www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মোহ (৫ থেকে ৯ )


বাইরে থেমেছে কিছুটা ঝড়ের তেজ,
নেমেছে শঙ্কার পাহাড় বুকের থেকে
ধীরে ধীরে যেভাবে উষ্ণতার পরশে
গলে গলে যায় জমাট-বাঁধা বরফ
সেভাবেই হয়েছি মুক্ত দুশ্চিন্তা থেকে।
জ্বরগ্রস্ত ভাল্লুকের মতো কাঁপে ফোন,
তুলে নিই হাতে,কাঙ্খিত স্বর-তরঙ্গে
কর্ণ-কুহরে কম্পিত ভয়ার্ত কথন,
"কিছু হয় নি তো তোমার ? কখন থেকে
ডায়াল-রিডায়ালে সাড়া না পেয়ে জানো?
কত অশুভ চিন্তা করেছে তোলপাড়!"
যুধিষ্ঠিরের মতো জীবনে কত বার
মিথ্যা-কথনে হতে হয় বাধ্য কে জানে!
শান্তস্বরে বলি,"তন্দ্রা এসেছিল চোখে";
প্রিয়ার কণ্ঠে এবার অভিমান ঝরে,
"জানো না বুঝি? এই আলাপন আমার
ঘুমের ওষুধ সাতটি বছর ধরে?
তুমিও তো বলেছো কতবার,বারোটা
যখনই বাজে চাঁদ পেয়ে যাও হাতে?
ভুলে গেলে সব?আমাকে ভোলালো তন্দ্রা!?"
"দুঃখিত প্রিয়া, ক্ষমা করো লক্ষ্মী আমার,
এমনটি হবে না আর দিলাম কথা।"
"কাল তবে দেখবো প্রথম শো মেট্রোয়,
অফিস কামাই, বসের ধমক, শাস্তি
তোমার এটাই দিলাম অপরাধের।"
"তোমার এ রায় শিরোধার্য মাই লর্ড,
কাল তবে হবে দেখা মেট্রোর প্রাঙ্গণে।"
ফোন ছেড়ে দীর্ঘশ্বাসে ফুসফুস ভরি,
ঘুম আসে না চোখে;ঝড়ের বেগে তুই
বুকের ভিতরে এসে জুড়ি নিলি সব।
কে যে কেন তোর নাম রেখেছিল 'দিয়া'?
আলেয়ার পিছনে ছুটে পাবি না আলো,
এত কেন মায়া তোর আমার উপর?
আজ যেন মনে হয় এ যে মোহ নয়,
ধীরে ধীরে কখন রাহুরই মতন
বুঝি গ্রাস করেছে তোকে অবুঝ প্রেম!
কি করে বোঝাবো তোকে? সূর্য নই আমি,
ভিন্ন এক কক্ষপথে ঘুরে চলা গ্রহ;
'হে জীবন-নাট্যের নিষ্ঠুর রচয়িতা,
তুমি কি মজা পাও,জ্বেলে প্রেমের চিতা?
কলমে একটু করুণার কালি ভরো,
দিয়ার কোমল হিয়া মোহ-মুক্ত করো।"
কখন থেকে যে একটু একটু করে
ব্যথার মেঘ জমছে বুকের ভিতরে
বুঝতে পারিনি, হঠাৎ অঝোর ধারা
ভাসায় বক্ষ, নেমে এসে দু চোখ বেয়ে।


পাতাল রেলের ঝকঝকে প্ল্যাটফর্মে
পবন-বেগে এলো হলুদ-রঙা ট্রেন,
আনমনা আমি সম্বিৎ ফিরে পেয়েই
কোনরকমে উঠে পড়ি স্বয়ংক্রিয়
দরজা বন্ধ হওয়ার ক্ষণেক আগে,
একটু পরেই শুনি মেয়েলি গলায়
ঘোষণা,"আগলা স্টেশন এসপ্ল্যানেড"
দরজা নিজেই গেল খুলে, নামি ধীরে,
চলন্ত সিঁড়িতে পা রেখে উঠি কিছুটা
আরও কিছুটা উঠলাম সিঁড়ি ভেঙে,
যেন পাতাল থেকে ঊঠে এলাম মর্তে,
অদূরে তাকাতেই প্রিয়ার হাসি মুখ
চোখের মিষ্টি ইশারায় ডাকছে কাছে,
যেতে যেতে ভাবি, সপ্ত পাতালের মধ্যে
একটি নাকি রসাতল! দিয়ার ডাকে
সাড়া দিই যদি, কেন জানি মনে হয়
সেটা হবে রসাতলে যাওয়া মরণ!
তবে কি প্রিয়ার হাত ধরে চলাটাই
হবে মাথা উঁচু করে মর্তে বিচরণ?
ড্রেস সার্কেলের দুখানা টিকিট কেটে
হল-ঘরে ঢুকতেই চোখে অন্ধকার,
ধীরে ধীরে ফোটে আলো,স্বস্তি এলো বুকে।
মনে মনে ভাবি, ফুলের মতো দিয়ার
কাটবে কবে এই মোহের অন্ধকার?
স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি মনে মনে,
"নিষ্পাপ মেয়েটিকে দিয়ো না এত সাজা,
এমন চাওয়া দিয়ো না ওর অন্তরে
যে চাওয়া হবে না পূর্ণ ইহজীবনে।"
সিনেমার পর্দায় "ম্যায়নে প্যার কিয়া"
সালমান-ভাগ্যশ্রীর প্রেমের কাহিনী,
কেন যে সব আজ ঝাপসা লাগে চোখে!
মনের পর্দায় দিয়ার মুখটা ভাসে
আমার দু-চোখে আর কপালে এখনো
যেন লেগে আছে ওর ঠোঁটের পরশ!
কি অসাধারণ মেধা সুশ্রী মেয়েটির!
ভবিষ্যতে আই এ এস হতেই পারে দিয়া;
যে ভাবেই হোক বোঝাতেই হবে ওকে।
বাড়ি ফিরে আগের দিনের ছেড়ে রাখা
প্যান্টের পকেটে কি যেন খুঁজতে গিয়ে
দেখি এক টুকরো কাগজে কিছু লেখা,
চেনা সেই অপূর্ব মুক্তাক্ষরে লিখেছে
"তোমাকে নিজের করে পাবো কি পাবো না
মহাকাল জানে, আমি জানতে চাই না,
আমি শুধু জানি মীরার সেই কাহিনী,
কৃষ্ণ ছিল যার জীবনের ধ্যান-জ্ঞান,
কাছে না পেয়েও আজীবন ছিল ভক্ত,
আমি না হয় হলাম এ যুগের মীরা,
তুমি আমার আরাধ্য দেবতা কানাই।"

সাপ প্রথমে ব্যাঙের মাথাটাই ধরে
তারপর ধীরে ধীরে গেলে পুরো দেহ।
মনে জাগে ভয় দিয়ার চিঠিটা প'ড়ে,
প্রেমই গিলেছে তাকে, এ যে নয় মোহ;
নিজেকেও লাগে অচেনা নিজের কাছে,
স্বপ্ন-ভূমিতে থাকতো কেবলই প্রিয়া,
আজ কেন তবে প্রিয়া চলে যায় পিছে?
হৃদয়-আকাশে ডানা মেলে শুধু দিয়া?
দুর্বলতা কাটিয়ে হতেই হবে শক্ত,
বাঁচাতে হবে তাকে আসন্ন কষ্ট থেকে,
বোঝাতে হবে, এ যুগে হতে নেই ভক্ত,
কৃষ্ণ সেজে আসল মুখ রেখেছি ঢেকে;
বোঝানো যাবে না জানি চিঠিতে বা ফোনে,
ভাবি, মুখোমুখি বসে দিতে হবে জ্ঞান,
অন্তরের জঞ্জাল সরাবো সন্তর্পণে
যাতে পড়াতেই শুধু দিতে পারে ধ্যান।
কামাই হবে কাজ পর পর দুদিন,
তবু যেতে হবে কালই দিয়ার কাছে,
ঘোচাবোই ওর মোহ, ফেরাবো সুদিন,
করবো প্রয়োগ আমার বিদ্যা যা আছে।
রাত বারোটার নিয়মিত ফোনে কান,
মন ডানা মেলে ওড়ে দিয়ার বাগানে,
প্রিয়া শোনায় ফোনে মিষ্টি প্রেমের গান,
কি যে হবে কাল, বিধাতাই শুধু জানে।
নিদ্রাহীন রাত শেষে এলো নয়া ভোর,
হলাম হাজির দিয়াদের আঙিনায়,
আমাকে দেখেই কাটে না দিয়ার ঘোর,
ছূটে এসে ধরে হাত, ঘরে নিয়ে যায়।

ঘরের মেঝেতে দিয়া পেতেছে মাদুর
"একটু বোসো আসছি আমি" বলেই সে
হরিণের মতো ছুটে চলে গেল দূর;
"মিষ্টান্ন এনেছি কিছু" বলে ফিরে এসে,
"এত দেরি হলো কেন, বাবা-মা কোথায়?"
"বাবা গেছে কাজে, মা ভাইকে নিয়ে স্কুলে,
ফ্রিজতো নেই, দেরি তো হবেই মশাই,
দূরের দোকান থেকেই এনেছি কিনে।"
বলি আমি,"পয়সা কোথায় পেলে শুনি?"
"টিফিনের পয়সা কিছু বাঁচিয়ে রাখি,
বুঝলে মাস্টার মশাই? চুরি করি নি,
খেয়ে নাও সব, আমি চা বানাতে থাকি।"
খেতে খেতে ভাবি, কি ভাবে পাড়বো কথা!
চা এনে দিয়া বসেছে বই-খাতা নিয়ে,
সরাসরি যদি বলি, মনে পাবে ব্যথা,
জিজ্ঞেস করি,"কী নিয়ে পড়বি এম এ?"
"ইচ্ছে আছে সাইকোলজি নিয়ে পড়ার",
"তোর মেধা আছে,পড় তুই তাই নিয়ে,
কিছু কথা ছিল তোকে জিজ্ঞেস করার",
"সব কিছু দিতে পারি, তুমি যা চাইবে,
পারবো না কেন দিতে কথার জবাব?"
"কেন আমাকে ভালবাসিস, বল তবে?"
"কেউ কি জানে বলো নিজের স্বভাব?
ফুল কেন গন্ধ ছড়ায় জানে কি নিজে?
জ্যোৎস্না বিলায় কেন জানে কি তা চাঁদ?"
"জীবনটা গদ্য রে, কবিতা নয় সে যে,
ভুবনে পাতা আছে শত মোহের ফাঁদ।
আমি যে পড়াই তোকে বিনা পয়সায়,
সেই কৃতজ্ঞতা থেকে জন্মেছে ভালবাসা,
তাই যদি হয়, তবে শোন মন দিয়ে,
পড়াই তোকে সব কাজ বজায় রেখে,
বলতে পারিস অবসরে জনসেবা,
আরো কিছু ছেলেমেয়েকে পড়াই আমি,
কর্তব্যবোধে যে কেউই পড়াতো তোকে,
এ পর্বটা তোর জীবনে ভীষণ দামি।"
"আমার জীবনে কোনটা দামি আর
কোন্ টা নয়,সেটা তো আমি জানি শুধু,
জেনে রাখো তুমি, কোনো কৃতজ্ঞতা নয়,
আমার প্রতিটি শিরা-উপশিরা জানে,
তুমি ছাড়া জীবনের নেই কোনো মানে,
আরাধ্য দেবতা হয়ে থাকো আজীবন,
আর কিছু চাওয়ার নেই তোমার কাছে,
তুমি চাইলে দিতে পারি আমার যা আছে।"
" শোন্ সোনা শোন্,হরিণ-শিশুটি তুই,
যেতে চাসনা এভাবে বাঘের ডেরায়,
আমারও কামনা আছে, আমিও পুরুষ,
এটা তোর অজানাকে জানার বাসনা,
প্রেম নয়, মোহ এটা, এ মহা কলুষ।"

"অবোধ শিশুকে যেমন গর্ভধারিণী
বর্গীর ভয় দেখানো গান শুনিয়েই
পাড়ায় ঘুম, ঠিক তেমন করে আমি
কামের শার্দুলটাকে পাড়িয়েছি ঘুম
সৌজন্যের ভয় দেখানো গান শুনিয়ে;
দোহাই তোর, জাগাস না এভাবে তাকে,
কাঙাল আমি মানুষের ভালবাসার,
সম্মান খোয়াতে হলে বাঁচবো না আমি।"

"কে তোমাকে বলেছেগো খোয়াতে সম্মান?
আমাকে ভেবো না তুমি অন্যদের মতো,
তোমার কাছে মোর নেই কোনো প্রার্থনা,
তোমার দেখা পেলেই সার্থক জীবন,
শুনিয়ো দরাজ কণ্ঠে মধুর বচন,
নিশ্চিন্ত্য থাকো তুমি, চাই না আর কিছু।"

"বল্ না আমাকে, কেন হলি মোর ভক্ত?
মনসা করেছে কত চাতুরি-ছলনা
চাঁদ সদাগরের পুজা পাবার তরে,
দেবী চণ্ডীও কালকেতুর পুজা পেতে
স্বর্ণ-গোধিকার বেশে করেছে প্রয়াস।
বন্ধুরা বলে, বড় কঠিন কর্ম নাকি
সুন্দরী তরুণীর হৃদয় জয় করা,
কাঠ-খড় নাকি পোড়াতে হয় প্রচুর,
গাঁটের কড়িও খসাতে হয় দেদার,
আমি তো কিছুই করিনি এসব তোকে,
তবু কেন ভালবাসলি আমাকে তুই?"

'জানি না জানি না, জানতে চেও না তুমি,
জানি শুধু দিনে-রাতে মনের পর্দায়
ভেসে ওঠে কেবল তোমার ওই মুখ,
সূর্যের আলোয় একটু একটু করে
পাঁপড়ি মেলে ধরে সূর্যমুখী যেমন,
তোমার স্ংস্পর্শে তেমন ধীরে ধীরে
হয়েছি পাগলিনী, মজেছে পোড়া মন,
জানি গো জানি, তোমাকে পাবো না কখনো,
জল যদি নাও পায় চাতক, তবুও কি
'ফটিক জল' বলা থামাতে পারে বলো?"

থেমে যায় দিয়া, দু চোখে জলের ধারা,
ছোঁয়াচে রোগের মতো ওর ব্যথা বুঝি
দ্বিগুণ হয়ে জ্বলে ওঠে আমারো বুকে;
হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে টেনে নিই
বুকে ওকে, সহসা যে দিয়ার হৃদয়
আমার হৃদয়ে মিশে এক হয়ে যায়!
গভীর চুম্বনে দিয়ার বিম্ব-অধরে
আমূল ডুবে যায় আমার এ অধর,
ভাষায় যায় না বলা এ কেমন সুখ!
দুজনের অশ্রু ভাসায় দুজনের বুক।
বিষয়শ্রেণী: কবিতা
ব্লগটি ৬২৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১২/১১/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • ফাহমিদা ফাম্মী ১২/১১/২০১৩
    smile
  • জহির রহমান ১২/১১/২০১৩
    পড়ছি... আর নিজেই একটা মোহে জড়িয়ে পড়ছি। :)
    • সহিদুল হক ১৩/১১/২০১৩
      অজস্র ধন্যবাদ ভাই জহির। ভাল থেকো সদা।
      ১৫ পর্বে সমাপ্তি টানবো ভাবছি।
 
Quantcast