www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

জেদ্দা থেকে বলছি ( পর্ব-২ )

সাত বছর! একটা জীবনের কম সময় নয়। মহামূল্যবান এই সময়টা কতটা অবহেলা আর তাচ্ছিল্যের সাথে কাটে সেটা লিখে প্রকাশ করা যায় না।  মুহূর্তগুলো কতটা  অনিশ্চিত আর হতাশার, একটা অবৈধ অভিবাসীর পক্ষ্যেই তা উপলব্ধি করা সম্ভব। কর্মক্ষেত্রে তুচ্ছতা, রাস্তায় চলতে গেলে চরম অস্থিরতা এই বুঝি পুলিশ এলো! এখনই হয়ত আইডি কার্ডের প্রশ্ন করা হবে! রাতে ঘুমানোর জায়গার জন্য অন্যের করুনা ভিক্ষা করতে হয়, কেউ সহজে অবৈধ লোককে রুমে আশ্রয় দেয় না। এই ভাবে একটানা এতোটা বছর পার করার জন্য কতখানি সহনশীলতা থাকতে হয়, কতটা মেনে নেবার ক্ষমতা বুকের মধ্যে আগলে রাখতে হয় তার পরিমাপ করা হয়তো যাবে না আর নিজের নিয়তির জন্য অন্যকে দোষ দেয়াও কাপুরুষতা তবুও বাস্তবতার নিরিখে কিছু প্রশ্ন এসে যায়, ফেরানো যায় না।  কেন এমন হল? কেন এমন হয়?
আমার জীবনটা এমন হবার কথা ছিল না, কত আশা ছিল, মনের মধ্যে কত স্বপ্ন দোলা দিত। আমার মায়ের ইচ্ছে ছিল বন্দকি জমিটুকু ফেরত আনবেন, ভাই-বোনদের অসীম প্রত্যাশা ছিল আমাকে নিয়ে আর প্রিয়তমার মনের গোপন চাওয়া পাওয়ার হিসাব, কিছুই মিলাতে পারলাম না। সেই বেদনা বুকজুরে শুধু হাহাকার করে।  
আমাকে বলা হয়েছিল এখানে এলে আমাকে বৈধ করে দেবেন, ভাল কাজ দেবেন। আমাকে কোন চিন্তাা করতে হবে না, আল্লাহকে হাজির নাজির করে সব প্রতিশ্রুতি করা হয়েছিল, বিশ্বাস করেছিলাম ফেরেস্তার মতো সেই  মানুষকে তিনি আমার এতো খানি নিকট আত্মীয়, যেই আত্মীয়কে আমাদের দেশে সব চেয়ে বেশী খাতির যত্ন করে,  সর্বোপরি তিনি আমার এলাকায় হাজী সাহেব হিসেবে পরিচিত যার সততা আর বিশ্বাস যোগ্যতা নিয়ে কারো মনে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নাই। তাকে দিয়ে ওয়াদার খেলাপ হয় এটা কল্পনাও করি নাই আর কল্পনা করার কথাও নয়। কারণ আমরা বাঙ্গালীরা মানুষকে নয় তার লেবাসকে বেশী গুরুত্ব দেই। টাকা অথবা পোশাকের জন্যই সম্মান দেয়া হয়, যে সম্মানের যোগ্য নয় তার জন্য অঢেল সম্মান আর যিনি সম্মানের যোগ্য তাকে অবহেলা অযত্নে ফেলে রাখি, মা বাবাকে অভুক্ত রেখে হুজুরের জন্য গাছের প্রথম ফল আর খোপের মুরগি। এজন্যই হয়তো পদে পদে লাঞ্ছনা! বাংলাদেশে দু'বছর তার পিছনে ঘুরতে ঘুরতে  বিশ্বাস ভাঙ্গাগড়ার দোলাচলে যেটুকু অবশিষ্ট ছিল জেদ্দা বিমান বন্দরে নেমে সেটুকুও উদাও হয়ে গেল, একটা কঠিন জীবন সংগ্রামের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার তাগিত অনুভব করলাম।
যখন মিরপুরের খালার বাসা থেকে রওনা দিলাম তখন রাত তিনটা, বাসার সামনে ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল আমি সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম, স্বপ্না ( আমার স্ত্রী'র ছদ্মনাম ) খালার পাশেই দাঁড়ান ছিল, ওর চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। নিচু মুখে গাড়ীতে উঠে বসলাম। গাড়ীর জানালা দিয়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম, আধো আলোতে ওর সেই ফ্যাঁকাসে মুখখানা এই জনমে ভুলে যাবার মতো নয়। গাড়ী এগিয়ে চলে আর আমি পিছু ফেলে যাই আমার ভালোবাসা আর তার নির্যাস অনাগত সন্তান। আমার স্বপ্না'র গোপন স্বপ্নগুলো গাড়ীর চাকায় পিষতে ছিল তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করছিলাম।
এয়ারপোর্টে যখন আসি তখন ফজর। আদম বেপারীর কথা মতো একটু আগেই এসেছি, কারণ আমাকে একজন মানুষের সাথে পরিচিত হতে হবে। তিনি একজন বৃদ্ধা, তার ছেলে বাবুল সপরিবারে সৌদি আরবের মক্কায় থাকে। তিনিও ওমরা ভিসায় যাচ্ছেন ওমরা করবেন আর ছেলে-বউ'র সাথে দেখা  করবেন, আমাকে তার সাথী হিসেবেই যেতে হবে। আমাদের পরিচয় তিনি আমার খালা আর আমি তার বোনের ছেলে, আমাকে নিয়ে ওমরা করতে যাচ্ছেন, সৌদি আরবে চল্লিশ বছরের কম লোকের জন্য ওমরা ভিসা দেয় না, তাই আমার বয়স দশ বছর বাড়িয়ে পাসপোর্টে লেখা হয়েছে আর মুখ ভর্তি দাড়ি রেখে ছবি তুলতে হয়েছিল পাসপোর্টের জন্য। তারপরেও ভিসা লাগছিল না তাই এই বৃদ্ধার দয়ায় তার সাথী হিসেবে আমাকে দেখান হল তারপরে ভিসা লেগেছিল। তিনি আরও কয়েকবার সৌদি আরবে গেছেন তাই তার সব জানাশোনা, আমাকে সব কিছু শিখিয়ে দিয়েছেন। তার পরিবারের সবার নাম আমাকে লিখে দেয়া হল, দুই ঘণ্টা সেই নামগুলো মুখস্থ করতে ছিলাম যাতে ইমেগ্রেশন পুলিশে জেরা করলে সব বলতে পারি। কিন্তু যখন ইমেগ্রেশনে যাই আমাকে পুলিশের সামনে যেতে দেননি। ঐ বৃদ্ধাই সব কিছু সামলে নিয়েছেন। আমার আর তার পাসপোর্ট এক সাথে দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন "ওইটা আমার বোনের ছেলে, আমার ছেলেরা বিদেশ থাকে,ও আমাকে দেখাশুনা করে তাই আমার সাথেই ওমরা করতে নিয়ে যাচ্ছি"। পুলিশ আমাকে আর কিছুই জিজ্ঞেস করে নাই।
সকল বাস্তব অবাস্তব, সত্য-মিথ্যা আর স্নেহ-মায়াকে পিছনে ফেলে বিমানে উঠে বসলাম, একেবারে পিছনে ডানের জানালার পাশে আমার সীট। বিমান উড়ছে আর প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে নতুন ভাবে হাজির হচ্ছে, মাটির বন্ধনহীন শূন্যে বিচিত্র সাজে সজ্জিত আকাশ দেখছি! সাদা মেঘের পর্বতমালা ভেদ করে বিমান এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মেঘের ফাক দিয়ে পৃথিবী দেখছি। সে এক অন্যরকম দৃশ্য ! সব কিছু তুচ্ছ করে মনের কোণে কখনও মায়ের মুখ ভেসে ওঠে কখনও বা প্রিয়ার। এতো মায়া, এতো প্রেম সব কিছু ফেলে রেখে অজানার উদ্যশ্যে যাত্রা।  আবার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আতঙ্কিত হই।  মনে আশা নিরাশার দোলাচল, এগিয়ে চলছে বিমান। আমাকে খাবার দেয়া হয়ছিল, কিন্তু খেতে পারিনি কিছুই।
যখন জেদ্দা বিমান বন্দরে আসি তখন বিকেল চারটার কিছু বেশী। ভিতরের কাজ শেষ করে বাইরে আসতে আসতে প্রায় পাঁচটা বাজে। আমার সাথে তেমন কিছু ছিলনা, সামান্য জামাকাপড়সহ হালকা একটা ব্যাগ। কিন্তু আমার সাথে যিনি আছেন সেই খালার অনেক বেশী জিনিস ছিল। কারণ তার ছেলে বউ আর নাতিনাতনির জন্য অনেক কিছু নিয়ে আসছিলেন।
ওগুলো নিয়ে যখন বাইরে আসি তখন ক্লান্তিতে দেহ আর চলে না। কথা ছিল হাজিসাহেব আমাকে নিতে আসবেন তিনি জেদ্দা থাকেন প্রায় পচিশ বছর ধরে, নামীদামী মানুষ, আমি আজ তার অতিথি, তার বাসায় যাবো। রেস্ট নিয়ে পরে মক্কা যাবো ওমরা করে ফিরে আসবো। কিন্তু নিরাশ এখানেও। তিনি আসেননি! যখন জানতে পারলেন আমার সাথে ওই বৃদ্ধা আছে তখন তিনি তার ছেলে বাবুল ভাইর নাম্বার নিয়েছিল তার বন্ধু আদম বেপারীর কাছ থেকে। বাবুল ভাইকে ফোন করে বলেদিলেন আমাকে যেন তাদের গাড়িতেই মক্কা নিয়ে ওখানে আমার আরেক আত্মীয় আছে তার ঠিকানায় পৌঁছে দেয়া  হয়।
বাবুল ভাইর মুখ থেকে এই কথা শুনে আমি স্থির হয়ে রইলাম!

                                                          (চলবে-)
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ১১৫২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৭/১১/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • কবীর হুমায়ূন ০৯/১১/২০১৩
    মন্তব্য কী করবো?
    মানুষ জীবনকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে।
    আমি তোমার লেখাগুলো 'সাম হোয়ারইন ব্লগে' শুধুমাত্র লিঙ্ক দিয়ে প্রকাশ করতে চাই।
    ভালো থেকো। তোমার মোবাইল বন্ধ কেনো?
    • মহিউদ্দিন হেলাল ০৯/১১/২০১৩
      কবীর ভাই,
      কৃতজ্ঞতা জানাই, আপনি প্রকাশ করতে পারলে করুন। আমি খুশী হবো।
  • জিয়াউর ০৭/১১/২০১৩
    proshi jiboner itikotha, khub valo laglo
  • আহমাদ সাজিদ ০৭/১১/২০১৩
    খুবই সুন্দর আর মর্মষ্পর্শি ভাষায় বর্ণিত লেখাটা বাস্তবতায় অতূলনীয়। ধন্যবাদ।
    • মহিউদ্দিন হেলাল ০৭/১১/২০১৩
      অনেক ধন্যবাদ সাথে অসীম ভালোবাসা আপনার জন্য।
      ভাই, আপনি কি কবিতার আসরের উদাস কবি?
  • আরজু নাসরিন পনি ০৭/১১/২০১৩
    আমার বড় ভাই ছিলেন, যখন আমি অনেক বেশিই ছোট...জানিনা ভাইয়ের কোন কষ্টের কথা, হয়তো ছোট ছিলাম বলেই জানতে পারিনি ।
    তবে বুঝতে শোর পর কিছুটা শুনেছিলাম...আজকে আপনার লেখা পড়ে মনটা কষ্টে ভরে যাচ্ছে আমার ভাইটির জন্যে ।

    অনেক শুভকামনা জানাই, মহিউদ্দিন আপনার জন্যে ।।
    • মহিউদ্দিন হেলাল ০৭/১১/২০১৩
      আপনার ভাই সহ যারা প্রবাসে আছে সবাইকে আল্লাহ ভাল রাখুন, এই প্রার্থনা।
      আপনার জন্য অশেষ শ্রদ্ধা। ভাল থাকুন নিরন্তন।
  • ইসমাত ইয়াসমিন ০৭/১১/২০১৩
    কি সুন্দর লিখেছেন ভাই, মনে হচ্ছে সব যেন দেখতে পাচ্ছি, সত্যি আরো পড়তে ইচ্ছা করছে, জানিনা কেমন করে আছেন সবাই কে ছেড়ে, হয়ত সন্তানের মুখ টা ও দেখতে পারেন নি। খুব কস্ট লাগছে আমার ।
    • মহিউদ্দিন হেলাল ০৭/১১/২০১৩
      আপনার ভাল লাগাটাই এই লেখার সার্থকতা।
      অনেক অনেক শ্রদ্ধা আপনার জন্য।
  • এমন করুন বাস্তবতার লেখা পড়ে আমার কলমের কালি শুকিয়ে গেছে।কি লিখব আমি কি লিখলে এই সব হতভাগা মানুষ গুলো র দুঃখ নিবারণ হবে।আপনি ঠিকই বলেছেন মা বাবা কে ভাত দেয় না কিন্তু হুজুরের জন্য মুরগি জবাই।সহমত পল্লব ভাই।
  • পল্লব ০৭/১১/২০১৩
    আপনার দু'টি পর্বই খুব মনযোগ দিয়ে পড়লাম। খুবই হৃদয়স্পর্শী লেখা! আরও লিখতে থাকুন।

    আর আপনার ঐ কথাটির সাথে আমি পুরোপুরি একমত। আমরা বাঙ্গালীরা মানুষকে তার লেবাস ও অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে বেশি সম্মান দেই, তার সততা বা যোগ্যতার উপর ভিত্তি করে না।
  • সহিদুল হক ০৭/১১/২০১৩
    অসাধারণ অভিজ্ঞতায় পাঠকরাও সমৃদ্ধ হবে।
    শুভ কামনা জানাই।
 
Quantcast