www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মেয়ে তুমি

মেয়ে তুমি-
--
গতকালই প্রথম দেখা তার সাথে,আমার টেবিলের পাশে এসে দাড়িয়ে খুব মিষ্টি করে কিছু জানতে চাচ্ছে,আমার মনে হল এ মেয়ে আমার বহুচেনা,বহু আপন,বহু যুগের চিরচেনা কোন এক নাম না জানা অথচ আমারই আত্মজা আমার পাশে এসে দাড়িয়েছে।
আমি মেয়েটিকে দেখছি কিন্তু দেখছি না।আমি চলে গেলাম প্রাচীন কোনও এক গুহাচিত্রে,যেখানে আবছায়ার মত রহস্য খেলা করে।
পলকে বাস্তবে চলে এলাম," তোমার নাম কি?"
---"ঋতু"
যেমন আপাদমস্তক মিষ্টি সে, তেমনি কিন্নর তার কণ্ঠ।তারুণ্যের দৃপ্ত ঔজ্জ্বল্যে ঝলমল কান্তিময়ী।
---" তোমাকে আমার এত চেনা লাগছে কেন? তুমি কি আমার পরিচিত কেউ?"
----" জ্বী না।আজই প্রথম দেখা"।
---"তোমাকে আমার খুব চেনা মনে হচ্ছে,তোমার পরিচয়টা বল"।
মেয়েটি হাজং,বাড়ি বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার চিনাকান্দি।সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে বাংলায় অনার্স পড়ছে,৪র্থ বর্ষে।
--" তুমি চমৎকার বাংলা বল,কী করে শিখলে?"
মেয়েটি হাসে- সে ট উচ্চারণ করতে পারে না কেবল,এ ছাড়া খুব চমৎকার তার উচ্চারণ,কণ্ঠের উঠানামা।
আমার মনে হল সে পর্যাপ্ত অনুশীলন করেছে যথাযথ উচ্চারণ আয়ত্ত করার জন্য।
আমার চোখের সামনে এবার ভাসছে পাহাড়ি সবুজ অরণ্যের একপাশে একটি সবুজ গ্রাম,যেখানে হাজং মেয়েরা মাথায় চেলি কাঠের বোঝা নিয়ে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বাজারের দিকে,খাসিয়া পান বিক্রি করছে নয়তো  বাড়ির দাওয়ায় বসে কাপড় বুনছে।
আমি কাছ থেকে কাপড় বুনতে দেখেছি,চাকমাদের কাপড় বোনা।আমার মা শিখেছিলেন চাদর বানানো,আমিও শিখেছিলাম- উপকরণ ছিল বিয়ং,ছিয়ং,তাগলুক সবই কাঠের তৈরি,সাথে সুতো।
আমার মায়ের বোনা চাদরগুলোর একটি আমার কাছে সযত্নে রক্ষিত- আমি জানি না আর কোনও পিস আছে কি না কোথাও।
ঋতুদের গ্রামে ত্রিশঘর হাজং পরিবার আছে, পাশে আরও দুটো গ্রাম আছে যেখানে হাজং সম্প্রদায় বাস করে।
ঋতু বলেছে তার পূর্বপুরুষগণ এখানেই যুগ যুগ ধরে বাস করে আসছে,এখানেই তাদের নাড়ি পোতা। জীবন নয় সহজ সরল গদ্যের মত,বড় কঠিন জীবনের সংগ্রাম তাদের।ভাষার প্রতিবন্ধকতা,সামাজিক প্রতিবন্ধকতা,দারিদ্র্য -সবকিছুকে তুচ্ছ করে মেয়েটি এগিয়ে চলেছে।
মেয়েটিকে চেয়ারে বসতে দিয়ে কাগজ বাড়িয়ে দিলাম,"তুমি কিছু বাক্য লিখে দাও তোমার ভাষায়,আর একটি গানের ধরা"।
ঋতু লিখে দিল-
* আপনি কেমন আছেন?
-- তয় কিংকে আসে?
* ভাল আছি
-- ভালা আসে।
* ভাত খেয়েছেন?
-- ভাত খাসে?
* কোথায় যাচ্ছেন?
--কুমায় যাই?
* কি তরকারি দিয়ে ভাত খেয়েছেন?
-- কি হাক দে ভাত খাসে?
* আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসবেন।
--আমলা ঘরবাই বিড়াবো আই।
গানঃ
" আমলা হাজং গাঁও
আমলা হাজং গাঁও
দিফুর নাই মাদাক নাই
হুনি পুখিলা রাও"
বাংলাঃ
" আমাদের হাজং গ্রাম,আমাদের হাজং গ্রাম
দুপুর নাই,বিকাল নাই
শুনি পাখির গুঞ্জন "।
সাদা কাগজটি ভরে দিল সে অক্ষর দিয়ে,ভালবাসা ভরা চোখে আমাকে বলল
" ম্যাডাম,আপনি আমাদের গ্রামে বেড়াতে যাবেন কিন্তু।"
-- " অবশ্যই যাব,আমার যেতে ভাল লাগবে তাই যাব।"
ঋতুরা তিনবোন এক ভাই,দারিদ্র্য হার মানাতে পারে নি তাকে,সে পড়ছে,নিজেকে গড়ে তুলছে।
আর এ সমাজ! একজন পিছিয়ে পড়া মানুষ বিশেষ করে মেয়েদের এতটুকু সহযোগিতা করবে না,বরং ভুল ধরবে,জীবন বিষিয়ে দেবার জন্য যাবতীয় সব কাজ সম্পন্ন করবে।
আর কোনও এক মেয়ে যদি নিজেকে গড়ে তুলে ঠিকমত,সে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে যায়,কাজে-কর্মে পুরুষকে ফেলে এগিয়ে যায় তবে প্রচণ্ড হীনমন্যতায় ভোগে অনেক পুরুষ।
নারী কেন মাথা তোলে দাড়াবে?
নারী হয়ে কেন সে পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে চলবে?
চলে তো চলে আবার সে পুরুষের চেয়ে এগিয়েও যেতে চায়? কেন?
সে পুরুষের মতই কথা বলতে চায়! কেন?
একজন নারী সবসময় পিছিয়ে থাকবে,একজন নারী পুরুষের চেয়ে কম জ্ঞান রাখবে,কম কথা বলবে,কম হবে তার চাওয়া,পুরুষ যতটুকু চাইবে সে ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ রাখবে নিজেকে- এটাই হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রকৃত চাওয়া একজন নারীর কাছে।
এখানে আর কোনও বিষয় নেই,একটাই বিষয় যে তুমি একজন নারী-তুমি পূর্ণমানব নও,ভাবা হয় না।
মেয়ে তুমি এই যে তোমার পারিপার্শ্বিক প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে এগিয়ে চলেছ,মনোবল হারাবে না,মনে রাখবে যারা তোমার সামনে দাড়াবার এতটুকু যোগ্যতা রাখে না-তারাই তোমার ত্রুটি খুঁজবে,সমালোচনা করবে।
প্রকৃত সাহায্যকারী,পরামর্শদাতা,এগিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা তুমি কমই পাবে।
এটুকু জেনে এবং মেনেই নামতে হবে জীবন জয়ের যুদ্ধে।
আমি সে প্রত্যয় দেখেছি তোমার মাঝে- এগিয়ে যাও দৃপ্ত পদক্ষেপে, অনেক শুভকামনা তোমার জন্য।
--০১/১২/২০১৯
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৪৬৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০১/১২/২০১৯

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast