www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

খুব ভয়ের গল্প--বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে (ষষ্ঠ পর্ব)

খুব ভয়ের গল্প:
ধারাবাহিক উপন্যাস:
বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে
(ষষ্ঠ পর্ব)
সাইয়িদ রফিকুল হক

অধ্যাপক লিটু মিয়া খুব মনোযোগসহকারে বাড়িটার ড্রইংরুম থেকে তার তদন্তকাজ শুরু করলেন। তিনি খুব যত্নসহকারে এখানকার প্রতিটি জিনিস খুটিয়ে-খুটিয়ে দেখছেন। বিশেষ করে এই বাড়িটার চারপাশের দেওয়াল থেকে শুরু করে এর মোটা, মাঝারি ও চিকন আকৃতি-প্রকৃতির পিলারগুলোও খুব ভালোভাবে দেখছেন। তাঁর দেখার ক্যারিশমা দেখে অর্ণব ভীষণভাবে মুগ্ধ। সে তাঁর আশেপাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। অধ্যাপকসাহেবের কাজে ব্যাঘাতসৃষ্টি হতে পারে ভেবে সে কোনো কথা বলছে না। সে একটু আগে তার বাবার মুখে শুনেছে—তিনি একজন নামকরা প্রাইভেট ডিটেকটিভ! এতে তাঁর প্রতি তার আগ্রহের পরিমাণ আরও বেড়ে গেছে। সে তার মনে খুব ভক্তিভাব নিয়ে অধ্যাপক লিটু মিয়ার আশেপাশে এখন ঘোরাফেরা করছে।
লিটু মিয়ার চেহারা দেখে এ-বাড়ির সবাই মুগ্ধ ও মোহিত। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি উচ্চতার সুস্বাস্থ্যের অধিকারী লোকটাকে সবাই পছন্দ করেছে। তারউপরে তাঁর গায়ের রঙ একেবারে ফর্সা। সুন্দর ও উন্নত নাসিকা তার। চমৎকার ও মানানসই দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী লোকটা খুব দ্রুত এ-বাড়িতে সবার ভক্তিভাজন পাত্রে পরিণত হয়েছেন। তাঁর বুদ্ধিমত্তাও সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বিশেষ করে তাঁর সাংঘাতিক এক ভক্তে পরিণত হয়েছে অর্ণব।
তাঁর পরনের পোশাকআশাকও সুন্দর। এখন গরমের দিন হওয়ায় তিনি চমৎকার মানানসই একটা ফুলশার্ট ও ফুলপ্যান্ট ইন করে পরেছেন। তারউপরে রয়েছে একটা হাফ-জ্যাকেট। এটি সবসময় তাঁর পরনে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে তাঁর নানান রকম যন্ত্রপাতি ও গোয়েন্দাগিরি করার বিভিন্নরকম সরঞ্জামাদি। তিনি যেকোনো জায়গায় গেলে এটি তাঁর পরনে থাকবেই। তাঁর পায়ে সুন্দর ও মনোরম একজোড়া কালো জুতা রয়েছে। অবশ্য তিনি যখন পেশাদারি গোয়েন্দাগিরিতে নামেন তখন তার পায়ে রাবার-সোলের মোটা কাপড়ের জুতা কিংবা আরামদায়ক কোনো কেডস্ থাকে। এতে তাঁর দৌড়াতে কিংবা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে খুব সুবিধা হয়।
ড্রইংরুমটা দেখা শেষ করে তিনি ঢুকলেন মোসাদ্দেকসাহেবের বেডরুমে। সেখানে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে তারপর ঢুকলেন শায়লার রুমটাতে। এখানে, তিনি দীর্ঘসময় ধরে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেন। দরজা-জানালা থেকে শুরু করে এই রুমটার সবকিছু তিনি বারবার দেখলেন। জানালা থেকে গাছের সঠিক দূরত্ব নোটবুকে লিখে রাখলেন। একটু পরে অর্ণবের রুমে ঢুকলেন। এই রুমটা কয়েক মিনিট দেখেশুনে তারপর আরও দুইটি ফাঁকা রুম ঘুরে সবশেষে তিনি মালেকার রুমটাতে ঢুঁ মারলেন। তিনি একে-একে এই বাড়িটার প্রতিটি রুমের চারপাশের দেওয়াল ও ছাদ খুব ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। আর সবজায়গায় তিনি খুঁজছেন কিছু-একটা।
ওরা তিনজন তাঁর কাজ দেখে বিস্মিত ও কিছুটা হতভম্ভও যেন। ওরা যেন কিছুতেই বুঝতে পারছে না—তিনি কী এতো দেখছেন? আর কী এতো খুঁজছেন?
তিনি হিসাব করে দেখলেন, দোতলায় সর্বমোট রুমের সংখ্যা হলো ছয়টি। এছাড়াও রয়েছে একটি বিশাল ড্রইংরুম, একটি আধুনিক ও বড়সড় রান্নাঘর, পাঁচটি টয়লেট, আর চারটি বারান্দা।
এরপর তিনি দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন। তাঁর সঙ্গে-সঙ্গে এলেন মোসাদ্দেকসাহেব, শায়লা ও অর্ণব। ওরা কেউই তেমন-কোনো কথাবার্তা বলছে না। শুধু তাঁর আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। আর নিজেদের মধ্যে ইশারায় ভাববিনিময় করছে। তবে মোসাদ্দেকসাহেব তাও করতে চাচ্ছেন না। তিনি একেবারে নীরব ও নিশ্চুপ। মাঝে-মাঝে তদন্তের স্বার্থে অধ্যাপকসাহেব প্রয়োজনীয় যেকোনোকিছু মোসাদ্দেকসাহেবের নিকট থেকে জেনে নিচ্ছেন।
নিচতলায় মোট রুমের সংখ্যা চারটি। এছাড়া, এখানে একটি বিশাল হলরুমসহ তিনটি টয়লেট, তিনটি বিশাল বারান্দা ও একটি ছোট কিচেনও রয়েছে। নিচতলার প্রতিটি জায়গাও তিনি বারবার ঘুরেফিরে দেখতে লাগলেন। এখানকার একটা জায়গায় তাঁর চোখজোড়া হঠাৎ আটকিয়ে গেল! আর এই জায়গাটা তিনি বারবার পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন। নিচতলার বিশাল হলরুমটাকে আকর্ষণীয় ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করতে বেশ কয়েকটি গোলাকৃতির বড়সড় পিলার ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, নিয়মবহির্ভূতভাবে এখানকার একপাশের পর-পর দুটি পিলার অতিরিক্ত বড় করা হয়েছে। তাঁর কাছে মনে হলো, এখানে কোনোপ্রকার স্ট্রাকচারাল ও আর্কিটেকচারাল ডিজাইন ছাড়াই এই পিলার দুটি এতবড় করা হয়েছে। তিনি খুব যত্নের সঙ্গে এই পিলার দুটি নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু করে দিলেন। তিনি বিরাট ভাবনায় পড়ে গেলেন—বাড়ির পশ্চিমদিকের পর-পর দুটি পিলার অন্যান্য পিলারগুলোর চেয়ে হঠাৎ করে এতো মোটা হয়ে গেল কেন? শেষে তিনি আপনমনে হিসাব মেলাতে না পেরে মোসাদ্দেকসাহেবের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, “বাড়ির কাগজপত্র সব আপনার কাছে আছে তো? এগুলো একটু দেখতে হবে।”
মোসাদ্দেকসাহেব হন্তদন্ত হয়ে তার গুরুজীর কাছে এসে দাঁড়ালেন। আর কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “কোন কাগজপত্র গুরুজী? আমাকে যদি একটু বুঝিয়ে বলতেন?”
অধ্যাপকসাহেব বললেন, “এই ধরুন গে, বাড়ির দলিলপত্র, বাড়িটা নির্মাণকালে এর যে স্ট্রাকচারাল ও আর্কিটেকচেরাল ডিজাইন বা নকশা অনুসরণ করা হয়েছিল তা, এবং বাড়িটা আসলে কত সালে নির্মাণ করা হয়েছিল—তার একটা সঠিক তথ্যপ্রমাণ।”
মোসাদ্দেকসাহেব এবার হেসে বললেন, “আছে গুরুজী, আছে। এসব কাগজপত্র আমার কাছে আছে।”
অধ্যাপকসাহেব এটা শুনে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে যেন বললেন, “চলুন তবে, এবার উপরে যাওয়া যাক। পরে এসব কাগজপত্র আমাকে দেখতে হবে।”

উপরে ততক্ষণে রাশিদা বানু মালেকাকে সঙ্গে নিয়ে খুব সুন্দরভাবে দুপুরের খাবারের আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছেন। তিনি বিশাল ডাইনিং টেবিলটায় সবকিছু রেখেছেন সাজিয়েগুছিয়ে। টেবিলের একপাশে আগে থেকে বসে রয়েছে সাদমান। সে সবার জন্য অপেক্ষা করছিল।
সবাইকে উপরে উঠতে দেখে সাদমান উঠে দাঁড়ালো। তারপর আবার নিজের জায়গায় বসে পড়লো।
অধ্যাপক লিটু মিয়া কোনোরকম ভনিতা না করে হাত-মুখ ধুয়ে সরাসরি খাবার-টেবিলে গিয়ে বসলেন। তিনি এই রাজসিক খাবারের আয়োজন দেখে একটু হাসলেন।

লিটু মিয়া খাবার খেতে শুরু করার পর সবাই খাওয়া শুরু করলো। একটেবিলে বসেছে সবাই। শুধু রাশিদা বানু পরে খাবেন। মালেকাও পরে খাবে তার সঙ্গে।
সাদমান অনেকক্ষণ যাবৎ কথা বলার জন্য একেবারে হন্যে হয়ে ছিল। সে খাওয়ার একফাঁকে হঠাৎ বলে বসলো, “গুরুজী, আসলেই কি পৃথিবীতে আত্মা আছে? আমি এই বিষয়টি সম্পর্কে জানতে খুবই আগ্রহী। যদি আপনি আমাকে এই বিষয়টি একটু বুঝিয়ে দিতেন!”
অধ্যাপক লিটু মিয়া একটু হেসে বললেন, “ভাই, আত্মা আসলেই আছে। তুমি তো তা গতরাতে হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছো। আমি তোমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে পারবো। তবে এবিষয়ে আমি এখন তোমাকে তেমনকিছু বলবো না। তার কারণ, খাবারের পরে এবিষয়ে আমি তোমাদের কাছে বিস্তারিত বলবো। মোসাদ্দেকসাহেবও আমাকে আজ আত্মাবিষয়ে এখানে কিছু বলার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন। আর আমি তো তার অনুরোধেই আজ এখানে এসেছি। তাই, আমি পরে সবার অনুরোধই রাখবো। কিন্তু ভাই, এখন নয়।”
সাদমান এরপর হেসে বললো, “জ্বি, ঠিক আছে, গুরুজী।”
অর্ণব একটা ব্যাপারে থাকতে না পেরে বললো, “গুরুজী, আমার একটা বন্ধু আছে—ওর নাম সামি আল-সাকিব। সে নামাজ পড়ে—কিন্তু হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র মিরাজ, আত্মা, কেরামতি, জ্বীন, ফেরেশতা, ওলীআল্লাহ ইত্যাদি নিয়ে সবসময় হাসিঠাট্টা করে থাকে। এমনকি সে বলে—এই দেশটা পাকিস্তান থাকলেই নাকি ভালো ছিল!”
অধ্যাপক লিটু মিয়া বললেন, “ঠিকই তো বলে! ও যে বংশের সন্তান সেই হিসাবে ও তো এটাই বলবে। এতে অবাক হওয়ার আর কী আছে? ওর বাপ-দাদারা রাজাকার ছিল, আর তারা বেঁচে থাকলে এখনও হয়তো তা-ই আছে। সেই বংশের একটা ছেলে এর থেকে ভালো আর কী বলবে?”
“ওরা কেন এসব বলে? যদি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলতেন!” অর্ণব যেন একেবারে নাছোড়বান্দা।
অধ্যাপকসাহেব এবার খাওয়ার ফাঁকে–ফাঁকে খুব স্বাভাবিকভাবে বলতে লাগলেন, “দেখো, এই বিষয়টি একেবারে রাজনৈতিক। আমি আজ তোমাদের এখানে রাজনৈতিক কোনো বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। আজ আমি এখানে এসেছি—তোমার বাবার আমন্ত্রণে—আত্মাবিষয়ে কিছু কথা বলতে। আর তোমাদের বাড়িতে আত্মার উপস্থিতিটাকে একটু সুন্দরভাবে সমাধান করার জন্য। এখানে, আজ রাজনৈতিক কোনো কথা বলার ইচ্ছা আমার নাই। এসব অন্য একদিন হতে পারে। তবে তোমার মনের ভাবটা লক্ষ্য করে আমি এই বিষয়ে খুব সংক্ষেপে কয়েকটি কথা বলছি: এদের এসব বলার কারণ হলো—শিকড়ের দোষ। এইসব ছেলে-মেয়েরা তাদের বাপ-দাদার শেখানো মিথ্যাবুলি এখনও ছাড়তে পারেনি। ১৯৭১ সালে, আমাদের দেশের মানুষজন বাঁচার বা আত্মরক্ষার জন্য পাকিস্তানী-হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াইয়ে যখন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল—আর তখন এই দেশেরই কিছুসংখ্যক কুলাঙ্গার পাকিস্তানরক্ষার জন্য রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তিকমিটি’র লোক হওয়ার নামে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জঘন্য, নৃশংস ও পৈশাচিক অপকাণ্ডে মেতে উঠেছিল। এরা ছিল জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান, ইসলামী ছাত্রসংঘ পাকিস্তান, পাকিস্তান মুসলিম-লীগ, নেজামে ইসলাম পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, হাটহাজারীমাদ্রাসার মুজাহিদবাহিনী, হেফাজতে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলন ইত্যাদি। ১৯৭১ সালে, ইসলামের নামে রাজনীতি করে খাওয়া এই দলগুলো বাংলাদেশ চায়নি। এরা চেয়েছিল পাকিস্তান। তাই, এরা পাকিস্তানীদের সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষজনকে হত্যা করতে শুরু করে দেয়। বুঝতেই পারছো—এরা কতটা খারাপ ছিল! বাংলাদেশে বাস করেও এরা বাংলাদেশ ও বাঙালির বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালাচ্ছিলো। এই নরপশুরা ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে ছিল ওহাবী, খারিজী, সালাফী ও মওদুদীবাদী। এদের সঙ্গে দেশের প্রকৃত মুসলমানদের ঈমান-আকিদাহগত বিরাট একটা পার্থক্য রয়েছে। এরাই এখন ইসলামের নামে নানারকম বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ইসলাম একটি বিশ্বাসের ধর্ম। এখানে, প্রায় সবকিছু না-দেখে বিশ্বাসস্থাপন করতে হয়। যেমন; একজন মুসলমান হিসাবে ইসলামধর্মের প্রতি আমাদের ঈমান আনার বা বিশ্বাসস্থাপন করার প্রাথমিক-মূলসূত্র হলো—সাতটি। আর এই সাতটির প্রতি যে মনেপ্রাণে বিশ্বাসস্থাপন করবে—সেই হবে মুসলমান। বিশ্বাসস্থাপন করার এই সাতটি বিষয়কে একত্রে বলা হয় ঈমানে মুফাসসাল। এগুলো হলো: আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, আল্লাহর ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস, আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসুলদের প্রতি বিশ্বাস, আল্লাহর কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস, আখেরাত বা শেষবিচারের প্রতি বিশ্বাস ও তাকদির বা ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস করা। এখানে, সবই কিন্তু না-দেখে বিশ্বাসস্থাপন করতে হচ্ছে। আমরা সবাই কিন্তু লোকমুখে ও ধর্মীয় বইপত্র পড়ে ইসলামধর্মের প্রতি ঈমান এনেছি। আমরা কেউই কুরআন-নাজিল হতে দেখি নাই! আবার আমরা কেউই কোনো নবী-রাসুলকে দেখি নাই! মহান আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাদেরও দেখি নাই। তবুও তাঁদের প্রতি বিশ্বাসস্থাপন করেছি। তাই বলছিলাম, আমাদের ইসলামধর্মের মূলমন্ত্র হলো—না-দেখেই সবকিছুর প্রতি বিশ্বাসস্থাপন করা। এর অর্থ আল্লাহ আছেন, তাঁর প্রেরিত নবী-রাসুলগণ সত্য, আল্লাহর তৈরিকৃত জান্নাত ও জাহান্নাম সত্য, এবং তাঁর ফেরেশতাসহ তাঁর বলা সবকিছুই সত্য। এসবকিছুই কিন্তু অদৃশ্য! কিন্তু তুমি মুসলমান হলে তোমাকে অবশ্যই এসব না-দেখে পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করতে হবে, এবং এসব ব্যাপারে কোনো প্রমাণ বা ভিডিওতথ্য চাওয়া যাবে না। এটাই আমাদের ধর্মের মূলবাণী। কিন্তু বর্তমানে মুসলমান-নামধারী একশ্রেণীর ওহাবী, খারিজী, সালাফী ও মওদুদীবাদীরা আমাদের বিশ্বাসে ফাটল ধরাতে চাইছে। এরা সবকিছুতে একটা অন্যরকম ব্যাখ্যা দেওয়ার অপচেষ্টা করছে। আর ইসলামধর্ম তথা কুরআনকে বৈজ্ঞানিকভাবে অপব্যাখ্যা করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। আসলে, আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে: কুরআন একটি ধর্মগ্রন্থ—এটি কোনো বিজ্ঞানগ্রন্থ নয়। আর বিজ্ঞানগ্রন্থ হলে তার মধ্যে ভুলত্রুটি থাকবেই। তার কারণ, বিজ্ঞানের ভুলত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু মহান আল্লাহর কোনো সীমাবদ্ধতা নাই। তিনি সবসময় অসীম, আর বিজ্ঞান হলো সর্বদা সসীম। এই অসীম ও সসীমের ভেদাভেদ যে পুরাপুরি বুঝতে পারবে—সেই প্রকৃত মুসলমান হতে পারবে। এই যে ওহাবী, খারিজী ও মওদুদীবাদীদের কথা বলছি—আসলে, এরা সবাই কিন্তু ওহাবী বা সালাফী বা মক্কার কুখ্যাত পাপিষ্ঠ মহম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর বংশধর বা তার অনুসারী। এরা সবিকছুতে আজ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়ার অপচেষ্টা করছে। তাই, তোমাদের খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে—যারা আল্লাহ-রাসুলের ব্যাপারে ভুলব্যাখ্যা দেয় তারা তো দেশের ব্যাপারে ভুল বলবেই। আর এইসব পাপী সেই ১৯৭১ সালের মতো বলে—পাকিস্তানই ভালো বা পাকিস্তানই ভালো ছিল! ধিক্ এই কুলাঙ্গারদের ধিক্!”
তারপর তিনি অর্ণবের দিকে তাকিয়ে খুব স্নেহের সুরে বললেন, “তুমি এদের সঙ্গে কখনো বন্ধুত্ব করবে না। এরা তোমার বন্ধু হওয়ার যোগ্য নয়। এরা হলো ভাইরাসের মতো। এরা তোমার বিশ্বাসের ভিত্তিকে নষ্ট করে দিবে। এদের থেকে সবসময় দূরে থাকবে।”
মোসাদ্দেকসাহেব সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা আর কেউই গুরুজীকে বিরক্ত করবে না। তিনি আহারের পর বিশ্রাম নিয়ে আমাদের সঙ্গে আত্মাবিষয়ে অনেক কথা বলবেন। সেখানে আমরা মনখুলে কথা বলবো। কিন্তু এখানে আর নয়। এবার সবাই গুরুজীর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করে মন দিয়ে আহার করো।”
এরপর কেউ আর কোনো কথা বললো না। সবাই খাবার খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

শায়লা এতোক্ষণ কোনো কথাই বলেনি। সে শুধু আত্মা দুটোর নিরাপদে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। আর নিজের আশেপাশে থাকা আত্মাটার কথাও ভাবছে। তার আশপাশ থেকে আত্মাটা চলে গেলেই সে খুশি। তার এব্যাপারে বেশি কিছু জানার তেমন-একটা আগ্রহ না থাকলেও সবার কথায় সে বেশ উৎসাহ ও আনন্দ পাচ্ছে।
অর্ণব আপনমনে তার মনের ভিতরকার এতোদিনের প্রশ্নগুলো সাজিয়েগুছিয়ে নিচ্ছে। সে একমনে কী যেন ভাবছে—আর আস্তে-আস্তে খাচ্ছে। এইসময় তার কোনোদিকে খেয়াল নাই।
দুপুরের খাবার খেয়ে অধ্যাপক লিটু মিয়া বিশ্রামের কোনো সুযোগ পেলেন না। তাঁকে প্রথমে পাকড়াও করলো সাদমান। সে যেন বুদ্ধি এঁটে প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা গুরুজী, আপনি তো ত্বরীকতপন্থী মুসলমান—তবুও আপনি কি বর্তমান যুগের পীরদের বিশ্বাস করেন? আর মুসলমানদের ত্বরীকা কয়টি এবং ত্বরীকা গ্রহণ করা কি খুব জরুরি?”
অধ্যাপক লিটু মিয়া ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন, “আমি ত্বরীকতপন্থী মুসলমান। নিজের জীবনকে সঠিকপথে পরিচালনার জন্য স্বেচ্ছায় জেনেশুনে আমি এই পথ গ্রহণ করেছি। বর্তমানে আমি তেমন কোনো কামেল বা হাক্কানী পীর দেখি না। এদের মধ্যে কাউকেই আমার মুত্তাক্বীন কিংবা তাসাউফপন্থী মনে হয়নি। আর হাতেগোনা যে কয়েকজন আমলদার-পীর রয়েছেন—তাঁরা কখনো মিডিয়ার সামনে আসেন না। এঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। বর্তমানে মিডিয়াসর্বস্ব যে-সব পীর দেখছি—এরা সব দুনিয়ালোভী ও টাউট-বাটপাড়। এদের আমি সামান্যতম বিশ্বাসও করি না। বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে ছোট-বড় মিলিয়ে অনেক ত্বরীকা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের প্রধান ত্বরীকা চারটি। আর এই চারটি প্রধান ত্বরীকা হলো—চিশতিয়া, কাদেরিয়া, নকশবন্দীয়া ও মোজাদ্দেদীয়া। এই চারটি ত্বরীকা সঠিকপথে আছে। কিন্তু অনেকে এর অপব্যবহারও করতে পারে। ভারতীয় উপমহাদেশের একজন কামেল সাধক ‘নকশবন্দীয়া ও মোজাদ্দেদীয়া’ ত্বরীকা দুইটি একইসঙ্গে অনুসরণ করেছেন। তিনি এই দুইটি ত্বরীকাকে একত্রে ‘নকশবন্দীয়া-মোজাদ্দেদীয়া’ নামকরণ করেছেন। এই ত্বরীকার পথিকৃৎ হজরত মোজাদ্দেদে আলফেসানী রহ.। তিনি-সহ পরবর্তীকালে আরও অনেকে এভাবে এই দুইটি ত্বরীকা একত্রে অনুসরণ করে মহাসাধকে পরিণত হয়েছেন। এজন্য এইসব কামেল সাধক ‘নকশবন্দীয়া-মোজাদ্দেদীয়া’ ত্বরীকার ওলী। আমি এঁদের দেখানো ‘নকশবন্দীয়া-মোজাদ্দেদীয়া’ ত্বরীকার লোক। আর ত্বরীকা গ্রহণ করাটা খুব জরুরি।”
সাদমান আবার বলে, “ম্যাটিরিয়ালিস্টিক মানুষ কীভাবে আধ্যাত্মিক হতে পারে?”
অধ্যাপক লিটু মিয়া বললেন, “পারে। পারবে না কেন? মানুষের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। এই মানুষ অনেককিছু করতে পারে। মানুষকে সেই ক্ষমতা ও প্রতিভা দিয়েই সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষ হচ্ছে প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মহান স্রষ্টার রাজ্যে সৃষ্টিকুলের মধ্যেও সেরা মানুষ। তাই, এই মানুষ অনেককিছু করতে পারে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস। প্রতিটি মানুষ জন্মগতভাবে ম্যাটিরিয়ালিস্টিক। আবার কেউ-কেউ বলে থাকেন—প্রতিটি মানুষ একই সঙ্গে ম্যাটিরিয়ালিস্টিক ও স্পিরিচ্যুয়াল। কিন্তু আমি তা মনে করি না। আর এটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। তার কারণ, সবাই একইসঙ্গে ম্যাটিরিয়ালিস্টিক ও স্পিরিচ্যুয়াল হতে পারে না—এই যোগ্যতা সবার থাকে না। এই মানুষের মধ্যে শুধু কেউ-কেউ একইসঙ্গে ম্যাটিরিয়ালিস্টিক ও স্পিরিচ্যুয়াল। আসলে, সবাই আধ্যাত্মিক হতে পারে না—পারবেও না। সবার দ্বারা এটা কখনো সম্ভব নয়। মানুষ চেষ্টা করলেই আধ্যাত্মিক হতে পারে। আমাদের ধর্মে যাঁরা আধ্যাত্মিকতার প্রাণপুরুষ—তাঁরা কিন্তু সবাই শৈশবে ছিলেন সাধারণ মানুষ। তবে তাঁদের কারও-কারও মধ্যে ছোটবেলা থেকেই এই অসাধারণত্ব প্রকাশ পেয়েছিল। এখানে, আমি খুব সংক্ষেপে বলছি: মানবদেহ চারটি উপাদানের সংমিশ্রণে তৈরি। এই চারটি উপাদান হলো—আগুন, পানি, মাটি ও বাতাস। এগুলো বলছি এজন্য যে—মানুষকে একেবারে তুচ্ছ ভাববে না। মহান স্রষ্টা মানুষকে বিরাট ক্ষমতা দিয়েছেন বলেই তো মানুষ শ্রেষ্ঠ। আরেকটি কথা মনে রাখবে: যেকোনো মানুষ বা মুসলমান সাধারণ নামাজ, রোজা, হজ্জ, জাকাত ইত্যাদি দিয়ে কখনোই আধ্যাত্মিক হতে পারবেন না। এই মানুষের মধ্যে যাঁরা মোরাকাবা-মোশাহেদায় পারদর্শিতালাভ করবেন—শুধু তাঁরাই আধ্যাত্মিক মানুষে পরিণত হতে পারবেন। এই উচ্চস্তরের মোরাকাবা-মোশাহেদার মাধ্যমে যেকোনো সাধারণ মানুষ আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়। মনে রাখবে: এজন্য উচ্চস্তরের সাধনা প্রয়োজন। আর সবাই কখনো মোরাকাবার মতো উচ্চস্তরের ধ্যান করতে পারবে না। সাধারণ মানুষের ধর্মীয় জীবনযাত্রা সাধারণতঃ জিকির-আসকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।”
সাদমান যেন সবকিছু আগে থেকে প্রস্তুত করে রেখেছিল। তাই, সে আবার বললো, “গুরুজী, আমি তো মাঝে-মাঝে মেডিটেশন করি—আমার কি মোরাকাবার কোনো প্রয়োজন আছে? মোরাকাবা আর মেডিটেশন তো একই! তবে এইব্যাপারে আপনার কী অভিমত?”
সাদমানের মুখ থেকে একথা শুনে অধ্যাপকসাহেব একটু হাসলেন। তারপর বললেন, “তুমি একেবারে ভুল বলোনি। কিন্তু তোমার বক্তব্য একটু সংশোধন করতে হবে আরকি। এবার আমি বলছি শোনো: ‘মোরাকাবা’ ও ‘মেডিটেশন’ দুটি ভিন্নভাষার (আরবি ও ইংরেজি) শব্দ হলেও মূলত এদের কাজ প্রায় একই। এই হিসাবে অনেকেই মোরাকাবা ও আধুনিককালের মেডিটেশনকে এক করে ফেলেছেন। আসলে, এই দুটো প্রক্রিয়ার মধ্যে খুব একটা বা বেশি পার্থক্য না থাকলেও সূক্ষ্ণ একটুকু পার্থক্য রয়েই গেছে। আর তা হলো—বিষয়গত ও পদ্ধতিগত—এটা কীভাবে আর কীজন্য করা হবে তারউপর এই পার্থক্যটুকু নির্ভর করছে। অনেকে মনে করে থাকে: মোরাকাবা হলো—আত্মিক-সাধনা আর মেডিটেশন হলো—মনসাধনা। আমাদের জাগতিক প্রয়োজন বা বর্তমান-সমস্যা-সমাধানের জন্য হলো মেডিটেশন—আর আল্লাহকে পাওয়ার জন্য হলো মোরাকাবা-মোশাহেদা। কথাটি সত্য হলেও—এখানেও আজ একটুখানি ভুলসংশোধন করে দিতে হবে। আর তা হলো—মোরাকাবা ও মেডিটেশনের ব্যবহারের ওপরে সবকিছু নির্ভর করছে। এটাকে যে যে-ভাবে ব্যবহার করবে—সে সেভাবেই এর ফল পাবে। আমার জানামতে, বর্তমানে বহুলোক মেডিটেশনের মধ্য দিয়েও আধ্যাত্মিক শক্তিও অর্জন করছে। আবার অনেকে শুধু তার ব্যক্তিগত বা মনোজগতের সমস্যা-সমাধানের জন্যও মেডিটেশনের দ্বারস্থ হচ্ছে। চীন-জাপান-তিব্বতসহ ইউরোপের অসংখ্য শিক্ষিত মানুষজন মেডিটেশনের মধ্য দিয়ে তাদের ভাগ্যপরিবর্তন করছে—আর জীবন বদলে ফেলছে। এমনকি তারা মেডিটেশনের মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিক শক্তিও অর্জন করছে। এখানে, আমাদের সবাইকে একটা কথা সবার আগে বুঝতে হবে, জানতে হবে ও মানতে হবে—আর তা হলো—আধ্যাত্মিকতা শুধু মুসলমানদের জন্য নয়। আর এটা মুসলমানদের একচেটিয়া কোনোকিছুও নয়। এইজন্য সুপ্রাচীনকাল থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও ইহুদীসহ সবধর্মেই আধ্যাত্মিক মানুষজন খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে, আরও একটি কথা তোমাদের জ্ঞাতার্থে বলে রাখছি: পাশ্চাত্যের মেডিটেশন, হিন্দু-বৌদ্ধসম্প্রদায়ের ধ্যান ও মুসলমানদের মোরাকাবার আদর্শগত পার্থক্য থাকলেও এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রকারন্তরে প্রায় এক ও অভিন্ন। সাম্প্রতিককালে এশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তরুণ-তরুণীদের অনেকেই নিজেদের মনোজগতের সমস্যা-সমাধানের জন্য মেডিটেশনে লিপ্ত হচ্ছে। কিন্তু অসংখ্য মানুষ আবার নিজের রুহানীশক্তিবৃদ্ধির জন্যও আধুনিক মেডিটেশনের পথ বেছে নিয়েছে। তারা সফলও হচ্ছে।”

সাদমান এবার বেশ ভক্তিসহকারে বললো, “গুরুজী, মোরাকাবা কেন করা হয়? আর মোরাকাবা দিয়ে কি আসলে কোনো কাজ হয়?”

অধ্যাপক লিটু মিয়া একটুও অধৈর্য হচ্ছেন না। তিনি আগের মতো বেশ শান্তভাবে সাদমানের প্রশ্নের জবাবে বলতে লাগলেন, “আমার মোরাকাবাবিষয়ক আগের কথাগুলোর মধ্যেও কিন্তু এর উত্তর প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে। তবুও আমি তোমাকে এব্যাপারে সরাসরি বলছি: মেডিটেশন যেমন সবধর্মের সবাই করতে পারে—মোরাকাবা তেমনি সবাই করতে পারে না। আর তা করেও না। সব মুসলমান মোরাকাবা করে না। মুসলমানদের মধ্যে শুধু উচ্চস্তরের মুত্তাক্বীন ও তাসাউফপন্থীরাই এই মহৎকাজটি করে থাকেন। মোরাকাবা-পদ্ধতিটা শুধু মুসলমানদের নিজস্ব একটা সাধনাপদ্ধতি। এখানে, যারাই মোরাকাবায় লিপ্ত হন—বুঝতে হবে—তিনি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য—আর তাঁকে পাওয়ার জন্যই এমনটি করছেন। মোরাকাবার অনেক শক্তি রয়েছে। এর মাধ্যমে জিকিরে মশগুল হলে তা উচ্চস্তরের ইবাদতে পরিণত হয়। ক্বলব-পরিষ্কারের জন্য লতিফার সাধনাও ‘মোরাকাবা’র ধ্যানে করতে হয়। আর মোরাকাবা এমন-একটা শক্তিশালী ব্যবস্থা যে—এর মাধ্যমে ফেরেশতা-জ্বীন থেকে শুরু করে স্বয়ং স্রষ্টাকেও দেখা সম্ভব।”
সাদমান হেসে বলে, “বিজ্ঞানের মধ্যে কোনোপ্রকার গোঁজামিল নাই। কিন্তু ধর্মের ভিতরে অনেক গোঁজামিল রয়েছে। এব্যাপারে আপনি কী বলবেন, গুরুজী?”
অধ্যাপক লিটু মিয়াও হেসে বললেন, “ভাই, বিজ্ঞানেও গোঁজামিল আছে। এসব কথার প্রমাণ দিবো। আমি তোমার আরও কিছু প্রশ্ন শুনে তারপর একবারে উত্তর দিবো। আর ধর্মে কোনো গণ্ডগোল বা গোঁজামিল ছিল না—মানুষই এসব সৃষ্টি করেছে।”

তারপর সাদমান হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, “গুরুজী, আপনি আত্মাবিশ্বাস করতে বলেন—কিন্তু আত্মা কেন দেখা যায় না? আর যা দেখা যায় না—তা কি সত্য? তা কি বিশ্বাস করা যায়?”

অধ্যাপক লিটু মিয়া এবার ধীরেসুস্থে বলতে লাগলেন:

“পৃথিবীর সবকিছু কি দেখা যায়? যায় না। আবার এমন অনেক জিনিসও আছে—যা কখনো খালি চোখে দেখা যায় না। এজন্য প্রয়োজন হয় নিদেনপক্ষে মাইক্রোস্কোপ কিংবা দূরের জন্য টেলিস্কোপ। পৃথিবীতে এমন আরও অনেককিছু আছে—যা টেলিস্কোপেও ধরা পড়ে না—কিন্তু রুহানীচোখে ধরা পড়ে—দেখা যায়। পৃথিবীতে কতরকম ভাইরাস বা মৌলউপাদান আছে—যা কখনো খালি চোখে দেখা যায় না। আত্মাও তেমনি দেখা যায় না। ধরা যায় না—আর তা ছোঁওয়াও যায় না। ধর্মের অনেক বিষয় ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ, আমরা সবকিছু জানি না। আর জানবার মতো শক্তি, সাধ্য ও সামর্থ্যও আমাদের নাই। এক্ষেত্রে, আমাদের চুপ থাকতে হবে। এসব ব্যাপারে নিজেদের মনগড়া কোনো কথা না বলাই ভালো। এমনকি বিজ্ঞানেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিজ্ঞানীরা এতো প্রচেষ্টার পরও আজ পর্যন্ত পৃথিবী ব্যতীত অন্য কোনো গ্রহে তাদের গবেষণার দ্বারা প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। তারা অন্য কোনো গ্রহে বা উপগ্রহেও যেতে পারেনি। এখানে, অনেকে হয়তো বলতে পারে—মানুষ তো চাঁদে গিয়েছে! আসলে, এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন আর অপপ্রচার। এর পিছনে একটি দেশের রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বলাভের ষড়যন্ত্র রয়েছে। ঘটনাটি আমি খুলে বলছি: আমরা ছোটবেলায় পড়েছি—আমাদের জোর করে পড়ানো হয়েছিল—মানুষ চাঁদে গিয়েছে! ১৯৬৯ সালের ১৬ই জুলাই নাকি এই চন্দ্রঅভিযান শুরু হয়েছিল! আর ১৯৬৯ সালের জুলাই-মাসের ২০ তারিখেই নাকি তিন মার্কিন নভোচারী—নীল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিন্স ও এডুইন অলড্রিন চাঁদে গিয়েছিল! আর দুই নভোচারী নাকি চাঁদের বুকে পা-ও রেখেছিল! যা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। তার কারণ, মার্কিনীরা যদি ১৯৬৯ সালে চাঁদে তিনজন নভোচারীকে পাঠাতে পারতো—তাহলে, এতোদিনে তারা চাঁদটা দখল করে তাতে নিজেদের বসতিস্থাপন করতে সক্ষম হতো। তোমরা বিশ্বাস করতে পারো—১৯৬৯ সালে তিনজন চাঁদে গিয়েছিল! কিন্তু এখন তারা চুপচাপ বসে রয়েছে কেন? আসলে, এর পিছনে একটি দারুণ ও করুণ ইতিহাস আছে। এবার তা আমি বলছি: তোমরা মন দিয়ে শোনো। পৃথিবীর ইতিহাসে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা আজকের রাশিয়া নামক দেশটি সর্বপ্রথম মহাশূন্যে নভোযান পাঠায়। ১৯৬১ সালের ১২ই এপ্রিল ভস্টক-১ নামক একটি নভোযানে চড়ে তাদের নভোচারী ইউরি গ্যাগারিন পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেন। তিনিই হলেন পৃথিবীর প্রথম নভোচারী—যিনি মহাশূন্যে ভ্রমণ করেন। এরপর রাশিয়া ভস্টক-৬ নামের আর-একটি নভোযানে করে পৃথিবীর প্রথম মহিলা নভোচারী ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভাকে মহাশূন্যে পাঠায়। তিনি ১৯৬৩ সালের ১৬ই জুন তারিখে মহাশূন্যে পরিভ্রমণ করেন। এই খবর প্রচারিত হওয়ার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নড়েচড়ে বসে। তারা এইসময় রাশিয়াকে টেক্কা দেওয়ার জন্য পাল্টা একটা বড়সড় কোনোকিছু করার দুরভিসন্ধি করতে থাকে। তারা বেশ কয়েক বছর সময় নিয়ে অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২০-এ জুলাই চাঁদে যাওয়ার নাটক মঞ্চস্থ করে। মানুষ আজ পর্যন্ত চাঁদে যেতে পারেনি। শুনেছি, বিজ্ঞানীরা মঙ্গলে নভোযান পাঠিয়েছেন। সেখানে তাঁদের গবেষণা চলছে। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো মানুষ এখনও পর্যন্ত চাঁদে যেতে পারেনি। আরে, পারলে কি মানুষ এখানে বসে নানারকম কথা বলে! অতিসম্প্রতি কেপলার-২২ নামের একটি গ্রহ আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। এটি নাকি অনেক সুন্দর একটি গ্রহ! মনোমুগ্ধকর জায়গা! এখানকার তাপমাত্রা সবসময় ২০-২২ ডিগ্রী সেলসিয়াস মাত্র। অর্থাৎ, এটি একহিসাবে চিরবসন্তের দেশ। কিন্তু এখানে যেতে মানুষের সময়ের প্রয়োজন হবে ৬০০ আলোকবর্ষ! ৬০০ বছর নয়—৬০০ আলোকবছর! এবার তাহলে বুঝতে পারছো, মহাশূন্যের কতকিছু এখনও বিজ্ঞানীদের অজানা রয়েছে। আর আমরা তো এব্যাপারে একেবারে শিশু! ৬০০ আলোকবর্ষ সময় কে পাবে? আর কে যাবে সেই কেপলার-২২ নামক চিরবসন্তের ও অনেক সুন্দর গ্রহে? পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারা সবকিছু দেখতে পারে না—আর সবকিছু আমাদের দেখাতেও পারে না। সেই হিসাবে আমাদের যে কাউকে আত্মা দেখায়ে তাকে মুসলমান বানাতে হবে—তার কোনো দায় পড়েনি। অনেককিছু আমরা সহজে বা খালি চোখে দেখি না—তবুও তা বিশ্বাস করি। যেমন; বাতাস দেখা যায় না—কিন্তু তা অনুভব করা যায়। গরম, ঠাণ্ডা বা শীত দেখা যায় না—কিন্তু তাও অনুভব করা যায়। এভাবে, আমাদের শরীরের কোনো ব্যথা, বেদনা, যন্ত্রণাও কখনো দেখা যায় না—কিন্তু তা খুব সহজে অনুভব করা যায়—আর তা আছে। আত্মাও তেমনি একটা বিষয় যা সবসময় হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়—কিন্তু কখনো তা দেখা যায় না। আর কেউ যদি তার অন্তর-চক্ষুকে জাগ্রত করতে পারে—তাহলে, সে সবকিছু দেখতে পারবে।”
সাদমান হঠাৎ বলে উঠলো, “চাঁদে তো মানুষ গিয়েছে! কিন্তু আপনি কেন বলেছেন—মানুষ চাঁদে যায়নি? গুরুজী, তার কি কোনো কারণ আছে?”
অধ্যাপকসাহেব হেসে বললেন, “আছে। অনেক কারণ আছে। এখানে, খুব সংক্ষেপে আমি শুধু বলছি: চাঁদে যাওয়ার অভিযানে চাঁদের যে-ছবি আমাদের দেওয়া বা দেখানো হয়েছে—তা চাঁদের মতো নয় কেন? চাঁদের আকাশে কেন তারা নাই? একটা তারাও দেখা যায়নি! তার কারণ কী? চাঁদে তো বাতাস নাই—কিন্তু বাতাসহীন পরিবেশে মার্কিনীদের পতাকাটা পত-পত করে উড়লো কীভাবে? মার্কিনীদের পতাকা সেখানে একেবারে টান-অবস্থায় দেখা গেছে! এটার জন্য প্রয়োজন বাতাস। কিন্তু চাঁদে বাতাস কোথায়? সবাই জানে—চাঁদে কোনো অক্সিজেন নাই। চাঁদে গিয়ে নভোচারীরা যে পায়ের ছাপ পেয়েছে বা আমাদের যা দেখিয়েছে তা নকল! আর সেগুলো কোনো মানুষের বা এইজাতীয় কোনো প্রাণিরও নয়। কারণ, চাঁদে এইরকম কোনো প্রাণি নাই। তাহলে, এই উদ্ভট পায়ের ছাপ এলো কোত্থেকে? পৃথিবীকে ঘিরে চাঁদে পৌঁছানোর আগমুহূর্তে কোনো-একটা জায়গায় যে-ধরনের মারাত্মক তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা রয়েছে তাতে তো অ্যাপোলো-১১ এর ক্রুসহ তিন নভোচারীর মারা যাওয়ার কথা! তারা জীবিত অবস্থায় পৃথিবীতে ফিরলো কীভাবে? তাছাড়া, মার্কিন মহাকাশ গবেষণাসংস্থা ‘নাসা’র তখন এতোটা সামর্থ্য ছিল না—তারা কীভাবে অ্যাপোলো-১১ এর লুনার মডিউল চাঁদে পাঠাবে? আমার সর্বশেষ কথা হলো: মার্কিনীদের চাঁদে যাওয়া সংক্রান্ত ধাপ্পাবাজির বিরুদ্ধে একটা সাড়াজাগানো বই লিখেছেন সাংবাদিক বিল কেসিং। তাঁর এই বইয়ের নাম ‘উই নেভার ওয়েন্ট টু মুন: আমেরিকাস থার্টি বিলিয়ন ডলার সুইন্ডল’। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। চাঁদে যাওয়ার এই ধাপ্পাবাজি এখনও অনেকে বিশ্বাস করে—কিন্তু আত্মার কথা বললেই তারা নানারকম প্রমাণ ও ভিডিও চায়! যাই হোক, প্রশ্নগুলোর জবাব যদি তুমি দিতে পারো—তাহলে, আমি চাঁদে যাওয়া বা না-যাওয়ার ব্যাপারে নিজের বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিবো।”
সাদমান হতাশ হয়ে সোফার ওপর চুপচাপ বসে থাকে। তার কাছে চাঁদে যাওয়ার ব্যাপারে অকাট্য কোনো প্রমাণ বা দলিল-দস্তাবেজ নাই। সে অন্যমনস্ক হয়ে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবতে থাকে। শেষে মনখারাপ করে বলে, “গুরুজী, পরে আমি এই বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখবো। এখন আপনার মূলবক্তব্য শুরু করুন।”
অর্ণব এতোক্ষণ একটা কথা বলারও সুযোগ পায়নি। সে মনে মনে সাদমানের ওপর ভীষণ রেগে আছে। তবে সে পরে তার প্রশ্নগুলো করার চিন্তাভাবনা করতে লাগলো।
মোসাদ্দেকসাহেব এতোক্ষণ সবকিছু শুনছিলেন আর দেখছিলেন। এবার তিনি সবিনয়ে সোফাছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “গুরুজী, এবার আপনি আত্মাবিষয়ে কিছু বলবেন। আর অনেকে বলে থাকে: আত্মা বলে কিছু নাই—সেই বিষয়েও আপনি একটা ব্যাখ্যা দিবেন। আপনার কাছে এইটা আমার বিশেষ অনুরোধ রইলো।”
ইতোমধ্যে বৈকালিক নাশতা ও চা নিয়ে এলেন রাশিদা বানু। তাকে সাহায্য করছে মালেকা। এবার তারাও আসরে বসে পড়লো।
চা-পান করতে-করতে শায়লা একসময় বললো, “গুরুজী, আমার একটা অনুরোধ—রাত্রি হওয়ার আগেই আপনি যত আত্মা দেখেছেন তার থেকে কিছু আমাদের বলুন—আমরা শুনি। এগুলো শুনতে আমার ভালো লাগে। পরে রাত হয়ে গেলে শুনতে ভয় লাগবে।”—কথাটা বলে সে হেসে ফেললো।
অধ্যাপক লিটু মিয়া চা-পান শেষে মোসাদ্দেকসাহেবের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, “তাহলে, আত্মার ইতিহাস পরে বলি?”
কথাটা শোনামাত্র তিনি যেন লাফিয়ে উঠে বললেন, “জ্বি, গুরুজী, তা-ই হবে। আপনি আমার আম্মাজানকেই আগে সন্তুষ্ট করুন।”
অর্ণবও যেন মনে মনে ঠিক এটাই চাইছিল। সে তার আপুনির দিকে তাকিয়ে মনে মনে তাকে ধন্যবাদ জানালো। এসব শুনতে তারও খুব ভালো লাগে।
অধ্যাপক লিটু মিয়া সোফার ওপরে খুব আরাম করে বসে বলতে লাগলেন:
“তখন আমি খুব বাউণ্ডুলে প্রকৃতির একজন মানুষ ছিলাম। আর তখন বয়সটাও আমার একেবারে কম ছিল। কলেজে ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার প্রতি আমার আগ্রহ একদম ছিল না। তখন দিনের বেশিরভাগ সময় বইপড়ে আর নয়তো বিভিন্নরকমের সিনেমা দেখে কাটাতাম। বই পড়লে ডিটেকটিভ, থ্রিলার, সাসপেন্স আর নয়তো উন্নতমানের ভূতের বই (যদিও আমি এগুলোকে ভূত মনে করতাম না) পড়তাম। বড়-বড় লেখকদের সাহিত্যও তখন গোগ্রাসে গিলতাম। তখন আমি সাধারণ লোকদের মতো ভূতপ্রেত বলে কোনোকিছুকে বিশ্বাস করতাম না। এইসময় আমি আত্মাকে বিশ্বাস করতে থাকি। সেই সময় আমার বাবার মুখে প্রথম শুনি, ‘আত্মা অমর। আত্মা কখনো মরে না। আর কোনো-কোনো আত্মা নাকি পৃথিবীতেই রয়ে যায়।’ আর এদের নিয়েই রচিত হয় নানান গল্প-উপাখ্যান।
সেই সময় আমার জীবনটা চলতো নিজের ইচ্ছেমতো। তবে পারিবারিক শৃঙ্খলা যে মানতাম না—তা নয়। একবার মায়ের সঙ্গে আমরা দুই ভাই গ্রামে গেলাম। আমরা মূলত ঢাকা-শহরেই থাকতাম। বছরে কখনো-কখনো একবার মায়ের সঙ্গে গ্রামে যাওয়ার সুযোগ হতো। গ্রামে যাওয়ার পর একদিন আমার ছোটভাইকে নিয়ে মা গেলেন নানার বাড়িতে। আর আমি রয়ে গেলাম দাদার বাড়িতে। সেখানে, আগে থেকে আমার এক বিধবা ফুপু থাকতেন। আমার মা তাঁর কাছেই আমাকে রেখে গেলেন। কিন্তু তিনি খাওয়াদাওয়া করতেন যৎসামান্য। এজন্য মা নানার বাড়িতে যাওয়ার সময় আমাদের পাশের বাড়ির শরীকআত্মীয় এক দাদিকে বলে গেলেন আমার কথা। তিনি মাকে বললেন, ‘তুমি কোনো চিন্তা কোরো না বউ। তোমার ছেলেকে খাইয়েদাইয়ে আমি দেখেশুনে রাখবো।’ তখন আমি কলেজে পড়লেও এঁদের কাছে একেবারে শিশুর মতো। দাদার বাড়িতে সারাদিন আমি একাকী যত্রতত্র ঘোরাফেরা করে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। দুপুরও হয়ে গেল। ক্ষুধাও লেগেছে। বৃদ্ধ ফুপুআম্মা মাটির হাঁড়ি থেকে কিছু ছাতু ও মুড়ি বের করে খেয়ে নিলেন। তাঁর দুপুরের খাওয়া হয়ে গেল! আমাকেও তিনি এসব খেতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি খাইনি। আমার একটা দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে, পাশের বাড়ির দাদিজান কিছু-একটা পাঠাবেন। আমাকে আশায় বুকবেঁধে খুব একটা বেশি সময় বসে থাকতে হয়নি। আমি গোসল করে আসার পর আমার মাথার ভেজা চুল শুকানোর আগেই দেখি পাশের বাড়ির সেই দাদির মেয়ের ঘরের এক নাতনি (ওর নাম এখনও মনে আছে—মলি) আমার জন্য খাবার নিয়ে আসছে। মলি খুব হাসতে-হাসতে বড় একটা ডিশে করে খাবার নিয়ে এলো। সে আমার সমবয়সী। আগেও যখন গ্রামে আসতাম—তখনও ওর সঙ্গে দেখা হতো। ও খুব হাসিখুশি একটা মেয়ে ছিল! সে আমাদের ঘরের একটা চৌকির ওপর খাবার রেখে দিয়ে বললো, ‘মিয়াসাহেব, খাবার তাড়াতাড়ি খেয়ো! নইলে, খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।’ তারপর সে ‘যাই’ বলে আবার হাসতে-হাসতে চলে গেল! দুপুরে পেটপুরে খাবার খেয়ে বিকালের দিকে সেই দাদির বাড়িতে গেলাম একটু হাসিঠাট্টা করতে। এমন সময় দাদিজান খুব ব্যতিব্যস্ত হয়ে আমার কাছে এসে মুখভার করে বললেন, ‘দুপুরে কিছু খেয়েছো, ভাই?’ তারপর তিনি আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বললেন, ‘তোমার জন্য দুপুরের খাবার রেখেছিলাম—কিন্তু তা পাঠানোর মতো কোনো লোক পাচ্ছিলাম না বলে তা পাঠাতে পারিনি। পরে আমি গোসল শেষ করে ঘরে এসে দেখি সেই খাবার কে যেন খেয়ে ফেলেছে! আর ডিশটাও খালি!’ ভাবলাম, দাদি-মানুষ তাই হয়তো আমার সঙ্গে তিনি রসিকতা করছেন! আমি বললাম, কেন সেই খাবার তো আমি খেয়েছি। আপনি মলিকে দিয়ে আমার জন্য কিছুক্ষণ আগে খাবার পাঠাননি? তিনি যেন চমকে উঠে বললেন, ‘কী বললে! মলি! মলি আসবে কেমন করে! সে তো...।’ তারপর তিনি চুপ হয়ে গেলেন। আমি বললাম হ্যাঁ, কিছুক্ষণ আগে মলিই তো আমার খাবার নিয়ে এসেছিল। দাদিজান আমার হাতধরে আমাকে একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘ভাইরে, মলির সাথে তোমার খুব খাতির ছিল—তাই, হয়তো তুমি আমার সঙ্গে এখন দুষ্টুমি করছো। কিন্তু তোমরা তো জানো না—মাস তিনেক আগে মলি পুকুরে ডুবে মারা গেছে। বোনটি আমার সাঁতার জানতো না। তাই, সবার অগোচরে দিনদুপুরে পানিতে ডুবে মারা গেল!’ কথাগুলো বলে তিনি কাঁদতে লাগলেন। তারপর তিনি আমাকে বললেন, ‘তোমার রাতের খাবার আমি নিজে দিয়ে আসবো। কিন্তু আজ দুপুরে তোমার কিছুই খাওয়া হলো না!’ বলে তিনি খুব আফসোস করতে লাগলেন। এরপর তিনি চলে গেলেন অন্য কাজে। কিন্তু তাঁকে আমি কীভাবে বোঝাবো যে, সত্যি-সত্যি মলি এসেছিল আমাদের ঘরে—আর সে আমার জন্য আজ দুপুরে খাবার নিয়েও এসেছিল। তখনকার দিনে এখনকার মতো মোবাইলফোনের কোনো ব্যবহার ছিল না। আর তখন টেলিফোন-ব্যবহারেও এতো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। তাই, মলির মৃত্যুখবর আমরা সময়মতো জানতে পারিনি। কিন্তু মলিকে আমি দেখেছিলাম! আর সেটা আমার সচেতন মনে কিংবা অবচেতন মনে—যেকোনোভাবেই হতে পারে। কিন্তু আমি তো তখন একেবারে সজ্ঞানে আর সচেতন ছিলাম! আমি এখনও সেই অভাবনীয় দৃশ্য মন থেকে মুছে ফেলতে কিংবা ভুলতে পারি না।”
সবাই যেন এতোক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর অবিশ্বাস্য-সত্য কথাগুলো শুনছিল। আর সবাই যে তাঁর কথাগুলো পুরাপুরি বিশ্বাস করেছে—তাতে কোনো সন্দেহ নাই। এতোবড় ড্রইংরুমটাতে তখন একেবারে পীনপতন-নিস্তব্ধতা! কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নাই!
এই নীরবতা ভঙ্গ করলো শায়লা। সে খুব আবেগভরে বললো, “তারপর কী হলো?”
অধ্যাপকসাহেব হেসে বললেন, “তারপর মানে? রাতের খাবার কে দিয়েছিল?”
শায়লা একটু হেসে বললো, “জ্বি, হ্যাঁ।”
অধ্যাপক লিটু মিয়া বললেন, “রাতের খাবার দাদিজান নিয়ে এসেছিলেন। সে হয়তো আসতো। কিন্তু তার আগমনের কথা আমি দাদিজানকে বলে দেওয়ায় সে আর আসেনি। আমি ইনডাইরেক্টভাবে আমার ফুপুআম্মাকে এই কথাটা বলায়—তিনি বললেন—এসব কারও কাছে বললে বা প্রকাশ করলে আত্মারা আর ধরা দিতে চায় না। তবুও তাকে আমি আরেকবার দেখেছিলাম! পরদিন আমি গ্রামের স্কুল-মাঠে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম—আর খুব অন্যমনস্ক ছিলাম। হঠাৎ আমার সেই দাদিজানের বাড়ির কাছে এসে দেখি—তাদের বড় বরইগাছটার নিচে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে! একেবারে জীবন্ত সে! আর আমাকে দেখে সে আগের মতো হাসছিল! আমি সবকিছু ভুলে ওর কাছে হয়তো এগিয়ে যেতাম। কিন্তু এমন সময় আমার দাদাজান গলাখাঁকরি দিয়ে বাড়ির কোনো কাজের লোককে হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘এই গোরুগুলো ভালোমতো বেঁধে রাখ তো!’ একথা শোনার পর সে যেন চোখের পলকে বাতাসের মতো কোথায় মিলিয়ে গেল! আর আমি দ্রুত হেঁটে বাড়ি ফিরে এলাম। সেদিন আমি একটু ভয় পেয়েছিলাম। তাই, রাতে আর ঘরের বাইরে বের হইনি। এরপর বহুদিন আর গ্রামে যাইনি। দেখা হয়নি মলির সঙ্গে!”
শায়লা এবার খুব আগ্রহের সঙ্গে বললো, “গুরুজী, প্লিজ, আরেকটি ঘটনা বলুন না! আপনার মুখ থেকে আজ আমার এসব শুনতে খুব ইচ্ছে করছে।”
ওর কথা শুনে অধ্যাপক লিটু মিয়া রুমে উপবিষ্ট সকলের মুখের দিকে একবার করে তাকালেন। তারপর তিনি বললেন, “একটি ভয়ংকর ঘটনা আছে—তোমরা শুনে আবার ভয়টয় পাবে না তো?”


(চলবে)


সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
রচনাকাল: ১৬/১২/২০১৯
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৩৮১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২১/১২/২০১৯

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast