www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

দেনমোহর মাত্র ৮৩৩ টাকা



ছোটগল্প: দেনমোহর মাত্র ৮৩৩ টাকা
সাইয়িদ রফিকুল হক

মেয়েটি আরশেদকে ভালোবেসেছিলো। অন্তত প্রথমদিকে সবার সেই ধারণাই হয়েছিলো। সবাই মানে আরশেদের বন্ধুরা। আজ কয়েকদিন আরশেদ মেসে খুব মনমরা হয়ে শুয়ে থাকে। আর ভাবে: শহরে এসে তার ভুল হয়নি তো? গ্রামেই তো ভালো ছিলাম।

আরশেদ মফস্বলের ছেলে। সে হঠাৎ পড়তে এসেছে ঢাকায়। সে বাজারে প্রচলিত ভালোছাত্র নয়। আর সে নিজেকে কখনও ভালোছাত্র বলে দাবিও করেনি। তবে সে মানুষ হিসাবে বড় ভালো। তার বন্ধুরা তা-ই বলেছে। আর তার গ্রামের লোকজনও তা-ই জানে।
তার চৌদ্দপুরুষ গ্রামে থাকে। তারা গ্রামেই ছিল। আর এখনও গ্রামেই আছে। হয়তো তারা ভবিষ্যতেও গ্রামেই থাকবে। আর সেই বংশেরই একটা ছেলে ঢাকায় পড়তে এসেছে! অনেকের কাছে এটা রীতিমতো একটা বিস্ময়ের ব্যাপার বলে মনে হতে পারে। আর সে-ই এই বংশের প্রথম ছেলে, যে কিনা ঢাকা-শহরে পড়তে এসেছে। তাদের বংশের উচ্চশিক্ষিত অধিকাংশ আত্মীয়স্বজনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়েছে। সে-ও সেখানেই পড়তে চেয়েছিলো। কিন্তু তার এম.এ.-পাস বড়বোন তাকে রাজধানী-শহরে পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলো। সেই থেকে আরশেদের শহরঅভিমুখে আগমন, এবং এখনও সে এখানেই পড়ছে। তবে তার পড়া প্রায় শেষের দিকে। তার স্বপ্ন: সে এখানে কয়েক বছরে পড়ালেখা শেষ করে আবার নিজেদের গ্রামেই ফিরে যাবে। চাকরিটা তার কাছে কোনো মুখ্য বিষয় নয়। তার শুধু একটি ডিগ্রী-সার্টিফিকেট প্রয়োজন। আর এর সঙ্গে বিদ্যাবুদ্ধি যা হয় তা তো বোনাস হিসাবে পাওয়া।

আজ কয়েকদিন যাবৎ আরশেদের মনটা ভীষণ খারাপ। সে ঠিকমতো পড়ালেখাও করতে পারছে না। সে ঢাকার একটা প্রাইভেট-বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন-বিষয়ের ছাত্র। সে এখন ফাইনাল ইয়ারে আছে। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে থাকতে তার সঙ্গে রিমির পরিচয় হয়। ওরা একসঙ্গেই পড়ছে। তবুও আগে ওদের মধ্যে তেমন একটা কথাবার্তা হয়নি। পাশাপাশি-কাছাকাছি একসঙ্গে ক্লাস করেছে। কিন্তু কথাবার্তা তেমন হয়নি। আর আগেভাগে পরিচয় না হয়ে ভালোই হয়েছে। তা-না-হলে আরশেদ তার পড়ালেখা শেষ করার আগেই গ্রামে ফিরে যেতো।

একদিন ওদের খুব কথা হলো। একটা গ্রুপ-ডিসকাশনে আরশেদ রিমির দলে জায়গা পায়। আর এখানে গ্রুপের সবাই আরশেদের চেহারাসুরত দেখে তাকেই গ্রুপ-লিডার বানিয়ে দেয়। আর সেইদিন আরশেদ সরাসরি রিমির প্রেমে পড়ে যায়। মেয়েদের নাকি পেটে-পেটে বুদ্ধি! তাই, সে রিমির মনোভাব সেদিন বুঝতে পারেনি। তবুও সে দিনশেষে মেসে ফেরার আগে এই বিষয়ে সে রিমিকে একটা সরাসরি প্রস্তাব দিয়ে দেয়। আর ভাবনা কী? আর দেরি কেন? সে গ্রামের ছেলে। তাই সে রাখঢাক করে চলতে পারে না। রিমিকে তার ভালোবাসার কথাটা জানিয়ে তারপর সে নিশ্চিন্ত-মনে মেসে ফিরে আসে। আর সেদিন থেকে সে একরকম নিশ্চিত হয়ে যায় যে, রিমি তাকে যেকোনো সময়ে বিয়ে করতে রাজী হবে। তার মেসের কয়েক বন্ধুও তাকে উৎসাহভরে তা-ই বলেছে।
না, রিমি এতে কোনো রাগ করেনি। কিংবা তাকে বিদ্রুপও করেনি। তবে সে শুধু একটু হেসেছিলো। আর ওই হাসিটুকু হৃদয়ে মেখে আরশেদ তার মেসে ফিরে এসেছিলো।

সেদিন সে তার মেসের বন্ধুদের কাছে সব বিষয় খুলে বলে। আর তাতে বন্ধুরা একবাক্যে বলে দেয়: মেয়েটি তোমার ভালোবাসা কবুল করেছে। আর এতেই আরশেদ আরও উৎসাহিত হয়ে ওঠে। পরদিন সে ক্যাম্পাসে গিয়ে সরাসরি রিমির হাত ধরে আবারও তার ভালোবাসার কথাটা তাকে জানিয়ে দিলো। আরশেদের কাণ্ডকারখানা দেখে সেদিন রিমি আরও জোরে হেসেছিলো। আর সেদিন দুপুর থেকে ওদের বন্ধুরা দেখলো: ওরা দুজন যেন একটু বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে।
এতে আরশেদের মনে আনন্দ আর ধরে না। সে গ্রামের সাধারণ একটা ছেলে। তবে সে অবস্থাসম্পন্ন ঘরের ছেলে। তবুও তার মতো একটা ছেলেকে—রিমির মতো আধুনিক ও শহরে বড় হওয়া একটি মেয়ে যে ভালোবাসবে—তা সে ভাবতেও পারেনি। ক্লাসের ফাঁকে-ফাঁকে তাদের সম্পর্ক আরও অনেক দূরে গড়াতে থাকে। তবে ক্যাম্পাসের আশেপাশেই শুধু তাদের দেখতে পাওয়া যায়। আর সবসময় দুজনকে একসঙ্গে।

আরশেদ বুঝে গেল এই কয়েক মাসের মধ্যে সে রিমির হৃদয়কুঠুরিতে আশ্রয় পেয়েছে। এতে যেন তার আনন্দের কোনো সীমা-পরিসীমা নাই। সে এতোদিন বরাবরই ছিল একজন খাপছাড়া-মানুষ। আর সেই আরশেদ কিনা রিমির প্রেমে নিমজ্জিত হয়ে বেশ স্মার্ট আর চৌকস হয়ে উঠলো। বন্ধুরা তাকে বাহবাই দিতে লাগলো। এখন আরশেদের কথাবার্তা শহুরে-ছেলেদের মতো।

রিমিকে ক্যাম্পাসে আগে সবাই চিনতো সুন্দরী হিসাবে। আর এখন চেনে সুদর্শন আরশেদের প্রেমিকা হিসাবে। এই নিয়ে রিমির মনে কোনো নেতিবাচক ধারণা নেই। বরং সে আরশেদকে মানুষের কাছে আরও ভালোভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করে।

প্রেমে নাকি ঝড় আছে। একটা ঝড় হঠাৎ করেই এলো আরশেদের জীবনে। সে এমন একটা ঝড়ের ধাক্কা সামলাবার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সে এখনও বেশ সাদামাটা। তাই, সে ধরেই নিয়েছিলো, রিমি তাকে যেকোনো সময় বিয়ে করতে রাজী হবে। সে মারপ্যাঁচ কিংবা অন্য কোনো কৌশল অবলম্বন করতে জানে না। সহজ-সরল আরশেদ তাই আচমকা ধাক্কায় জীবনের হিসাব মিলাতে ভীষণ হিমশিম খাচ্ছে। আর তাই, আজ কয়েকদিন হলো সে খুব মন খারাপ করে মেসেই শুয়ে থাকে। আগের মতো আনন্দ নিয়ে আর ক্যাম্পাসে যায় না। বরং ক্যাম্পাসে ঢুকতেই এখন তার ভীষণ বিরক্তি লাগে। তবুও ফাইনাল পরীক্ষার জন্য তাকে সেখানে যেতেই হয়।

ঘটনাটা ঘটেছিলো ওদের প্রেমের তিন-চার-মাস পরে। একদিন আরশেদের বন্ধুরা ক্যাম্পাসের একপাশে দাঁড়িয়েছিলো। হঠাৎ তারা দেখলো রিমি—আরশেদের রিমি একটি RAV-4 গাড়ি থেকে নামছে। আর সঙ্গে একটি ছেলে। ওরা ছেলেটিকেও চিনতে পারলো। ওদের ডিপার্টমেন্টের, কিন্তু কয়েক ব্যাচ জুনিয়র। আর ছেলেটির নাম আন্দালিব। সে বেশ টাকাপয়সাওয়ালা-লোকের ছেলে। এই ছেলেটির সঙ্গে রিমির যে প্রেমের সম্পর্ক তা তারা মুহূর্তের মধ্যে বুঝে গেল। রিমি ওই ছেলেটির হাতধরে ক্যাম্পাসে ঢুকেছে। আর মুখে তার সেই হাসি। ঘটনাটা ক্যাম্পাসের আরও অনেকে দেখেছে। আর কেউ-কেউ এই নিয়ে খুব হেসেছেও।
আরশেদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠবন্ধু মুতাসিম মুহূর্তের মধ্যে আরশেদকে খুঁজে বের করে তার চোখে দেখা সমস্ত ঘটনা খুলে বলতে বাধ্য হলো। আর সবকিছু শুনে আরশেদ একেবারে স্তম্ভিত হলো। আর ভাবলো: সামান্য কয়টা টাকা আর একটা RAV-4 গাড়ির জন্য রিমি তার এতো সাধের ভালোবাসাকে একেবারে ধূলায় মিশিয়ে দিলো! আরশেদ সেই থেকে ভয়ানকভাবে মুষড়ে পড়েছে। সে রিমির সঙ্গে প্রেম করেছিলো—কখনও অভিনয় নয়। সেদিন বন্ধুদের সঙ্গে সে নিজের চোখে আরেকটি ঘটনা দেখেছিলো—রিমি খুব হাসতে-হাসতে সেই ছেলেটির সঙ্গে আবার গাড়িতে চড়ে কোথায় যেন চলে গেল। আরশেদ যে একটি মানুষ রিমি যেন তা বেমালুম ভুলে গেছে। তার কাছে এখন একটি ফ্ল্যাট আর RAV-4 গাড়িই বড়!
সেই থেকে আরশেদ এখন ক্যাম্পাসে যেতে লজ্জাবোধ করে। তবুও তার বন্ধুরা মেসে এসে তাকে নানারকম সান্ত্বনা দিতে থাকে। এতে অবশ্য কাজ হয়। আর আরশেদ কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
বন্ধুদের সহায়তায় আরশেদ পড়ালেখা নিয়ে এবার খুব মনোযোগী হয়ে পড়লো। আর সে নিয়মিত ক্যাম্পাসেও যেতে লাগলো। ফাইনাল পরীক্ষার আর মাত্র কয়েকদিন বাকী আছে। আরশেদ এখন মেস ছেড়ে আর-কোথাও যায় না। সারাক্ষণ বই নিয়ে পড়ে। এতোদিনের ফাঁকিটা ওর পুষিয়ে নিতে হবে না—তারই যেন একটা জোরপ্রচেষ্টা চলছে।

রিমির ফাইনাল পরীক্ষা আজ শেষ হলো। আর শেষ-পরীক্ষাটা দিয়ে সেদিন সে আন্দালিবের সঙ্গে সন্ধ্যার একটুখানি আগে ওদের ফ্ল্যাটে গেল। আর গিয়েই সে বুঝলো: সে খুবই ভুল করেছে। ফ্ল্যাটে এখন আন্দালিব আর সে ছাড়া আর-কেউ নাই। আর এরকম পরিস্থিতিতে সে পড়ার জন্য আগে থেকে আদৌ প্রস্তুত ছিল না। আন্দলিবের আজকের উদ্দেশ্য তার মোটেও ভালো লাগছে না।

একটু পরেই আন্দালিব যা ইঙ্গিত করলো তাতে রিমি বারবার কেঁপে উঠতে লাগলো। আর তখনই তার বারবার আরশেদের কথাটা মনে পড়তে লাগলো। আরশেদ কখনও তার কাছে কোনো অন্যায় আবদার করেনি। আর সে এখন আন্দালিবের মধ্যে দেখছে শুধু দৈহিক-কামনার সুস্পষ্ট-ছাপ। এছাড়া তার মধ্যে যেন আর-কিছু নাই। তার মনে হলো: আন্দালিব তার সঙ্গে এতোদিন শুধুই প্রেমের অভিনয় করেছে—আর সে এতোদিন যেন তার দেহভোগের একটা চান্সে ছিল। আজ যেন সে এই সুযোগ পেয়ে গেছে। আন্দালিবের চোখে-মুখে এখন অন্যরকম নেশা—একেবারে যেন খুনের নেশা। কামজ্বরে সে এখন ভয়ানক বাতিকগ্রস্ত।

ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝতে পারছে রিমি। আর সে এখন এই ফ্ল্যাট থেকে পালানোর চেষ্টা করছে। এমন সময় সে দেখলো আন্দালিব তার আরও দুই বন্ধুকে ফোনে তার বাসায় আসতে বলছে। এতে আরও ঘাবড়ে গেল রিমি। আর হঠাৎ তখনই তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। সে আন্দালিবের কাছে এগিয়ে এসে বললো, “আমাকে এখনই আইসক্রিম খাওয়াতে হবে। নইলে, আমার মাথাধরাটা ছাড়বে না। প্লিজ, আমার জন্য একটা ঈগলু কিংবা পোলার জাতীয় ছোট্ট-আইসক্রিম কিনে নিয়ে এসো।”
আন্দালিব বললো, “আচ্ছা, এনে দিচ্ছি। আজ তুমি সবই পাবে।”—বলে সে গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল। আর এই সুযোগে তার একটু পরে দ্রুত সিঁড়ি-ভেঙে নিচে নামতে লাগলো রিমি।

রিমি জানে, আন্দালিব লিফটে চড়ে নিচে নেমেছে। আর সে ফিরবেও লিফটে। তাই, সে নিজেকে বাঁচাবার জন্য সিঁড়ি-ভেঙে নিচে নামার বুদ্ধিটা খুঁজে পেয়েছে। আন্দালিব ফেরার আগেই খুব সাবধানে নিচে নেমে রিমি একেবারে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। আর এখানে এখন কেউ তাকে জোর করতে পারবে না। এতোক্ষণে সে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। আর তার মনে হলো: এইমাত্র তার বুকের উপর থেকে হিমালয়-পর্বতটা যেন সরে গেল।
হঠাৎ সে আন্দালিবকে দেখে একটা সিএনজির আড়ালে সরে দাঁড়ালো। আর আন্দালিব চলে যেতেই সে আড়াল থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সা ঠিক করলো—সরাসরি তাদের বাসার দিকে। আর ভয় নাই। তবুও রিমি খুব ভয় পেয়েছে। আর সে রিক্সায় বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে রইলো কিছুক্ষণ। আর সে তখনই বসে-বসে ভাবতে লাগলো: এই জীবনে তার আর RAV-4 গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, টাকাপয়সা কিছুই লাগবে না। তার এখন চাই শুধু আরশেদের মতো একজন ভদ্র-মার্জিত আর সুন্দর মনের ভালোমানুষ। এমন একজন মানুষকেই সে বিয়ে করবে। আর দেরি নয়।

বাসায় ফিরে রিমি তিনদিন একেবারে খুব মনমরা হয়ে বসে রইলো। তারপর সে চতুর্থ-দিবসে ফিরে এলো আরশেদের মেসে। সেখানে এসে সে শুনতে পেলো: পরীক্ষা শেষ করেই আরশেদ গ্রামে ফিরে গেছে। আর তার শহরে ফিরতে এবার দেরি হবে।
রিমির ফোন পেয়ে একটু পরে আরশেদের মেসে এলো মুতাসিম। রিমি তাকে বললো, “আমার সঙ্গে আজ-এক্ষুনি তোকে আরশেদদের বাড়িতে যেতে হবে। আর তুই যেতে পারবি কিনা বল?”
মুতাসিম একটু ভাবদেখানোর ভান করে আমতা-আমতা করার ভঙ্গিতে বললো, “পারবো। তবে কী জন্য যাবো সেটা একবার জানতে পারলে খুব ভালো হতো।”
এবার সলজ্জহাসিতে রিমি বললো, “আমি আরশেদকে বিয়ে করতে চাই। এবং তা আজই। আর আমি ভুল যা করেছি তার জন্য আজই তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবো।”
সব শুনে মুতাসিম ভীষণ খুশি হয়ে বললো, “তাহলে, আমি তোমার সঙ্গে যেতে একপায়ে খাড়া।”
রিমির সঙ্গে আরশেদের মেসের এক বন্ধু—সুলতানও রওনা হলো।

আরশেদের বাড়ি পাবনার রাধানগরে। ওরা সকালে-সকালে গাবতলী গিয়ে একটি ভালো মানের পাবনাগামী-কোচ-সার্ভিসের টিকিট কেটে একসঙ্গে গাড়িতে উঠলো। মুতাসিম আগেভাগে তাদের আগমনের সবকিছু আরশেদকে জানিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু রিমি তাকে এসব বলতে নিষেধ করায় মুতাসিম আর-কিছু করার সাহস পেলো না।


দুপুরে আরশেদ গোসল করার জন্য নিজেদের বিশাল পুকুরের পাশে গিয়ে সবেমাত্র দাঁড়িয়েছে—আর এমন সময় বাড়ির ভিতরে একটা ভয়ানক শোরগোল পড়ে গেল। ব্যাপারটা কী দেখার জন্য সেখানে ছুটে আসতেই আরশেদের চক্ষু একেবারে ছানাবড়া হয়ে গেল। তাদের বাড়ির বিশাল উঠানে দাঁড়িয়ে রয়েছে রিমিসহ তার আরও দুই ঘনিষ্ঠবন্ধু। সে ভয়ানকভাবে অবাক হয়েছে। আর সে এতো অবাক হয়েছে যে, সে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না।

আরশেদ দেখতে পেলো, তার বাড়ির লোকেরা ততক্ষণে এদের বেশ সমাদর করতে শুরু করে দিয়েছে। বিশেষতঃ সুন্দরী রিমিকে নিয়ে তাদের বাড়িতে রীতিমতো হৈচৈ-ই পড়ে গেছে। এইমুহূর্তে আরশেদ রিমিকে উদ্দেশ্য করে তেমনকিছু বলার সুযোগ পেলো না। আর সে দেখলো: তার মা রিমিকে কী সমাদর করে ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন।
মুতাসিম এসে আরশেদকে জড়িয়ে ধরে সব কথা বলে দিলো। সঙ্গে সুলতানও টুকিটাকি কথা বলতে বাদ রাখেনি। আর সব শুনে আরশেদ বললো, “আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে—এজন্য আমি সন্তুষ্ট। এখন বাবা-মা রাজী হলে বিয়েটা আজই হতে পারে।”
মুতাসিম হেসে বললো, “চাচীআম্মা প্রথমেই রাজী হয়েছেন। কারণ, বাড়িতে ঢুকেই আমি তাকে সবকিছু বলে দিয়েছি। ঘটনাটা এখন আর-কাউকে ম্যানেজ করতে হবে না? দেখিস, চাচীআম্মাই সবকিছু ঠিকঠাকমতো ম্যানেজ করে নেবেন।”
ঘটনাটা শোনার পর আরশেদের বাবা তেমনকিছু বললেন না। সবকিছু তিনি আরশেদের মায়ের উপর ছেড়ে দিলেন। তবে তিনি বললেন, “আজ-এক্ষুনি বিয়ে করার কী আছে? আমরা ঢাকা গিয়ে তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে সবকিছু পাকাপাকি করে বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে তোমাদের বিয়ের আয়োজন করবো।”
রিমি তবুও সলজ্জভঙ্গিতে বললো, “বাবা, আজই বিয়েটা পড়িয়ে রাখুন। তারপর না-হয় ঘটা করে আবার সব হবে। তাছাড়া, বিয়েটা আজ এখানে হয়ে গেলে আমি চলে যাবো। আমার বাড়ির লোকজনের সঙ্গে তখন আপনারা কথা বলবেন। কিন্তু আজই বিয়েটা হোক।”
আরশেদের বাবা খুব অভিজ্ঞ মানুষ। তিনি সহজেই বুঝে গেছেন, তার ছেলেটির সঙ্গে এই মেয়েটির হৃদয়ঘটিত ব্যাপারস্যাপার রয়েছে। কিন্তু সেটা কতখানি গভীর-খাঁটি তা তিনি যাচাই করার জন্য একটা চালাকির আশ্রয়গ্রহণ করে আরশেদের উদ্দেশ্যে বললেন, “দেখো বাবা, তোমাদের বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি নাই। তোমার মা যেহেতু রিমিকে পছন্দ করেছে, সেখানে আমার আর বলার কিছু নাই। কিন্তু আমার একটি ছোট্ট-শর্ত। আর তা হলো: তোমার বিয়েতে সব খরচ আমি নিজের হাতে করবো। কিন্তু বিয়েতে রিমির দেনমোহরের টাকাটা কিন্তু তোমাকেই দিতে হবে, বাবা। আর তুমি এইব্যাপারে কারও নিকট থেকে ঋণগ্রহণও করতে পারবে না। তোমার এখন যা-সম্বল তা-ই দিয়ে তুমি আজ রিমিকে ঘরোয়াভাবে বিয়ে করতে পারো।”—কথাটা বলে তালেবুর রহমান সাহেব আরশেদ ও রিমির দিকে তাকিয়ে রইলেন।

একথা শুনে আরশেদ খুব ঘাবড়ে গেল। কিন্তু রিমি একটুও ঘাবড়ালো না। আর সে বললো, “বাবা, আপনার কথা আমি মেনে নিয়েছি।”
আর তখনই তালেবুর সাহেব আরশেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বাপজান, তোমার পকেটে এখন কত টাকা আছে দেখি তো! তোমার মানিব্যাগটা আমার কাছে নিয়ে আসো।”
আরশেদ সুবোধ-বালকের মতো তার মানিব্যাগটা এনে বাবার হাতে তুলে দিলো। আর তালেবুর সাহেব খুব মনোযোগ দিয়ে সব টাকা গুনে দেখলেন—সেখানে মাত্র ৮৩৩ টাকা রয়েছে।
এবার তিনি ঘরের সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমরা কেউ-কিছু বলবে না। এখন আমি আমার রিমি-মায়ের উদ্দেশ্যে একটি কথা বলবো।”
তারপর তিনি রিমির উদ্দেশ্যে বললেন, “তুমি কি মা এই ৮৩৩ টাকায় আমার পুত্রকে বিবাহ করতে রাজী হবে?”
রিমি খুব স্বাভাবিকভাবে-দৃঢ়কণ্ঠে বললো, “বাবা, আমি রাজী। আর আপনি ঘরোয়াভাবে বিয়ে পড়ানোর জন্য এখনই একজন মাওলানা-সাবকে ডেকে আনুন। আমরা তৈরি হয়ে নিচ্ছি!”



সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
রচনাকাল: পহেলা ফেব্রুআরি-৩রা জুন ২০১৬
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৫৫৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৮/০৭/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • পরশ ২৬/০৭/২০১৬
    ভাল লাগলো
  • ফয়জুল মহী ১৯/০৭/২০১৬
    চুম্বকশক্তি আছে, লেখাটি ভালো লাগলো
 
Quantcast