www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

নূর আলমের স্বপ্ন

১।

ইদ্রিস মিয়ার চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছে নূর আলম। যদিও চা খাওয়ার জন্য নূর আলম ইদ্রিস মিয়ার দোকানে আসেনি। সে আসলে রেশমির পথ চেয়ে অপেক্ষা করছে, চা খাওয়াটা একটা অজুহাত মাত্র ...

নূর আলম রিক্সা চালায়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এখন তার পরনে ময়লা একটা শার্ট, চেক লুঙ্গী, লুঙ্গীটার প্রান্ত গোড়ালির এক বিঘত উপর পর্যন্ত এসে তারপর থেমেছে -- কেননা এতে রিক্সা চালাতে সুবিধা হয়। ওর বয়স কম-বেশি বিশ/একুশ।

প্রতিদিন সকাল ৮টা বাজার আগেই ইদ্রিস মিয়ার দোকানে চলে আসে নূর আলম। চা/নাস্তা করে। এ সময় কোন ভাড়া আসলে, কোন একটা অজুহাত দেখিয়ে প্যাসেঞ্জারকে সে বিদায় করে দেয়।

রেশমির সাথে কথা বলতে নূর আলমের বড়ই ভাল লাগে। রেশমির মায়ের সাথে নূর আলমের মায়ের ভাল সম্পর্ক, সে সুবাদে রেশমির সাথে মাঝে মাঝে দু/চারটা কথা হয় এটা ঠিক, কিন্তু সেগুলিও নিতান্ত মামুলী ধরণের কথা।

"কই যাও"
"আজ গার্মেন্টস যাওনাই ক্যান"
"শরীর খারাপ?"

এবং এ মামুলী কথাগুলিও নূর আলম আগবাড়িয়ে বলে। রেশমি তেমন একটা কথা বলেনা। দায়সারাভাবে উত্তর দেয় কখনোসখনো।

রেশমির এই দূরে দূরে থাকার কারণটা বুঝে নূর আলম। রেশমি সুন্দরী - সুন্দরিদের একটা সহজাত দেমাগ থাকে। রেশমিদের পরিবার বস্তির অন্যান্য ঘরগুলোর চেয়ে তুলনামূলক স্বচ্ছল। ওদের তিন-বোনই গার্মেন্টস চাকরি করে। বস্তিতে ওর বাবার চা-পান-বিড়ির ছোট একটা দোকানও আছে। তিন বোনই এইট পাশ।

অপরদিকে নূর আলম রিক্সা চালায়, বাবা নাই। মা অসুস্থ। রিক্সা চালিয়ে যা আয় করে তার অর্ধেক ই মায়ের ওষুধ-পত্রে লেগে যায়। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ে নূর আলম আর পড়াশোনা করতে পারেনি।

চায়ের কাপে তৃতীয় চুমুক দিতেই চোখ পড়লো হেঁটে এগিয়ে আসা রেশমির দিকে। পরনে হলুদ রঙের সলোয়ার-কামিজ, হাতে টিফিন ক্যারিয়ার, চুল গুলো ভিজা - হয়তো স্নান করে গার্মেন্টসে যাচ্ছে।

রেশমি এ বস্তির সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে। নূর আলমের চোখে পুরো ঢাকা শহরে রেশমির মত সুন্দর মেয়ে দুটো নেই। তার রিক্সায় স্কুল,কলেজ,ভার্সিটির কতো মেয়েই তো চড়ে বেড়ায়! কই তাদের দেখে তো তার বুক এমন ধড়াস ধড়াস করেনা?

বেঞ্চিতে চায়ের কাপটা রেখে দিয়ে, বুকের সমস্ত সাহস নিয়ে নূর আলম রেশমির সামনে এসে দাঁড়ালো। ওর আচরণ আর ভঙ্গী দেখে একটু অবাক হল রেশমি। রেশমির চোখে ভয়মিশ্রিত নারীসুলভ কৌতুহল।

নুর আলমের গলা শুকিয়ে গেছে, অনেক কষ্টে সে বলল,
'একটা কথা হুনবা রেশমি?

'কন, কি কইবেন।'

'তোমারে একটু রিক্সায় কইরা গার্মেন্টস নিয়ে যাই?'

'না, লাগবো না!'

রেশমি হঠাৎ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল, ঠোঁটে ফুটে উঠল মুচকি হাসি, অদ্ভুত চোখে নুর আলমের দিকে তাকিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল গন্তব্যের দিকে!

এ ঘটনার পর নূর আলমের সাহস বেড়ে গেছে কারণ ওর বন্ধু শফিক বলছে, 'মাইয়া মানুষ যদি "না" কয়, তাইলে বুইঝা লবি আধা হ্যাঁ কইছে, আর যদি হাইসা হাইসা "না" কয় তাইলে বুঝবি ঘটনা ঘইটা গ্যাছে। মাইয়া তোর লাইগা পুরাই আউলা।'

কিন্তু 'আউলা' হওয়ার কোন লক্ষণ রেশমির মধ্যে দেখেনি নূর আলম। রেশমিকে যতবারই রিক্সা করে গার্মেন্টস পৌছে দিতে চেয়েছে, সে ততবারই না বলছে। হেসে হেসেই না বলছে! কখনোই রেশমিকে তার রিক্সায় উঠাতে পারেনি ও।

তবে নুর আলমও নাছোড়বান্দা - স্বপ্ন দেখে একদিন ঠিকই রেশমিকে নিয়ে সে তার রিক্সায় সমস্ত ঢাকা শহর ঘুরে বেড়াবে! রেশমির পরনে থাকবে লাল শাড়ী, লাল চুড়ি, কানের লতি থেকে অল্প একটু ঝুলে থাকা কানের দুল!

২।

মুক্তি সিনেমাহলের সামনে রুবেলের জন্য অপেক্ষা করছে রেশমি!
নতুন একটা সিনেমা এসেছে। নাম 'লাভ ম্যারেজ'। শাকিব খান আর অপু বিশ্বাস হচ্ছে রেশমির প্রিয় নায়ক নায়িকা। এ ছবি সে কিছুতেই মিস করতে পারেনা।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি রেশমিকে। একটা রিক্সা করে রুবেল একেবারে রেশমির সামনে এসে থামল। রুবেল সুঠামদেহী একজন তরুণ। সে গার্মেন্টসে ইলেক্ট্রিক টেকনিশিয়ান এর কাজ করে। সে সূত্রে রেশমির সাথে পরিচয়।

গত ৬ মাস ধরে ওদের মধ্যে সম্পর্ক। রুবেল ছেলেটাকে যতোবার দেখে রেশমির বুকের ভিতর কেমন সুখ সুখ লাগে - ছেলেটা যেন যাদু জানে - ওর পাশে থাকলে যেন সমস্ত পৃথিবী সুন্দর হয়ে যায়।

রুবেলের হাতে শাড়ির একটা প্যাকেট। রেশমি বলল, 'এটা ক্যান আনছো? তোমারে না কইছি আমি শাড়ী পরতে পারিনা।'

রুবেল উদাস ভঙ্গীতে বলল, 'পয়লা বৈশাখের দিন পরবা। আমার জন্য পরবা। আর হুনো, বিয়ার আগে যত ইচ্ছা সালোয়ারকামিজ পরো, সমস্যা নাই। কিন্তু বিয়ের পর শাড়ী ছাড়া কোন কথা নাই। যদি না পরো তোমার সাথে এক বিছানায় থাকুম না!'

'ইইশ! শখ কতো?' লজ্জায় লাল হয়ে যায় রেশমি।
রুবেল বলে 'আরে এত শরম পাওনের কিছু নাই... চল চল টিকেট কাইটা লই।'
.

সিনেমা দেখে ওরা যখন বের হল, বাইরে তখন ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে গেছে। খুবই মজা পেয়েছে ওরা সিনেমাটা দেখে। বাসার উদ্দেশ্যে হাঁটছে দুজন। হঠাৎ করেই রুবেলের মনের মধ্যে অত্যধিক আনন্দ উথলে উঠলো। সে তার ডানহাত দিয়ে রেশমির চিবুক আদরের ভঙ্গীতে নেড়ে দিয়ে সুর করে গাইল "তোমার সাথে হইবরে আমার লাভ ম্যারেজ!"

৩।
আজ পহেলা বৈশাখ।
রায়ের বাজার বধ্যভূমির প্রাঙ্গণে মেলা বসে গেছে। বিকেল হতে না হতেই লোকে লোকারণ্য। চারদিকে সজ্জিত মানুষের ভীড়। বাচ্চারা হাতে মুখে এঁকে নিয়েছে নানা রকম নকশা। উৎসব উৎসব একটা ভাব। মেয়েরা সেজেছে ইচ্ছেমত।

কিন্তু নূর আলমের জন্য আজ উৎসবের দিন নয়, কঠিন খাটুনির দিন - টাকা উপার্জনের দিন।

সন্ধ্যা নেমেছে আধঘণ্টা আগে, অন্যান্য দিনে এ সময়ে নির্জন হয়ে যেত জায়গাটা। কিন্তু আজ ঘটনা ভিন্ন। মানুষজনে গিজগিজ করতেছে এলাকাটা।

বধ্যভূমির গেটের সামনে নূর আলমের রিক্সা এসে থামল। প্যাসেঞ্জার ওকে দাম মিটিয়ে দিলে পর ও রিক্সা ঘুরিয়ে নিচ্ছিল রাস্তার অন্যপাশে যাবে বলে - এমন সময় কাছ থেকে একটা ছেলের কন্ঠ শুনতে পেল ও
'এ রিক্সা!'

ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ধ্বক করে উঠল নূর আলমের বুকটা। কারণ ছেলেটার হাত ধরে ছেলেটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রেশমি। খুশিতে তার চোখমুখ ঝলমল করছে। আবছা আলোয় সে টের পাচ্ছে তার পরনে লাল শাড়ী, লাল চুড়ি, কানের লতি থেকে অল্প একটু ঝুলে থাকা কানের দুল! - এটা তো ওর কল্পনার দৃশ্য, এ তো ওর স্বপ্ন!

রেশমি আনন্দে এত বিভোর, সে খেয়ালই করেনি যে, এ লোকটা নূর আলম, অন্য কোন রিক্সাওয়ালা নয়। অথবা এমনও হতে পারে নূর আলম পরিচিত হলেও একজন রিক্সাওয়ালাকে চিনতে পারার দরকার নেই। বিশেষ করে ওর পাশে যখন সুঠামদেহী সুন্দর একটা ছেলে আছে!

'মামা, টালি অফিস যাবা?' রুবেল বলল।
'যামু' কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল নূর আলম।

নূর আলমের মনে হচ্ছে তার পায়ে কোন শক্তি নেই। সে বুঝতে পারছেনা রিক্সাটাকে কিভাবে টেনে নিয়ে যাবে ও! যা হোক রেশমি আর রুবেল যখন সীটে বসল, রিক্সা টানতে শুরু করল ও।

কিছুক্ষণ পর রুবেল বলল, 'মামা এত আস্তে চালাও ক্যান?

'চালাওক না, তাইলে তোমারে আরো কিছুক্ষণ কাছে পাই।' রেশমি বলল!

নুর আলমের চোখে জল আসে। কত স্বপ্ন দেখেছিল সে রেশমিকে নিয়ে। কতো রাত সে ঘুমায়নি রেশমির কথা ভেবে ভেবে। আজ রাতেও কি তার ঘুম আসবে?

গত দুইটা বছর ধরে শত চেষ্টা করেও রেশমিকে একটি কথা বলবে বলবে করেও কখনো বলা হয়নি। কখনো তাকে মুখ ফুটে বলত পারেনি যে সে তাকে কতটা ভালোবাসে। কারণ তার ভয় হত, ভালবাসার কথা বলতে গেলে যদি রিক্সাওয়ালা বলে অপমান করে!

নূর আলম স্বপ্ন দেখত রেশমির সাথে সে তার রিক্সায় ঘুরে বেড়াবে। রেশমির পরনে থাকবে লাল শাড়ী, লাল চুড়ি, কানের লতি থেকে অল্প একটু ঝুলে থাকা কানের দুল -- নূর আলম জানতো সে একজন সামান্য রিক্সাওয়ালা, রেশমিকে পাওয়ার যোগ্যতা তার নেই -- কিন্তু ভাগ্যবিধাতা তার স্বপ্নকে এমন নির্মম ভাবে সত্যে পরিণত করবে তা কি আর সে জানতো?
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৬৭৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৫/০৯/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast