www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

খুব ভয়ের গল্প---বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে (পঞ্চম পর্ব)

খুব ভয়ের গল্প:
ধারাবাহিক উপন্যাস:
বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে
(পঞ্চম পর্ব)
সাইয়িদ রফিকুল হক

সকালবেলা আজ অনেক দেরিতে ঘুম থেকে জাগলো সাদমান। তার ঘুম-ঘুম-ভাবটা যেন এখনও কাটেনি। গতরাতে তার দেহ ও মনের ওপর দিয়ে যে ধকল গিয়েছে—তা তার জীবনে অভূতপূর্ব। ঘুম থেকে জেগে সে দেখলো—সে তার খালুজানের বাড়ির ড্রইংরুমে শুয়ে রয়েছে। আস্তে-আস্তে তার সবকিছু মনে পড়তে লাগলো। একসময় গতরাতের পুরা ঘটনাটা তার মনে পড়তেই—সে লজ্জায় যেন একেবারে কুঁকড়ে গেল। তার শরীর এখনও যেন কিছুটা দুর্বল রয়েছে। তবুও সে জোর করে মনে সাহস এনে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। সে কিছুটা উঠে-দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলো—নাহ্, এখন সে স্বাভাবিক হয়েছে। এবার সে সোফায় বসে পড়লো।
এর কিছুক্ষণ পরে শায়লা, অর্ণব, মোসাদ্দেকসাহেব ও রাশিদা বানু একসঙ্গে এসে সাদমানের সামনে হাসিমুখে দাঁড়ালো। তারপর ওরা সাদমানের সামনের সোফাটায় বসে পড়লো। ওদের চোখেমুখে কোনো কৌতুক বা বিদ্রুপাত্মকভাব নাই। ওরা চারজন একেবারে স্বাভাবিক। আর ওদের চেহারায় বরং একটা দারুণ সহানুভূতির ভাব রয়েছে যেন।
অর্ণব অনুযোগ করে প্রথমে মুখ খুললো, “ভাইয়া, আমাকে রাতে আপনি কেন যে ডাকেননি! আমি তো আপনার পাশের রুমেই ছিলাম। একটু যদি ডাকতেন!”
সাদমানের মুখে সেই হাসি আর নাই। তবুও সে স্বাভাবিককণ্ঠে বললো, “ভাইরে, তোমাকে ডাকার আর সময় পেলাম কই? জন্তুটা এমনভাবে হিংস্রতা দেখাচ্ছিলো যে—আমার মনে হচ্ছিলো—সে বুঝি এখনই সবকিছু শেষ করে ফেলবে! সামান্য একটা বিড়ালের এমন যে আগ্রাসীভাব হয়—তা আমার আগে জানা ছিল না। সেজন্য মুহূর্তের মধ্যে আমি হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলাম।”
মোসাদ্দেকসাহেব এবার বেশ আগ্রহী হয়ে বললেন, “বাবা, আমি কয়েকবার তোমার এখানে এসে ঘুরে গিয়েছি। তোমার ঘুম ভাঙেনি বলে এতোক্ষণ ভিতরের রুমে অপেক্ষা করছিলাম। এবার তুমি সত্যি করে বলো তো—গতকাল রাতে তুমি কী দেখেছিলে? আর কেনই-বা এতো ভয় পেয়েছিলে?”
সাদমান আজ-এখন কোনোরকম সংকোচ বা ভনিতা না-করে বলতে লাগলো, “খালুজান, গতরাতে আমি একটা বই পড়তে-পড়তে ক্লান্ত হয়ে শেষে নিজের মোবাইলে ফেসবুক দেখছিলাম। আমার ইচ্ছে ছিল—আমি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকবো। আর ওই আত্মাটাকে দেখবো। কিন্তু কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম—তা আমি বলতে পারবো না। হঠাৎ একটা বিজাতীয় ফ্যাস-ফ্যাচ শব্দ শুনলাম যেন। এইজাতীয় শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। তারপর ক্রমাগত এই বিকট শব্দগুলো শুনতে থাকি—একটা বিড়ালের মুখ থেকে। কিন্তু এই বিড়ালটাকে আমি কোথাও দেখতে পাচ্ছিলাম না! তারপরই তো একের-পর-এক বিকটশব্দে জানালার কাচগুলো ভাঙতে লাগলো! খালামণি রাতে আমার পানিপানের জন্য শায়লার রুমে একটা বড়সড় কাচের জগ রেখে গিয়েছিলেন—সেটাও একসময় ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ার শব্দ শুনলাম। আর বললাম না—ওই বিজাতীয় ফ্যাচ-ফ্যাচ শব্দ শুনে আমার গায়ের রক্ত একেবারে বরফ হয়ে গিয়েছিল! আরেকটি কথা: এইসময় ওই রুমের লাইটটা কেন যে বন্ধ ছিল—তা কিছুতেই বুঝতে পারছি না! আর এসব মিলিয়ে হঠাৎ আমি এতো ভয় পেয়েছিলাম যে—কোনোরকমে একদৌড়ে খালামণির রুমে এসে পড়েছিলাম। তারপর আপনারা তো দেখলেনই—আমি কী করেছি!”
সাদমানের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে অর্ণব যেন ভিতরে-বাইরে একেবারে লাফিয়ে উঠে বললো, “এই তো ভাইয়া, এটাইতো ঘটনা। আর আসল ঘটনাইতো এইখানে—লাইটটা কে যেন সবসময় বন্ধ করে রাখে! আপুনির সঙ্গেও এইরকম হয়েছে! লাইটটা জ্বালিয়ে রাখলেও তা কেউ বন্ধ করে দেয়! আর গতকাল আপনার সঙ্গেও সেই একই ঘটনা ঘটেছে!”
শায়লা এবার একটুখানি হেসে বলে, “যাক, এবার তবুও ভাইয়া আমার ব্যাপারটা একটু হলেও বিশ্বাস করতে চাইবে। তাছাড়া, এসব ঘটনা বানিয়ে বলে আমার কী লাভ? আর মামণিও তো কতবার এসব দেখেছে!”
সাদমান মাথানিচু করে বলে, “তোমরা, আমাকে এইব্যাপারে আর লজ্জা দিয়ো না। আমার জীবনে যে শিক্ষা হয়েছে—তা কোনোদিনও ভোলবার নয়।”
রাশিদা বানু কিছুই বললেন না। তিনি হয়তো পরম করুণাময়ের কাছে আপনমনে এখনও প্রার্থনা করছেন। তাঁর দয়ায় তিনি তার এই পুত্রটিকে অক্ষত অবস্থায় পেয়েছেন।
মোসাদ্দেকসাহেব ওদের আলোচনার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে সাদমানের উদ্দেশ্যে বললেন, “চল তো, বাবা, সবার সঙ্গে গিয়ে একবার আমাদের শায়লা-মামণির রুমটা দেখবে।”
সাদমান আর-কোনো কথা না বলে সবার সঙ্গে আবার শায়লার রুমে প্রবেশ করলো। আর সে রুমে গিয়ে খুব অবাক হলো—সেখানকার জানালার একটা কাচও ভাঙেনি! এমনকি রুমের ভিতরে তার খালামণির রাখা কাচের জগটা এখনও অক্ষত রয়েছে!
সে বিস্মিতভাবে রুমের চারিদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, “খালুজান, এইটা অনেক শক্তিশালী আত্মা হবে। আমার জীবনে কখনো এরকম তো দেখি নাই! তাই, খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
ওরা কয়েকজন আবার এসে বসলো ড্রইংরুমে। আত্মা নিয়ে গল্প জমে উঠতে বেশি সময় লাগলো না। এমনকি ওদের গৃহসাথী মালেকাও এসে বসলো ওদের সঙ্গে।
ওদের আলোচনার একফাঁকে মোসাদ্দেকসাহেব সাদমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “বাবা, তোমার যদি কোনো সমস্যা হয়—মানে, শারীরিক কোনো সমস্যা দেখা দেয়—তাহলে, আগেভাগে আমাদের সব বলবে—প্রয়োজনে তোমাকে আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাবো। তাছাড়া, আরও একটা কথা—গতকালের ব্যাপারটি তোমার মাকে মনে হয় এখনই জানানো উচিত।”
একথা শুনে সাদমান লাফিয়ে ওঠে। আর খুব জোরে বললো, “না-না, খালুজান, এই কাজটি করবেন না। তাহলে, আমার মা এখনই গাড়ি নিয়ে রওনা হবেন। আর আমাকে এসে নিয়ে যাবেন। মায়ের এসব বিষয়ে খুব বিশ্বাস। তিনি আমাকে আর একমুহূর্তও এখানে রাখতে চাইবেন না।”
মোসাদ্দেকসাহেব মনভার করে বলেন, “তবুও, যদি তোমার খারাপ কোনোকিছু হয়ে যায়। আর তোমার শরীরের যদি কোনোরকম অবনতী ঘটে! নাকি নাশতাশেষে তুমি সরাসরি তোমাদের বাসায় চলে যাবে? পরে নাহয় সুস্থ হয়ে আবার একসময় এসো।”
সাদমান বলে, “না-না, খালুজান। আমার শরীর এখন ভালো আছে। আমি একদম ঠিক আছি। আর আজও আমি স্বেচ্ছায় আপনার বাসায় থাকবো। আপনার গুরুজীর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। আত্মাবিষয়ে আমিও কিছু জানতে চাই। তাঁর কাছে আমার বিশেষ কিছু প্রশ্নও আছে। এগুলো আমি শেষ না করে যেতে চাচ্ছি না।”
এতে মোসাদ্দেকসাহেব যারপরনাই আনন্দিত হলেন। আর তিনি তাকে অভয় দিলেন যে—ব্যাপারটি তার মাকে আর জানাবেন না।
তারপর রাশিদা বানু সবাইকে নাশতার টেবিলে ডাকলেন।


মোসাদ্দেকসাহেব দুপুর একটা বাজার পর থেকে তার গুরুজীর জন্য বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করছেন। তিনি এখন সুন্দর জামাকাপড় পড়ে বাড়ির বাইরে মেইন গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বাড়ির দারোয়ান ইসমাইলও তার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আজ তার জীবনের একটি আনন্দময় দিন। তার গুরুজী এই প্রথম তার বাড়িতে আসছেন। এজন্য গতকাল রাত থেকেই মোসাদ্দেকসাহেবের মনের মধ্যে দারুণ একটা চঞ্চলতা আর ভালোলাগা-উত্তেজনা কাজ করছিল।
দুপুর দেড়টার সময় অধ্যাপক লিটু মিয়া হাঁটতে-হাঁটতে একেবারে মোসাদ্দেকসাহেবের প্রায় সামনে এসে দাঁড়ালেন। মোসাদ্দেকসাহেব তখন অন্য একদিকে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, তার গুরুজী হয়তো এই পথেই আসবেন। হঠাৎ এভাবে গুরুজীকে তার সামনে দেখে তিনি আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠলেন। খুব তাজিমের সঙ্গে তিনি দুহাত বাড়িয়ে তার গুরুজীর সঙ্গে আগে করমর্দন করলেন। তারপর তাঁকে সসম্মানে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু অধ্যাপক লিটু মিয়া আগেই বাড়ির ভিতরে ঢুকতে চাইলেন না।
তিনি মোসাদ্দেকসাহেবের দিকে তাকিয়ে স্মিতহাস্যে বললেন, “আগে পুরো বাড়ির দেওয়ালের বাইরের দিকটা একবার ভালোভাবে চক্কর দিয়ে দেখেশুনে নিতে চাই। তারপর বাড়ির দেওয়ালের ভিতরের দিকটা ভালোভাবে ঘুরেফিরে দেখেশুনে একবারে বাসার ভিতরে গিয়ে বসবো। সবশেষে পুরো বাড়ির ভিতর দিকটাও খুব ভালোভাবে ঘুরেফিরে দেখবো।”
মোসাদ্দেকসাহেব আগের মতো তাজিমের সঙ্গে বললেন, “জ্বি, গুরুজী। তা-ই হোক।”

অধ্যাপক লিটু মিয়া খুব ধীরস্থিরভাবে বাড়িটার প্রাচীরের বাইরের ডানদিক থেকে পর্যবেক্ষণ শুরু করলেন। একপর্যায়ে তিনি তাঁর হাফ-জ্যাকেটের পকেটের ভিতর থেকে শক্তিশালী ম্যাগনিফাইং-গ্লাসটা বের করে হাতে নিলেন। কয়েক জায়গায় তিনি ম্যাগনিফাইং-গ্লাস দিয়ে কী যেন ভালোভাবে দেখতে লাগলেন। পুরো বাড়িটার বাইরের চারপাশ দেখাশেষে তিনি বাড়ির মেইন গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন। এইসময় তিনি তাঁর হাফ-জ্যাকেটের পকেট থেকে বের করলেন একটা ছোট নোটবুক।

বাড়ির ভিতরে ঢোকামাত্র অর্ণবকে গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি একটু হাসলেন। অর্ণবও হাসলো। সে তাঁর হাতে কয়েকটি রজনীগন্ধার স্টিকসহ একটি ফুলগুচ্ছ তুলে দিলো। অধ্যাপক লিটু মিয়া ফুলগুলো হাতে নিলেন। তারপর কিছুটা দূর থেকে ফুলগুলোর একটু ঘ্রাণ নিয়ে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “তুমি নিশ্চয়ই অর্ণব?”
অর্ণব ‘জ্বি’ বলে তাঁকে সালাম দিলো। তিনি সালামের জবাব দিয়ে তাকে বললেন, “পরে কথা হবে। আগে বাড়ির সীমানার ভিতরের দিকটা একটু দেখি।”
তিনি আবারও ডানদিক থেকে পর্যবেক্ষণের কাজ শুরু করলেন। এবার অর্ণবও তাঁর সঙ্গে রইলো। আর মোসাদ্দেকসাহেব সর্বক্ষণ তার গুরুজীর সঙ্গে ছায়ার মতোন চলছেন।
এবার অনেক সময় নিয়ে তিনি পুরো বাড়িটার চারপাশ দেখছেন। আর দেখাশেষে শায়লার সেই রুমটার আশেপাশের জায়গাটা খুব দক্ষতার সঙ্গে দেখতে লাগলেন। তাঁর হাবভাব দেখে অর্ণবের তাঁকে এযুগের শার্লক হোমস বলে মনে হলো। সে অধ্যাপক লিটু মিয়ার কাজের গতি ও ধরন দেখে যারপরনাই বিস্মিত ও বিমুগ্ধ। সে সামনে তাঁকে কিছু না বললেও ভিতরে-ভিতরে একেবারে আনন্দে যেন উদ্বেলিত। তার পড়া গোয়েন্দা-চরিত্রের সঙ্গে যেন তাঁর আচরণের সবকিছু মিলে যাচ্ছে! কিন্তু তার বাবা যে বলেছিলেন—তিনি একজন আধ্যাত্মিক সাধক!
অধ্যাপক লিটু মিয়া তাঁর ম্যাগনিফাইং-গ্লাসের সাহায্যে শায়লার জানালার নিচের আশেপাশের মাটি ও বিভিন্ন দ্রব্যাদি খুব যত্নসহকারে দেখতে লাগলেন। বিশেষ করে, জানালা থেকে কয়েক ফুট দূরে অবস্থানরত বকুলগাছগুলোও খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। গাছগুলোর নিচের দিকের পুরো শরীর তিনি ম্যাগনিফাইং-গ্লাসের সাহায্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভুল করলেন না।
তিনি আশেপাশের বিভিন্ন জায়গার মাটি থেকে শুরু করে বিভিন্ন দ্রব্যাদির ওপর ম্যাগনিফাইং-গ্লাস রেখে তা বারবার পরীক্ষা করে দেখলেন। তারপর একটু হেসে মোসাদ্দেকসাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন, “চলুন, এবার একদম বাড়ির ভিতরে যাওয়া যাক। আমরা ড্রইংরুমে গিয়ে বসি। তারপর সব কথা সেখানে খুলে বলবো।”
মোসাদ্দেকসাহেব ‘জ্বি’ বলে তার গুরুজীর পিছনে হাঁটতে লাগলেন।
শায়লা ও তার মা দোতলায় জানালার পাশে দাঁড়িয়ে এতোক্ষণ যাবৎ অধ্যাপক লিটু মিয়ার সমস্ত কার্যকলাপ দেখছিল। তাদের চোখেমুখেও এখন বিস্ময়! অধ্যাপকসাহেব মনোযোগ দিয়ে কী এতো দেখছেন! তাদের যেন ভাবনার শেষ নাই!

ভিতরবাড়ির গেইটের কাছে আগে থেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাশিদা বানু। অধ্যাপক লিটু মিয়া ভিতরে প্রবেশ করার সঙ্গে-সঙ্গে তিনি সালাম দিয়ে তাঁকে যেন সাদর সম্ভাষণ জানালেন। ততক্ষণে শায়লাও এসে পড়েছে তার মায়ের পাশে।

ড্রইংরুমে আগে থেকে বসা ছিল সাদমান। সেও নিচে নামতে চেয়েছিল। কিন্তু রাশিদা বানু তাকে নিচে নামতে দেননি। তিনি মনে করেছেন—গতরাতের পর থেকে ওর আরেকটু বিশ্রামের প্রয়োজন।
সাদমান এবার উঠে দাঁড়িয়ে বেশ ভক্তিসহকারে অধ্যাপক লিটু মিয়াকে সালাম জানালো।
তিনি সালামের জবাব দিয়ে হাসিমুখে সবাইকে বসতে বললেন।

খুব অল্পসময়ের মধ্যে মোসাদ্দেকসাহেব সবার সঙ্গে তার গুরুজীর পরিচয় করিয়ে দিলেন। সাদমান সঙ্গে-সঙ্গে অধ্যাপক লিটু মিয়াকে কিছু-একটা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু ইশারায় তাকে থামতে বললেন তিনি। আর তিনি তাকে ইশারায় আরও বুঝিয়ে দিলেন যে, এখনও কোনো বিষয়ে কথা বলার সময় হয়নি।
এমন সময় সবার জন্য শরবত নিয়ে এলো গৃহসাথী মালেকা।
মোসাদ্দেকসাহেব বললেন, “গুরুজী, আগে এর একটু সদ্ব্যবহার করুন।”
অধ্যাপকসাহেব শরবত গ্রহণ করে সবাইকে তা পান করার জন্য আহ্বান করলেন।
শরবতপানশেষে অধ্যাপক লিটু মিয়া বললেন, “আমি পুরো বাড়িটার বাইরের ও ভিতরের দিকটা খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলাম—এখানে কোনো মানুষজনের কোনোরকম চালাকি কিংবা কারও কোনো ভোজবাজি নাই। এখানে, আত্মার প্রবেশ কিংবা অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আর পুরো ঘটনাটা আত্মাকেন্দ্রিক। আমি এই বাড়ির বাইরের দিকে কিংবা ভিতরের দিকে কারও কোনো পায়ের ছাপ বা শায়লার রুমের জানালা থেকে বেশ কিছুটা দূরের গাছগুলোতে কারও বেয়ে ওঠারও কোনো প্রমাণ পাইনি। এটা কোনো মানুষের কারসাজি নয়। তাছাড়া, এই বাড়িটার দশ ফুট উঁচু প্রাচীর ডিঙিয়ে কে-ই-বা এখানে আসবে এতোসব ভণ্ডামি করতে! অবশ্য এই বাড়িতে শায়লার মতো এতো সুন্দর মেয়ে থাকায় ভণ্ডশয়তানদের আনাগোনা বেড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু এখানে তা ঘটেনি। আর এটা সেরকম কোনোকিছুও নয়। এটা আত্মার খেলামাত্র। তবে আমি এখনই সব বলছি না—এবিষয়ে পরে আমি আরও বলবো।”
মোসাদ্দেকসাহেব হঠাৎ বললেন, “গুরুজী, তার আগে যদি দুপুরের খাবারটা...।”
অধ্যাপক লিটু মিয়া হাততুলে হাসিমুখে বললেন, “থাক না এখন। একটু পরে খাওয়া যাবে। এইমাত্র তো আমরা বড়-বড় গেলাসভরে শরবতপান করলাম। আগে তা হজম হতে দিন না।”
তারপর তিনি বললেন, “বাড়িতে কাজের লোক থাকলে তাকে হাজির করুন। আর কিছু সময়ের জন্য বাড়ির বাইরের মেইন গেইটটা বন্ধ করে দিয়ে আপনাদের দারোয়ানকেও একবার এখানে ডাকুন তো। কয়েকটি জরুরি কথা আছে।”
অর্ণব সঙ্গে-সঙ্গে ছুটে বাইরে চলে গেল—দারোয়ান ইসমাইলকে ডাকতে। আর রাশেদা বানু ড্রইংরুমে বসেই মালেকাকে ডাকলেন।
মালেকা সলজ্জভঙ্গিতে এসে অন্য একটা সোফার এককোণে বসলো। তারপর দেখতে-দেখতে ইসমাইলও চলে এলো। সেও একটা চেয়ার নিয়ে একপাশে বসলো।
এবার অধ্যাপকসাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন, “সবাইকে এইমুহূর্তে একদম সত্যকথা বলতে হবে। আর কেউ যদি সত্য গোপন করে কিংবা মিথ্যা বলে—তবে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রথমে তিনি মালেকার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি তো এই বাড়িতে বেশ কিছুদিন হলো অনেকরকম কাজ করছো। এজন্য দিনে-রাতে বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় চলাফেরাও করছো। তুমি কি কখনো কোনো ভূতটুত দেখেছো? তুমি নির্ভয়ে আমাদের কাছে এসব বলো। কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। তুমি তো আমাদেরই একজন।”
অধ্যাপক লিটু মিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে আত্মাকে ভূত বলেছেন। নইলে, এরা আত্মা চিনতে পারবে না। আর সাধারণ মানুষজন আত্মাকে ভূতটুত বলতেই বেশি অভ্যস্থ।
রুমে তখন পীনপতন নিস্তব্ধতা। কেউ কোনো কথা বলছে না। আর মালেকাও একেবারে নিশ্চুপ! রাশেদা বানু হয়তো মালেকাকে কিছু-একটা বলার জন্য ভিতরে-ভিতরে খুব উসখুস করছিলেন।
এমন সময় মালেকা মুখ খুললো। আর সে কাঁদ-কাঁদ গলায় বললো, “এই বাড়িতে প্রথম-প্রথম আমি কিছু দেখি নাই। কিন্তু আমি একদিন একজনকে দেখছিলাম। কিন্তু আমি ভয়ে খালাম্মারে সেই কথা আইজও কই নাই। যদি তিনি আমার কথা বিশ্বাস না করেন! আমি একদিন দেখি কি...সেদিন খালুজানের শরীরটা ভালো ছিল না। সর্দি-ভাব ছিল। তার জ্বর-জ্বর লাগছিল। অনেক রাতে আমি রান্নাঘরে গিয়েছিলাম খালুজানের জন্য এককাপ চা বানাতে। এমন সময় দেখি—আমাদের রান্নাঘরে আমার আগেই কে যেন ঢুকে কী-সব করছে। তার মাথায় বিরাট ঘোমটা দেওয়া। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, এইটা খালাম্মাই। তাই, তার পিছনে দাঁড়িয়ে কইলাম, ‘খালাম্মা, আপনে না খালুজানের কাছে ছিলেন? আমার আগে এতো তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে আসলেন কেমনে! তবে তিনি আমার সাথে কোনো কথা কইলেন না। আমি ভাবলাম—খালুজানের শরীরটা খারাপ—তাই, হয়তো তিনি মনখারাপ করে আমার সাথে কথা কইতেছেন না। এই মনে করে—যেই আমি চায়ের কেতলিটা ওপরের তাক থেকে নিচে নামিয়ে চুলাটা জ্বালানোর জন্য একটু ঘুরে দাঁড়িয়েছি—অমনি দেখি তিনি নাই! তবুও ভাবলাম, খালাম্মাই হবেন। খালুজান হয়তো তাকে ডাকছিলেন—তাই, তিনি তাড়াতাড়ি তাদের রুমে চলে গেছেন! পরে চা বানিয়ে আমি খালুজানের কাছে এসে দেখি—খালাম্মা আগের মতো সেখানে শুয়ে রয়েছেন! সেদিন আমি একটু ভয় পাইছিলাম। তবুও এতোকিছু বুঝি নাই বইলা বাঁইচা গেছি। তারপর আর-কিছু দেখি নাই, স্যার।”
অধ্যাপক লিটু মিয়া এবার একটু হেসে রাশিদা বানুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “মা-জী, আপনি এই সমস্যাটা নিয়ে কখনো ওর সঙ্গে আলাপ করেছিলেন কিংবা ও-কে এব্যাপারে কোনোকিছু বলেছিলেন কিংবা ওর কাছ থেকে কখনো কোনোকিছু জানতে চেয়েছিলেন?”
রাশিদা বানু সলজ্জভঙ্গিতে বললেন, “না।”
“কেন?”—অধ্যাপকসাহেব জানতে চাইলেন।
রাশিদা বানু এবার আরও কাঁচুমাচুভঙ্গিতে বললেন, “আমি ভেবেছিলাম, ওর কাছে এসব বললে, ও হয়তো ভয় পেয়ে ওদের গ্রামে ফিরে যাওয়ার জন্য খুব উতলা হয়ে উঠবে। এইমুহূর্তে আমার একজন সাহায্যকারী খুব দরকার। সেজন্য ও-কে আমি কিছু বলি নাই বা কোনোকিছু জানতে দেইনি।”
অধ্যাপকসাহেব আর-কিছু না বলে একটু হাসলেন।
তারপর তিনি ইসমাইলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি তো এই বাড়িতে মোসাদ্দেকসাহেবদের সঙ্গেই বসবাস করতে শুরু করেছো। বাড়িটার গেইটের পাশেই তো তোমার থাকার জন্য একটা সুন্দর ব্যবস্থাও রয়েছে। তুমি তো ডিউটিও ভালো করো। আর রাতও জাগো। তুমি এতোদিনে এখানে কিছু কী দেখেছো? এই বাড়িতে মোসাদ্দেকসাহেবের পরিবারের লোকজন ছাড়া কি আরও কেউ আছে?”

ইসমাইল মিনিটখানেক চুপচাপ বসে থেকে শেষে খুব গম্ভীরমুখে বললো, “আছে স্যার। এখানে আরও দুই-একজন আছে। আমি স্বচক্ষে তাদের কয়েকবার দেখেছি! কিন্তু আমি একথা কাউকে কখনো বলিনি। তার কারণ, সাহেব যদি এই কারণে বাড়িটা অন্য কারও কাছে বিক্রি করে দেন—তাইলে, আমার চাকরি শেষ হয়ে যাবে। এই সাহেব খুব ভালোমানুষ। এখানে চাকরি করে আমি খুব সুখে আছি। এই বাড়িটার কাছাকাছি জায়গায় আমি একটা বাসাভাড়া করেছি। সেখানে আমার পরিবার থাকে। সবাইকে নিয়ে আমি খুব সুখে আছি। তাই, এইব্যাপারে আমি কাউকে কিছু বলি নাই।”
তারপর সে আগের মতো গম্ভীর হয়ে রাশিদা বানুকে দেখিয়ে বললো, “খালাম্মার বয়সী একজন মহিলা এবং আর-একজন জওয়ানমর্দ ছেলেকে আমি এই বাড়িতে বেশ কয়েকবার ঘোরাফেরা করতে দেখেছি! তবে তারা আমাদের মতো মানুষ নয়। তারা অন্য কেউ! তাদের আমি চিনি নাই। আর আমিও ভয়ে এতোদিন এই বাড়ির কাউকে কিছু বলি নাই। তার কারণ, যদি আমার চাকরিটা চলে যায়। সেইজন্য আমি এতোদিন এসব দেখেও না দেখার ভান করেছি।”
অধ্যাপক লিটু মিয়া বললেন, “এজন্য তোমার চাকরি যাবে না। তুমি নির্ভয়ে এ-পর্যন্ত এই বাড়িতে যা-যা দেখেছো—তা সবিস্তারে বলো। আমি তোমার মুখ থেকে সবটা শুনতে চাই। তারপর তোমরা আমার কিছু কথা শুনবে।”
একথা শুনে ইসমাইল ধীরস্থিরভাবে বলতে লাগলো, “আমি এখানে চাকরিতে জয়েন করার পর একদিন অনেক রাতে কারেন্ট চলে যায়। সেদিন খুব গরম পড়েছিল! আমি গেটের পাশে নিজের থাকার ছোট বাসাটার দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ভাবছিলাম, বাড়িটার চারপাশে এতো উঁচু ওয়াল দেওয়া—চোর-ডাকাত তো সহজে এখানে ঢোকবার সাহস পাবে না। এই মনে করে আমি একেবারে বাড়ির সামনের বিশাল ফাঁকা জায়গাটায় বসতে যাবো। এমন সময় দেখি—বিল্ডিংয়ের পিছনদিক থেকে বড়সড় একটা ঘোমটা দেওয়া একজন ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন! তাকে বেশ দূর থেকে দেখে আমি ভেবেছিলাম—তিনি আমাদের খালাম্মা। শায়লা-আপার আম্মা। কিন্তু কী মনে করে আমি তার দিকে একটু ভালোভাবে তাকিয়ে দেখি—ভদ্রমহিলা যেন বাতাসের উপর ভর করে হেঁটে যাচ্ছেন! এইসময় হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ায়—আমার গা-টা যেন কেমন কাঁটা দিয়ে উঠলো। আমি শুনেছি যে, ভূতেরা নাকি শূন্যের উপর ভর দিয়ে চলে। তাদের পা নাকি কখনো মাটিস্পর্শ করে না। সেই ভদ্রমহিলা হাঁটতে-হাঁটতে এবাড়ির সামনের দিকটায় চলে এলেন। তারপর দেখলাম, তিনি যেন কেমন করে বিল্ডিংয়ের শক্তিশালী কলাপসিবল গেটের বাধা ডিঙিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লেন! আমি তখন পড়িমড়ি করে একদৌড়ে আমার ছোট্ট কোয়ার্টারে ঢুকে পড়লাম। দরজা আটকিয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি—সেই ভদ্রমহিলা ততক্ষণে সিঁড়ি দিয়ে হয়তো উপরে চলে গেছেন। সেইদিন আমি একটুর জন্য বেঁচে গেছি। প্রথমে তাকে আমি খালাম্মা ভেবে তার কাছে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা করে ছিলাম। কিন্তু পরে কী যেন ভেবে তার কাছে আর যাইনি!
তারপর একদিন দেখি, খালাম্মার মতো একটা শাড়ি পড়ে সেই ঘোমটাওয়ালা-ভদ্রমহিলা হাতে একটা প্রদীপ নিয়ে বিল্ডিংয়ের সামনে দিয়ে হেঁটে বিল্ডিংয়ের পিছনদিকে যাচ্ছেন। আমি আচমকা সেদিন তাকে খালাম্মাই ভেবে বসেছিলাম। আর নিজের রুমের দরজা খুলে দ্রুত হেঁটে তার কাছে খানিকটা এগিয়ে বলেছিলাম, ‘খালাম্মা, এতো রাতে কোথায় যাচ্ছেন? গাছের লেবু আনতে যাচ্ছেন নাকি?’
আমার কথা শুনে সেই ভদ্রমহিলা হ্যাঁ-বা-না—কোনোকিছু না বলে আরও জোরে হাঁটতে লাগলেন। আমি আবারও তাকে খালাম্মা ভেবে তার আরও কাছে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ তিনি প্রদীপটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে বেশ জোরে শব্দ করে হেসে উঠলেন! আর তখন আমি ভয়ে চিৎকার দেইনি ঠিকই—তবে কোনোরকমে পাগলের মতো একদৌড়ে নিজের রুমে ফিরে এসেছিলাম। খালাম্মাকে দেখতাম, তিনি মাঝে-মাঝে বিভিন্ন সময় বিল্ডিংয়ের পিছনদিকের বড় লেবুগাছটা থেকে লেবু আনতে যেতেন। সেদিন খুব বোকামি করে আমি ভেবেছিলাম, আজও বুঝি খালাম্মাই লেবু আনতে যাচ্ছেন! কিন্তু তখন রাত যে কত গভীর! সে খেয়াল আমার ছিল না। এরপর থেকে আমি খুব সতর্ক হয়ে যাই। আর বাড়িটাতে যে কোনো আত্মা আছে তা আমি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি। আরও কয়েকবার তাকে আমি দেখেছি—এই বাড়িটার মধ্যে চলাফেরা করতে—কিন্তু আমি কখনো আর তার সামনে পড়ার আর-কোনো চেষ্টা করিনি। এখানেই শেষ নয়। একটা যুবকের আত্মাও এখানে আছে। মাসখানেক আগে একদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো। সেদিন এই বাড়ির সবাই আগেভাগে বাসায় ফিরেছে। গেটে ভালোভাবে তালা দিয়ে আমি সবেমাত্র নিজের রুমে গিয়ে বসেছি। আর ভাবছিলাম, আজকে মোবাইলে একটা সিনেমা দেখবো। বাইরে তখনও বৃষ্টি হচ্ছে। আমি একটা সিনেমা সবেমাত্র চালু করেছি। এমন সময় বাড়ির দক্ষিণদিক থেকে একটা পুরুষ-মানুষের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে লাগলো! বাইরে সেদিন ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল! খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো! অনেক রাত হয়েছিল সেদিন। আশেপাশের সব লাইটও বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু শায়লা-আপার রুমে একটা লাইট জ্বলছিল। বুঝতেই পারতেছেন স্যার—খুব অন্ধকার ছিল চারিদিকে। মানুষের কান্নার আওয়াজ শুনে আমি আর মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। তাই, ভাবছিলাম—নিজের বড় টর্চলাইটটা সঙ্গে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে চারিদিকে একবার খোঁজ করে দেখবো যে, কান্নার আওয়াজটা কোত্থেকে আসতেছে? আমি সবকিছু গোছগাছ করে বেরিয়ে পড়বো—এমন সময় হঠাৎ সেই মহিলার আত্মাটার কথা আমার মনে পড়ে গেল! আর সঙ্গে-সঙ্গে নিজের রুমের দরজাটা ভালোভাবে আটকিয়ে দিয়ে জানালাটাও আটকাতে গিয়েছি—এমন সময় স্বচক্ষে দেখি—সেই জামগাছটার কাছ থেকে একটা লম্বা-চওড়া ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে! আমি কিছুটা ভয় পেলেও—তবুও জানালাটা একটু ফাঁক করে রেখে তাকে দেখতে লাগলাম। দেখি, সেই যুবকটিও যেন হাওয়ায় ভেসে শায়লা-আপার রুমের নিচে যে বকুলগাছগুলো রয়েছে—সেদিকেই সে যাচ্ছে। তারপর আমি জানালা বন্ধ করে দিয়েছি। সেদিনও আমি একটু ভয় পেয়ে গেছিলাম। হাজার হলেও তো আমি একজন মানুষ, স্যার। আমার তো একটু ভয়-ভয় লাগেই।
আরও একদিন এই অচেনা যুবককে হঠাৎ আমি দেখেছিলাম। সেদিন ছিল একেবারে ভরদুপুরবেলা। কতকগুলো কাক দলবদ্ধভাবে জামগাছের ডালের উপরে বসে খুব কা-কা করছিল। আমি এগুলোকে তাড়ানোর জন্য একটু এগিয়ে যেতেই দেখি—একটা ছায়ামূর্তি গাছ থেকে নেমে আসছে! দিনদুপুরে এমন একটা আজব দৃশ্য দেখে আমি সঙ্গে-সঙ্গে একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম! তখন আমি মূর্তির মতো সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর তখন আমার যেন কোনো বোধশক্তি ছিল না! আমি পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেছিলাম! কিছুক্ষণ পরে যেন আমার হুঁশ হলো। আমি তাড়াতাড়ি গোসল করলাম। ভয় পেলে নাকি গোসল করতে হয়। আরও দুই-তিনবার দেখেছি এই যুবকটাকে। একদিন খুব ভোরে শায়লা-আপার জন্য বকুলফুল কুড়াতে গেছি—এমন সময় আমার চোখ আটকিয়ে যায় আপার জানালায়—দেখি, জানালার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছে ওই ছায়ামূর্তিটা! সেদিনও আমি ভয়ে যেন একেবারে কাঠ হয়ে গেছিলাম! তখন চারিদিকটা ছিল একেবারে নীরব-সুনসান।”

সব শুনে অধ্যাপক লিটু মিয়া স্মিতহাস্যে বললেন, “ইসমাইল, তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি কথাগুলো খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে বলতে পেরেছো। আর মালেকাকেও ধন্যবাদ। সেও তার দেখা ঘটনাটা সুন্দরভাবে বর্ণনা করতে পেরেছে।”
মোসাদ্দেকসাহেব অনেকক্ষণ যাবৎ তার গুরুজীকে কিছু-একটা বলার জন্য খুব ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তার হাবভাব লক্ষ্য করে অধ্যাপকসাহেব ভালোবাসার সুরে বললেন, “আপনি কিছু বলবেন?”
এবার তিনি একটু হেসে বললেন, “জ্বি, গুরুজী। আপনার সম্পর্কে দুই-চারটা কথা এদের কাছে বলার জন্য আপনার একটু অনুমতি চাচ্ছিলাম।”
অধ্যাপকসাহেব হেসে বললেন, “আমার পরিচয় সবটুকু বা বেশি দিয়েন না। যেটুকু প্রয়োজন শুধু সেটুকুই দিবেন।”
মোসাদ্দেকসাহেব ‘জ্বি-আচ্ছা’ বলে বলতে শুরু করলেন, “আমাদের গুরুজী একজন নামকরা প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তিনি বহু সমস্যার সমাধান করেছেন। তাঁর আরও বড় পরিচয়...।”
অধ্যাপক লিটু মিয়া হেসে হাততুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আর তেমনকিছু বলতে হবে না। আমি সামান্য একজন মানুষ। আমার সম্পর্কে এতো কথা বলার তেমন-কোনো প্রয়োজন নাই।”
মোসাদ্দেকসাহেব নীরবে বসে পড়লেন। তবে তিনি একটুও মনখারাপ করেননি।
অধ্যাপকসাহেব এবার বলতে শুরু করলেন, “আমরা এতোক্ষণ আত্মার কথা শুনেছি। এই বাড়িটাতে দুইটি আত্মা আছে। এব্যাপারে আমি একেবারে নিশ্চিত। আর তা আমি ইতঃপূর্বে মোসাদ্দেকসাহেবের কাছ থেকে ফোনে শোনা সংক্ষিপ্ত ঘটনার আলোকে বুঝতে পেরেছিলাম। আর এখন, মালেকা ও ইসমাইলের মুখ থেকে সব ঘটনা শুনে বুঝতে পারলাম—দুইটা আত্মাই হবে। এরা এই বাড়িতেই এখনও অবস্থান করছে। তবে এরা অনেক ভদ্র আত্মা। এখনও তারা কোনোরকম হিংস্রতা দেখায়নি কিংবা কোনোরূপ হিংস্র হয়ে ওঠেনি।”
তারপর তিনি মালেকা ও ইসমাইলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা কখনো এদের ভয় পাবে না। কিংবা এখন থেকে এদের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে চলাফেরা করবে। সহজে এদের সামনে যাবে না।”
সাদমান অনেকক্ষণ যাবৎ কিছু-একটা বলার জন্য খুব উসখুস করছিল। সে এবার থাকতে না পেরে বলে উঠলো, “গুরুজী, আপনি বলেছেন—এই আত্মারা এখনও হিংস্র হয়ে ওঠেনি! কিন্তু আমি যে গতকাল রাতে...।”
অধ্যাপক লিটু মিয়া তাকে হাততুলে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “তোমার সব কথা মোসাদ্দেকসাহেব আমাকে সকালে জানিয়েছেন। সেটি অন্য বিষয়। পরে বলবো। পরে আমাদের আরও কথা হবে।”
অধ্যাপক লিটু মিয়া এরপর গেলাস থেকে একটু পানিপান করে আবার বলতে লাগলেন, “আমাদের দেশে সাধারণ মানুষজন আত্মাসম্পর্কে তেমনকিছু জানে না বলে—তারা সকল আত্মাকে ভূতপ্রেত বলে বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস করে থাকে। তারা মনে করে থাকে—এগুলো ভূতপ্রেত! আসলে, এগুলো আত্মা। আর জগতজুড়ে এই আত্মার খেলাই চলছে। আমাদের দেহের মধ্যেও রয়েছে আত্মা। একসময় আমাদের দেহ থেকে এই আত্মা বেরিয়ে যাবে। তখন আমরা মারা যাবো। আর যাদের আত্মা এই বাড়িটাতে ঘোরাফেরা করছে—তারাও একদিন জীবিত ছিলেন। হয়তো কোনো কারণে তারা মারা গিয়েছেন কিংবা তাদের হত্যা করা হয়েছে কিংবা কোনো অপঘাতে বা অন্য কোনোভাবে তাদের অপমৃত্যু হয়েছে। কোনো মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যু হলে সহজে তার আত্মা এভাবে ঘোরাফেরা করতে পারে না। আমার প্রাথমিক ধারণায় এই দুইটি আত্মার এই বাড়িতে ঘোরাফেরা করার মূলে রয়েছে তাদের অপমৃত্যু। আশা করি, আমরা অচিরেই এ-রহস্যের কূলকিনারা করতে পারবো। আপাততঃ আমাদের কথাবার্তা এই পর্যন্তই থাক। বাকিটা পরে হবে। আর আমি এখন এই বাড়িটার নিচতলা থেকে একেবারে দোতলার প্রতিটি কক্ষ তন্ন-তন্ন করে খুঁজে দেখবো। আমি একটা জিনিস খুঁজছি! আশা করছি, জিনিসটা পেয়ে যাবো। আর এখন আমার সঙ্গে থাকবে মোসাদ্দেকসাহেব ও অর্ণব।”
শায়লা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বিনম্রভঙ্গিতে বললো, “গুরুজী, আমি আপনাদের সঙ্গে থাকলে কি কোনো অসুবিধা হবে?”
অধ্যাপকসাহেব হেসে বললেন, “না-না, তা হবে কেন? তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না বলে তোমার নাম বলিনি। তাছাড়া, তোমাদের অন্য কোনো কাজও থাকতে পারে।”
শায়লা এবার সলজ্জভঙ্গিতে বললো, “আমিও থাকবো।”
অধ্যাপকসাহেব বললেন, “ঠিক আছে, তবে চলো। আমরা এখনই কাজে লেগে পড়ি।”
অধ্যাপকসাহেব সবাইকে নিয়ে উঠ পড়লেন।

অর্ণব ভেবে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছে না—অধ্যাপকসাহেব কী খুঁজছেন? কোন্ জিনিস খুঁজছেন? আর কেনই-বা এই জিনিসটা খুঁজছেন? সেটা আসলে কী?


(চলবে)


সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
রচনাকাল: ২৬/১১/২০১৯
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৩৩৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৬/১২/২০১৯

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast