www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গল্প--আমাদের মা

গল্প--আমাদের মা
সাইয়িদ রফিকুল হক

আশফাক সকালে খুব তাড়াহুড়া করে অফিসে যাচ্ছিল।
সে প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে। এখানে, পান থেকে চুন খসার কোনো সুযোগ নাই। সামান্য একটু বিলম্ব হলেও বড়সাহেব মুখভার করেন। আর কারও এরকম পর-পর দুইদিন হলে তিনি তাকে তার কক্ষে ডেকে রীতিমতো অফিসিয়াল ‘ল’ বুঝাতে থাকেন। এসব কথা ভেবে আশফাক আজকাল সকালে ঠিকভাবে খেতেও পারে না। কোনোরকমে দুটো রুটি পেটে পুরে সে অফিসের দিকে ছুটতে থাকে।
আজও সে তাড়াতাড়ি খাচ্ছিল। খাওয়ার ফাঁকে-ফাঁকে সে বিছানায় শোয়া তাদের একমাত্র মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছিল।
তাদের একমাত্র মেয়েটি এখনও ঘুমাচ্ছে দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। নইলে তিন বছরের মেয়েটি জেগে উঠলে আশফাকের অফিসে পৌঁছুতে আরও বিলম্ব হবে।
আশফাক কোনো কথা বলছিল না দেখে তাহমিনা ওর সামনের চেয়ারটা টেনে বসলো। তারপর একটু সময় নিয়ে বললো, “তুমি কি তাহলে আজই তোমার মাকে আনতে গ্রামে যাবে?”
‘তোমার মা’ কথাটা শুনে আশফাক প্রথমে কিছুটা রাগান্বিত হলো। পরে সে নিজেকে সংযত করে বললো, “হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছো। আর একথা তো আমি তোমাকে গতরাতেই বলেছি। এটা নিয়ে নতুন করে এখন কথা বলার আর কী আছে?”
কথাটা শেষ করে সে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
তাহমিনা কয়েক মিনিট সময় নিয়ে বললো, “উনি গ্রামের মানুষ গ্রামেই থাকুক। উনাকে এখানে টেনে আনার কোনো প্রয়োজন আছে কী?”
আশফাক এতে খুব রাগান্বিত হলেও নিজের রাগটা ষোলোআনা সামলে নিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বললো, “প্রয়োজন আছে মানে? একশ’বার প্রয়োজন আছে। মাস চারেক হলো আমাদের বাবা মারা গিয়েছেন। এখন মা সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়েছেন। আমরা দুই ভাই-ই শহরে থাকি। তাছাড়া, আমি মায়ের বড় সন্তান। আমার দায়িত্ববোধটা একটু বেশি হওয়া উচিত। ছোটভাইটা ওর ওখানে মাকে নিতে চেয়েছিল। আমি নিতে দেইনি। কারণ, ওরা দুজনেই চাকরি করে। সারাদিন ওদের বাসায় মা একা-একা থেকে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তারচেয়ে আমাদের বাসাটা মায়ের জন্য অনেক সুবিধার। এখানে, তুমি সারাদিন বাসায় থাকো। আর অফিসছুটির পরে আমি তো আছিই। তারউপরে আমাদের কন্যা আতিয়া মাকে ব্যস্ত রাখতে পারবে। এতে মারও ভালো লাগবে। তাছাড়া, মা ঢাকায় এলে তিনি মাঝে-মাঝে ছোটভাইটার ওখানেও যেতে পারবেন।”
সে একটু থেমে তাহমিনার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, “এতে তো তোমার খুশি হওয়ারই কথা। একটা মানুষ কাছে থাকলে আমাদের কত লাভ! কত উপকার! আর সবচেয়ে বড় কথা—তিনি আমার মা। এখন আমাদের মা। তোমারও তো তিনি মা হন। অথচ, তুমি মাকে আগের মতো এই সাতসকালে ‘তোমার মা’ বলে উল্লেখ করলে! এতে আমি ভীষণভাবে লজ্জিত হয়েছি।”
আশফাকের শেষের কথাটায় তাহমিনা যেন জ্বলে ওঠে। সে ভয়ানক রেগে বললো, “তুমি তোমার মাকে আনতে গ্রামে যাবে না। আমি উনার সঙ্গে একসাথে থাকতে পারবো না। উনি এলে আমি এই বাসা ছেড়ে চলে যাবো। তোমার মায়ের সঙ্গে আমার এডজাস্টমেন্ট হয় না।”
আশফাক এত উত্তেজনার মধ্যেও নিজের মাথাটা ঠাণ্ডা রেখে খুব শান্তকণ্ঠে বললো, “বেশ তো, তুমি না থাকলে না থাকবে। তাতে এমনকিছু আসে যায় না। কিন্তু আমার মা আমার বাসায় আমার সঙ্গেই থাকবেন। তার কারণ, আমি মায়ের সন্তান। মা আমাকে পেটে ধরেছেন। মাকে আমার বুকে ঠাঁই দিতেই হবে। আর তুমি মায়ের সঙ্গে থাকতে পারো না—এটা তোমার ব্যর্থতা । এতে আমাদের মায়ের কোনো দোষ দেখি না। তিনি তোমাকে কত স্নেহ করেন! কত ভালোবাসেন! তবুও তোমার এত আপত্তি কীসের? আসলে, তোমাদের মতো মেয়েরা আজকাল মানসিক রোগে ভুগছে। তাই, নিজেদের স্বার্থের বাইরে তারা আর কোনোকিছু ভাবতে পারছে না।”

এরপর আশফাক খাবার শেষ করে উঠে পড়লো। সে গেইট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তাহমিনার উদ্দেশ্যে বললো, “আমার ফিরতে একদিন দেরি হতে পারে। তুমি আজই আম্মাকে এখানে আসতে বলো। একা বাসায় তোমাদের সমস্যা হতে পারে।”
সদর দরজা বন্ধ করে তাহমিনা কিছুক্ষণ গুম হয়ে সেখানেই বসে থাকে। তার চেহারাটা এসময় খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। আসলে, সে খুব অল্পে রেগে যায়। সেই স্কুলজীবন থেকে তার এমনটি হচ্ছে।

আশফাক ঠিক সময়ে আজ অফিসে পৌঁছুতে পেরেছে। অফিসে ঢুকেই সে বড়সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করলো। আজকে আধাবেলা অফিস করাসহ সে একদিনের ছুটি চেয়ে নিলো। তার কাজেকর্মে খুশি বলে বড়সাহেব এতে আপত্তি করলেন না।

আশফাক আগে থেকে তার মাকে কিছুই জানালো না। সে একেবারে কাছে গিয়ে মাকে চমকে দিতে চায়। তার মা খুব চাপাস্বভাবের মানুষ। শত দুঃখকষ্টেও তিনি সন্তানদের জড়াতে চান না। গ্রামে যে তিনি ভালো নাই—তা আশফাক অনুমানে বুঝতে পারে। তাই, সে মাকে তার নিজের কাছে এনে রাখতে চায়।

দুপুরের লাঞ্চটা কোনোরকমে সেরে আশফাক সিরাজগঞ্জের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। এখন তার মনে দারুণ আনন্দ। প্রায় মাস তিনেক হলো মায়ের সঙ্গে তার দেখা হয় না। বাবার চেহলামের পর সে আর গ্রামে যায়নি। মাকে তখন সে কিছুটা অসুস্থ দেখে এসেছিল। প্রতিদিন সে ফোনে মায়ের খোঁজখবর রেখেছে। তবুও সে মনে করে, মায়ের সঠিক খবর সে পাচ্ছে না। কারণ, মাকে ফোন করলেই তিনি বলতেন, ‘আমি খুব ভালো আছি বাবা। তোমরা ভালো থেকো।’ অফিসের ছুটি ম্যানেজ করতে না পারায় আজ যাই কাল যাই করে সে বড় বিলম্ব করে ফেলেছে। একসময় সে দারুণ অনুশোচনায় ভুগতে থাকে।

সন্ধ্যার অনেক পরে সে গ্রামে পৌঁছুল।
গ্রামে বিদ্যুৎ আছে। তবুও সে দেখলো, মায়ের ঘরে একটা টিমটিমে বাতি জ্বলছে। সে বুঝলো, পল্লীবিদ্যুৎ আগের মতোই ভেল্কি দেখাচ্ছে। এদের আসা-যাওয়ার কোনো টাইম-টেবিল নাই। এরা খুব স্বাধীন আর দারুণ স্বেচ্ছাচারী।
সে ঘরের দরজার কড়া নাড়তেই ভিতর থেকে তার মায়ের গলার আওয়াজ পেল। সে শৈশবের দুরন্ত কিশোরের মতো বলে উঠলো, “তাড়াতাড়ি দরজা খোলো মা। আমি তোমার আশফাক।”
দরজা খুলতেই আশফাক মাকে জড়িয়ে ধরলো। তার চোখে প্রায় জল। কিন্তু মা হেসে বললেন, “কী যে আনন্দ হচ্ছে আমার! একটা খবর তো দিতে পারতিস বাবা। আজ সকালেও তো তোর সঙ্গে কথা বললাম। তবুও কিছু জানতে দিলি না!”
আশফাক সত্যটা গোপন করে বললো, “হঠাৎ এসে পড়লাম মা। তাই, আগে থেকে তোমাকে কিছুই জানাইনি।”
মায়ের হাসি দেখে আশফাকের মন ভরে গেল।
এতদিন পর এ-বাড়িতে হঠাৎ বেশি আওয়াজ শুনে পাশের বাড়ির চাচি ছুটে এলেন। তিনিও আশফাককে দেখে খুব খুশি হলেন। আরও কয়েকজন এলেন পরে।
আশফাক দেরি না করে সবার সামনে বললো, “চাচি, মাকে নিতে এসেছি। এখন থেকে মা আমার সঙ্গে ঢাকায় থাকবে। মাঝে-মাঝে বাবার কবর জিয়ারত করার জন্য আমরা আসবো।”
ছেলের কথা শুনে রাবেয়া বেগম আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। পাড়াপড়শিরা বললেন, “খুব ভালো হয়েছে বাবা। এই তো চাই। তুমি ছেলের মতো কাজ করলে বাবা। আমরা একজন কথা কওয়ার মানুষ হারালেও বুবু’র সুখের কথা ভেবে আমরাও খুশি।”
রাবেয়া বেগম বড়মুখ করে বললেন, “আমার বড় বৌমা কত ভালো। আমাকে নিতে আশফাককে পাঠিয়েছে। হবে না! বৌমা আমার কত শিক্ষিত! এমএ পাস যে!”
এসময় আশফাক ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকার-আকাশের তারাগুলো দেখতে থাকে।

ঢাকায় ফিরে আশফাক দেখলো, তাহমিনা রাগ করে বাবার বাড়ি চলে যায়নি। তার শাশুড়ি গতকালই এসেছেন। সে তাকে দেখে খুশি হলো। সালাম দিলো ভক্তিসহকারে।
এমন সময় তাহমিনা স্বামীর হাত ধরে তাকে নিজেদের শোবার ঘরে নিয়ে খুব বিনীতভাবে বললো, “আমার মাকে এখানে কিছুদিন রাখতে চাই। বড়ভাবি, মেজভাবি, ছোটভাবি মায়ের সঙ্গে আজকাল খুব খারাপ ব্যবহার করে।” কথাটা শেষ করতেই ওর চোখে পানি চলে এলো।

আশফাক একটু হেসে তাহমিনার চিবুক ছুঁয়ে বললো, “তোমার মা আমার মা—এসব কী? আজ থেকে ভালোবেসে বলবে: আমাদের মা। উনারা দুজনেই আমাদের মা। আমাদের হাতে এখন দুই-দুইটা বেহেশতো! আল্লাহ আমাদের অনেক সামর্থ্য দিয়েছেন। আমরা এই দুটো মাকে চিরদিন ধরে রাখতে পারবো।”

তাহমিনা এবার আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে স্বামীর বুকে মাথা রাখলো। তার চোখে এখন আনন্দাশ্রু।


সাইয়িদ রফিকুল হক
১৫/০৪/২০১৯
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৩৬০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৮/১২/২০১৯

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast