www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গোপলা কথা - ৩৩

ভাষা বাংলার চিন্তায় ভাবনা
দীপঙ্কর বেরা

বাংলা বই ও বাংলা ভাষা ক্রমশ অধোগামী। আর এ আলোচনা রাস্তা ঘাটে গ্রাম বাংলার অলিতে গলিতে শোনা যায়। প্রথমে জানার চেষ্টা করা যেতে পারে। আমরা পড়াশুনা করি কেন?
জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে ভবিষ্যতে সেই পড়াশুনা দ্বারা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য। এক্ষেত্রে বাংলা ভাষার মাধ্যমে জ্ঞান এবং শিক্ষা তথা ডিগ্রী ভবিষ্যতে কতটা কার্যকরী। অর্থাৎ বাংলায় তেমন কাজ আছে কি? ধীরে ধীরে মন্দার বাজারে কর্মক্ষেত্র কমছে। কাজের জন্য বাংলা ছেড়ে অ-বাংলাভাষীতে যেতে হচ্ছে। এবং ভবিষ্যতে আরও যেতে হবে। তাহলে বাংলা ভাষার সাথে থেকে এ রকম কর্ম প্রচেষ্টায় পিছিয়ে পড়তে হয়। শিক্ষালাভ যদি অন্য ভাষার সাথে করে থাকি তাহলে বাংলা ভাষাতে থাকতে অসুবিধা হবে না। আবার বাংলা ভাষার বাইরে তো অসুবিধাই হবে না। তার মানে বাংলা ভাষার জন্য পিছিয়ে পড়া।
বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে যে যার মাতৃভাষার সাথে ইংরেজি বা অন্য ভাষায় শিক্ষার বিস্তার ঘটানো জরুরী। যে বা যারা উচ্চ শিক্ষায় পারদর্শী হতে পারল তারা সহজেই বাইরে ছড়িয়ে পড়ল আর যারা মোটামুটি শিক্ষা অর্জন করে তারা যে যার মাতৃভাষা অঞ্চলে কিছু কাজ কর্ম জুটিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করে। বর্তমানে বাংলা ভাষা অঞ্চলে এই কর্ম সংস্থান একটা মস্ত বড় ফ্যাক্টর।
আবার উচ্চ শিক্ষায় ইংরেজি ছাড়া কিছু হবে না। অনার্স কোর্স থেকে শুরু করে কম্পিউটার, সায়েন্স, থিসিস গবেষণা এবং ডাক্তারই ইঞ্জিনিয়ারিং নার্সিং ম্যানেজমেন্ট ভোকেশনাল সবেতেই ইংরেজি প্রয়োজন।
পেটের খিদে মেটার পর শুরু হয় মনের চাহিদা। সব বাবা মা ছেলেমেয়ের জন্য পড়াশুনার দ্বারা মিনিমাম খিদে মেটানোর সংস্থানের রাস্তা খোঁজেন। সেখানে প্রথম অফসান চলে আসে ইংরেজি। পারুক বা না পারুক। কেন না বাংলায় কিছু হবে না। সে বাংলা ভাষা অঞ্চলে থেকে কিংবা বাংলা ভাষা অঞ্চলের বাইরে থেকেও। আবার এই বাংলাতেই বাইরের অনেকেই বিজনেস করছে। কিভাবে? কেন না বাংলার নিজস্ব বাংলাভাষী সংস্থান কোথায়?
এর পরবর্তী অবস্থান হল বাংলাভাষা চর্চা। শুরুতেই সেখানে গলদ বড় আকারে বিস্তারিত সেখানে এই চর্চা রহিত। কর্মক্ষেত্রে কোন চিঠি চাপাটি পড়া বা লেখা কোনটাই আর বাংলায় নেই। সে সরকারী হোক বা বেসরকারি। সমস্ত প্রায় ওয়েবসাইট নির্ভর। পুরোটাই ইংরেজি। ফলে কর্মক্ষেত্রে প্রায় সবাই বাংলা ভাষা কেবল নিজেদের মধ্যে বলে আর সকালে চোখ বোলানো খবরের কাগজ পড়ে। অর্থাৎ কোন অফিস আদালতে বাংলা অনেকটাই প্রবেশ নিষেধ। যে টুকু অচেনা অজানা ঠকমক বাংলা ভাষায় দু একটা দরখাস্ত আসে তাও বোধগম্যের বাইরে। এর বাইরে কিছু শিক্ষক মহাশয় এবং সাহিত্যপ্রেমী ও লিখিয়েরা এবং বাংলা ভাষাভাষী ছাত্রছাত্রীরা বাংলা বই নাড়াচাড়া করে।
তাহলে বাংলা ভাষার প্রসার বা বাংলা ভাষা কিভাবে জগতে নিজস্ব স্থানে অটুট থাকবে? এর পরে আছে সাহিত্যপ্রেমী ও লিখিয়ে। অর্থাৎ যারা গল্প উপন্যাস ও কবিতা লিখছে। তারা কতটা টানতে পারছে পাঠক সমাজকে। বইমেলায় নামী প্রকাশক কতটা সবে নামকরা বা অনামীদের স্থান দিচ্ছে? তার মূল্যায়নে কিছুটা হলেও ভাষা অবস্থিত হয়। সেখানে দেখবেন সেই বঙ্কিম শরৎ হয়ে সুনীল শীর্ষেন্দু সুচিত্রা জীবনানন্দ শঙ্খ জয় শ্রীজাততে থেমে গেছে। পরবর্তী তেমন আসছে না।
কেন আসছে না? নামী প্রকাশক বাধা দিচ্ছে, না কি গভীরতার অভাব আছে? ভাবার বিষয়। উপরে উপরে ভেসে বেড়ানো কেউ সহজে নেবে না। কালের নিয়মে তার হারিয়ে যাওয়া নিশ্চিত। অল্প ভাবনা অল্প পাঠ অল্প নিরীক্ষণ এবং অল্প বিষয়ীকরণ এই বাংলা ভাষা হারিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী নয়তো?
নাক ঘুরিয়ে পাঠককে বোকা বানানো, সরকারী তকমা বা অন্য পুরস্কারে পুরস্কৃত লেখক বা কবি কেউকেটা হয়ে যান। কত পুরস্কার! অথচ তিনি হয়তো জানেন না “অর্থাৎ পেছন ফিরিয়ে সিগারেট খায়”।
আবার অনেকেই আছেন তাঁর বই বিক্রির খতিয়ান প্রকাশ্যে বিতরণ করেন। কিন্তু লাভ কি হচ্ছে? বাংলা ভাষাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? যদিও গল্প উপন্যাসের বই বিক্রি হচ্ছে তাও একবার পড়ার পর তাকে আর ছুঁয়ে দেখছে না। পরবর্তী প্রজন্মকে বলছে – ওটা থাক বাবা, তুই বরং শীর্ষেন্দু পড়। সুচিত্রা পড়। কিংবা চেতন ভগত। তাহলে আপনার বই বিক্রি হয়ে কি লাভ হল? ভাবুন। আপনার সামনে বা বইমেলায় অটোগ্রাফের জন্য বই কিনল ( কেন না বেশির ভাগ লেখক নিজের বই ছাড়া কোন ডাইরি বা অন্যের লেখা বইয়ে অটোগ্রাফ দিতে চান না)। তারপর ফেলে রেখে দিল। তাহলে বাংলাভাষা কি করে এগোবে?
অর্থাৎ আসল বিষয় হল গভীরতা। যা খুবই প্রয়োজন। তার জন্য নিজেকে পড়ার সাথে সাথে নিরীক্ষণ করা খুবই জরুরী। বাংলা ভাষায় যে গভীরতা রবীন্দ্রনাথ বিস্তৃত করে গেছেন, জীবনানন্দ প্রসারিত করে গেছেন তার আরও তলদেশে ডুব সাঁতার দিতে হবে। এবং লেখক হিসেবে কবি হিসেবে সেই মণি মুক্তো তুলে আনতে হবে। না হলে তুমি আমি নিয়ে লেখা, চুটকি, ছড়া, বোরোলীনে সারানো ক্ষতের মত ক্ষত থেকে যাবে। আর ভাষা হবে পঙ্গু।
বাংলা ভাষা হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাবে চিৎকার করে কি লাভ? সেই বনলতা সেন, সেই চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, সেই শেষের কবিতা, সেই রক্তকরবী, সেই চাঁদের পাহাড়, সেই মনোজদের অদ্ভুত বাড়িতে বাংলা সাহিত্য আটকে গেছে। যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল তারা আবার ঘরের ভেতরে। ভাসছে উপরে উপরে।
সে তুলনায় অন্য ভাষা আরও তলদেশে ডুবছে। খুঁজে আনছে মুক্তো। সেক্সপীয়ারকে সাথে করে অনেকটা দূর পাড়ি দিয়েছে। বাংলা ভাষা বাঁচানোর এটাও অন্যতম রাস্তা। আমি আমার ছেলেকে ধমকে বলতেই পারি যা ওদিকে যা। সে আমাকে দেখিয়ে এগিয়ে যাবে। যদি তার মনের মত হয় তবে সে নিজেই সে পথে যাবে না হলে হঠাৎ রাস্তা পাল্টে ফেলবে। সে রকম বাংলা বই আপনাকে দেখিয়ে কিনবে কিন্তু যদি রসদ না পায় খেলো কথায় তাকে ভোলানোর চেষ্টা করে লাভ হয় না। তাহলে সে রাস্তা বদল করবেই। এখনকার এ রকম অনেক লেখক আছে। উদাহরণও দেওয়া যেতে পারে তাতে লাভ হবে না। দায়িত্ব সবার।
লেখক বা কবি বা এই চর্চার সাথে যুক্ত সবাই এক গোত্রীয় হওয়া উচিত। সবার উচিত আলোচনার গভীরতায় অগ্রবর্তী হওয়া। অর্থাৎ পেছনে কেউ নেই। যারা চর্চায় তারা প্রত্যেকের লেখা পড়ুক। আত্মগম্ভীরতা বড্ড বেশি দেখা যাচ্ছে। ভাবছে আমার বই তো বেশ বিক্রি। তাহলে আর ওদিকে তাকিয়ে লাভ কি?
এবার আসা যাক গ্রাম বাংলার কথা। যাদের ভরসায় কিন্তু বাংলা ভাষা এখনও জীবন্ত উজ্জীবিত। খেটে খাওয়া জীবনযাত্রায় বাংলাভাষা স্বমহীমায় প্রতিষ্ঠিত। গাঁথা গান পাঁচালি যাত্রা মঙ্গলকাব্য গীতিকা কীর্তন লোকগান ভাটিয়ালী এখনও নানান ভাবনা চিন্তায় নিজের মত প্রচারিত। সেই মাটির সাথে বাংলা ভাষা শালুক ফুল তোলে ডিঙি বায় বৃষ্টিতে ভিজে চাষ করে। শহুরমুখী তথাকথিত ধীরে ধীরে বাংলাভাষা ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতির সাথে মিশে থাকা এই সব মানুষী বাংলাভাষার পরম হৃদয়। এদের জন্যই কোনদিন কোনভাবেই বাংলাভাষা হারিয়ে যাবে না।
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ৯৪৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৮/০৩/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast