www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

বিবেকানন্দ এবং সমকালীন ভাবনা

পাঠক, প্রথমেই অনুরোধ রইল সময়ের বিষয়টা খেয়াল রাখবেন। কেননা একশ পঞ্চাশ বছর আগের কথা বলছি। যখন অবিভক্ত ভারত বৃটিশদের অত্যাচারে জর্জরিত ছিল। সেই সময় বিবেকানন্দ সংকল্প করেছিলেন বৃটিশ শাসন থেকে মুক্ত হতে হবে। সেই অর্থে বিবেকানন্দ পরবর্তী বিপ্লবীদের মন্ত্রগুরু। গান্ধী, নেহেরু, নেতাজির মত ব্যক্তিরাও বিবেকানন্দের ব্যক্তিত্বে আপ্লুত ছিলেন। ডান, বাম, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সকলের কাছেই তিনি প্রিয়। তিনিই প্রাচীন ভারতীয় দর্শনকে আধুনিক বিশ্বে সহজ করে তুলে ধরেছেন। বিবেকানন্দ রচনাবলী পড়লে তা সহজেই বোঝা যায়। যেখানে যেটা ভাল সেটা গ্রহণ করার মত উদার মানসিকতা তাঁর ছিল। তিনি বলেছিলেন ধর্মীয় সংস্কার এবং অহঙ্কার ছেড়ে আগে খাওয়া পড়ার ব্যবস্থা করতে। তিনি বুঝেছিলেন পরজীবী ব্যবসায়ী শ্রেণী নয় শ্রমজীবী ব্যবসায়ী শ্রেণীই আমাদের উন্নতি ঘটাতে পারে। উদাহরণ দিয়ে তিনি দেখিয়েছিলেন বেদান্তের চোখে নারী পুরুষ সমান। স্বার্থান্বেষী মহলের সৃষ্ট জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আমরা সংস্কারমুক্ত হই। আত্মউপলব্ধির মাধ্যমে বিচার বিশ্লেষণ করে পথ চলি। মনোবল বৃদ্ধিতে তাঁর লেখা আজো ভীষণ অনুপ্রেরণা দেয়। সন্ন্যাসী হয়েও তিনি কেবল নিজের মুক্তির কথা না ভেবে সংসারের সকলের সমস্যার কথা ভেবেছেন। ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, নিপিড়ীত, নির্যাতিত, শোষিত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত মানুষের জন্য দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন। একাধারে ভাববাদ ও বস্তুবাদের সমন্বয় তাঁর মধ্যে দেখা দিয়েছিল। এইসব দিক থেকে তিনি কালোর্ত্তীন, অর্থাৎ যুগের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। তাঁর সময়ে এই ধরণের চিন্তা চেতনার জন্যে তাঁকে অনেক সমালোচনাও সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু সেইসব সমালোচক কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে। কেউ তাদের মনে রাখেনি। মনে রেখেছে বিবেকানন্দকে। তিনি যে এসেছিলেন তাঁর একটা চিহ্ন রেখে গেছেন। কিন্তু আমরা যারা বিবেকানন্দের ছবি ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখি, বইয়ের তাকে বিবেকানন্দের লেখা সাজিয়ে রাখি, মঠে-মন্দিরে, সভা-সমিতিতে বিবেকানন্দের বিষয়ে বক্তব্য রাখি তাঁরা তাঁর রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজের কতটা সমাপ্ত করতে পারছি। দেড়শ বছর চলে গেলো এখনো কুসংস্কার, জাতিভেদ সমাজ থেকে গেলনা। বরং রূপ পাল্টে আরো ভয়াবহ রূপে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। বিভিন্ন উপাসনালয়, বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন উপাস্য, বিভিন্ন মতবাদ, পরস্পরবিরোধী বক্তব্য, ধর্মান্ধদের সহিংসতা, ধর্মব্যবসায়ীদের আনুষ্ঠানিকতা, ধর্মোন্মত্তদের আচারসর্বস্বতা, দলভেদ, পোশাকনির্ভর ধর্ম, ধর্মীয় উপনিবেশ, একেশ্বরবাদ, নিরীশ্বরবাদ, বহু ঈশ্বরবাদের প্রচার প্রসার, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ধর্মের অবাধ বাণিজ্য, অনাচার, অত্যাচার, জাতীয়তা, আঞ্চলিকতা, লৌকিকতা, অলৌকিকতা, আসক্তি, অনাসক্তি, নিরাসক্তি ইত্যাদি হাজার সমস্যায় সমাজ জর্জরিত হয়ে পড়েছে। সভ্যতা ও আধুনিকতার মুখোশ পড়ে অসভ্যতা ও বর্বরতা সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মানুষের পরিচয় এখন মানুষ নয়। বরং কার শিষ্য, কোন ধর্মের, কোন মতবাদের তা-ই দেখা হয়। এই মায়াজাল ছিন্ন করে মানুষকে তার আসল পরিচয়ে পরিচিত করতে যে আয়না দরকার সে আয়না নিয়ে বিবেকানন্দ, পরমানন্দের মতো মানুষেরা এসেছিলেন; তাঁদের মতো মানুষের আজ বড় প্রয়োজন। আমাদের এখন তাঁদের চরণ না ধরে তাঁদের আচরণ ধরতে হবে। নির্দ্বিধায় বলতে হবে এসব আধ্যাত্মিকতা নয়। প্রকৃতির নিয়ম থেকে দূরে সরে গিয়ে মানুষ প্রকৃতির অবাধ্য সন্তান হয়ে প্রকৃতি প্রদত্ত শাস্তিস্বরূপ বিভিন্ন দুর্যোগ, বিপর্যয় ও মহামারি ডেকে আনছে সমগ্র বিশ্বজুড়ে। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ এখন নিকৃষ্ট প্রাণীর চেয়েও নির্মম, নির্দয়, নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে। সব কিছুই এখন ব্যাপক আকারে সংঘটিত হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে সুখের চেয়ে অসুখের, ভালোর চেয়ে মন্দের, সত্যের চেয়ে অসত্যের, আসলের চেয়ে নকলের প্রসার বেড়ে গেছে। প্রচারবিমুখ যাঁরা মহাজাগতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দায়িত্ব পেয়ে মানুষের কল্যাণে মানুষের সুখের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তাঁদের ছেড়ে প্রচারসর্বস্ব সুবিধাভোগী মানুষের সৃষ্ট অবাস্তব চিন্তাপ্রসূত মরীচিকার দিকে অসহায়, অজ্ঞানী, অসচেতন, অর্ধসচেতন, অচেতন, অপরিণামদর্শী, অদৃষ্টবাদী মানুষেরা দলে দলে ছুটে যাচ্ছে। একবারও ভাবছেনা- যে নিজে শান্তিতে নেই সে অন্যকে কিভাবে শান্তি দিবে। যে অন্যের উপর নির্ভরশীল সে কি করে অন্যের দায়িত্ব নেবে। যে নিজে সংস্কারমুক্ত নয় সে কি করে কুসংস্কার দূর করবে। ফলে প্রতারণার ফাঁদে পড়ে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় ও অর্থ নষ্ট করছে। প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী কেউ হয়তো বেরিয়ে আসতে পারছে, কেউ পারছে না। পুরো জীবনটাই ভুলের মধ্যে কেটে যাচ্ছে। মানুষের দুর্বলতাকে পুঁজি করে সুখ, শান্তি, ঐশ্বর্যের আশ্বাস দিয়ে এরা আসলে নিজের স্বার্থসিদ্ধির পাঁয়তারা করছে। নতুনকে মানুষ গ্রহণ করবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু নির্বিচারে গ্রহণ করাটাও ঠিক নয়। বিবেকানন্দ বিচার না করে কোন কিছু গ্রহণ করেন নি, তাঁর সতীর্থদেরকেও তিনি বিচার করতে উৎসাহিত করতেন, এমনকি তাঁর কথাও নির্বিচারে গ্রহণ করতে নিষেধ করতেন, একই মতের পক্ষে, বিপক্ষে এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করে দেখাতেন যে বিভিন্ন দিক থেকে দেখলে একই বিষয়ে বিভিন্ন মাত্রা আরোপ করা যায়। তাই আমরাও আমাদের মস্তক বন্ধক না দিয়ে সুস্থ মস্তিস্কে সবদিক বিচার করে যা যুগোপযোগী কল্যাণকর তাই গ্রহণ করব এবং আপত্তিকর অমানবিক যে কোন কিছু যেই বলুক যেখানেই বলুক যেভাবেই বলুক নিসংকোচে নির্ভয়ে নির্দ্বিধায় বর্জন করব এবং অন্যদেরকে সে বিষয়ে সচেতন করতে সচেষ্ট থাকব। যে কোন ধরণের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াবো। আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হোক।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ১১১৬ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০১/১১/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast