানে কারো সাথে কথা বলতে পারছিলাম না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বললেন তুমি যখন খুশী আমার বাসায় আসবে, আমার সাথে কথা বলবে, কোন সমস্যা নেই। কথায় কথায় জানলাম উনার দুই মেয়ে আর এক ছেলে, বড় মেয়ে ইউনিভারসিটি থেকে পাশ করে এখন চাকরী করে আলাদা বাসায় থাকে । উনি ছোট মেয়ে আর ছেলেটাকে নিয়ে থাকে। উনার স্বামী উনাকে  ছেড়ে গেছে প্রায় ১০ বছর হল। বললেন এখানে কিছু ইউনিভারসিটির ছেলে মেয়ে আছে, ওরা আমার এখানে খায়। তা ছাড়া কেউ খাবার অর্ডার দিলে আমি বানিয়ে দিই। এই ভাবেই দিন চলে যাচ্ছে। আমাকে কফি বানিয়ে খাওয়ালেন। আমার কাছে শুনলেন আমি কি কি থাই খাবার পছন্দ করি। বললেন যখন খুশী আমি উনার ওখানে গিয়ে নিজের মত করে খাবার খেতে পারি।
সেই থেকে শুরু। আবীর কে উনি এত ভালবাসতেন যে কি বলব, নিজের মেয়েকে ঠিক করে দিলেন ওকে থাই ভাষা শেখাবার জন্য। যার ফলে  আবীর তিন মাসের  মধ্যে পুরোপুরি থাই ভাষা পড়া ও লেখা শিখে গেল । উনার ছেলের নাম নেট। নেট এর বয়স তখন আট হবে। উনি সব সময় উনার ছেলেকে বলতেন যে সব  খেলায় যেন আবীরকে জিতিয়ে দেয়।কারন আবীর খেলায় না জিততে পারলে কান্না শুরু করে দিত।  উনি আবীরকে বললেন উনাকে ম্যা ( থাই ভাষায় যার মানে মা)  ডাকতে, আবীর ও তাই ম্যা ডাকা শুরু করে দিল। নিজের ছেলের জন্য কিছু রান্না করলে আবীরের জন্য ও করত। উনার কাছ থেকেই আস্তে আস্তে আমি থাই খাবার রান্না করা, খাওয়া সব শিখে গেলাম।  
২০০৭ সালের জানুয়ারী মাসে আবীরের স্কুলের সিড়ি থেকে পড়ে গিয়ে হঠাত করে আমার পা ভেঙ্গে যায়। হয়ে গেলাম গৃহ বন্দী। কারন পা প্লাস্টার করা ,তার উপর ক্রাচ দিয়ে হাটা।চিন্তায় পড়ে গেলাম কে আবীরকে স্কুলে দি য়ে আসবে আর নিয়ে আসবে।কারন বাসাটা স্কুলের পিছনে হলে ও ঘুরে যেতে হলে হাফ কিলোমিটার হাঁটতে হয়। আমার এই বিপদে ভিনদেশী ম্যা এগিয়ে এলেন। আবীরকে রেডী করে আমি নীচে নামিয়ে দিয়ে বেলকনিতে এসে দাড়িয়ে থাকতাম, কখন ও উনার মেয়ে, বা পরিচিতজন দের  দিয়ে উনি নিজ দায়িত্তে পাঠিয়ে দিতেন, মাঝে মাঝে নিজে ও দিয়ে আসতেন। আনার সময় ও একই ভাবে উনি যেভাবেই পারুক কাউকে দিয়ে নিয়ে আসতেন। প্রতিদিন সকালের দিকে আমার বাসায় আসতেন, কোনদিন  খাবার সাথে করে নিয়ে, আবার কোনদিন এসে বলতেন তুমি আমাকে দেখিয়ে দাও আমি তোমার দেশী খাবার রান্না করে দিই । ঘরটা পরিস্কার করে দিতেন, আর দুই তিন দিনের কাপড় নিয়ে যেতেন ওয়াশিং মেশিনে দেবার জন্য। ধোয়া হয়ে গেলে উনার ছেলে বা মেয়েকে দিয়ে আমার রুমে পৌঁছে দিয়ে যেতেন । উনি না থাকলে যে আমি কিভাবে সব কিছু করতাম তা আমি নিজে ও জানি না।এর মধ্যেই  ২৪ শে ফেব্রুয়ারী আবীরের জন্মদিন। স্কুলে কেক, খাবার এগলো নিয়ে যেতে হবে। আমাকে বললেন কোন চিন্তা করোনা,  সব আমি ম্যানেজ করব। উনি নিজ হাতে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিকেন ফ্রাই, হট ডগ সব বানালেন, কেক কিনে নিয়ে আসলেন, তারপর উনার মেয়ে কে দিয়ে আবীর এর হোম রুম টিচার এর কাছে পৌঁছে দিলেন। এই ভাবে উনি আমাদেরকে ভালবাসার বন্ধনে বেঁধে ফেললেন। উনার বাসায় গেলে আমার কখনই মনে হতোনা এটা পরের বাসা।  
২০০৮ সালে আমরা আবার প্রাতুনাম মুভ করি। কারন আমি চাকরী  পেলাম, আমার অফিস প্রাতুনামে, আমার হাজবেন্ড এর অফিস ও প্রাতুনামে। চলে আসার সময় বার বার বলছিলেন যেও না মিন ( উনি আমাকে এই নামে ডাকতেন) , আমি তোমাদেরকে খুব  মিস করব। আমি বললাম আবীর তো এখানে প্রতিদিন আসবে, আমি মাঝে মাঝে আসব, দেখা হবে। আমরা ও তোমাকে খুব মিস করব।আমাকে বললেন আমার যখন খুশী, বা যখন আমার বাবা মায়ের জন্য, দেশের জন্য মন খারাপ হবে আমি যেন উনার কাছে চলে যায়।  
এর মধ্যে  আবীর একদিন স্কুলে অসুস্থ হয়ে যায়, প্রাতুনাম থেকে যেতে যেতে আমাদের প্রায় এক ঘন্টা লাগবে, উনাকে ফোন দিলাম, উনি সাথে সাথে স্কুলে গিয়ে হাজির।যখনই উনাকে ডেকেছি কোন কারনে কোন্দিন না বলেন নি, সাহায্য করেছেন আমাদের মন প্রান দিয়ে।
২০১০ সালে থাইল্যান্ডে যখন রাজনৈতিক  অস্থিরতা শুরু হয়, ক্ষমতাসীন দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (হলুদ পার্টি নামে পরিচিত) তখন আর্মি নামায়। কারন দীর্ঘদিন ধরে থাই রক পার্টি ( লাল গ্রুপ নামে পরিচিত) প্রাতুনামের  পাশে সেন্ট্রাল ওয়রল্ড নামক শপিং মলের সামনে দখল নিয়েছিল। আর্মি নামানোর উদ্দেশ্য হল লাল গ্রুপ কে ওখান থেকে হটানো। তাই আর্মিরা প্রাতুনাম, লুম্ফিনি এই সব জায়গায় অবস্থান নেয় এবং চারপাশের রাস্তা বন্ধ করে দেয়, যাতে রেড গ্রুপ এর কেউ ওই সব এলাকায় প্রবেশ করতে না পারে। সরাসরি গৃহ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। সারারাত গুলাগুলি হত। এমন কি দিনে ও। ওদের অর্ডার ছিল কেউ বাইরে বের হতে পারবে না, এমন কি জানালা দিয়ে উঁকি দিলে ও গুলি করা হবে।আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি এরকম পরিস্থিতিতে পড়ব।পরে দেখি ভয়াবহ অবস্থা। তখন প্রায় সবাই  আর্মির সহায়তায় ওই জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা যায়নি। কোথায় যাব এই ভেবে। আমার তখন দুই বাচ্চা, আমার দেবরের একটা, আমরা চারজন। এত গুলো মানুষ কোথায় যাব এই বিদেশে। এখানে তো কোন আপনজন  নেই।
হঠাত  করে একদিন ফোন, আবীরের স্কুল থেকে, ম্যা খুব উত্তেজিত অবস্থায়” এই তোমরা কোথায় , প্রাতুনামে তো গোলাগুলি হচ্ছে, আমি তোমাদের নাম্বার হারিয়ে ফেলেছি, তাই আজকে স্কুলে এসে ফোন করছি। আমি খুব চিন্তায় আছি তোমাদের নিয়ে, তোমরা আর ওখানে  থাকবেনা। আমার বাসায় চলে আস। যদি আগুন ধরিয়ে  দেয় তাহলে কি করবে। আমি কোন কথা শুনতে চায় না,  কোন কাপড় আনতে হবে না, আমি সব ব্যাবস্থা করব।তোমাদের থাকা খাওয়ার সব ব্যাবস্থা আমার।  তোমরা খালি হাতে চলে আস। উনার কথা শুনে আমাদের চোখে পানি চলে আসে এই ভেবে যে এই ভিনদেশী  মহিলা আমাদের এত ভালবাসে, আমাদের নিয়ে এত চিন্তা করে।
এই তো কয়েকদিন আগের কথা, আবীর স্কুল থেকে আসার সময় বাসে আসে। হঠাত  করে হলুদ গ্রুপ রাস্তা দখল করে ফেলে।। আবার ও সেই রাজনৈতিক  অস্থিরতা। বাস আসবে না। আবীর আমাকে ফোন দিল আম্মু কিভাবে  বাসায় আসব। ওখান  থেকে তখন প্রাতুনামে আসার একমাত্র  ঊপায় হল ইঞ্জিন চালিত বোটে আসা। কিন্তু ও জানে না কিভাবে, কোথায়  গিয়ে বোটে উঠতে  হয়। আমি বললাম তুমি চিন্তা করোনা , ম্যা এর কাছে যাও, ম্যা তোমার ব্যাবস্থা করে দেবে। ম্যার কাছে যাওয়ার পর উনি ওকে খাইয়ে, পরিচিত মোটর  সাইকেল দিয়ে , আরো টাকা দিয়ে বোটে পাঠিয়েছে।  শুধু তাই না, এক ঘন্টা পর ফোন করেছে ও বাসায় ঠিক মত পউছালো কিনা।
আমাদের এই ভিনদেশী বোন ,আমার ছেলের ম্যা মাঝে মাঝেই আমাকে ফোন করে , বলে “ তোমরা আমার বাসায় চলে আস, তিন তলা ফাঁকা , তোমাদের কোন ভাড়া দিতে হবে না, বাচ্চারা স্কুল থেকে এসে আমার কাছে থাকবে, কোন সমস্যা হবেনা, আমি ওদেরকে দেখে রাখব। ওদেরকে রান্না করে খাওয়াব। তোমাদেরকে খুব মিস করি”।
উনার কথা শুনে আমার দু চোখ জলে ভিজে ওঠে, মনে হয় জীবনে কোনদিন মনে হয় কোন ভাল কাজ করেছিলাম সেই জন্য এই বিদেশে থেকে এই ভিনদেশী বোনের কাছ থেকে এরকম নিঃস্বার্থ ভালবাসা পাচ্ছি।
বিষয়শ্রেণী: অন্যান্য
ব্লগটি ১০২৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৪/০২/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • আবিদ আল আহসান ০৩/১২/২০১৪
    জীবনে চলার পথে কখনো বা মনের অজান্তেই গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব,
    তা হতে পারে অপ্রত্যাশিত কোন ব্যাক্তির সাথেও।
    সময়ের তগিদে জীবনের বাস্তবতায় কখনো বা তার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। আবার কখনো জীবনের মোড় ঘুরে সত্যিকার মমতায় জড়িয়ে সেটা রুপ নেয় এক নিঃস্বার্থ ভালবাসার্।
    হ্যাঁ গল্পটি খুব সুন্দর্। গল্পটি নিছক বানোয়াট নয় বলে অসাধারণ বলবো।
  • অনিরুদ্ধ বুলবুল ১২/১১/২০১৪
    একটা বিরল ভালবাসার কাহিনী পড়লাম। পড়তে পড়তে দু'চোখ ভিজে উঠছিলো!
    থাইদের কাছ থেকে যতদূর দেখেছি; তারা বন্ধুবাৎসল হয় ঠিকই, আচার ব্যবহারেও বিনয়ী। কিন্তু যুগ বাস্তবতায় তারা কাউকে নিজের বাড়িতে ডাকতে চায় না, বিদেশী হলে তো আরো না। কিন্ত আপনি যে ম্যা'র গল্প বললেন এটা সম্পূর্ণই ব্যতিক্রমী ঘটনা। লেখাটা পড়ে খুব মজা পেলাম। ধন্যবাদ।
  • প্রবাসী পাঠক ১৪/০২/২০১৪
    সত্যিই নিঃস্বার্থ ভালবাসা। অনেক অনেক শ্রদ্ধা রইল ভিন দেশি মানুষটাকে যে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসার বন্ধনে বেঁধে রেখেছে আপনাদের ।



    ভালবাসা হোক সার্বজনীন। আপু , ভাইয়া , আবীর এবং ভিনদেশী ওই মানুষটির জন্য রইল - ভালবাসা দিবসের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
 
Quantcast