www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গল্প-অনিন্দ্যর গাধাদর্শন

গল্প-অনিন্দ্যর গাধাদর্শন
সাইয়িদ রফিকুল হক

আজ শনিবার। অনিন্দ্যর বাবার অফিস বন্ধ।
সে আজ বাবার সঙ্গে ঢাকা-চিড়িয়াখানায় যাবে গাধা-দেখতে। এজন্য সকাল থেকে তার মনের মধ্যে একধরনের ফুর্তিভাব বিরাজ করছে। সে জীবনে কখনো স্বচক্ষে জীবন্ত গাধা দেখেনি।
অনেকের কাছে মনে হতে পারে, পৃথিবীতে এত জন্তুজানোয়ার থাকতে হঠাৎ সে কেন গাধা দেখতে যাবে! কারণ আছে। অনিন্দ্যর স্কুলের কয়েক বন্ধু মাস দুয়েক আগে চিড়িয়াখানা থেকে গাধা-দেখে এসেছে। ওরা এসে বলেছিল, “জানিস, গাধাগুলো কত সুন্দর! আর খুব নিরীহ। দেখলে খুব মায়া জাগে মনে। ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক্যাল চ্যানেলে তো এতদিন শুধু ভিডিয়ো দেখেছি। এবার নিজের চোখে দেখে এলাম জীবন্ত গাধা!”
আরও কয়েকটি কারণ আছে। ক্লাসেও ওরা একজন আরেকজনকে মাঝে-মাঝে ইয়ার্কি-ফাজলামি করে গাধা বলে হাসিঠাট্টা করে থাকে। অনিন্দ্যও ভেবেছে, প্রতিদিন তারা রসিকতার সুরে কতজনকে অহেতুক এই নিরীহ প্রাণিটার নাম নিয়ে তিরস্কার করছে! আসলে, গাধা জিনিসটা দেখতে কেমন―তা-ই ওরা এতদিন যাবৎ জানতো না! তাই, জন্তুটাকে একনজর দেখতে গিয়েছিল ওর বন্ধুরা। আর বন্ধুদের মুখে গাধার চেহারার বর্ণনা শুনে সেও এখন গাধা-দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ওর বন্ধুরা গাধা-দেখে গাধার কষ্টে খুবই মর্মাহত হয়েছে। ওরা এসে বলেছে, চিড়িয়াখানায় শুধু গাধা কেন―সব জন্তুজানোয়ারকেই ঠিকমতো খাবার দেওয়া হয় না। ওদের ভাগের খাবার চুরি করছে দায়িত্বরত অসৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এই নিয়ে কয়েকবার পত্রিকায় রিপোর্টও করা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। চিড়িয়াখানার পশুদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আর গোবেচারা গাধাগুলো রয়েছে খুব কষ্টে! সেই থেকে ওর মনে ইচ্ছে জেগেছিল, সেও গাধা-দেখবে।
আজ ছুটির দিন বলে সে বাবার সঙ্গে গাধা-দেখতে বের হলো। ওর বাবা বাসার সামনে থেকে একটা রিকশাভাড়া করে চিড়িয়াখানার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
ছুটির দিন হওয়ায় আজ চিড়িয়াখানায় ভিড় একটু বেশিই। তবুও অনিন্দ্যর খারাপ লাগছে না। সে নিজের চোখে আজ বড়সড় একটা গাধা-দেখবে!
অনিন্দ্য দেখলো, এখানকার সিস্টেম ভালো নয়। দেশ অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আচরণগত কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। এরা সেই মান্ধাতার আমলের চিন্তাচেতনা নিয়ে এখনও পড়ে রয়েছে। আর আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে গোল্লাছুট খেলছে!
সে দেখলো, টিকিট কেটে চিড়িয়াখানায় ঢোকা থেকে শুরু করে অনেককিছুতেই দর্শনার্থীরা ভয়ানক বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে। এই একবিংশ শতাব্দীতেও লোকগুলোর কোনো বোধোদয় হয়নি।
তার বাবার মতো সেও দেশকে ভালোবাসতে শিখেছে। এসব দেখে তার মনখারাপ হয়ে গেল! চিড়িয়াখানার গেইটের লোকজনের আচরণ মিনিবাসের কন্ডাক্টর আর হেলপারদের মতোই চরম অসৌজন্যমূলক।
এসব দেখে তার মন আরও খারাপ হলো। তবুও সে বাবার হাতধরে গাধা-দেখার জন্য চিড়িয়াখানার ভিতরে ঢুকলো। এখন তার মনে দারুণ একটা উত্তেজনা! আজ সে গাধা-দেখেই ছাড়বে!

অনিন্দ্য চিড়িয়াখানায় ঢুকে দেখলো, সেখানে একটা গাধাও নাই! গাধার খাঁচাটা একদম খালি! সে খুব মনখারাপ করলো। বড় আশা করে সে বাবার হাতধরে চিড়িয়াখানায় এসেছিল গাধা-দেখবে বলে! আশাভঙ্গের বেদনায় সে এখন কিছুটা মর্মাহত। তার বাবা ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন।
তিনি বললেন, “মনখারাপ কোরো না, বাবা। গাধারা এখন এখানে থাকে না! আর গাধারা বাইরে চলে গেছে! প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যে অনেককিছু বদলে গেছে! গাধাদের ঠিকানাও পরিবর্তিত হয়েছে তাই। তবে তুমি বড় হলে অনেক গাধা দেখতে পারবে! গাধাদের তখন চিনতে পারবে।”
অনিন্দ্য তবুও মনখারাপ করে বলে, “কোথায় গাধা পাবো, বাবা? যেখানে গাধা থাকার কথা সেখানেই তো গাধা নাই! আর কোথায় গেলে গাধাকে দেখতে পাবো!”
শমসেরসাহেব তবুও সস্নেহে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “বলেছি তো পারবে, বাবা। পারবে। তুমি জীবনে বড় হও। অনেক গাধা দেখতে পাবে। তখন তুমি গাধাদের চিনতে পারবে! আমাদের আশেপাশে কত গাধা আছে!”
সে তবুও মনখারাপ করে বলে, “তবে আমাকে একটা গাধা দেখাও তো! আমি গাধা-দেখতে চাই। আজ আমার খুব গাধা দেখতে ইচ্ছে করছে, বাবা! প্লিজ, একটা গাধা-দেখাও আমাকে!”
ছেলের কথা শুনে তিনি এবার মনভরে হাসলেন। আর শেষে বললেন, “বাবা, গাধা-দেখার মধ্যে তেমন কোনো আনন্দ নাই। এই জীবনে বেঁচে থাকলে তুমি এত-এত গাধা-দেখবে যে, শেষে হয়তো বিরক্ত হয়ে যাবে! চার-পেয়ে গাধাগুলো তবুও মানুষের অনেক কাজে লাগে। এরা খুব বিশ্বস্ত আর ভারবাহী। কিন্তু অন্য গাধাগুলো সমাজের জন্য শুধুই ক্ষতিকর।”
তারপর তিনি অনিন্দ্যকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে চলে এলেন বাঘের খাঁচার সামনে। কিন্তু বাঘকে দেখে অনিন্দ্য আজ তেমন খুশি হলো না। আর তা দেখে শমসেরসাহেব যারপরনাই আশ্চর্যান্বিত ও বিস্মিত হলেন!
ছেলেটি তার যথেষ্ট বুদ্ধিমান। গতবছর সপ্তম শ্রেণি থেকে প্রথমস্থান অধিকার করে সে এবার অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছে। এমন একটা ছেলেকে তিনি সহজে বোঝাতেও পারছেন না। ছেলেটি তার এখন গাধা-দেখার জন্য একেবারে গোঁ ধরে বসে রয়েছে!
তার বাবা কোনো কথা বলছেন না-দেখে সে আবার বলে, “বাবা, গাধারা এখন চিড়িয়াখানায় থাকে না কেন? ওদের কী হয়েছে? কিংবা কেউ কি ওদের এখানে থাকতে বারণ করেছে?”
তিনি আগের মতো মোলায়েম হাসিতে বললেন, “তা নয়, বাবা। এই গাধারা এখন বড়-বড় গাধাদের দাপটে নির্যাতিত হয়ে মারা যাচ্ছে! তাই, এখানে থাকতে এরা আর ভরসা পাচ্ছে না। আর এদের চেয়ে আরও বড়-বড় গাধা আছে। তাদের দেখেই মানুষ এখন বেশি খুশি হয়! তবে কেউ ওদের এখানে থাকতে নিষেধ না-করলেও ওদের খাতিরযত্নও ঠিকভাবে করছিল না। আসলে, এখানে ওদের আদরযত্ন ঠিকমতো হচ্ছিলো না। বড়-বড় গাধারা ওদের ভাগের খাবার সবটা সাবাড় করছিল! চার-পেয়ে গাধারা তাই চিড়িয়াখানায় থাকার মতো অভিযোজন-ক্ষমতাও হারিয়েছে। তাই, ওদের ঠিকানা পরিবর্তিত হয়েছে।”
তবে ওরা এখন কোথায় থাকে?
থাকে। সবজায়গায়ই থাকে। গাধা এখন কমবেশি চারিদিকেই ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে! আর আশেপাশে তুমি খুঁজে দেখলে অনেক গাধা পেয়ে যাবে।
মানে?
মানে হলো: গাধারা এখন চিড়িয়াখানায় থাকে না। ওদের আর এখানে থাকার দরকার হয় না। বলেছি না, ওদের চেয়ে বড় গাধাও এখানে আছে! ওরা এখন লোকালয়ে রয়েছে। আমাদের লোকালয়ে এখন অনেক গাধা গিজ গিজ করছে! এই ধরো, আমার অফিসেও কতকগুলো গাধা আছে। এরা সরকারি টাকায় খুব আরাম-আয়েশে দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু অফিসে কাজকর্ম তেমন একটা করে না! আবার এই গাধাগুলো সময়ের কাজ সময়েও করে না। কিংবা যৎসামান্য কাজ করলেও সরকারি ফাইল আটকিয়ে রেখে ঘুষ খেতে চায়। এই গাধাগুলো শুধু পেটসর্বস্ব। দেশ, জাতি আর মানুষের জন্য মাঙ্গোলিক ভাবনা এদের নাই!
তাইলে সরকার ওদের টাকাপয়সা খরচ করে লালনপালন করছে কেন?
করতে হয়, বাবা। না-করলে সমস্যা যে! কারণ, এই গাধাগুলোও যে রাষ্ট্রের নাগরিক! ওদেরও অধিকার আছে বেঁচে থাকার। তুমি বাইরে বের হলে দেখবে অনেক গাধা বাইরে ঘোরাফেরা করছে! ওদের এখন রশি দিয়ে আর বেঁধে রাখতে হয় না। ওরা খুব লাগামহীন। ওদের অনেক স্বাধীনতা। ওরা স্বাধীনতার প্রচণ্ড সুখ অনুভব করছে।

মনখারাপ হলেও অনিন্দ্য বাবার সঙ্গে চিড়িয়াখানা ঘুরেফিরে দেখতে লাগলো। সে স্পষ্ট দেখতে পেল, এখানকার নিরাপত্তাকর্মীরা বাগানের বিভিন্নরকমের ফলফলাদি নিজের ইচ্ছেমতো ভোগ করছে। চিড়িয়াখানা দেখতে আসা লোকজনের কাছে তারা প্রকাশ্যে এসব বিক্রয়ও করছে! ওদের আত্মীয়স্বজনরাও এসব ইচ্ছেমতো ভোগ করছে! অথচ, চিড়িয়াখানার সকলকিছু রাষ্ট্রের সম্পদ। এগুলো বিক্রয় করতে হলে টেন্ডার ডেকে তা করতে হবে। সে তার বাবার নিকট থেকে এসব জেনেছে। তাছাড়া, এর ভিতরে যে-সব খাবারের দোকান বা হোটেল-রেস্টুরেন্ট রয়েছে―তারা যেন একেকটা আস্ত জলদস্যু! এদের আচার-ব্যবহারও অতি জঘন্য! তবুও এরা বছরের-পর-বছর চিড়িয়াখানার ভিতরে বহাল তবিয়তে রয়েছে। এমনকি এরা চিড়িয়াখানার ভিতরের পাবলিক টয়লেটগুলো নিয়েও কী নোংরা ব্যবসা করে খাচ্ছে!
সে আরও অনেক গাছে অনেকরকম ফল দেখতে পেল। তা দেখে সে তার বাবাকে বললো, “বাবা, এসব কারা খাচ্ছে?”
ওর বাবা আগের মতো হেসে বললেন, “বাবা, এসব গাধারা খাচ্ছে। সবকিছু এখন গাধাদের দখলে! আর এসব তোমার এখন জেনে লাভ নাই। চলো, আমরা কিছু পাখি দেখে আসি।”
অনিন্দ্য আর-কোনো কথা না-বলে বাবার হাতধরে হাঁটতে লাগলো। কিন্তু তার মনের খটকা কিছুতেই দূর হচ্ছে না! চিড়িয়াখানার ভিতরে কোনো গাধা নাই! কিন্তু বাবা বলছেন, সবকিছু গাধারা খাচ্ছে! তার কাছে কথাটা কেমন যেন রহস্যময় মনে হতে লাগলো!

চিড়িয়াখানার প্রায় সব জন্তুজানোয়ার দেখা শেষ করে অনিন্দ্য আবার ওর বাবার হাতধরে বাইরে বের হওয়ার জন্য গেইটের কাছে এসে দাঁড়ালো। এই গেইটটা দর্শনার্থীদের বাইরে বের হওয়ার জন্য করা হয়েছে।
অনিন্দ্য দেখলো, গেইটে বড়-বড় হরফে লেখা আছে: এই গেইট দিয়ে দর্শনার্থীদের বাইরে বের হতে হবে। অথচ, সে দেখলো, এই গেইট দিয়ে কিছু লোক চিড়িয়াখানার ভিতরে ঢুকছে!
সে সবিস্ময়ে তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, “বাবা, ওরা বাইরে বের হওয়ার গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকছে কেন? এটা তো ঠিক নয়। আর এটা খুব বেআইনি।”
শমসেরসাহেব হেসে বললেন, “বাবা, ওরা গাধা! তাই, নিয়মকানুন মানে না। আর জানো তো, গাধারা কখনো মানুষ হয় না। সেইজন্য ওরা সবসময় উল্টাপাল্টা কাজ করে।”
বাবার কথা শুনে অনিন্দ্য ফিক করে হেসে ফেললো। আর বললো, “বাবা, এবার বুঝেছি। আমার গাধা-দেখার শখ মিটে গেছে! চারিদিকে এত গাধা! আর আমি কিনা খাঁচার ভিতরে একটা গাধা খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম!”
ওর বাবা আরও বললেন, “যারা ঘুষ খেয়ে এই লোকগুলোকে এদিক দিয়ে বেআইনিভাবে ভিতরে ঢোকাচ্ছে, তারা আরও বড় গাধা। এগুলো রাষ্ট্রের শত্রু। এইসব গাধার উৎপাতে আজ দেশবাসী অতিষ্ঠ! আর এদের উৎপাতে চিড়িয়াখানায়ও কোনো গাধা নাই! সব গাধা এখন বাইরে। এবার তো নিজের চোখে দেখলে বাবা! বাইরে এত-এত গাধা থাকতে চিড়িয়াখানার খাঁচায় দুই-একটা গাধাকে বন্দি করে রাখার কী দরকার?”
অনিন্দ্যও হাসতে-হাসতে বলে, “ঠিক বলেছো, বাবা। আমাদের চারপাশে কত জাতের কত গাধা রয়েছে! গাধায়-গাধায় চলছে সমানে গুঁতোগুঁতি! আর এত গাধা আছে বলেই দেশটা কিছুতেই এগুতে পারছে না! আর আমি এখন বুঝতে পারছি: চিড়িয়াখানাটাও গাধাদের হাতে পড়েছে!”
শমসেরসাহেব হেসে বললেন, “ঠিক তা-ই।“
তারপর তিনি একটু থেমে আবার বললেন, “এসো বাবা। আমরা একটা স্লোগান দিই: গাধামুক্ত বাংলাদেশ চাই। আর বাংলাদেশ গাধামুক্ত হোক।”


সাইয়িদ রফিকুল হক
০৫/০১/২০২১
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ২৮৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৯/০১/২০২১

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast