www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

রাতের অন্ধকার

তখন সবে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে উঠেছি, সামনে এক লম্বা ছুটি, প্রায় মাস তিনেকের , মনে মনে অনেক প্ল্যান পরিকল্পনা করে ফেললাম, কার কার বাড়ি যেতে হবে, কী কী সিনেমা দেখতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি, এর মধ্যে আবার বাবা বোলে উঠলেন – দিপু এই যে ছুটিটা পেয়েছ এর মাঝে ভালো কোরে ইংলিশ টা ঝালিয়ে নাও, কারন আজীবন তোমাকে ওকে বন্ধু করে চলতে হবে সুতরাং তোমার যাবতীয় প্ল্যানের আগে ওটীকে আগে রেখ। শুনে আমার মাথাটা একটু বো বো করলেও আমি ভয়ে শুধু মাথাটি নেড়ে সামনে থেকে সুড়ুৎ কোরে হাওায়া হয়ে গেলাম।
যা হোক অনেক প্ল্যানের মাঝে মা বলল এক কাজ কর দীপু, তুই বরং  মাসির বাড়ি যা, অনেকদিন ধরে তোর মাসি বলছিল পরীক্ষার পর তোকে নিয়ে আসতে, কিন্তু তোর বাবা তো আর ছুটি পাবে না সুতরাং আমাদের যাওয়া হবে না, তুই বরঞ্চ দিন কয়েক গিয়ে থেকে আয়।
আমার মাসির বাড়ি নবদ্বীপ , ঠাকুর দেবতার জায়গা , বিখ্যাত সব মহাপ্রভুদের পীঠস্থান , আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন একবার বাবা মার সাথে গেছিলাম, তারপর আর যাওয়া হয়নি, এর মধ্যে মাসিরা অন্য বাড়ি ভাড়া করে চলে গেছে, ছোট বেলার অনেক সুখকর স্মৃতি আমার মনের মধ্যে এখনো স্বপ্নের মতন বেঁচে আছে কাজেই ওখানে যাবার কথাটা আমার বেশ মনে ধরলো। ওখানে যাবার আরো একটা কারন হোল আমার মাসতুতো দাদা বাপ্পা দা । বছরে সে দু তিনবার আমাদের বাড়ী আসে, এক দু দিন থাকে , বাপ্পা দা বেশ মজা করতেও ভালোবাসে আবার মজা দিতেও। এহেন মাসীর বাড়ী যাবার কথাতে আমি বেশ এক পায়ে রাজি হয়ে গেলাম ।
ঠিক হোল বাবা আমাকে ওখানে ছেড়ে দিয়ে সেদিনই চলে আসবে আর দু তিনদিন পর বাপ্পা দা আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। আমার বেশ মোজা লাগলো, এই প্রথম বাবা মা ছাড়া আমি একা রাত কাটাবো , মনে মনে বেশ একটা উত্তেজনা অনুভব করলাম। যাওয়ার দিন মা আমাকে একেবারে তোতাপাখির মতন শিখিয়ে দিল – মাসির বাড়ি গিয়ে মাসি, মেসো আর বাপ্পা কে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করবি, বেশী এদিক ওদিক যাবি না আর একা একা তো কোথাও বেরবিনা। আমি মন দিয়ে সবটা শুনলাম কিন্তু কতটা মনে ঢোকালাম বলা মুশকিল।
সকাল সাতটায় হাওড়া থেকে ট্রেনে চাপলাম, বাবার সাথে, বাবা আমায় দিয়ে সেদিনের রাতের ট্রেনেই ফিরে আসবেন। যথাসময়ে ট্রেন ছাড়ল, খুব বেশী ভীর নেই ট্রেনে , আমি জানার পাশে বসলাম আর আমার পাশে বাবা। ট্রেনে বসে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে আমার ছোটোবেলা থেকেই ভালো লাগে, ছোট্ট বেলায় আমি জানালার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে আবাক দৃষ্টি দিয়ে দেখতাম বাইরের বাড়ি ঘর , গাছপালা, সব ট্রেনের পিছন দিকে ছুটে চলেছে , এখন জানালার সামনে দাঁড়ানোর বয়স হয়তো নেই কিন্তু জানালার সামনের সিটে বসে এসব দেখতে এখনো বেশ ভালই লাগে।
এভাবে আনমনে বাইরে চেয়ে বসে আছি, এক একটা স্টেশন আসছে, ট্রেন থামছে, হুড়োহুড়ি করে লোক নামছে, উঠছে, লোকজনের একটা মৃদু কোলাহল, চীৎকার , চেঁচামেচি এভাবেই বোধহয় ঘণ্টা খানেক সময় পেরিয়ে এলাম। এমন সময় হটাৎ একটা গম্ভীর আর হুঙ্কারের মতন আওয়াজ আমার কানে এল, জানালা দিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে দেখি আমার ঠিক সামনে এক লাল গেরুয়া পোশাকে, মাথায় এক বিশালাকার জট নিয়ে, গলায় কম কোরে সাত আটটা রুদ্রাক্ষের মালা নিয়ে আমার দিকে বড় বড় চোখ কোরে তাকিয়ে আছেন এক সাধু বাবা আর বললেন–ব্যোম ভোলে, খোকা কোথায় যাচ্ছ?
আমার সবে একটা গোঁফ হব হব করছে আর আমায় কিনা বলে খোকা, বেশ রাগ ধরলো সাধুবাবার উপর, কিন্তু মনে সে সাহসের জোর পেলাম না , একটু ভ্যবাচাকা খেয়ে বললাম- মাসির বাড়ি।
সাধু বাবা আবার মুখ থেকে জোড়ে আওয়াজ কোরে বলল – ব্যোম শঙ্কর, তা মাসির বাড়ি কোথায়। সঙ্গে কে?
এবার বাবা পাশ থেকে বলল – সঙ্গে ওর বাবা আছে, কী দরকার তোমার ?
সাধু বাবা বোধহয় ভেবেছিলেন আমি একা, বাবা কে দেখে তিনি একটু দমে গেলেন, কিন্তু সেটা বুঝতে না দিয়ে আবার তার সেই বিখ্যাত গলা উঁচিয়ে বললেন- ব্যোম শঙ্কর , তারপর আমার আর বাবার সামনে মুখটা নিয়ে এসে যা বললেন – তাতে আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম, শঙ্কর বাবার চ্যালা বললেন- এই খোকা বাবুর সামনে একটু সময় খারাপ আছে, সাবধান করে দিলাম।
বাবা এবার একটু রেগে বললেন – তুমি বেশী বাজে বোকোনাতো, সরে দাড়াও।
সাধু বাবার মনে হয় এতে খুব একটা হেল দোল হোলো না, সে আবার বলল – বিপদ, বিপদ ।
বাবা এবার একটু জোড়ে গলায় বললেন – তুমি এখান থেকে গেলে।
বাবার গলায় স্বরটা এবার একটু হুঙ্কারের মতন হওয়াতে সাধুবাবা বোধহয় একটু ঘাবড়ে গেলেন, আশেপাশের লোকরাও এবার সাধুবাবার দিকে তাকাতে লাগলো, এবার বাবাজি একটু ভয়ে পিছপা হয়ে গেলেন আর পরের স্টেশনে ট্রেন থামতেই নেমে গেলেন।
হটাৎ দেখি সেই সাধুবাবা আমাকে চমকে দিয়ে  জানালার সামনে এসে বললেল – খোকা বাবু, সামনে বিপদ , একটু সামলে।
বাবা কিছু একটা বোলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ট্রেনটা ছেড়ে দেওয়াতে কথা আর বলা হলনা।
বাবা শুধু আমার দিকে চেয়ে বললেন , কিরে ভয় পেয়েছিস নাকী, ও বোধ হোয় তোর ঐ জানালার সিট চাইছিল তাই তোকে ভয় দেখানোর চেষ্টায় ছিল। পাশের লোকটি এতে সায় দিয়ে বলে উঠল – ঠিকই বলেছেন, যা দিনকাল পরেছে সাধুবাবার বেশেই হয়তো আতঙ্কবাদীরা ঘুরে বেরাচ্ছে।
আমি কিছু বললাম না, ভয় যে আমি খানিকটা পাইনি তা নয়, তবে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছি সুতরাং ভয় টয় পেলে তা প্রকাশ করতে নেই। আমি আবার জানালা দিয়ে দৃশ্য দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্তু মাথায় তখন সেই সাধু বাবার সাবধান বানী – “সামনে বিপদ” কথাটা ঘুরতে লাগলো। মনে মনে ভাবলাম , কী বিপদ, যাচ্ছি তো মাসির বাড়ি, মাসি আছে ,মেসো আছে, বাপ্পা দা আছে , চিন্তা কি? কী আর এমন হতে পারে। হটাৎ মনে পরে গেল মাসির বাড়ির একটা কথা। মার মুখ থেকে শুনেছিলাম ,মাসি যে নতুন বাড়িটা ভাড়া নিয়েছে সেখানে নাকি ভূতের আনাগোনা আছে, মাসিরা রাত্রি বেলায় নাকি ওপরের ঘর থেকে ধূমধাম আওয়াজ পায়, তাহলে কী ওটাই বিপদ, বুকটা আমার একটু কেঁপে উঠলো বটে কিন্তু আবার সদ্য গোঁফ ওঠা মন বললো ধুর , ভূতে আজকাল আবার কেউ বিশ্বাস করে নাকি।
বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ আমরা মাসির বাড়ি চলে এলাম, বাড়িটা একটা পাকা রাস্তা দিয়ে গিয়ে দু দুটো সরু গলি পাশ দিয়ে বেশ একটা ঝোপ-ঝাড় বেষ্টিত জমির পাশে। বেশ পুরনো দিনের বাড়ি, সামনে একটা সদর দরজা অর্ধেক দেওয়া ছিল, সেটা একটু ঠেলতেই একটা লম্বা ক্যাঁচ করে শব্দ দিয়ে সেটি খুলল। সদর দরজা দিয়ে ঢুকে আমার বুকটা কোন কারন ছারাই  কেঁপে উঠলো।
সামনে একটা বেশ বড় বাঁধানো চাতাল, চাতালের বাঁ দিকে একটা জরাজীর্ণ ঘর ,ঘরটার দিকে তাকিয়ে আমার বুকটা আবারো একটু কেঁপে ঊঠলো,ঘরটার চারপাশে আগাছায় ভর্তি, ঘরটার ছাদেও দেখলাম অনেক লতা পাতা ঝুলছে , দেখে মনে হোল এ ঘরে অনেকদিন কোন মানুষের পদচিহ্ন পরেনি।  এবার আমার চোখ গেল সামনের দিকে, দুতলা একটা বেশ পুরনো দিনের ঘর দেখলাম, নিচে দুটো ঘর আর তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওপরেও দুটি ঘর। বেশ বড় বড় লোহার গরাদ দেওয়া জানালা, তাতে কাঠের পাল্লা , নিচের ঘরের জানালা গুলো খোলা, সেখানেই আমার মাসিরা থাকে আর ওপরের গুলোর সবকটাই প্রায় বন্ধ শুধু একটা একটু ফাঁক করে খোলা।
চাতালের একেবারে ডানদিক ঘেঁসে একটা পাতকুয়া, একটা চাপা কল আর বাথরুম দেখতে পেলাম, ও জায়গাটায় আলোর জোর টা অনেক কম।  আরেকটা জিনিস দেখে বেশ অবাক হলাম যে বাড়িটার চারপাশে কম করে একটা পনেরো ফুটের পাঁচিল, আর তার চারপাশে অজস্র গাছপালা, আর সেটা এ বাড়িটাকে বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে । আমি চারপাশ বেশ ভালো করে দেখতে লাগলাম, এরকম বাড়ি , ঘর আমি খুব একটা দেখিনি, এপাশ ওপাশ দেখতে দেখতে চোখ টা আমার উপরের ঘর গুলোর দিকে চলে গেল, মনে মনে ভাবলাম এই সেই ঘর যেখানে নাকি ভূতেরা থাকে , ভালো করে চেয়ে দেখতে লাগলাম , দেখলাম শুধু কতোগুলো পুরনো  দিনের জানালা, বড় বড় লোহাড় গারদ আর কাঠের পেল্লাই পাল্লা, সবকটাই প্রায় বন্ধ , শুধু একেবারে কোনার ঘড়ের জানালাটায় একটু ফাঁক ছিল, সেই ফাঁক দিয়ে দেখলাম ঘরটায় বাইরের একটা আবছা আলো আর তার চারপাশে শুধু মিশ মিশে কালো অন্ধকার, হটাৎ আমার মনে হোল কে যেন ঘরের মধ্যে এক পাশ দিয়ে অন্য পাশে চলে গেল। বুকটা আমার ধক করে উঠলো, হটাৎ মাসির গলা কানে এল  – দিপু এতকি দেখছিস , ভিতরে আয়।
তখনো আমি ভাবছি , কি দেখলাম, কে সরে গেল, যতদূর জানি ওপরে কেউ থাকে না, মাসি কে বললাম – ওপরে কেউ থাকে না মাসি ?
মাসি বলল – না বাবা, আমরাই এখানে একমাত্র থাকি , এই নিচতলায়, কেন বলতো?
আমি আমতা আমতা কোরে বললাম – না এমনই বললাম।
মাসি একটু হেঁসে বলল, নে এবার চান টান করে খেয়ে দেয়ে নে, তোর বাবা তো আবার বিকালের ট্রেন ধরে চলে যাবে। বাবার চলে যাওয়ার কথাটা শুনে মন টা একটু খারাপ করে উঠলো, এই প্রথম মনে হয় আমি বাবা মা ছেড়ে একা এতো দূরে থাকবো, কিন্তু আবার আমার সদ্য গোঁফ ওঠা মনটা বলে উঠলো – ধুর বোকা তুই এখন বড় হচ্ছিস, আজ বাদে কাল চাকরি করবি।
সেদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে বিছানায় আমি আর বাপ্পাদা এটা সেটা নিয়ে গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি খেয়ালই করিনি, ঘুমটা ভাঙল মাসির ডাকে, তখন সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে, বাইরে তাকিয়ে মনটা একটু ভার হয়ে গেল। বিছানার পায়ের নিচের জানাটা খোলা ছিল সেটা দিয়ে শুধু বাইরের নিকষ কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা যেন শুধু রঙ দেখলাম। পাশে ফিরে দেখি বাপ্পা দা বিছানায় নেই। ঘরটা বেশ অন্ধকার , একা আমি শুয়ে আছি , চারদিক শুনশান ,মনে পড়ে গেল সেই ওপরের ঘরে কাউর চলে যাওয়ার কথা , বুকটা একটু ছ্যাঁত করে উঠলো।মাসি আবার পাশের ঘর থেকে হাক মারল – দিপু ওঠ, সাড়ে ছটা বেজে গেছে।
আমি ধরমরিয়ে উঠে পড়লাম, সত্যিই তো অনেক টা বেলা হয়ে গেছে, বাড়িতে আমি এতো বেলা পর্যন্ত কোন দিন ঘুমাই নি। বিছানা  থেকে উঠে আমি একটু বাইরে গেলাম, বাইরে সেই ঘন কালো অন্ধকার, বেরিয়েই আমার অজান্তে চোখটা চলে গেল সেই পরিত্যক্ত ঘরটার দিকে, তাকিয়ে বুকটা আবার একটু ছ্যাঁত করে উঠলো। এরকম একটা নিস্তব্দ , নির্জন  জায়গায় আমার দাড়াতে মন চাইলো না, আমি তাড়াতাড়ি আবার ঘরে ঢুকে পড়লাম।
মাসিকে বাপ্পা দার কথা আর মেসোর কথা জিজ্ঞেস করাতে ,মাসি বলল ,তোর বাবা কে ছাড়তে বাপ্পা দা স্টেশন গেছে আধ ঘণ্টা খানেক হোল,আর মেসো আজ ছুটি পাইনি বলে বাবার সাথে দেখা করতে পারেনি তাঁরও আস্তে আস্তে রাত নটা দশটা বাজবে।
মাসিদের ঘর বলতে দুটি, একটা ঘরে রান্না আর শোওয়া দুটোই হয়, আরেকটা সুধুই শোওয়ার ঘর। শুধু শোওয়ার ঘরটি বেশ ছোট সেখানেই আজ দুপুরে আমি ঘুমিয়ে পরেছিলাম। সামনে এক চিলতে বারান্দা, আর  বারান্দার সামনেই সেই বিশাল চাতাল। ঘরেতে বিদ্যুতের আলো আছে ঠিকই, কিন্তু তার ভোল্টেজ এতই কম যে আলাদা ভাবে লন্ঠন জ্বালতে হয়। আর সেই বিদ্যুৎ থাকে কম যায় বেশী।
মাসি রাতের রুটি করছিলেন , আমি একা থাকতে খুব একটা ভরসা না পেয়ে মাসির কাছে গিয়ে বসলাম।
মাসি রুটি করছিল একটা স্টোভ জ্বালিয়ে, ঠিক তার উপরে একটা বাল্বের আলো মিট মিট করে জ্বলছে , আবার তার পাশে একটা লণ্ঠনও জ্বালানো। আমি পাশে গিয়ে বসে জিজ্ঞেস করলাম – এখানেকি ভোল্টেজ একেবারেই থাকে না।
মাসি আমার দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিল- থাকে , তবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই।
তারপর মাসি আমাকে বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলেন, পরীক্ষা কেমন দিয়েছি, কি নিয়ে পড়ার ইচ্ছা আছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এভাবে মিনিট কুড়ি কেটে গেল, এমন সময় আমি একটা আওয়াজ পেলাম বাইরে থেকে, মনে হোল কেউ যেন দৌড়ে এই ঘরের দরজার সামনে দিয়ে চলে গেল।
আমি একটু চমকে মাসি কে বললাম – কিসের একটা আওয়াজ শুনলাম মনে হোল।
মাসি হেসে বলল ও কিছু না, রাতের দিকে কুকুর টুকুর এখানে ছোটা ছুটি করে।
কথাটা আমার ঠিক বিশ্বাস হলনা, কুকুরের পায়ের শব্দ আমি বিলক্ষণ চিনি, এ যে সেটা নয় আমি একেবারে নিশ্চিত , আমি ভয়ে ভয়ে সামনের খোলা জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে চাইলাম, ঘন কালো অন্ধকারে আমার চোখে সেরকম কিছু এবার পড়লো না, আমি এবার একটু ভয় মিশ্রিত গলায় মাসিকে বললাম – মাসি , শুনেছি তোমাদের এ বাড়িতে নাকি ভূত আছে।
এমন সময় কারেন্ট চলে গেল, লন্ঠনের আলো টা যেন বেশী জোর পেল ঘরটাকে আলোকিত করার জন্য, মাসি বলল – এই যাঃ , এই যে গেল কখন যে আসবে তার ঠিক নেই।
হটাৎ করে আমার চোখটা চলে গেল পাশের ঘরে , ঘরটা তে এতক্ষণ একটা আলো জ্বলছিল বেশ ধিমি তালে, সেটা এখন আর জ্বলছে না, ঘরটার দিকে চেয়ে মনে হোল ঘরটার নিকষ কালো অন্ধকার যেন আমাকে ডাকছে,  মনে হোলে ঘরের মধ্যে কেউ আছে, তারা ফিস ফাস করে কথা বলছে, আমি আরও কিছুটা মাসির দিকে ঘেঁসে বসলাম, মাসি এবার আমার দিকে চেয়ে বলল – ধুর বোকা, ওসব ভূত টুত বলে কিছু আছে নাকি, ওসব গুজব। একথা শেষ হতে না হতেই আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম ওপরের ঘরের মেঝেতে ধুপ করে একটা শব্দ, আমি ভীষণ ভাবে চমকে মাসির প্রায় ঘাড়ে উঠে গেছিলাম, মাসি বলল- ও কিছু না উপরে বেড়ালের ভারী উপদ্রব। আমি মনে মনে ভাবলাম , বেড়াল , তা হতে পারে, কিন্তু ওটা যে বেড়ালের শব্দ আমার মন তা মানতে চাইলো না।
মাসি এবার একটু গম্ভীর স্বরে বলল – দিপু ব্যাটাছেলেদের ওতো ভয় পেলে চলে না। যা তুই ওঘরে গিয়ে বস, আমি আলো দিয়ে আসছি।
আমি রীতিমত চমকে উঠলাম – মনে মনে বললাম, ওই অন্ধকার ঘরে আমি একা যাবো ? বাপরে কি মিশমিশে অন্ধকার তার উপর এসব ধুপ ধাপ আওয়াজ, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারলাম না, মাসির ব্যটাছেলে কথা টা আমার সদ্য গজানো গোঁফটার মনে একটু হোলেও লেগেছে, আমি ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলাম। ঘরের মধ্যে রান্নাঘর থেকে আলোর একটা রেশ আসছে ঠিকই, কিন্তু তা আমাকে আশ্বস্ত করার পক্ষে যথেষ্ট নয়, আমি ভয়ে ভয়ে বিছানার উপর উঠে বসলাম, পাশের জানালাটা এখনো খোলা, আর তার বাইরে  ধু ধু অন্ধকার, হটাৎ মনে হোল কে যেন জানালার পাশ দিয়ে সরে গেল, ভয়ে আমার মুখ শুখিয়ে এল, গা হাত পা কেমন কাঁপতে লাগলো, রান্না ঘরের দিকে চেয়ে দেখি ওই টিম টিমে আলোটা যেন আমার দিকে এগিয়ে আসছে, আমি ভয়ে কুঁকড়ে উঠলাম, আলো টা ধীরে ধীরে আমার ঘরে ঢুকল, যেন আমার দিকে এগিয়ে আসছে , আমি চিৎকার করে মাসিকে ডাকতে যাবো এমন সময় হটাত মাসির কথায় আমার সম্বিৎ ফিরে এল –মাসি একটা তেলের ল্যাম্প হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে , মিনিট খানেক পর আমায় বলল দিপু, ল্যাম্পটা রেখে গেলাম, তুই একটু বস, আমি তরকারিটা রান্না করেই আসছি। তুই কিছু খাবি এখন?
আমি ল্যাম্পটার দিকে চেয়ে একটু মনে জোর পেলাম, খিদেও পেয়েছিল কিন্তু বললাম – না এখন নয়, বাপ্পা দা আসলে একসাথে খাবো।
মাসি ঠিক আছে বলে, ল্যাম্পটা বিছানার পাশে রাখা একটা টেবিলে রেখে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল।
আমি এবার একটু বিছানায় এলিয়ে বসলাম, মনে মনে ভাবলাম সতিই একটা আলো মানুষের মনের অন্ধকার কতটা দূর করে দেয়। ওই ল্যাম্পের আলোতে আমি ঘরটাকে দেখতে লাগলাম, উপরে কড়ি কাঠের দেওয়া ছাদ, দেওয়ালে প্লাস্টার গুলো তে একটু ঘুন ধরেছে , কেমন যেন একটা স্যাতস্যাতে ভাব, হটাত চেনা একটা  শব্দে আমার চোখ টা উপরে চলে গেল আর যা দেখলাম তাতে আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম, এই লোডশেডিঙে দেখলাম উপরের সিলিং ফ্যানটা আস্তে আস্তে ঘোরা শুরু করল,  আমি একবার রান্না ঘর আরেক বার ঘরের অন্য দিকে চাইলাম, না কোথাও কোন কারেন্ট আসার চিহ্ন নেই, কোথাও আলো জ্বলছে না, রান্না ঘরে একটা লণ্ঠন, আর স্টোভের একটা ঘ্যাসঘ্যাসে শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই, আমি আবার ভয়ে ভয়ে ওপরে তাকালাম, ফ্যান টা ঘুরে চলেছে, কিন্তু স্পিড বেশী নয়, আমি বেশ ঘাবড়ে গিয়ে ডাকলাম – মাসি, কিন্তু স্বরটা এতো আস্তে ছিল যে আওয়াজ টা ওই ঘর পর্যন্ত পৌছালোনা । আমি ভয়ে ভয়ে ফ্যানটার দিকেই চেয়ে রইলাম, এরকম চলন্ত ফ্যান আমি অনেক দেখেছি কিন্তু বিনা বিদ্যুতে ফ্যান , না আমি বেশ বুঝলাম আমি ঘামছি।
ঘরে আমি একা, ওঘরে মাসি রান্না করছে , কিন্তু মনে হোল কেউ কোথাও নেই , আমি যেন এক মৃত্যু পূরীতে একাকী বসে রয়েছি, ওপরে ফ্যানটা একটা মৃদু শব্দ করে ঘুরছে আর তার হাওয়াতে ল্যাম্পটার শিখাটা কাঁপছে, আর তার ঠিক পাশেই সেই ল্যাম্পটার একটা লম্বা বড় ছায়া দেওয়ালে পড়ে অদ্ভুত ভাবে দুলছে, যেন মনে হচ্ছে কেউ ওই দেওয়ালের ওপর হাঁটাচলা করছে।
এভাবে মিনিট পাঁচেক চলার পর ফ্যানটা হটাত বন বন করে বেশ জোরে ঘুরতে লাগলো, কিন্তু কোথাও এখনো কোনো কারেন্ট আসার চিহ্ন নেই, আমি ভয়ে কুঁকড়ে অজান্তে বিছানার একেবারে ধারে সেই জানালার পাশে চলে গেলাম , হটাত জানালার দিকে আমার চোখ চলে গেল – আমি এবার চোখ বিস্ফারিত করে চেয়ে দেখলাম জানালাটা বন্ধ, আমি এ ঘরে এসে অব্দি দেখেছি জানালা টা খোলা, কিন্তু তাহলে এটা কে বন্ধ করলো, হটাত টের পেলাম টেবিলের ওপর রাখা ল্যাম্পটা দপ দপ করছে, আমি ভয় পেয়ে গেলাম, নিভে যাওয়ার আশঙ্কায় তাড়াতাড়ি ওটাকে নিয়ে আমার জানালার নিচে সরু মতন সিমেন্টের বাঁধানো জায়গায় রাখলাম। হটাত আমার মনে হোলে রান্না ঘরটা ফাঁকা কেন, মাসি ছিল না ? হটাত আমায় ভীষণ ভয় পাইয়ে রান্না ঘরের আলোটা নিভে গেল, আমি দু দু বার মাসি বলে ডাকার চেষ্টা করলাম, কিন্তু গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরল না। আমি শুধু ল্যাম্পটার পাশে বসে বিছানার উপর জানালার শিক গুলো শক্ত করে ধরে আছি, কোন এক কালে শুনেছিলাম লোহা আর আগুন থাকলে নাকি ভূতে কিছু করতে পারে না। মাথার উপর পাখাটাও বন বন ঘুরছে , আমি ভয়ে আর উপরের দিকে তাকালাম না, আমার মনে হোল রান্না ঘরের অন্ধকারে কারা যেন ফিসফাস করে কথা বলছে , আমি ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। এভাবে মিনিট দুয়েক বসার পর শুনলাম জানালায়  কে যেন টোকা মারছে, কান টা আবার খাঁড়া করে শুনলাম , হ্যাঁ, একবার, দুবার , তিনবার , স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, আমি কি মনে করে জানালাটা পুরো খুলে দিলাম, আর খুলে দিতেই ওই ল্যাম্পের মৃদু আলোয় যা দেখলাম তাতে আমার বুকের রক্ত শুকিয়ে গেল , দেখলাম একটা মেয়েছেলে ঠিক জানালার বাইরে আমার দিকে তার সবকটি দাঁত বার করে, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে, কপালে তার ইয়া বড় লাল টিপ, মাথার চুলটা তার কোমর পর্যন্ত ছাড়া, পড়নে তার টকটকে লাল শারী , আর যেটা দেখে আমি আমার সমস্ত বাহ্যিক জ্ঞান হারালাম তা হোল তার একটা পা আমার জানালার নিচে আরেকটা পা জানালা থেকে অন্তত পাঁচ ফুট দূরে সেই পাতকুয়োর পাশে , আর এক অস্পষ্ট গলায় শুনতে পেলাম, আমার কানে যেন কেউ ফ্যাকাসে গলায়  বলছে – আমার মেয়েটা মরে যাচ্ছে, ওকে বাঁচা, ওকে বাঁচা, বেরিয়ে আয়, বেরিয়ে আয়। হটাত করে জানালার নিচে রাখা ল্যাম্পটা নিভে গেল আর  আমার চোখের সামনে দরজাটা খুলে গেল আর আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতন বেরিয়ে পড়লাম , আমি কোথায় যাচ্ছি হুঁশ নেই, কেন যাচ্ছি জানিনা, কিন্তু যাচ্ছি, কেউ যেন আমার কানের সামনে ফিসফিস করে বলছে- আরেকটু, আরেকটু , আমার শুধু মনে আছে আমি বেরিয়ে সেই মিশমিশে অন্ধকারে প্রথমে কিচ্ছু দেখতে পেলাম না, তারপর দেখলাম সদর দরজার সামনের ঘরটায় একটা আবছা আলো জ্বলছে, আর তাতে দেখলাম কেউ যেন উপরের সিলিং থেকে ঝুলছে, আমি একটা গোঙ্গানির মতো আওয়াজ করে এবার মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম।
চোখ যখন খুললাম তখন দেখি ভোর হয়ে গেছে, চেয়ে দেখি পাশে মাসি, বাপ্পা দা, মেসো বসে আছে। আমি চোখ খুলতেই মাসি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল – বাবা কেমন আছিস , আমাদের চিনতে পারছিস তো?
আমি মাথা নেড়ে বললাম হ্যাঁ।
মাসি একটু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, আবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো-
হ্যাঁরে কাল রাতে তুই ওই বাইরের ঘরের সামনে কি করছিলি, তোকে আমি এতো করে পিছন থেকে ডাকলাম , তুই কোন সাড়া শব্দ না দিয়ে ওখানে চলে গেলি, তারপর আমি লণ্ঠন টা নিয়ে গিয়ে দেখি তুই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছিস। সারা রাত প্রায় বেহুঁশের মতন পরেছিলি, একবার চোখ খুলছিস আবার চিৎকার করে বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছিস।
আমি মনে করার চেষ্টা করলাম কাল রাতে কি হয়েছিল, মনে করতেই আমার সারা শরীরে কেমন যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। ওপরে চেয়ে দেখলাম সেই ফ্যন টাই কেমন চেনা ছন্দে ঘুরছে, বাইরের জানালা দিয়ে দেখলাম ভোরের সুন্দর মায়াবী আলো , বুকে একটু সাহস সঞ্চয় করে বললাম – মাসি মার জন্য মন কেমন করছে।
কথাটা শুনে সামনের সবাই একসাথে হেসে উঠলো, মেসো বলে উঠলো ঠিক আছে আজ দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে নাও তারপর তোমাকে বাপ্পা দিয়ে আসবে। মাসি বলল সেই ভালো,বাড়ি গিয়ে সুস্থ হয়ে মার সাথে আসিস বাবা।
বিকালের ট্রেনে বাপ্পাদার সাথে আমি রওনা দিয়ে দিলাম, ট্রেনে যেতে যেতে বাপ্পাদাকে আমি কাল রাতের সব ঘটনা খুলে বললাম , বাপ্পা দা সব শুনে একটু চুপ থেকে বলল –ও বাড়িতে কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা হয় বলে আমরা জানি, শুনেছি আমরা আসার আগে ওই বাড়িতে দু দুটো অপমৃত্যু হয়েছিল, বাড়িওয়ালীর বউ আর মেয়ে , বাড়িওয়ালীর বারো বছরের মেয়েটা নাকি খেলতে খেলতে পাতকুয়ায় পড়ে যায়, তাকে আর জীবন্ত উদ্ধার করা যায়নি আর সেই শোকে বউটা কিছুদিন পর ওই বাইরের ঘরটাতে গলায় দড়ি দেয়। তার পর থেকে সবাই বলে ওই মেয়েটা নাকি সন্ধ্যে বেলায় ওই চাতালে দৌড়ে বেড়ায়  আর ওর মা পাতকুয়োর সামনে বসে থাকে যাতে ওর মেয়ে আর পাতকুয়াতে ঝাঁপ দিতে না পারে।
আমি মুখ শুকনো করে বললাম- তোমরা কোনদিন কিছু দেখনি?
বাপ্পা দা বলল – তোর মাসি মানে আমার মা নাকি দেখেছে , আমি আর বাবা আওয়াজ শুনেছি কিন্তু কোনদিন কিছু দেখিনি, আমি জানিনা কাল তুই ওটাই দেখেছিস কিনা তবে আমার মনে হয় তুই কাল রাতে ওই অন্ধকার ঘরে ঘুমিয়ে ভয়ের স্বপ্ন দেখেছিস, আর হয়তো ঘুমের ঘোরে বাইরে বেরিয়ে পড়ে গেছিলিস। ওসব কিছু না দিপু, আর এখন এ যুগে কেউ ওসব বিশ্বাস করে না, বুঝলাম বাপ্পাদা আমার ভয় কাটানোর চেষ্টা করছে।
আমি চুপ করে গেলাম, আমার মনে পড়লো এখানে আসার সময়কার সেই সাধু বাবার কথা, সে কি বুঝতে পেরেছিল যে এসব আমার সাথে ঘটবে? কে জানে?
স্টেশন থেকে নেমে আমি একটা রিক্সা নিয়ে নিলাম, বাপ্পাদা আমার সাথে আর এলনা, সে এর পরের ট্রেনেই ফিরে যাবে। রিক্সায় আসতে আসতে আমি ভালো করে মনে করার চেষ্টা করলাম , কাল রাতে কি আমি সত্যিই ঘুমিয়ে পরেছিলাম উঁহু তালে ওই ঘরের সামনে কি করে গেলাম, তার আগে বিনা কারেন্টে কি করে সিলিং ফ্যানটা চলল, আর রান্না ঘর থেকে মাসি কোথায় চলে গেল আর সেই বুকের রক্ত হিম করে দেওয়া মেয়েছেলেটি, যাকে দেখলাম ওই জানালার বাইরে সেও কি মিথ্যে, সেও কি স্বপ্ন , আমার হটাত মনে পড়ল না এটা স্বপ্ন নয় কারন আমি সকালে দেখেছিলাম রাতে মাসির দিয়ে যাওয়া ল্যাম্পটা জানালার নিচে অথচ মাসি ওটা বিছানার পাশের টেবিলে রেখে গেছিল। না আমি আর ভাবতে পারছি না।
আমি চার পাশে লোকজনের যাওয়া আসা দেখতে লাগলাম, দিনের আলো এখনো আছে আর আমার চারপাশের কোলাহল আমাকে কিছুটা হলেও মনে সাহস এনে দিল। মনে মনে ভাবলাম মাসির এ বাড়িতে আমি আর কখনই যাবো না, বাবা মাকে নিয়েও নয়।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১১২২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৯/১০/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast