www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

শিশিরের প্রণয় ও শীতের টেকনাফ

মাহবুব নেওয়াজ মুন্না :::
একটু একটু শীতের এই সন্ধ্যায় লেদার শরনার্থী আশ্রয় শিবির থেকে টেকনাফ শহরের দিকে ফিরতি যাত্রা করছে শিশির। শরনার্থী আশ্রয় শিবির থেকে লেদা বাজারে এসে সে মাহিন্দ্রা সিএনজি অটো নামক কানের পর্দা ফাটা আওয়াজের এক অদ্ভুত যাত্রীবাহী যানবাহনে উঠল। মাহিন্দ্রার ড্রাইভার আরো ক'জন যাত্রী তার গাড়িতে আরোহণ করিয়ে গাড়িটি পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষায় গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করে রেখেছে। শিশিরও অপেক্ষায় আছে কবে গাড়িটি যাত্রা শুরু করবে।

প্রায় ২০ মিনিট পর গাড়িটি লেদা বাজার থেকে টেকনাফ শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল। শিশির প্রতিদিন কাজের শেষে যখন টেকনাফ শহরে ফিরে যায় তখন তার এই সময়টা খুবই ভাল লাগে। শিশির আজ বসেছে গাড়িটির ফ্রন্টসীটে ড্রাইভারের পাশে।

নিত্যদিনের মতো লেদা থেকে টেকনাফ শহরে ফিরতে মহাসড়কটির দুপাশের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যগুলো শিশিরের খুবই ভাল লাগে। সারাদিনের কাজের চাপ আর মনেই থাকে না।

লেদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গেইটের সামনে একজন যাত্রীর ডাকে গাড়িটি একটু পর থামল। যাত্রীটিকে নামিয়ে গাড়িটি আবার যাত্রা শুরু করল।

গাড়িটি যেতে যেতে নয়াপাড়া শরনার্থী আশ্রয় শিবির ও জাদিমুড়া বাজার পার করে মহাসড়কের পশ্চিম পার্শ্বে টেকনাফ গেম রিজার্ভের মোচনী বনবিটের দমদমিয়ায় অবস্থিত টেকনাফ নেচার পার্কের মূল ফটকটি দেখে শিশিরের অনেক স্মৃতি মনে পড়ল। কারণ কিছুদিন আগেই শুক্রবারে শিশির তার এক রুমমেটকে নিয়ে জীববৈচিত্র্যের সৌন্দর্যময় এই পার্কটি ঘুরে এসেছিল। কিন্তু এই পার্কটি এখন আর আগের মতো নেই, কালের বিবর্তনে সংস্কারের অভাবে দর্শনার্থী কমে গেছে।

একটু পর দ্রুত গতিতে গাড়িটি চলার কারণে সম্বিত ফিরে পেয়ে শিশির নিজেকে দেখল পেল সে এখন দমদমিয়াস্থ সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভ্রমণের জাহাজ ঘাটে। এই সন্ধ্যায় থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ শেষে জাহাজ থেকে নেমে মহাসড়কে এসে শতশত পর্যটক বাড়িতে ফেরার জন্য চট্টগ্রাম-ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে যাওয়া বাসগুলোতে আরোহণ করতেছে।

গতবছর শীতের ঠিক এই সময়ে শিশির তার অফিসের সহকর্মীদের সাথে সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে জাহাজে করে সেন্টমার্টিন দ্বীপ ঘুরে আসল। জাহাজে করে নাফ নদ থেকে বঙ্গোপসাগরে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাওয়ার সময় সে একপাশে টেকনাফ শহর ও সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের জেটিঘাটসহ গ্রামীণ সব দৃশ্য দেখতে পেল, অন্যদিকে পাশ্ববর্তী দেশ মায়ানমারের পাহাড় ও অন্যান্য দৃশ্য দেখতে পেল। সেন্টমার্টিন দ্বীপের পাশে গড়ে উঠা ছোট্ট ছেঁড়া দ্বীপেও তারা গিয়েছিল কাঠের নৌকায় আরোহণ করে। ছেঁড়া দ্বীপে শিশির সবার সাথে ডাবের মিষ্টি পানিও পান করেছিল। সবাই মিলে ছবিটবি তুলল। সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণকালে শিশিরের সব চাইতে ভালো লেগেছিল যখন সে এক সিনিয়র সহকর্মীর সহযোগিতায় লঞ্চের ৩য় তলার ডেকে অনুমতি নিয়ে ক্যাপ্টেনের রুমে প্রবেশ করার পর কিভাবে সাগরে এত বড় জাহাজ চালানো হয় তা সচক্ষে দেখতে পারল।

দমদমিয়া জাহাজ ঘাটের যানজট শেষে গাড়িটি পৌঁছল টেকনাফ স্থল বন্দর ও কোস্ট গার্ড বাহিনীর সিজিসি স্টেশন এলাকায়।

বন্দর এলাকা শেষে যখন গাড়িটি নাফ নদ ও পাহাড়ের মাঝখানের জায়গা পৌরসভা গেইট নামক উঁচু স্থানে (উঠনি) উঠল, তখন বরাবরের মতো শিশির পশ্চিম পাশের বনের সুউচ্চ নেটং পাহাড় এবং পূর্ব পাশে নাফ নদের জলে রাতের পূর্ণিমার আলোর কিরণ দেখতে পেলো। রাতের তারা-নক্ষত্রগুলো নাফ নদের জলে জোনাকির মতো আলো দিচ্ছে, আর চাঁদ-তারার আলোতে নাফ নদের নীল রংয়ের জলকে আরো অসাধারণ মনে হয় শিশিরের। রাত বাড়ার সাথে শীতের হিম প্রবাহও বেড়ে যাচ্ছে, তাই শিশির শেষপর্যন্ত ব্যাগ থেকে জ্যাকেটটি বের করে গায়ে পরে নিল।

গাড়িটি চলতে চলতে টেকনাফ বাস টার্মিনাল পার হয়ে ঝর্ণা চত্বরে গিয়ে থামল। শিশিরের বাসা টেকনাফ শহরের কেকে পাড়ার এক ব্যক্তির বিল্ডিংয়ের ২য় তলার একটি ফ্ল্যাটে। শিশির ও আরো কয়েকজন চাকুরীজীবি মিলে এই ফ্ল্যাটটিতে দীর্ঘদিন ধরে থাকে।

শিশিরের জন্ম ও বেড়ে উঠা কিশোরগঞ্জ জেলায়। শৈশব থেকেই চরাঞ্চলে তাদের নিম্ন আয়ের পরিবারের নৈমিত্তিক দুঃখ-কষ্টকে লালন করে পড়াশোনা করে শিশির। কোনরকম স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা করে সে গত ২ বছর ধরে টেকনাফের শরনার্থী আশ্রয় শিবিরে চাকুরী করছে।

রাতের খাবার শেষে শিশির যখন তার স্মার্টফোনটির ইন্টারনেট সংযোগ চালু করল, তখনই দেখতে পেল বীথি তার খবরাখবর জানতে চেয়ে অনেকগুলো খুদে বার্তা পাঠিয়েছে। বীথিকে সে অনেক ভালবাসে। স্বপ্ন দেখে বীথিকে নিয়ে একদিন সুখের ঘর বাঁধার। বীথি সবেমাত্র একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হলো। শিশির যখন নিয়মিত এলাকায় থাকতো তখন থেকেই বীথিরও শিশিরকে ভালো লেগে যায়। তাই বীথি শিশিরের ভালবাসাকে হৃদয়ে গহীনে ধারণ করে নেয়। সেই থেকেই বীথি নিয়মিত শিশিরের খবরাখবর নেয়, তার মনের সব কথা শিশিরকে জানায়। অপেক্ষা করে শিশির কখন ছুটিতে বাড়িতে বেড়াতে আসে, তাকে দেখতে আসবে।

এদিকে শিশির স্বপ্ন দেখে, এই রকম কোন এক শীতের সময়ে বিয়ের পর সে বীথিকে নাফ নদ ও পাহাড়ের মাঝখানের টেকনাফের পৌরসভা গেইট (উঠনি), টেকনাফ নেচার পার্ক, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, বাহারছড়ার বাঘ ঘোনা ঝর্ণা, মেরিন ড্রাইভের জিরো পয়েন্টের সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, সী বিচ, শাহপরীর দ্বীপের জেটিঘাট ও মনোরম রেস্টুরেন্ট সাউদার্ন পয়েন্ট ইত্যাদি সব জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাবে।

রাত তখন ১১ টা, মুঠোফোনে বীথির সাথে আলাপ করতে করতে কবে যে শিশিরের চোখে ঘুম চলে আসল টেরই পায়নি। তাই সে বীথিকে শুভ রাত্রী বলে মুঠোফোনের আজকের আলাপের সমাপ্ত করলো, কারণ পরদিন ভোরে উঠে আবারতো কাজের জন্য অফিসে যাওয়া লাগবে।

মাহবুব নেওয়াজ মুন্না : লেখক ও প্রাবন্ধিক। জন্ম ১৯৯৩ সালের ২২ ডিসেম্বর। শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা কক্সবাজারের বিশেষ পর্যটন অঞ্চল সাবরাংয়ে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ও কম্পিউটার বিষয়ে পেশাগত ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেছেন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে লেখকের কর্মজীবন শুরু। বর্তমানে ২০১৮ সাল থেকে উন্নয়ন সংস্থা শেডে কর্মরত। প্রথম লিখা প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৩৬ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২১/১২/২০২৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast