www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গোপলার কথা - ১১

আমি তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি । আমাদের হতিহাসে শিক্ষক ছিলেন জ্ঞানদাস । তাঁর নাম যাই থাক সবাই তাঁকে জ্ঞানদাস বলে ডাকতেন । ইতিহাস সম্পর্কে বেশি কিছু বলতেন না। কিন্তু জীবনে চলার পথে নানা অভিজ্ঞতার কথা বলতেন। পড়াশুনা না করলে কি কি ক্ষতি হতে পারে। নিজের মধ্যে বন্ধুত্ব ধরে রাখা খুব দরকার। কোথায় কবে কাদা রাস্তায় পড়ে একজনের খুব লেগেছিল। স্নান করারও নাকি নিয়ম আছে। গুরুজনকে ভক্তি করার কি কি লাভ। ইত্যাদি ইত্যাদি। যা আমাদের সেই বয়সে জ্ঞানই মনে হত।
তাই সারা স্কুল তাঁকে জ্ঞানদাস বলে ডাকত। সেটা তিনি জানতেন। তবে দুঃখ পেতেন না। বুঝতেন আজ না হোক কাল জীবনের শিক্ষায় কেউ না কেউ তাঁকে মনে রাখবেন। আজ যেমন আমি মনে রেখেছি।
ক্লাসে এসেই বলতেন - আমি কিন্তু প্রতিদিন বইয়ের প্রথম থেকে যেখানে মনে হবে সেখান থেকেই পড়া জিজ্ঞেস করব। একটা চ্যাপ্টার পুরো পড়ার পরে তবেই না আমরা দ্বিতীয় চ্যাপ্টারে গিয়েছি। তাহলে প্রথমটা ভুলে গেলে চলবে না। সব মনে রাখতে হবে। এই ১৫ পাতা থেকে ২২ পাতা পড়া দেওয়া থাকল।
যদিও তিনি এক অক্ষরও বুঝিয়ে দেন নি। কিংবা পরেরদিন পড়া নেবেন কিভাবে? একজনকে বলতে বলবেন। তিনি মোটামুটি ইতিহাসের চরিত্র সময় জায়গার নাম উল্লেখ করে বলে গেলেই তাকে বাহবা দেবেন।
আমরা গুঞ্জন করে বলতাম - এতটা! বুঝিয়ে দিন। রেগে যেতেন তবে কাওকে মারতে দেখি নি। বকেছেন - ইতিহাস হল ছবির মত পড়া। পড়তে পড়তে বাবর হুমায়ূনকে মনে মনে কল্পনা করে ধাপে ধাপে পড়বি ঠিক বুঝতে পারবি। ফাইভ সিএক্সে হলে বুঝিয়ে টুঝিয়ে দিতাম। এখন তোরা নাইন। তোদের উপর ভরসা কত। তোরা হলি যৌবনের দোর গোড়ায়। যা পড়বি তাই হয়ে যাবে জলবৎ তরঙ্গ।
বলেই চলে যেতেন। ক্লাস ঘণ্টা পড়ুক না পড়ুক। পরদিন এসে নির্দিষ্ট তিন চার জনকে ধরা থাকত। তাদেরই পড়া জিজ্ঞেস করতেন। বাকীরা তাই পড়ত না। তাছাড়া ওই তিন চার জন পড়া পারছে মানে ক্লাসের সবাই খুব ভাল পড়াশুনায় এই ব্যাপারটা সবার নজরে পড়বে। তাই। আর আমি সব সময় বাকীদের দলে থাকতাম। তবে পরীক্ষার আগে পড়া ঠিক কমপ্লিট করে ফেলতাম।
সেই স্যার একদিন না আসায় তার জায়গায় ক্লাসে এলেন আমাদের স্কুলের লাইব্রেরীয়ান। এসেই উনি পড়া দেখেই তো অবাক। বললেন - এ-ত-টা! ৩২ পাতা থেকে ৪১।
তারপর একটু ভেবে বললেন - ঠিক আছে। পড়া দিয়েছে যখন বলো। আচ্ছা। দু একজনকে জিজ্ঞেসে করা যাক। বলেই সারা ক্লাস এদিক ওদিক দেখলেন। আমাদের ভাল করে চেনেন না। শুধু স্কুলের দু জন শিক্ষকের ছেলে স্নেহাংশু আর বিদেশ আছে তাদের চিনতেন। একজন বড় ব্যবসাদারের ছেলে রথীন্দ্রকে চিনতেন। আর দুচার জন গান জানা আবৃত্তি করতে পারা ছেলেমেয়েকে চিনতেন। আমি কোন দলে পড়ি না।
তাই বললেন - ফার্স্ট বয় কে? দাঁড়াও।
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমাকে দেখেই স্যার কেমন একটা মুখের ভাব করলেন। সুতির কোঁকড়ানো মোচড়ানো জামা পরা। সপ্তাহের প্রায় শেষের দিকে তাই তিনদিন কাচা হয় নি। একটু টাক পড়া। থ্যাবড়ানো নাক। মাথায় তেলচিটে চুল। টিফিনে কোনদিন খাওয়া হয় না আজও টিফিনের পরে শরীর তেমনি অবসন্ন।
স্যার বললেন - তুমি? তুমি ফার্স্ট বয়! আমি তো ভাবতাম স্নেহাংশ ফার্স্ট।
যেন মনে হয় আমি নোট করে যাই হোক করে ধরে টরে ফার্স্ট হয়েছি। অথচ আমি ক্লাস সিক্স থেকে বরাবর ফার্স্ট। স্নেহাংশু তুলনায় প্রায় ২০/৩০ নম্বরের ফারাক থাকেই।
তারপর যেন অনেকটাই রাগান্বিত হয়ে বললেন - বলো। ইব্রাহিম লোদীর শাসন কাল। সমস্ত সাল ও সমালোচকের নামসহ বলবে।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম স্যারের দিকে মুখ করে।
উনি আবার অনেকটা অর্ডার করার মত বললেন -কি হল। বলো। পড়া করে আস নি? স্কুল কি বেড়ানোর জায়গা। পড়াশুনা করে তো আসতেই হবে।
তারপর ক্লাসে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন -কে পারবে? বল। স্নেহাংশু। তুমি? রথীন্দ্র।
কিন্তু কেউ পারল না। উনি সবাইকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। একে একে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল । তাই দেখে লাইব্রেরিয়ান স্যার আমার কাছে এসে বলে উঠলেন - কেউ না পারুক তুমি তো ফার্স্ট বয়। তুমি পড়া পার নি এ তো লজ্জার।
আমার যৌবন মুখ। সবে গোঁফের রেখা উঠেছে। আর স্যারের অন্য রকম মনোভাবের জন্য আমিও বলে বসলাম - ফার্স্ট বয় হলে কি সব পড়া পারতেই হবে?
কথাটার কোন সারবত্তা নেই। আমরা যতই বিদ্যাধর হই না কেন আমরা কি সব পড়েছি। সমস্ত ইন ডিটেলস জানি? পরীক্ষার মত করে কিছু পড়া আমরা নিজের মত আয়ত্ব করে পড়ি। কিছু আবছা কিছু অজানা তো থেকেই যায়।
লাইব্রেরিয়ান স্যার আরো কিছুক্ষণ সারা ক্লাসে পায়চারি করলেন। কিছুক্ষণ চেয়ারে বসলেন। তারপর এদিক ওদিক দেখে কি ভেবে ক্লাস থেকে চলে যান। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে থাকলাম। সবাই আমার দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তা আজকে আর মনে নেই।
পরে স্যারের কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে নিই।
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ৮০২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২২/০৩/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast