www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

দোযখিদের তালিকা

১।

দোকানটা খুলে,জিনিসপত্র গুছিয়ে বিসমিল্লাহ বলে সাঈদ মিঞা যেই ক্যাশে বসতে যাবে ঠিক তখনি সে আজিজ ড্রাইভারকে দেখল। সঙ্গে সঙ্গে তার মন খারাপ হয়ে গেল। আজকের দিনটা না জানি কেমন যাবে? দোকান খুলেই এই পাপীকে দেখতে হল! লোকটা মানুষ হিসেবে যেমন খারাপ দেখতেও ঠিক সেরকম-ই ভয়ংকর। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল। সেই চুল এতই কুৎসিত দেখলে যে কেউ বলবে, এ লোক মানুষ না; বুনো ভল্লুক!

আজিজ ড্রাইভার বলল, "দুটা সিগারেট দেও তো।"

সাঈদ মিঞার ইচ্ছে হল বলতে যে সিগারেট নেই। কিন্তু পারলনা। মিথ্যা বড় গুনাহের কাজ, মিথ্যা সকল পাপের জননী। সে সিগারেট দিয়ে টাকাটা নিল।

আজিজ ড্রাইভার চলে যাবার পর সে গভীর চিন্তার মধ্যে পড়ল। আজিজের কাছ থেকে নেয়া টাকাটা কি হারাম হবে? হতেও তো পারে। হলে আল্লাহ পাক কি মাফ করবেন?এসব ভাবতে ভাবতে সে ঠিক করল, সে আর কোনদিন সিগারেট বিক্রি করবেনা। স্টকে যা আছে তা শেষ হলেই সিগারেট আনা বন্ধ করবে। সিগারেট বন্ধ করলে তার দুটি লাভ হবে-

১।সিগারেট হচ্ছে নেশার জিনিস। তা মানুষের ক্ষতি করে। যে জিনিস মানুষের ক্ষতি করে তার ব্যবসা করলে নিশ্চয় আল্লাহ পাক নারাজ হবেন। কাজেই এ ব্যবসা বন্ধ করা দরকার। আরো আগে বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ ছিল কিন্তু দেরিতে হলেও যে কাজটা করা হচ্ছে তাতে আল্লাহ পাক মাফ করলেও করে দিতে পারেন।

২।আজিজ ড্রাইভারের সাথে লেনদেন বন্ধ হবে। কেননা আজিজ ড্রাইভার তার কাছ থেকে শুধু সিগারেট-ই কেনে।

যদিও এতে তার কিছু ক্ষতিও হবে। তার দোকানে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় চা বিড়ি আর সিগারেট। বস্তি এলাকা। এগুলো তো ভালো বিক্রি হবেই। কিন্তু তারপরও সে মনে মনে শপথ করল, বিড়ি সিগারেট বন্ধ। ক্ষতি যদি হয় হোক। রিযিকের মালিক তো আল্লাহ। কোন দিক দিয়ে যে আল্লাহ রিযিক পাঠাবেন তার কি কোন হিসেব আছে?

দোকানে যখন কোন কাস্টমার থাকেনা সাঈদ মিঞা তখন নানা ধরনের চিন্তা ভাবনা করে। তার বেশিরভাগ চিন্তা বেহেস্ত দোযখ নিয়ে। সে প্রায়-ই মনে মনে হিসেব নিকেশ করে কে বেহেস্তে যাবে আর কে দোযখে যাবে। মাঝে মাঝে এ জন্য সে লজ্জিত হয়। যে সিদ্বান্ত আল্লাহ নেবেন তা নিয়ে তো তার মাথা ঘামানোর কোন কারণ নেই।

মজার ব্যাপার হচ্ছে বেহেস্তে কে যাবে এটা নিয়ে চিন্তা করলে সে একটা মানুষও খুঁজে পায়না! একটা মানুষকেও খাঁটি মনে হয়না যে কিনা বেহেস্তে যাবার যোগ্য। সে নিজে তো নয়-ই। আল্লাহ পাকের কঠিন হিসেব গলে কে যে বেহেস্ত যাবে আল্লাই মালুম।

কিন্তু দোযখিদের তালিকা যেন শেষই হয়না। প্রথমেই যে মুখটা ভেসে ওঠে সেটা আজিজ ড্রাইভারের মুখ! ছিঃ ছিঃ ছিঃ ঘৃণায় শিউরে ওঠে সে! লোকটা বিয়ে করেনি। ড্রাইভারি করে যে টাকাটা পায় তা দিয়ে মদ গিলে,গাজা খায় আরো নানা রকম নেশা করে। মদ খেয়ে রাত্রে মাতলামি করে একে তাকে নাকি মারধরও করে। তাছাড়া প্রায় রাতেই খারাপ পাড়ায় যায়। মাঝে মাঝে মেয়ে নিয়ে আসে। সে নাকি একদিন তিনটা মেয়ে নিয়ে এসেছিল। সারারাত মেয়ে তিনটার সাথে কাটিয়েছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ ভাবতেই বমি আসে। আফসোস! এ লোকগুলোর যে কি হবে। দুনিয়ার জীবনকেই এরা জীবন মনে করে। আসল দুনিয়া যে ওই পরকাল তা ওরা ভেবেও দেখেনা। আফসোস!

২।

রাত আটটা।
সাঈদ মিঞা জিনিস পত্র গুছিয়ে দোকান বন্ধ করতে লাগল। এমনিতে সে রাত বারোটা একটা বাজার আগে দোকান বন্ধ করেনা। কিন্তু আজ তেমন বিক্রি টিক্রি হচ্ছেনা। হবে কিভাবে? সকালেই যে ওই পাপীটার মুখ দেখতে হল!

সে ঠিক করল নিউ মার্কেটের ওদিক থেকে ঘুরে আসবে; কিছু জিনিসপত্র কেনা দরকার। আজ বিক্রি যখন তেমন হচ্ছেইনা, কাজটা সেরে রাখাই ভাল।

দোকান বন্ধ করার পরপর-ই এশার আযান হল। সে নামাজ পড়তে চলে গেল। আল্লাহ পাকের কাছে খাস দিলে ক্ষমা প্রার্থনা করল মোনজাতের সময়। আর দোয়া করল তার একমাত্র মেয়ে শাম্মি'র জন্য। শাম্মির জন্মের তিন বছরের মাথায় শাম্মির মা মারা যায়। সে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেনি। মা মরা মেয়ে ঠিক মত দেখশুনা সে করতে পারেনা। এর মধ্যে যদি সে দ্বিতীয় বিয়ে করে, সৎ মায়ের হাতে মেয়েটার কি দুর্দশাই না হবে এসব ভেবে সে আর বিয়ে করেনি।

মোনজাত করতে করতেই তার মনে পড়ল শাম্মি তাকে চুড়ি কিনে দিতে বলেছিল। সে মনে মনে খুশি হল -কাজের সময় ব্যাপারটা মনে পড়ল। নিউমার্কেট থেকে আসার সময় ভাল দেখে চুড়ি কিনতে হবে।মেয়েটার কথা ভাবলেই সাঈদ মিঞার আনন্দে মনটা কানায় কানায় ভরে ওঠে! এতটুকুন মেয়ে অথচ এখনই কেমন মা মা ভাব!

বাজার সদাই করা,জ্যাম সব মিলিয়ে কখন যে রাত বারোটা বেজে গেল সাঈদ মিঞা খেয়াল করতে পারেনি। মেয়েটার জন্য দুশ টাকা দিয়ে চুড়ি কিনেছে। সে গরীব মানুষ। দুশ টাকা তার কাছে অনেক টাকা। কিন্তু মেয়েটার কথা ভাবলে সে যে গরীব সেটা আর তার মনে থাকেনা! চুড়িগুলো কিনতে পেরে তার মন একেবারে জুড়িয়ে গেছে! সে আনন্দে পরিপূর্ণ মন নিয়ে ঘরে ফিরছিল।

কিন্তু বস্তিতে ঢুকেই তার মনটা ধ্বক করে ওঠল! শত শত মানুষের ভীড়! কি হয়েছে এখানে? হাঁটতে হাঁটতে লোকমুখে নানা কথা শুনে সে অনেক কিছু জেনে যায়। বস্তিতে আগুন লেগেছে! সবকিছু একেবারে ছাই হয়ে গেছে। মারাও গেছে নাকি কয়েকজন!

সাঈদ মিঞা আর হাঁটতে পারেনা। ভয়ে কাউকে তার মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে পারেনা,পাছে কোন দুঃসংবাদ শুনে!
ঘরের কাছাকাছি এসে,যেন ভয়ংকর কোন কিছু শুনবে এমন দৃষ্টিতে সে পরিচিত মানুষজনের দিকে তাকায়।

এক মহিলা বলে ওঠে "আল্লার কি লীলা! আজিজ ড্রাইভার মইরা গিয়া তোমার মাইয়া বাইচ্চা গেল! আল্লার কি লীলা! এ জন্যই বলে হায়াত মউত আল্লার হাতে।"

"কই আমার মাইয়া কই?" সাঈদ মিঞা থরথর করে কাঁপছে!

মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে সাঈদ মিঞা। হাতে আর পায়ে অল্প কিছু পুড়ে গেলেও মেয়ের তেমন একটা ক্ষতি হয়নি। পুরো ঘটনাটাই সে ইতোমধ্যে শুনে ফেলেছে।

ঘটনা হচ্ছে শাম্মির বাঁচার কোন কথাই ছিলনা। যখন আগুন লেগেছে সে নাকি ঘরে বসে পড়ছিল। হঠাৎ ভয়াবহ আগুন দেখে সে ভয় পেয়ে যায়। আতংকে বের হতে পারেনা।সবাই শুধু বলছিল,"কেউ একজন মাইয়াটারে বাঁচাও" কিন্তু সেই আগুন ভেদ করে কারোই যেতে সাহস হলনা। তখন কোত্থেকে আজিজ ড্রাইভার দৌড়ে এসে বেড়া ভেঙ্গে ভিতর ঢুকে গেল। মেয়েটাকে পাঁজকোলা করে ভিতর থেকে নিয়ে আসতে বেশ কিছুক্ষন সময় লাগল। আজিজ ড্রাইভার তার গায়ের কাপড় দিয়ে শাম্মিকে পেঁচিয়েছে,তার গা খালি। আর মাথাভর্তি চুলে সে কী আগুন!শাম্মি কে পাঁজকোলা করে ধরেছে বলে হাত দিয়েও সে আগুন নিভাতে চেষ্টা করেনি!

আগুন থেকে বের হয়ে সে শাম্মি সহ মাটিতে ধপাস করে পড়ে গেল। শাম্মির তেমন কিছু নাহলেও আজিজ ড্রাইভার তখনি মারা যায়। তার লাশ এখন হাসপাতালে আছে। কেউ কেউ বলছিল মাথার চামড়া পুড়ে গিয়ে মগজও নাকি দেখা যাচ্ছিল!

৩।

রাত আড়াইটা।
পুরো বস্তি এলাকা শান্ত। যদিও কারো চোখেই ঘুম নেই। সাঈদ মিঞা মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মাথার ভিতর ভাবনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তার এই ভাবনা উপর ওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে -
"হে আল্লাহপাক যে আজিজ ড্রাইভার একটা মানুষকে বাঁচানোর জন্য নিজে আগুনে পুড়ে মরল,সে যত বড় পাপী-ই হোক তুমি কি তাকে ক্ষমা করবেনা? তুমি কি পারবে তাকে আগুনে নিক্ষেপ করতে? হে আল্লাহ পাক আমি আমার মেয়েকে ভালোবাসি তাই তার কোন কষ্ট কল্পনাও করতে পারিনা,তুমি তো পরম করুণাময়! অসীম দয়ালু, আমি আমার মেয়ে কে যতটা ভালবাসি পৃথিবীর সকল মানুষকে তুমি নিশ্চয় তার চেয়েও বেশি ভালবাস!সে ভালবাসার মানুষকে তুমি কিভাবে দোযখের আগুনে নিক্ষেপ করবে?"

সাঈদ মিঞা এতদিন বেহেস্তিদের তালিকায় মানুষ পেতনা, আজ হঠাৎ করেই তার দোযখিদের তালিকা শূন্য হয়ে গেল!
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৪৮২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১১/০৯/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast