www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

প্রিন্সিপাল রুম (ভূতের গল্প)

আমি মনোজ, cctv ক্যামেরা ইনস্টলেশন এর কাজের সূত্রে নৈহাটী থেকে আমাকে উড়িষ্যায় যেতে হচ্ছে । সাথে আমার বন্ধু মোহন আছে হেল্পার হিসেবে । রাত নটার সময় কলকাতা বাবুঘাট থেকে বাসে উঠেছি সবে মাত্র ।

ভোর বেলায় বাস থামলো ভুবনেশ্বর, ঘুম চোখে নামলাম রাস্তায় । আমাদের ভুবনেশ্বর রেল স্টেশন যেতে হবে । পাশেই অটো স্ট্যান্ড কেমন যেন অদ্ভুত পড়োবাড়ির মতো দাড়িয়ে আছে, সারি সারি পুরোনো অটো গুলোর মধ্যে থেকে হঠাৎ বাজখাই গলাতে শব্দ এলো,

          - কাহা জানা হে ?

কাউকে দেখতে না পেয়েও বললাম,

          - রেল স্টেশন জায়েগা কিয়া ?

উত্তর আসলো,

          - হ্যাঁ, লেকিন ভাড়া দোশো রুপিয়া লাগেগা ।

কেমন যেন লাগলো সেই শব্দ, হটাৎ একটা বুড়ো এগিয়ে আসছে দেখলাম,  ভাড়া কমানোর অনেক চেষ্টা করার পর,  শেষমেশ একশো টাকাতে সেই অটো ড্রাইভার রাজি হলেন । অটোতে উঠে কুড়ি মিনিট পর পৌঁছালাম স্টেশন ।

শিয়ালদার মতোই দারুন ভিড় স্টেশনে আমরা ভুবনেশ্বর থেকে বীরহামপুর যাবো, টিকিট কেটে বসে আছি সকাল ৬ টা বাজে ।

এক ঘন্টা পর ট্রেনে উঠলাম, চার সাড়ে চার ঘন্টার পথ । রাতে বাসের মধ্যে ঘুম হয়নি তেমন । জানালার ধারে বসে দূরের পাহাড় দেখতে দেখতে ছুঁটে যাচ্ছি দুজন । ঠান্ডা হওয়াতে মাঝে মাঝে ঘুমে ঝুলে পড়ছি, এক্সপ্রেস ট্রেনের হুইসেলে আবার জেগে যাচ্ছি । ক্রমশঃ ট্রেন পাহাড় নদী পেরিয়ে কোন এক অজানা জঙ্গলের মধ্যে ছুঁটে চলেছে বুঝতে পারছি না ।

অবশেষে এগারোটা নাগাদ পৌঁছালাম বিরহামপুর স্টেশন । স্টেশনটা বিশাল বড়ো একদিকে পুরোনো প্লাটফর্ম আরেকদিকে নতুন তৈরী হচ্ছে । আমরা সেখানে নেমে দাঁড়িয়ে আছি, একজন আমাদের নিতে আসাবে কথা আছে । কিন্ত জনমানবহীন স্টেশনে দাঁড়িয়েই আছি ঘন্টা দুয়েক, কেউ এলো না দেখে আসে পাশে লজ এর সন্ধানে ঘুরছি । রাস্তায় নেমে একজন কে আসতে দেখে তাকে জিজ্ঞাস করলাম,

        - আসপাশ মে কোই লজ হে কিয়া রাহনে কে লিয়ে ?

লোকটি ইশারাই সোজা একটি বিল্ডিং দেখিয়ে দিলেন । আমরা ক্লান্ত, হেঁটে পৌঁছালাম সেই খানে । মোহন আমাকে বললো,

       - ভাই কেমন জায়গা রে, একটাও লোকজন নেই !

আমি বললাম কী আর করা যাবে । চল আগে একটু ফ্রেশ হয়ে নিই । মোহন আবার বললো,

       - ভাই কাজ কোথাই করতে হবে ?

       - এখনো অনেক দূর যেতে হবে । এক সপ্তাহের কাজ পাঁচটা জেলায় তেরো টা স্কুলে ক্যামেরা লাগাতে হবে ।

লজ ভাড়া করে ফ্রেশ হতে সন্ধ্যা নেমে এলো । এতবড়ো লজ এ আমরা দুজন ছাড়া আর কাউকে দেখলাম না । একটু ভয় লাগলেও সেই লোকের ফোন আসার অপেক্ষায় বসে থাকলাম । রাত ১১ টার পরেও ফোন এলো না দেখে আমরা দুজন শুয়ে পড়লাম ।

রাত্রে ঘরের মধ্যে খচ খচ শব্দে ঘুম হলো না । সকালে এলো সেই লোক তার সাথে ক্যামেরা এর বাকি সরঞ্জাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কাজে ।

চার পাঁচ দিন ভালোই কাজ করলাম, কোনোরকম অসুবিধা হয়নি । গাড়িও ঠিক মতো পেয়েছি আর আর খাবার হোটেলও । কিন্ত লাস্ট দিন অর্থাৎ কাল আমরা এখান থেকে ১৪০ km দূরে একটা জেলা মোহনাতে কাজ করে ফিরে যাবো এই চিন্তা ভাবনা করে ওই স্কুলেই ঘুমিয়ে পড়লাম ।

সকাল ১০ টা নাগাদ গাড়ি ভাড়া করে মাল পত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মোহনার উদ্দেশে । দুর্গম পথ, টোটাল পাহাড়ি এলাকা । গাড়ি টলতে টলতে পাহাড়ের উপর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলছে ।

সন্ধ্যায় নামলাম সেই স্কুলে, স্কুলটি অনেক পুরোনো স্কুলের গেটে লেখা আদাভা আদিবাসী গার্লস স্কুল । মালপত্র নামিয়ে গাড়ি ভাড়া চুকিয়ে স্কুলের ভিতরে ঢুকলাম । একজন আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতেও
এলেন । পাহাড়ের শীর্ষে এই স্কুল, আশেপাশে বাড়ি ঘর তো দূরের কথা একটাও দোকান পর্যন্ত নেই । তেমন উন্নয়ন হয়নি এখনো ।

যাইহোক ভাঙা চোরা স্কুলের ভিতর ঢুকেছি সবে মাত্র । আমাদের কাছে ক্যামেরার পেটি তারের বস্তা ও অন্যান্য জিনিস আছে, সেগুলো রাখতে হবে এজন্য সেই ভদ্র লোককে বললাম,

       - স্যার হাম লোগোকা এক কামরা চাহিয়ে, ইয়ে সব সামান রাখনা হে ।

ভদ্র লোকটি স্কুল থেকে কিছুটা দূরে একটা ছোট ঘরে রাখার জন্য নির্দেশ দিলেন, ঘরটা তুলনামূলক ভাবে বেশি পুরোনো আর বর্তমান প্রিন্সিপাল রুম থেকে কুড়ি গজ দূরে ছিল । সেই ঘরটাতেও ক্যামেরা লাগাতে হবে ।

আমরা ইতস্তত বোধ করলেও রাজি হলাম, কিন্তু ঘরটার চাবি আমাদের দিয়ে বলা হলো,

        -  আপ লোগ রুম ওপেন কিজিয়ে, মে আ রাহা হু ।

লোকটি চলে গেল, স্কুলে হোস্টেল ছিল, বিশাল বড়ো স্কুল । কিন্তু আমাদের কেন জানিনা একটু অন্যরকম লাগতে লাগলো । এইখানে বলি এতদিন আমরা যে স্কুলে কাজ করেছি সেই স্কুলের ক্লাস রুম এ থাকতে হয়েছে, আমাদের কাছে শোয়ার জিনিসপত্র ছিল । কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে সেরকম টা হবে না । ব্যবহার টা ঠিক কেমন যেন অদ্ভুত ধরণের । যেন আমরা ভুল ঠিকানায় চলে এসেছি ।

রাত আটটা বাজে, আমি ঐ রুমের চাবি নিয়ে মোহন কে বললাম,

        - ভাই মাল গুলো নিয়ে আই, আমি তালা খুলছি ।

জঙ্গলের মধ্যে সেই রুম, কোনোরকম আলোর ব্যবস্থা নেই, তবে বাকি রুম গুলোতে ছিল ।  আমাদের এই রুম এ আসতে যেতে মোবাইল টর্চ আর আলোতে  কাজ করতে হবে । ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে কাঁটা ঝোপ পেরিয়ে গেলাম ঝুল কালি পরা বারান্দায় ।  মনে মনে ভাবছি -- এই রুম এ ক্যামেরা লাগানোর কী প্রয়োজন ছিল, সালা কপাল করে একটা স্কুলও পেয়েছি ।

দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই একটা পচা ভেবসা গন্ধ আমাকে ঘিরে ধরলো । যেন আমাকে কে ধাক্কা মেরে বাইরে বের করে দিতে চাইছে । আমি ভাবলাম ঘরটা অনেক দিন বন্ধ থাকার কারণে অনেক Co2 জমে গেছে এই কারণে এরকম মনে হচ্ছে । আমি ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ঘরের জানালা গুলো খুলতেই বাইরে থেকে মোহনের আর্তনাদ শুনলাম,

         -  মনো - ও - ও - জ.....

আমি এক লাফে দৌড়ে বাইরে গেলাম দেখি ও মাটিতে পরে আছে । আমি বললাম

        - ভাই কী হয়েছে ? পরে গেছিস ?  এরকম চিৎকার করলি কেন, আমি ভয় পেয়ে গেছি ।

মোহন আর্ত কণ্ঠে বললো,

        - ভাই এখানে কে যেন আমাকে পা টেনে ধরেছিল ।

আমি ওকে ধমক দিয়ে বললাম,

        - কী যা তা বলছিস ? গাছের ডাল পায়ে বেঁধে গেছিলো হয়তো ।

মোহন খুব ভয় পেলো । আমি ওকে নিয়ে সেই লোকটাকে খুঁজতে স্কুলের দিকে গেলাম জোরে জোরে ডেকেও কাওকে পেলাম না । ঘাটের মরাটা কোথায় গেলো কে জানে ।

স্কুলের মধ্যে আমাদেরকে লাইব্রেরিতে থাকতে বলা হয়েছিল, লাইব্রেরি টা নতুন বেশ বড়ো, এটা বর্তমান ক্লাস রুমের পাশেই । আমি মোহন কে বললাম

          - ভাই লাইব্রেরিতে গিয়ে তুই জল খেয়ে রেস্ট কর, আমি মাল গুলো ঐ ঘরে রেখে আসছি এখনই ।

আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না, ভীষণ বিপদে পড়েছি এখানে এসে । একটা লোক নেই স্কুলের  ! এভাবে কাজ হয় ?

মাল গুলো টানতে টানতে ঐ ভাঙা ঘরে ঢুকিয়ে রেখে মোহনের কাছে আসলাম । মোহন চুপিচুপি বললো,

         - মনোজ তোর একটু অন্যরকম লাগছে না স্কুলটা ?

আমি হাসতে হাসতে বললাম,

         - আরে না না, কী যে বলিস । যাই হোক তুই ভয় যখন পাচ্ছিস তোর কাজ করতে হবে না, ৯ টা তো বাজেই তুই খেয়ে শুয়ে পর আমি কাজটা করি ।

একসাথে খেয়ে নিয়ে আমি চলে এলাম কাজে, মোহন লাইব্রেরিতে শুয়ে পড়লো । আমাকে একা একা কাজ কমপ্লিট দিতে হবে । ভয় আমারো একটু লাগছে, কিন্তু কী আর করার আছে । রাত সাড়ে ১০ টা বাজে । সন্ধ্যার সময়েই মহাশশ্মান লাগছিলো আর এখন তো এই স্কুল টাকে মৃত্যু পুরী মনে হচ্ছে ।

৭ খানা রুম এবং ঐ পুরোনো ঘরটাতে ক্যাবল তার ফেলতে ফেলতে ১২ টা বেজে গেলো । অন্ধকার পাহাড়ের মাঝখানে একা একা, এদিক ওদিক খুট খুট ঝুপ ঝাঁপ বহু আওয়াজ শুনলাম কিন্তু সাহস নিয়ে কাজ করে চলেছি ।

প্রিন্সিপাল রুম এ DVR বসিয়েছি ৮ খানা রুম এই ঘর থেকে নজর রাখা যাবে, ক্যামেরার তার এই রুমে নিয়েসে আমি ৮ টা ক্যামেরা আর যন্ত্রপাতি নিয়ে ক্যামেরা লাগাতে বের হলাম । সমস্ত ঘরে লাগানোর পর জঙ্গলের পুরোনো ঘরে যাচ্ছি । ঝিরি ঝিরি হাওয়া হচ্ছে । আমি গুনগুন করে গান করতে করতে পৌঁছলাম ।  ঘরে ঢুকতেই আমার গা সিরিয়ে উঠলো....

ঘরের জানলা তো তখন খুলে দিয়েছিলাম এখন বন্ধ কে করলো ?

আমার হৃদস্পন্দন বাড়তে থাকলো তবু প্রশ্রয় না দিয়ে আবার জানলা খুলে ঘরের ভিতর টা ভালো করে দেখলাম, একটা ব্ল্যাক বোর্ড, একটা আলমারি ও টেবিলের সাথে একটা ধুলো পরা চেয়ার পরে আছে । আমি চেয়ার টা টেনে ঘরের একটা কোনায় নিয়েসে ক্যামেরা টা লাগাচ্ছি কিন্তু হটাৎ করে কে যেন আমাকে চেয়ার থেকে পা টেনে মেঝেতে ফেলে দিলো । আমি ভাবলাম স্লিপ কেটেছে হয়তো । কোনোরকম ক্যামেরা লাগিয়ে DVR রুম এ এসে কম্পিউটার ও SMPS সেটিং করছি রাত্রি পৌনে ১ টা বাজে । ১৫ মিনিটের মধ্যে কাজ হয়ে যাবে । কিন্তু হটাৎ বাইরে কে যেন কথা বলছে অস্পষ্ট ভাবে কিছুটা অলচিকী ভাষার মতো আদিবাসী রা যেভাবে কথা বলে । আমার শুনতে ভুল হচ্ছে হয়তো । ডিসপ্লে তে সব ক্যামেরা চলে এসেছে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, নাইট মুড ক্যামেরা তাই আলো ছাড়াও সাদা কালো ছবি দেখাচ্ছে ।

হঠাৎ দেখি ৮ নম্বর ক্যামেরার রুমে চেয়ারে কে যেন বসে আছে । ভালো করে খেয়াল করার আগেই ক্যামেরাটা অফ হয়ে গেলো । সময় রাত ১ টা ১ মিনিট । আমি আবার সেই রুমে গেলাম একটা ক্যামেরা BNC জ্যাক আর DC কর্ড নিয়েছি, সাথে যন্ত্রপাতি ।

ঘরের ভিতরে ঢুকে আবার সেই দৃশ্য জানলা বন্ধ কিন্ত ব্ল্যাক বোর্ড এ এগুলো কী লেখা ?

আমি পড়তে পারলাম না ঠিকই কিন্তু ভয়ে আমার পিঠের লোম খাড়া হয়ে উঠলো, কেননা প্রথমবার, দ্বিতীয়বার ঘরে ঢুকে দেখেছি বোর্ড খালি ।

আমি এক ছুঁটে DVR রুম এ আবার গিয়ে মোহন কে ফোন করছি ওর ফোন বন্ধ, আমি চিৎকার করে ডাকবো গলার স্বর বেরোচ্ছে না । হটাৎ কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে দেখি ৮ নম্বর ক্যামেরা পুনরায় চলছে, চেয়ারে কেউ বসে নেই । ঘড়িতে সময় ১ টা ১৫ মিনিট ।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৩০৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৭/০৪/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast