www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

ইসলাম হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ ও সার্বজনীন জীবন বিধান। জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও সভ্যতার চরম উৎকর্ষতায় পূর্ণ একবিংশ শতাব্দীর সূচনায় দাঁড়িয়ে আমাদের ভাবিয়ে তুলছে সমস্যা সঙ্কুল বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে। নৈসর্গীক শোভামন্ডিত, অসংখ্য-অজস্র নিয়ামতে পূর্ণ এ পৃথিবীতে পরম স্রষ্টা মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মর্যাদায় অভিষিক্ত করে পিঠিয়েছেন। অথচ মানুষ তার সুদীর্ঘ ইতিহাসে বারবার শান্তি-সমৃদ্ধি-শৃঙ্খলার পথ ছেড়ে দিয়ে অশান্ত-উশৃঙ্খল-ভ্রান্ত পথের অনুসরনে মত্ব হয়ে পৃথিবীকে বিপর্যস্থ করেছে এবং এখনও তারই পুনরাবৃত্তি করছে। পথভ্রান্ত, বিপর্যস্থ মানব জাতির মুক্তির লক্ষে যুগে যুগে নবী ও রাসূলগণ (মহামানব) এসেছেন এবং হযরত মুহাম্মদ (স.) সর্বশেষ রাসূল হিসেবে। কোরআন শরীফে উল্লেখ আছে, "নিঃ‌সন্দেহে আমি তোমাকে (মুহাম্মদ) পাঠিয়েছি সত্যের সাথে সূসংবাদদাতা এবং সতর্ককারীরুপে। আর এমন কোনো সম্রদায় নেই, যাঁদের মাঝে একজন সতর্ককারী পাঠানো হয়নি" (৩৫:২৪)। সমগ্র সৃষ্টি জগতের প্রতি আশির্বাদস্বরুপ প্রেরিত হয়ে মুহাম্মদ (স.) মানব জাতির জন্যে স্থায়ী এক সুন্দর জীবন বিধান ইসলাম বাস্তবায়ন করে গিয়েছেন। আর এ বিধান আনুসারে আমাদের জীবন পরিচালিত করতে পারলে বর্তমান অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

ইসলাম -এর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষন করলে দেখা যায় শান্তি স্থাপন -ই ইসলামী বিধানের মূল উদ্দ্বেশ্য। আরবী ইসলাম (~¼aA) শব্দ ~ | b ধাতু হতে উৎপন্ন, এর বুৎপত্তিগত অর্থ শান্তি, আপোষ, বিরোধ পরিহার। স্বরচিহ্নের তারতম্যে বিভিন্ন আকারে একই অর্থে কোরআন শরীফে এই ধাতু হতে নিষ্পন্ন কয়েকটি পদের ব্যাবহার -

» ä~{a - যুদ্ধ পরিহারের জন্য শান্তির প্রস্তাব (৮:৬১)।

» ä~{a - ইসলামী বিধান (২:২০৮)।

» ä~{a - যুদ্ধ পরিহারের প্রস্তাব (৪:৯০-৯১)।

» ä~{a - শান্তি (১০:১৫) অথবা শান্তি কামনামূলক মুসলিম অভিবাদন (৫১:২৫)।

অতএব, ইসলামী বিধানের মূলকথা হলো যুদ্ধ পরিহার অর্থাৎ যা মানুষের ক্ষতিসাধন করে ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তা পরিহার এবং শান্তি স্থাপন।

ইসলামের অর্থ - (১) এক ও অদ্বিতীয় পরম স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পন করা (২:১১২), (২) শান্তি স্থাপন তথা বিরোধ পরিহার করা। দ্বিতীয় অর্থটির ব্যাখ্যায় বলা হয় (ক) আত্মসমর্পনে আল্লাহর সাথে শান্তি স্থাপিত হয় ও তাঁর বিরোধীতা পরিত্যাক্ত হয় এবং (খ) আল্লাহর সৃষ্টি মানুষের সাথে একাত্বতার অনুভূতিতে সাম্য-নীতির স্বীকৃতিতে সমাজে শান্তি-নিরাপত্তার অনুকুল অবস্থার সৃষ্টি হয় (বুখারী, ২য় খন্ড, ৩)।

"ইসলাম মানবের চিরন্তন ধর্ম" (৩:১৮) -এর ৫টি মূল স্তম্ভ বা ভিত্তি রয়েছে - (১) কালেমা অর্থাৎ ঈমান বা বিশ্বাস, (২) নামাজ বা প্রার্থনা, (৩) সিয়াম বা নির্ধারিত কিছু কাজ থেকে বিরত থাকা, (৪) যাকাত বা দান এবং (৫) হজ্জ্ব বা মক্কা/তীর্থস্থান ভ্রমন। ইসলামের মূল বিশ্বাস - (১) আল্লাহর একত্ব ও অদ্বিতীয়ত্বে বিশ্বাস, (২) মৃত্যুর পর আখিরাত, পুনরুত্থান ও বিচারান্তে অনন্ত পরজীবনে বিশ্বাস এবং (৩) আমল-সালিহ বা সৎকর্মে আত্মনিয়োগ। বিশ্বাসের পর্যায় - (ক) ফেরেশতাগণ, (খ) ঐশী গ্রন্থসমূহ, (গ) সকল নবী-রাসূলগণ ও (ঘ) আল্লাহর সর্বময় নিয়ন্ত্রন অর্থাৎ তাগদীর বা ভাগ্য -এ বিশ্বাসও উপরোক্ত ৩টি মৌলিক উপাদানে যুক্ত। এসব বিষয়ের উপর যদি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা হয় তাহলে বিশৃঙ্খলা-অশান্তি নিজ থেকেই দুর হয়ে যাবে। কারন এসব বিশ্বাসের ফলে মানুষ খারাপ কাজ, পাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে। বুঝতে পারবে ভালো কাজ করলে পরকালে চিরশান্তি এবং অন্যায় কাজ করলে, বিধান পরিপন্থী কার্যকালাপ করলে পরকালে শাস্তির ব্যাবস্থা রয়েছে।

ইসলামী শরিয়তের ৪টি উৎস রয়েছে - (১) আল-কিতাব বা কোরআন শরীফ, (২) সূন্নাহ্ বা হাদিস, (৩) ইজমা ও (৪) কিয়াস। কোরআন শরীফ হচ্ছে এমন এক ঐশী গ্রন্থ যা স্বীকার ও সত্যায়ন করে পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূল ও ঐশী গ্রন্থসমূহ। এখানে মানুষের জীবন সৎভাবে পরিচালিত করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, ভালো-মন্দের পার্থক্য বলে দেয়া হয়েছে। কোরআন শরীফে উল্লেখ আছে, "সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর, কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্মীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রিতদাসদের জন্যে। আর যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য্য ধারনকারী তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেযগার" (০২:১৭৭)। ইসলামী বিধানের মূল উৎস হল এই কোরআন শরীফ, বর্তমানে যাকে বলা হয় বিজ্ঞানময় কোরআন। আর এর বাস্তব প্রমান দেখানো হয়েছে হাদিসে। মুহাম্মদ (স.) -এর কথা, কাজ, অনুমোদন এবং তাঁর দৈহিক ও চারিত্রিক যাবতীয় বৈশিষ্টই হল হাদিস। পাপ-পূন্য সম্পর্কে মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, "পূন্য হলো সদ্ব্যবহার, আর পাপ হলো যা সন্দেহ তৈরী করে এবং তুমি পছন্দ করো না যে লোকজন তা জেনে ফেলুক" সহীহ মুসলিম (৩২:৬১৯৫)। তিনি আরো বলেছেন, "প্রত্যেক আদম সন্তানই পাপ করে, পাপীদের মধ্যে তারাই সর্বত্তোম যারা তওবা করে" সুনানে তিরমিযী (২৪৯৯)। মানুষের জীবন কিভাবে পরিচালিত করতে হবে, কিভাবে পরিচালিত করলে দুনিয়ায় ও পরকালে চিরশান্তিতে থাকা যাবে হাদিসে তা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এ দু'টি গ্রন্থ অনুসরন করে চলতে পারলে শান্তিময় সুশৃঙ্খল সামাজ ব্যাবস্থা বজায় রাখা সম্ভব। মুহাম্মদ (স.) নিজেই বলেছেন, "আমি তোমাদের কাছে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, তোমরা যতদিন এ দুটি বস্তু আকরে থাকবে ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব (কোরআন) এব‌ং অপরটি হচ্ছে তাঁর রাসূলের সুন্নাহ্ (হাদিস)" মিশকাত। আর বর্তমানে যদি এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যার সরাসরি সমাধান কোরআন বা হাদিসে নেই, ইজমা ও কিয়াস দ্বারা তার সমাধান করা সম্ভব। কোরআন শরীফেও উম্মতী মুহাম্মদের ঐক্যমতের বা কিয়াসের ইঙ্গিত করা হয়েছে। ফলে বোঝা যায় ইসলাম সবদিকদিয়ে সয়ংসম্পূর্ণ জীবন বিধান।

একটি প্রশাসনিক সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা স্থাপন করে ইসলাম মানুষের জীবনে শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। যে দেশে একসময় আইন-শৃঙ্খলা বলে কিছুই ছিল না, যে দেশের লোক দিনের বেলায় স্বাধীনভাবে ঘুরে বেরাত তবে রাতের শেষে দেখা যেত সে অন্যের ক্রীতদাস হয়ে শিকল টানতে টানতে তাঁর পেছনে চলছে, যে দেশের যে কোনো জনপদ নিশীথ রাতে অজানা শত্রুর অতর্কিত আক্রমনে মুহূর্তে বিদ্ধস্থ হয়ে পরত। মানুষের জীবনের, তাঁর প্রাণের ও রক্তের মূল্য যে দেশে ছিল না, সেই দেশেই (আরব) একজন মহিলা পূর্ণ-অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে একাকী সান'আ থেকে মদীনা পর্যন্ত কয়েকশত মাইল ভ্রমন করে, অথচ কেউ তাকে আক্রমন করে না। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ইসলামী বিধান বাস্তবায়নের ফলে আইন ও শৃঙ্খলার এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে।

ভিন্ন ধর্মালম্বীর সহিত শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান নীতি ইসলামের অবদান। কোরআন শরীফে আহ্বান করা হয়েছে, "তুমি (মুহাম্মদ) বল, হে কিতাবীগণ, এসো সেই কথায় যা তোমাদের এবং আমাদের মধ্যে এক; যেন আমরা আল্লাহ ব্যতীত কারো ইবাদত না করি। কোনো কিছুকেই তাঁর শরিক না করি। এবং আমাদের কেউ কাউকে আল্লাহ ব্যতীত উপাস্য হিসেবে গ্রহন না করি। যদি তাঁরা মূখ ফিরিয়ে নেয় তবে বল, তোমরা সাক্ষী থাক; অবশ্যই আমরা মুসলিম" (৩:৬৪)। ইসলাম সকলের ধর্মীয় স্বাধীনতার পক্ষপাতী, এমনকি অমুসলিমদের ধর্ম-মন্দির রক্ষার দায়িত্ব মুসলিমের উপর পরে, যদি কেউ তা ধ্বংশ করতে উদ্যত হয় (২২:৪০)। কা'বায় উপাসনার অধিকারে হস্তক্ষেপকারী ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মুলোচ্ছেদকামী মুশরিকদের বিচারেও ন্যায়ের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে (৫:২৮)। ইসলামী আইনের শাসন অপর ধর্মালম্বীগণের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট নয়।

যুদ্ধরত বিধর্মীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে ইসলাম। শান্তির প্রচেষ্টা ব্যার্থ হলে যুদ্ধ করতে হবে (৮:৬১)। তবে কোরআন শরীফে সতর্ক করা হয়েছে, "আর লড়াই কর আল্লাহর ওয়াস্তে তাদের সাথে, যারা লড়াই করে তোমাদের সাথে। অবশ্য কারো প্রতি বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না" (২:১৯০)। যারা যুদ্ধরত বা যুদ্ধাক্ষম নয়, অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক-বালিকা, বৃদ্ধ, নারী, মঠ-মন্দিরাশ্রয়ী সাধু তাঁদের উপর আঘাত করা নিষিদ্ধ, অযথা তাঁদের শস্য ও সম্পদ ধ্বংশ করা, তাঁদের ঘরবাড়ি ভুমিসাৎ করা যাবে না [অভিযান প্রেরনের সময় মুহাম্মদ (স.) -এর উপদেশ; হালাবী ৩:৩৬,৩৯৩ কিতাবুল জিহাদে মিশকাত উদ্বৃত হাদিস]। সুতরাং শান্তির প্রস্তাব অবশ্যই গ্রহনীয়, এমনকি প্রতিপক্ষের শঠতার সন্দেহ থাকলেও (৮:৬১-৬২)। শান্তির খাতিরে অসুবিধাজনক শর্তেও সন্ধির নজির রয়েছে। বিনা বিজ্ঞপ্তিতে এককভাবে শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করা যাবে না (৯:৬)। ফলকথা, ইসলাম অতি পরিছন্ন আন্তর্জাতিকতার ধারক ও বাহক।

সামাজিক বিশৃঙ্খলা, অশ্লীলতা ও ব্যভিচার নিরসনের লক্ষে ইসলামে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই পর্দা বা শরীরের নির্দিষ্ট কিছু অংশ আবৃত রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে (২৪:৩০-৩১)। কেননা অনেকক্ষেত্রে নারী-পুরুষ অবাধ মেলামেশায় সামাজিক অনাচার দেখা দিতে পারে। তবে ইসলাম সর্বাবস্থায় নারীদের ঘরে আবদ্ধ করে রাখার কথা বলে না। মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, "অবশ্যই প্রয়োজনে তোমাদের (নারীদের) বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে" সহীহ বুখারী (৪৪৩৬)। কোরআন শরীফে বলা হয়েছে, "হে নবী, বলুন আপনার স্ত্রী ও কন্যাদেরকে এবং বিশ্বাসী নারীদেরকে যে, তাঁরা যেন তাদের বহিরাবরন পরে থাকে (যখন বাইরে যাবে)। এটা তাঁদের পরিচিতির অত্যন্ত উপযোগী। (তাঁরা যেন পরিচিত হয় বিশ্বাসী হিসেবে) তাহলে আর অহেতুক উৎপিড়ীত হবে না। আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল দয়াবান" (৩৩:৫৯)। ইসলামে নারীর অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নোত রাখা হয়েছে। মুহাম্মদ (স.) অনেক সাহাবিকেই আয়েশা (রা‌.) এর কাছে ধর্মীয় বিধান শিক্ষার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইসলাম নারীর উপর জোর-জুলুম নিষিদ্ধ করে নারীর সুচিন্তিত মতামতের গুরুত্ব দিয়েছে (সহীহ বুখারী, ৪৭৬৪)। অর্থাৎ সমাজে নারী-পুরুষ উভয়ের ভূমিকাই ইসলাম স্বীকার করে পারিবারিক ও সামিজিক সম্পৃতি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করেছে।

ইসলামে নামজ বা প্রার্থনা, রোজা বা সংজম ফরয করা হয়েছে। কোরআন শরীফে বলা হয়েছে, "হে ইমানদারগণ; তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরুপ ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার" (২:১৮৩)। নামাজের মধ্যে সকল শ্রেণী-পেষার মানুষ একসাথে কাধে কাধ মিলিয়ে দাড়াতে হয়, ফলে সমাজের উচু-নিচু ভেদাভেদ নির্মূল হয়, তৈরী হয় সাম্য-ভ্রাতৃত্ববোধ। ইসলামে ধর্ম বৈষম্য সৃষ্টিকারী, শোষনমূলক সূদ হারাম, যাকাত ওয়াজিব, উত্তরাধিকার আইন সম্পদ বন্টনমূলক। ইসলামী বিধানের সকল নিয়োম-নীতি, আচার-আচরন, বিচার ব্যাবস্থা বিশ্বাসী সব ধরনের মানুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। এতে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য দুর হয়, যা ইসলামের একটি অবদান।

হযরত মুহাম্মদ (স.) (৫৭০ - ৬৩২ খ্রি‌.) হচ্ছেন বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (১৭৬৯ - ১৮২১ খ্রি.) তাকে একজন আদর্শ আইন নির্মাতা এবং মহামানব আখ্যা দিয়েছেন। মাইকেল এইচ. হার্ট. বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একশত মনিষী জীবনি গ্রন্থে তাঁকে প্রথম স্থানে রেখেছেন। এছাড়া অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তা ও বিশেষজ্ঞদের মতে তিনি ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা। তাঁর এই বিশেষত্বের অন্যতম কারন হচ্ছে আধ্যাতিক ও জাগতিক উভয় ক্ষেত্রেই চুরান্ত সফলতা অর্জন। তাঁর উত্তম চরিত্র, আমানতদারী, সত্যবাদীতা ও সদাচরনের কারনে বালক বয়সেই তৎকালীন অরবরা তাকে আল-আমিন বা বিশ্বাসযোগ্য বলে সম্বোধন করতেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ফিজারের যুদ্ধে (৫৮৪ খ্রি.) অংশগ্রহন করে যুদ্ধের নির্মমতায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন, তবে তখন তাঁর কিছুই করার ছিল না। তিনি ছিলেন শান্তিকামী। তৎকালীন আরবদের মধ্যে বিদ্যমান অরাজকতা, হিংস্রতা, খেয়ানতপ্রবনতা এবং প্রতিশোধস্পৃহা দমনের জন্যই তিনি কয়েকজন উৎসাহী যুবকদের নিয়ে গঠন করেন হিলফুল ফুজুল বা শান্তিসংঘ (৫৮৪ খ্রি.)। আর্তদের সেবা করা, অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করা, অত্যাচারিতকে সাহায্য করা, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং গোত্রে গোত্রে শৃঙ্খলা ও ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখাই ছিল এ শান্তিসংঘের উদ্দেশ্য। বস্তুত আধুনিক বিশ্বের আজকের জাতিসংঘ, সেদিনকার যুবসংগঠন হিলফুল ফুজুল -এর কাছে অনেকাংশে ঋনী। তবে পার্থক্য এই যে, মুহাম্মদ (স.) সেই যুবসংঘের নিতীমালা যে নিষ্ঠার সাথে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছিল, বর্তমানের জাতিসংঘ তা পারছে না। বিশ্বব্যপি আজ অশান্তির আগুন, ব্যাপক বিধ্বংশী অস্রে সজ্জিত সুপার পাওয়ারগুলো মহা আতঙ্কে রয়েছে, দুটি বিশ্ব যুদ্ধও হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে (১৯৩৯-৪৫ খ্রি.) প্রায় পাঁচ কোটি লোক নিহত হয়েছিল। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি বেধে যায়, তাহলে হয়ত সমগ্র পৃথিবীই নিহত হবে। জাতিসংঘ স্বস্তি পরিযদ স্বস্তি দিতে পারছে না। অথচ সপ্তম শতাব্দীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনগ্রসর বিশ্ব, নৈরাজ্য ও নৈরাশ্যে মুহ্যমান বিশ্ব স্বস্তি ও শান্তির পরশ পেয়েছিল। সকল সমস্যার সমাধান করে দিয়েছিল মদীনা সনদ (৬২২ খ্রি.), যা বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান। একথা ইতিহাস স্বীকৃত যে, মুহাম্মদ (স.) প্রতিষ্ঠিত সেই সমাজ ও কল্যাণ রাষ্ট্র আজও পৃথিবীর বুকে মাইলফলক হয়ে আছে। ধর্মীয় ব্যাপারে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, "তোমরা ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকবে। জেনে রেখো তোমাদের পূর্ববর্তীগণ এই বাড়াবাড়ির কারনে ধ্বংস হয়ে গেছে" সহীহ মুসলিম কিতাবুল হজ্জ্ব (১৫৯)। মুহাম্মদ (স.) -এর সে মহান আদর্শিক বিপ্লবের কারনে তৎকালীন বর্বর ও অসভ্য আরব সমাজ সোনায় পরিনত হয়েছিল। এখনও যদি তার পূর্ণ অনুসরন করা যায়, তাহলে সন্দেহাতীতভাবেই বর্তমানের দাবানলসমূহ, এই অশান্ত পৃথিবীর বুকে প্রশান্তির প্রবাহ বইয়ে দেয়া সম্ভব।

মুহাম্মদ (স.) -এর মৃত্যুর (৬৩২ খ্রি.) পর অবু বকর সিদ্দীক (রা‌.) (৫৭৩ - ৬৩৪ খ্রি.) মুসলিম বিশ্বের খলিফা নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন মুহাম্মদ (স.) এর একজন প্রধান সহযোগী, ইসলামে প্রথম খলিফা (৬৩২ - ৬৩৪ খ্রি.) এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহনকারী (৬১০ খ্রি.)। ব্যাক্তিগতভাবে ছিলেন শিক্ষিত, মার্জিত ও আদর্শবান এবং কাব্যের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। সিদ্দীক বা বিশ্বস্ত তাঁর উপাধি। ইসলাম গ্রহনের পর অনেক অত্যাচার সহ্য করেছেন এবং মুহাম্মদ (স.) এর সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। তাবুক যুদ্ধে (৬৩০ খ্রি.) তিনি তাঁর সকল সম্পদ দান করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন এবং এক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য ছিল, "আমি আল্লহ ও তাঁর রাসূলকে আমার ও আমার পরিবারের জন্য রেখেছি"। মুহাম্মদ (স.) এর মৃত্যু স‌ংবাদ প্রচার হওয়ার পর পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে, বিশেষ করে উমর (রা.) অশান্ত হয়ে পড়েন ও মানতে অস্বীকৃতি জানান। আবু বকর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ঘোষনা করেন, "তোমাদের মধ্যে যারা মুহাম্মদ (স.) এর পূজা করতে তারা জেনে রাখুক যে মুহাম্মদ (স.) মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদত করতে, অবশ্যই আল্লাহ সর্বদাই জীবিত থাকবেন কখনো মৃত্যুবরণ করবেন না"। তাঁর এই বক্তব্যের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় এব‌ং উমরের অবস্থা শান্ত হয়। মুহাম্মদ (স.) সরাসরি কোনো উত্তরাধিকার মনোনিত করে যাননি। ফলে নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এব‌ং গোষ্ঠী প্রধানদের সমর্থনে আবু বকর (রা.) মুসলিম বিশ্বের খলিফা বা সরকার প্রধান নির্বাচিত হন (৬৩২ খ্রি.)। খলিফা পদে অধিষ্টিত হয়ে তিনি ঘোষনা করেন, "আমি যতদিন আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের নির্দেশিত পথে চলি, তোমরা আমায় অনুকরন করবে আমাকে সহায়তা করবে। আর ভূল পথে চল্লে তোমরা আমাকে সাথে সাথে স‌ংশোধন করে দিবে। তোমাদের মধ্যে যারা দূর্বল, তাদের হক আদায় না করা পর্যন্ত তারা আমার নিকট সবল ও শক্তিশালী। আর যারা সবল তাদের কাছ থেকে হকদারের হক না আদায় করা পর্যন্ত তারা আমার নিকট দূর্বল।" তাঁর এ ভাষন সর্বকালের শাসকদের জন্য আদর্শ। মুহাম্মদ (স.) পরবর্তী পরিস্থিতি তিনি দৃঢ়ভাবে নিয়োন্ত্রন করেন এবং শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সমর্থ হন। বর্তমানেও যদি শাসকবৃন্দ নিজেদের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন হন এব‌ং দোষ-ত্রুটি স‌ংশোধনের মানষিকতা সৃষ্টি করেন, তাহলে দেশ তথা বিশ্বে সুশাসন অবশ্যই নিশ্চিত হবে।

আবু বকর সিদ্দীক (রা.) এর মৃত্যুর (৬৩৪ খ্রি.) পর উমর ফারুক (রা‌.) (৫৭৭ - ৬৪৪ খ্রি.) মুসলিম বিশ্বের খলিফা মনোনিত হন। তিনি ছিলেন মুহাম্মদ (স.) এর অন্যতম সহযোগী, ইসলামী আইনের একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ এবং ইসলামে দ্বিতীয় খলিফা (৬৩৪ - ৬৪৪ খ্রি.)। ব্যাক্তিগতভাবে ছিলেন শিক্ষিত, রুচিশীল ও দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী। নিজে কবি না হলেও কাব্য ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। প্রথমদিকে তিনি ইসলামের ঘোর বিরোধীতা করেছিলেন, এমনকি মুহাম্মদ (স.) কে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। তবে ঘটনাক্রমে তিনি কোরআন শরীফের কিছু অংশ পাঠ করে এর মর্মবানী উপলব্ধি করেন, তাঁর মানষিক পরিবর্তন আসে, ফলস্রুতিতে তিনি ইসলাম গ্রহন করেন (৬১৬ খ্রি.)। ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করার কারনে মুহাম্মদ (স.) তাঁকে ফারুক বা সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী উপাধী দেন। পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামী বিধান বাস্তবায়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় মুহাম্মদ (স.) এর সাথে শক্ত ভূমিকা পালন করেন। ইসলামী খিলাফতের প্রতিষ্ঠা (৬৩২ খ্রি.) উমরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন অবদান, যা পৃথিবীর ইতিহাসেও গুরুত্বপূর্ণ। উমর খলিফা পদে অধিষ্টিত হওয়ার পর খিলাফতের সীমানা অকল্পনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়, তিনি প্রায় ৩৬০০০ শহর বা দূর্গ দখল করেন এব‌ং বিজিত অঞ্চলে প্রায় ১৪০০ মসজিদ নির্মাণ করেন। জেরুজালেম জয়ের পর পূর্ববর্তী খ্রিস্টান রীতি বদলে ইহুদীদেরকে সেখানে বসবাসের ও উপাসনা করার সুযোগ দিয়েছিলেন। তিনি আদেশ জারি করেন যাতে বলা হয় এই খ্রিস্টান ও ইহুদীদের সাথে ভালো আচরন করতে হবে এবং তাদের নতুন বসতিতে সমপরিমান জমিও প্রদান করা হয়। ইসলামী সম্রাজ্যের স্থাপতি হিসেবে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাঁর শাসন পচ্শিমে বর্তমান লিবিয়া থেকে পূর্বে সিন্ধু নদ ও উত্তরে আমুদরিয়া নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অথচ তাঁর বাড়ি ছিল মাটির তৈরী এব‌ং প্রায় রাতেই তিনি সর্বসাধারনের অবস্থা যাচাইয়ের জন্য ছদ্মবেশে রাস্তায় বের হতেন। তিনি বলতেন, "যদি ইউফ্রেটিসের তীরেও একটি কুকুরও না খেয়ে মারা যায়, তবে উমর সে জন্য দ্বায়ী থকবে"। উমর বাইতুল মাল নামক রাষ্ট্রীয় কোষাগার স্থাপন (৬৪১ খ্রি.) করেন এব‌ং এখান থেকে মুসলিম ও অমুসলিম দরিদ্র, অসহায়, বৃদ্ধ, এতীম, বিধবা ও অক্ষমদের সহায়তা প্রদান করা হত। তাঁর শাসন ও বিচার ব্যবস্থা ছিল নিরোপেক্ষ ও নিখুঁত। আইনের চোখে উঁচু-নিচু, ধনী-গরীব, আপন-পর কোনো ভেদাভেদ ছিল না। মদ্যপানের অপরাধে নিজ পূত্র জুবায়ের বা আবু শাহমাহকে তিনি কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন। কোনো এক বিচ্ছিন্ন ঘটনার করনে একজন পারসিয়ানের ছুরিকাঘাতে উমর গুরুতর আহত হন এবং তিনদিন পর মৃত্যবরণ করেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল যে মদীনায় বসবাসরত পারসিয়ানরা এই হামলার জন্য দ্বায়ী, এতে উমরের পূত্র উবাইদুল্লাহ উত্তেজিত হয়ে মদীনার পারসিয়ানদের হত্যা করতে উদ্যত হন। উমর মৃত্যুপূর্বে মুমুর্ষ অবস্থায় এই সংবাদ জানতে পেরে উবাইদুল্লাহকে বন্দী করার আদেশ দেন এবং বলেন, "পরবর্তী খলিফা উবাইদুল্লাহর রায় নির্ধারণ করবেন"। এভাবে সমস্ত অন্যায়-অনাচার ও বিশৃঙ্খলামূলক কর্মকান্ড তিনি কঠোরহস্তে দমন করেন। বর্তমানে এ দূর্নীতিপরায়ন বিশ্বে যদি ইসলামী বিধান অনুসারে তাঁর মতো অন্যায়কে কঠোরভাবে দমন করা যায়, তাহলে শান্তিপূর্ন সুশৃঙ্খল ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা হতে বাধ্য।

মোটকথা, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যাবস্থার নাম। মানব জীবনের এমনদিক নেই যা ইসলামে আলোচনা করা হয়নি। শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। ইসলামের তাত্বিক ব্যাখ্যায় যেমন দেখা যায়, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রতি জোর তাগিত দিতে, তেমনি বিভিন্ন মনিষীগণ ইসলামী বিধান বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। এখানে উল্লেখিত শাসকগণ ছাড়াও আরো অনেক শাসক ইসলামী বিধান অনুসারে শাসন পরিচালনা করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছেন। সুতরাং বর্তমানের এই সংকটময় বিশ্ব পরিস্থিতিতে ইসলামী বিধান-অনুশাসন অনুযায়ী আমাদের জীবন পরিচালিত করতে পারলে সমাজ, দেশ তথা বিশ্বে শান্তি বিরাজ করবে।



নিরিবিলি, মাদারিপুর│ ১৪।০৩।২০০৪
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৫৮৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২০/০৬/২০১৯

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

 
Quantcast