www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মাতৃত্ব

ছোট্ট তিন্নীকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে ! ছোট্ট বেনারসী শাড়ীর পোশাক , কপালে চন্দনের আলপনা আর মাথায় ফুলের মুকুট – তিন্নী যেন এক রাজকুমারী ! আজ তিন্নীর অন্নপ্রাশণ , মামুর হাতে প্রথম ভাত খাবে আজ । একটু দূরে দাঁড়িয়ে অপলকে তিন্নীকে দেখছিল শর্মিলা । হঠাৎ কানের কাছে শুনতে পেল , এই দিদি, কাঁদছিস কেন ? চমকে উঠে শর্মিলা গালের উপর হাত দিয়ে চোখের জল মুছে ফেললো, কখন যে অজান্তে চোখের জল বেড়িয়ে গাল বেয়ে নেমেছে তা বুঝতেই পারেনি ! বোন ঊর্মিলার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলো, না রে , কাঁদবো কেন ? দিদির হাতে সহানুভূতির অল্প চাপ দিয়ে ঊর্মিলা বলল , বুঝি রে দিদি, তোর কষ্ট । কি করবি বল , ভাগ্যের উপর কি কারও হাত আছে ? তিন্নীই তো তোর মেয়ের মতো । শর্মিলা বলে ওঠে, হ্যাঁ হ্যাঁ , সে তো নিশ্চই বোন !
ঊর্মিলার শাশুড়ী ঊর্মিলাকে ডাকছেন , সে চলে যায় অন্যদিকে । শর্মিলা তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে ভাবে, সে তিন্নীকে খুব ভালোবাসে, সে জানে তিন্নী তার মেয়ের মতোই, কিন্তু মেয়ে নয় !! তাই আজ এই শুভদিনে সে তিন্নীকে একবারও কোলে নিতে পারেনি ! ঊর্মিলা দিদির কষ্ট বুঝে তিন্নীকে বেশী বেশী করে দিদির কাছে দিতে চায় , কিন্তু তার শাশুড়ী একটু বেশীই প্রাচীনপন্থী । বিয়ের দশ বছর পরেও আজও শর্মিলা মা হতে পারেনি , তাই সমাজের চোখে সে বন্ধ্যা নারী, কোনও শুভকাজে তার স্পর্শ চলে না ! শাশুড়ীর কথা অমান্য করার সাহস ঊর্মিলার নেই, তাই দিদির কাছে আগেই হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে সে । শর্মিলা একবার ভেবেছিল আসবে না কিন্তু তিন্নী যে তার প্রাণের টুকরো । আজ সে প্রথম ভাত খাবে আর সে আসবে না ? তাই কষ্ট পাবে জেনেও না এসে থাকতে পারেনি । সমাজের কি অদ্ভূত নিয়ম ! কত সহজে এক নারীকে ‘বন্ধ্যা’ বলে দাগিয়ে দেয় ! কেউ কি কখনও জানতে চেয়েছে সন্তান না হওয়ার ব্যর্থতার জন্য দায়ী কে ? পিতা-মাতা দুজনে মিলেই তো জন্ম দেয় এক সন্তানের , তাহলে সন্তান না হওয়ার দায় কেন যুগ যুগ ধরে শুধু নারীরাই বহন করে চলবে ? কেন সবার অপমান সহ্য করে নীরবে চোখের জল ফেলবে ? কেন তার অসীম স্নেহের স্পর্শ অশুভ বলে গণ্য হবে ? শর্মিলা ভাবে, তার স্বামীকে তো কেউ বারণ করেনি তিন্নীকে কোলে নিতে !! তাহলে কেন তার প্রতি এই নিষেধাজ্ঞা ? তার হৃদয় নিঙড়ানো মাতৃত্ব স্তন্যসুধা হয়ে কোনও শিশুকে তৃপ্তি দিতে পারেনি বলে ? কিন্তু তার এই অতৃপ্ত মাতৃত্ব তো সে উজাড় করে দিতে চায়... কিন্তু কেউ নেই তা গ্রহণ করার মতো । তাহলে কি সবই ভাগ্য ? আজকের যুগেও মানুষ ভাগ্যের কাছে অসহায় ? কিন্তু তা তো নয় ! কত বুভুক্ষু মতৃহৃদয় তো সন্তান কোলে নিয়ে মাতৃত্বের হাসি হাসতে পেরেছে ! তবে কেন সে পারবে না ? আজকের চিকিৎসা বিজ্ঞান কত অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছে, কত তথাকথিত ‘বন্ধ্যা’ নারী সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে । তবে সে কেন বঞ্চিত হবে তা থেকে ?
শর্মিলার মনে পড়ে যায় বিয়ের কিছুদিন পরের কথা । বি.এ. পড়তে পড়তেই তার বিয়ে হয়ে যায়, এক বিয়েবাড়ীতে সুন্দরী, নম্র শর্মিলাকে দেখে তার শ্বশুরমশাই এর খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো, তার একমাসের ভেতরেই বিয়ে । স্বামী সুদর্শন সত্যই সুদর্শন, উপরন্তু বিদেশী কম্পানিতে উচ্চপদে চাকুরীরত, তাই বাবা-মা এ বিয়েতে খুব খুশী হয়েছিলেন । সেও সুপুরুষ ও ভদ্র স্বামীকে পেয়ে কিছু কম খুশী হয়নি । সুদর্শন তার সুন্দর মার্জিত ব্যবহার দিয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছিল । হনিমুনে কাশ্মীর গিয়েছিলো তাঁরা, দিঙ্গুল কেতে যাচ্ছিলো স্বপ্নের মতো, কিন্তু রাত এলেই সুদর্শন যেন কেমন আড়ষ্ট হয়ে যেতো ! একটু গল্প করতে করতেই তার খুব ঘুম পেয়ে যেতো ! সুন্দরী যুবতী স্ত্রী এর সঙ্গে রাত জাগার কোনও আগ্রহ তার মধ্যে দেখতে পেত না শর্মিলা ! বিয়ের আগে বিবাহিতা দিদি ও বৌদিদের কাছ থেকে শোনা কোনও কিছুর সঙ্গে কিছুতেই যেন মিল খুঁজে পেত না ! সে তখন নতুন বৌ, লজ্জায় স্বামীকে কিছু বলতেও পারত না ! বৌদিদের কাছ থেকে শোনা তাদের ফুলশয্যা ও মধুচন্দ্রিমার কাহিনীর সঙ্গে নিজের কল্পনার রঙ মিশিয়ে যে লজ্জামধুর ছবি সে এঁকেছিল, তা তো প্রাণ পেল না এখনও !!
ফিরে এলো বাড়ীতে , দিদি বৌদিদের রসালো প্রশ্নের উত্তরে বলবার মতো কিছুই তার অভিজ্ঞতার ঝাঁপিতে জমা হয়নি । কোনও রকমে সকল্কে এড়াতে পারলেও বৌদিদিকে কিছুতেই এড়াতে পারেনি সেদিন । বৌদিদির অভিজ্ঞ চোখে বুঝি ফাঁকিটা ধরা পড়ে গিয়েছিলো । তার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সব বলেছিল শর্মিলা । বুঝতে পারলো , তার স্বামীর কোনও সমস্যা আছে বিবাহিত জীবনে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনে । কিন্তু সেটা কি তিনি আগে জানতেন না ??
শ্বশুরবাড়ীতে এসে অসীম সাহসে ভর করে ধীরে ধীরে স্বামীকে কিছু কিছু প্রশ্ন করেছিলো শর্মিলা । সুদর্শন প্রথমে স্বীকার না করলেও পরে স্বীকার করেছিলেন নিজের শারীরিক সমস্যার কথা, নিজের অপারগতার কথা । শর্মিলা তাকে অভয় দান করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল । কিন্তু পারেনি, এই দশ বছর ধরে মানে-অভিমানে , রাগে-অনুরাগে, অনাহারে-অনশনে , ক্রোধে , জেদে বিভিন্নভাবে সুদর্শনকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে – কিন্তু সফল হতে পারেনি । সুদর্শনের স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসায় কোনও অভাব নেই, কিন্তু এউ একটি ব্যাপারে তার ইগো প্রবল । শর্মিলার কোনও কথাই যেন সে শুনতেই পায় না ! তাকে এ ব্যাপারে কিছু বলা আর দেওয়ালের সঙ্গে কথা বলা সমান ! লজ্জার মাথা খেয়ে শর্মিলা শাশুড়ীমার কাছেও কথাটা তুলেছিল, কিন্তু তিনিও কি অদ্ভূতভাবে ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়েছিলেন । বাপের বাড়ি থেকে মা, বৌদি সবাই চেষ্টা করেছিলো ওদের বোঝাতে, কিন্তু কোনও কিছুতেই কোনও কাজ হয়নি ।
সুদর্শন-শর্মিলার বিবাহিত জীবন আজ শুধুই অভ্যাস । দাম্পত্য জীবনের অন্যতম এক শর্ত পূরণ না করেও সমাজের চোখে তারা দম্পতি । শর্মিলা অনেকবার ভেবেছে কি লাভ এই অসম্পূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে জীবন কাটানোর ? আবার এই সুতো ছিঁড়ে ফেলতে গিয়েও তা পারেনি, সুদর্শনকে সে খুব ভালোবাসে যে !! কি অদ্ভূত এই মানুষের মন – যার থেকে দূরে সরে থাকতে চায় তাকেই আবার ভালোবেসে ফেলে ! মাঝে মাঝে নিজেই ভাবে, এ ভালোবাসা কি স্বামীর প্রতি পত্নীপ্রেম না কি তার হৃদয়ের গভীরে লুকোনো ব্যর্থ অপত্যস্নেহেরই ভিন্নরূপে বহিঃপ্রকাশ ?
তিন্নীকে নিয়ে আজ সবাই কত আনন্দ করছে । মাতৃত্বের পূর্ণ রূপ ঊর্মিলার চোখে-মুখে ঝলমল করছে । শর্মিলাও ‘মা’ হতে চায়, ছোট্ট একটা নরম শরীর বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরতে চায় । তিন্নীর জন্মের পর থেকেই একটু একটু করে শর্মিলার মনে একটা প্রত্যয় দানা বাঁধছিল । আজ সে দৃঢ়সঙ্কল্প হল, আর নয় , চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে এবার সে ‘মা’ হবেই । আর সুদর্শন যদি এখনও তাতে অরাজী থাকে তাহলে সে দত্তক নেবে কোনও অনাথ শিশুসন্তানকে, নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে, এতদিনের জমে থাকা মাতৃস্নেহের সবটুকু দিয়ে তাকে বড় করে তুলবে । সে আজ দৃঢ়প্রত্যয়ী, কোনও কিছুই আজ আর তাকে দমিয়ে রাখতে পারবে না, শর্মিলা এবার জিতবেই, মাতৃত্ব জয়ী হবেই ।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১০৩৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৫/০৩/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • ফয়জুল মহী ৩০/০৩/২০১৬
    প্রাণবন্ত লেখা
  • পরশ ১৫/০৩/২০১৬
    সহমত
  • আগে তো নারীত্বের শর্ত পূর্ণ হবে তারপর মাতৃত্বের ! অক্ষম পুরুষ সাধারণত নানা অজুহাতে বিয়ে করতে চায়না, অক্ষমতার লজ্জাও কম নয়। সেসব ক্ষেত্রে বিয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়না। গল্পের খাতিরে পরিস্থিতিকে ব্যতিক্রমী মনে করলেও গল্পটিকে প্রাচীন পন্থী মনে হয়।
    কিছু টাইপো আছে।
 
Quantcast