www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম

একসময় সামাজিক রীতিনীতি, সামাজিক রেওয়াজ, সামাজিক কাঠামো কতইনা মজবুত ছিল। সমাজে প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। অভাব থাকলেও সেটা কোন ব্যাপার ছিল না। ধনী-গরীবের ব্যবধানও ছিল কম। শাহ আব্দুল করিমের (বাউল) ভাষায়-আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। বর্তমানে ইটপাথরের নাগরিক ও যান্ত্রিক যুগে সমাজের সেই চেহারা আর বর্তমান নাই। সামাজিক মূল্যবোধ সমাজ থেকে সমূলে দূরীভ‚ত। আগে সমাজে বিভিন্ন রকমের আচার অনুষ্ঠান হতো। আর তা ধনী-গরীব সবাই সমান তালে উপভোগ করতো উৎসাহ ভরে। এক সমাজের সাথে আরেক সমাজের একটা প্রতিযোগীতাও ছিল। বিভিন্ন রকমের ভালো ও আন্দদায়ক কাজের উৎসাহ উদ্দীপনা মূখ্য বিষয় ছিল। যেমন-ষাঁড়ের লড়াই, মুরগির লড়াই, বলি খেলা, ফুটবল প্রভৃতি খেলার প্রতিযোগিতা হতো। যাত্রা, জারী, পালা গান ইত্যাদি বেশ ভালই জমতো আসর। বিশেষ দিনকে উপলক্ষ্য করে এসব প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। যারা ভালো করতো প্রতিযোগীতায় তাদের নাম ডাক আশ-পাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়তো। যা সমাজের মানুষগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে সহায়ক ছিল। কোন রকম সমস্যা দেখা দিলে সমাজের সৎ, সম্মানিত ও যোগ্য ব্যক্তিদের শরনাপন্ন হতো। কারো কোনরূপ সমস্যা সম্মুখীন হলে, অন্যেরা সামর্থ অনুযায়ী সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। ন্যায় সংগত সমাধানের পথ খুঁজে বের করতেন নিঃস্বার্থভাবে। অভাবের কারণে কারো মেয়ে বিয়ে দিতে অসুবিধা হলে, যার যা সামথ্য ছিল সহযোগীতা করা হতো। যেটা উপভোগ্য উপাদান ছিল। কিন্তু আজ ঐসব অতীত। সমাজিক বন্ধন বলে আর কিছুই বর্তমান নাই।
সবাই এখন নিজকে নিয়ে চিন্তিত। নিজের ক্যারিয়ার গঠনে ব্যস্ত। নিজের ভবিষ্যৎ কিংবা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে যতটা চিন্তিত নিজের বাবা-মা’কে নিয়ে ততোটা চিন্তিত হতে কাউকে দেখা যায় না। যে বাবা-মা হৃদয় নিংড়ানো ¯েœহে সন্তানদেরকে লালন-পালন করেছেন একেবারে নিঃস্বার্থভাবে। আজ নিজের হীন স্বার্থের কারণে বাবা-মা’কে আর সন্তানদের সহ্য হয়না। অথচ নিজের সন্তানদেরকে যতো রকমের সুবিধা আছে জগতের, সকল সুবিধা দিতেও কুন্ঠাবোধ করেনা। কিন্তু বাবা-মা’য়ের জন্য হলে-চলে নানান অযুহাত। অবশেষে অনেকের অবস্থান তো আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। বৃদ্ধাশ্রম! এক নতুন সংস্করন বাঙ্গালীর সমাজে প্রচলন ঘটেছে। যা পূর্বে কখনো ছিল না। আর এটা কারো জন্য কাংক্ষিতও না। এইজন্য দায়ী কে?
অবশ্য বাবা-মা এখন আর নাতী-নাতনীদের আগের মতো আদর-কদর করার সুযোগ পান না ইচ্ছা থাকলেও। কারণ যৌথ পরিবার গুলো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। সামান্য সুখের আশায় সবাই আলাদাভাবে নতুন বাড়ী করছে। কেউ শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। বাবা-মা’দেরকে গ্রামেই থাকতে হচ্ছে। ফলে নাতী-নাতনীরা দাদা-দাদীর আদর-কদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে পদ্ধতিগত কারণে। নাতী-নাতনীরা আর আগের মতো দাদা-দাদী’কে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে সুযোগ পাচ্ছে না। দাদা-দাদীরাও যে ঐপরিবারেরই সদস্য, সেটা আর নাতী-নাতনীরা জানতে/মেনে নিতে পারে না। নাতী-নাতনীরা দাদা-দাদীর সাথে একত্রে বসবাস করলে তারা যে নৈতিক শিক্ষা ও দোয়া পেতো। তা তাদের বাকী জীবনের চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকার কথা ছিল। কিন্তু তার আর কোন সুযোগ নেই। উভয় পক্ষে সম্পর্কের একটা বড় ফারাক সৃষ্টি হচ্ছে যৌক্তিক কারণে। আর এতে করে মানসিক বিকাশ কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশু-কিশৌরদের। আত্মীয়তার বন্ধন তথা সামাজিক বন্ধন ভেঙ্গে যাওয়ার এটাও একটা অন্যতম কারণ। একটু আরাম আয়েসে থাকার আশায় মানুষ কতো যে পাষাণ হয়ে যাচ্ছে। তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একক পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশ (গবহঃধষ ঐবধষঃয এৎড়ঃিয), বুদ্ধিমত্তা (ওহঃবষষবপঃঁধষ), সাধারণ জ্ঞান (ঈড়সসড়হ ঝবহংব), নিজের প্রতি আস্থা (ঝবষভ-পড়হভরফবহপব), এবং নৈতিক মূল্যবোধ (গড়ৎধষ ঠধষঁবং), কখনো যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোরদের সমত‚ল্য হবে না।
কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম’সহ অনেক দেশ আছে এখনো তারা যৌথ পরিবার পদ্ধতি চালু রেখেছে। ছোট একটা ঘরে অনেক লোক বাস করলেও তারা কোন প্রকার হীনমন্যতায় ভোগে না। বয়ো-বৃদ্ধদের মূল্যায়ন কোনভাবে কম নয়, তাদের সমাজে। বয়ো-বৃদ্ধদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে যুব সমাজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। আর বাঙ্গালী মুসলমান সমাজে আমরা পুরো উল্টো একটা চিত্র দেখতে পাচ্ছি। বিশেষ করে নতুন বউ’রা শাশুরীদের অথবা শশুর বাড়ীর লোকদের অপেক্ষকৃত কম খাতির যতœ করার চেষ্টা করেন। ক্ষেত্র বিশেষে একেবারে সহ্য করতে পারে না, এমন নজিরও আছে। একারণে অনেক সময় অনেক অনৈতিক/অপরাধ সংঘঠিত হতে দেখা যায়। সম্পর্কের ছেদ সৃষ্টির দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল খুবই খারাপ ও ভয়ানক হতে পারে। যা পরবর্তীতে বৃদ্ধা বাবা-মা’র জন্য অনেকটা মনো কষ্টের কারণ হয়ে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সাথে চিরদিনের জন্য সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেতে পারে সন্তানদের। মনে রাখতে হবে যে, আজ যে তরুন নওজোয়ান, কাল সে হবে বৃদ্ধ। দুনিয়ার মোহে বাবা-মাকে অবহেলার কারণে দূরে ঢেলে দিয়ে কোন লাভ নেই; কারণ সন্তানরাও তোমাকে একই ভাবে দূরে ঢেলে ফেলে দিতে পারে, যখন তুমিও বৃদ্ধ বয়সে উপনিত হবে। ভ‚লে গেলে চলবে না-প্রত্যেক মানুষের জন্য একইভাবে জীবন চক্র বহমান। আজ যে বউ, কাল সে হবে শাশুড়ী। আজ যে লৌহ মানব, কাল সে হবে রোগাগ্রস্ত অসহায় বৃদ্ধ। আজ তোমার অনেক টাকা, অফিসে অনেক বড় পদের চাকুরী, অনেক নামী দামী ব্রান্ডের গাড়ী, সবাই তোমাকে অনেক মূল্যায়ন করে, তুমি যা বল আর সবাই এক বাক্যে মেনে নেয়। কাল এসবই অতীত হয়েও যেতে পারে।
একক স্বাধীনচেতা পরিবোরে বেড়ে ওঠা বর্তমান সময়ের ছেলে-মেয়েদের মন মেজাজ একদম খিটখিটে, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিক চরিত্র ও বড়দের প্রতি সম্মানবোধ সামান্যতমও নেই বলে মনে হয়। মুখে মুখে তর্ক করা। অন্যকে কথা দিয়ে হলেও ঘায়েল করার চেষ্টা। নিজের এটা আছে, সেটা আছে, এই সবের অহংবোধ মারাত্মকভাবে গিলে খাচ্ছে সমাজটাকে। যার পরিণামে আমরা সমাজে নানান রকমের অপরাধ ও অস্থিরতা দেখতে পাচ্ছি। যা নিয়ে অনেক অভিভাবকও যেমন শঙ্কিত তেমনি হতবম্ব। খুব দ্রæত পাল্টে যাচ্ছে সমাজের মানুষগুলোর মনমানসিকতা। সবাই কেন জানি একটু বেশী আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। সমাজের এই ভয়াবহ অবস্থা দেখে সমাজ বিজ্ঞানীরাও চিন্তিত। এই সবের সমাধান কি?
কোন কিছুর বিনিময়ে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা যাবে না। সামাজিক বন্ধন অটুট রাখতে হলে ছেলে-মেয়েদের শিশু বয়স থেকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। ধৈর্য ও ত্যাগ স্বীকারে অভ্যাস করতে হবে। ছোটখাটো ত্যাগ স্বাীকারও অনেক বড় প্রাপ্তি এনে দিতে পারে। অভিভাবক ছাড়াও শিক্ষকদের আরো পেশাদারিত্ব সূলভ আচরণ বাড়াতে হবে। সমাজের মধ্যে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ও অস্থিরতা থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে। তা না হলে চরম অস্থিরতা জাতিকে নিয়ে যাবে এক অজানা অন্ধকার রাজ্যে। হতভাগ্য অস্থির জাতিকে পরবর্তী প্রজন্ম কখনো সহজভাবে নিবে না। (লেখক: কবি, কলামিস্ট ও ঊন্নয়ন কর্মী)
Cell# 01715363079
[email protected]
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৬৫৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৪/১০/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • well done
  • সোলাইমান ২৬/১০/২০১৭
    অপূর্ব সুন্দর কাব্যিকতায় লেখা দারুন সুন্দর। অনেক অনেক শুভকামনা রইল প্রিয় কবি।
  • লেখার শিরোনাম Khair-Columnistএটা না হয়ে আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম হওয়া উচিত ছিলো
  • আজাদ আলী ২৪/১০/২০১৭
    Valo
 
Quantcast