www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আমার বাংলা ভাষা ও অমর একুশে

আমার বাংলা ভাষা ও অমর একুশেঃ
----- নাসরীন আক্তার খানম।

বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ইতিহাসঃ-
বাংলা ভাষা একটি প্রাচীন ভাষা।কালের বিবর্তনে এর প্রাচীন রূপটি পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে।প্রাচীন রূপের সাথে বিভিন্ন ভাষা থেকে আগত শব্দাবলী যুক্ত হয়ে এ ভাষাটিকে করেছে সমৃদ্ধ।
বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ইতিহাস সম্পর্কে বিজ্ঞজনদের মধ্যে রয়েছে নানা রকম অভিমত।বাংলা ভাষার উদ্ভব সম্পর্কে একদল মনে করেন যেহেতু সংস্কৃত ভাষার অনেক শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়,কাজেই ওই সংস্কৃত ভাষাই হচ্ছে বাংলা ভাষার সূতিকাগার।আবার আরেকদল মনে করেন বাংলার সাথে সংস্কৃত ভাষার যোগসূত্র অতীব ক্ষীণ।কারণ সংস্কৃত ভাষাটি হচ্ছে উচ্চবর্গীয়।তাই তাঁদের অভিমত সংস্কৃত নয় অন্য কোন ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব।প্রাচীন কাল হতে এ অঞ্চলের মানুষ কথা বলত নানা রকম প্রাকৃত ভাষায়।প্রাকৃত ভাষা হচ্ছে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত কথ্য ভাষা।
নানারকম প্রাকৃত ভাষা প্রচলিত ছিল ভারত বর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে।এবং এ ভাষাগুলো থেকেই বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়।এ সম্পর্কে প্রথম স্পষ্ট অভিমত প্রকাশ করেন জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন।তাঁর মতে, মাগধী প্রাকৃতের কোন পূর্বাঞ্চলীয় রূপ থেকে জন্ম নেয় বাংলা ভাষা।
পরবর্তীতে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্র্রোপাধ্যায় বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস রচনা করেন।যে ইতিহাস আমাদের নিয়ে যায় অন্তত কয়েক হাজার বছর আগে।
প্রাচীন ভাষাগুলোকে বলা হয় প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা।প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার প্রাচীন রূপ পাওয়া যায় ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলোতে।এগুলো সম্ভবত যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও এক হাজার বছর আগে লিখিত হয়েছিল
যিশুর জন্মের আগেই পাওয়া যায় ভারতীয় আর্যভাষার তিনটি স্তর।স্তর তিনটি হল বৈদিক সংস্কৃত,সংস্কৃত এবং অপভ্রংশ।মূলতঃ বিভিন্ন অপভ্রংশ থেকেই উৎপন্ন হয়েছে বাংলা ভাষাসহ নানা আধুনিক আর্য ভাষাসমূহ।
ডক্টর সুনীতি কুমার চট্রোপাধ্যায় মনে করেন,পূর্ব মাগধী অপভ্রংশ থেকে উদ্ভূত হয়েছে বাংলা, আসামী ও ওড়িয়া ভাষা।তাই এই ভাষাগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রচুর মিল।এছাড়া মৈথিলি মগহি ভোজপুরিয়া ভাষার সাথেও রয়েছে বাংলা ভাষায় মিল।কারণ সেগুলোও জন্মেছিল মাগধী অপভ্রংশের অন্য দুটি শাখা থেকে।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে অবশ্য একটু ভিন্ন মত পোষণ করতেন।তাঁর মতে গৌড়ী প্রাকৃতের পরিণত অবস্থা গৌড় অপভ্রংশ থেকে উৎপত্তি ঘটে বাংলা ভাষার।
(তথ্যসূত্রঃ বাংলা ভাষার জন্ম কথা- ডক্টর হুমায়ুন আজাদ)

ভাষা হিসাবে অবস্থানঃ-
দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ২২কোটি মানুষের স্থানীয় ভাষা বাংলা ও পৃথিবীর মোট ৩০ কোটি মানুষের ভাষা বাংলা হওয়ায় বাংলা ভাষার অবস্থান পৃথিবীতে সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা হিসাবে চতুর্থ।

একুশ ফেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপট ও ফলাফলঃ-
১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্র হিসাবে স্বাধীন হয়।পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ এবং পশ্চিম পাকিস্তান মিলে যে রাষ্ট্রটি ইংরেজগণ এদেশের মানুষের উপর চাপিয়ে দেয় তা ছিল এদেশের মানুষের চেতনার মূলে চরম আঘাত স্বরূপ।কারণ পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ছিল ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত ঐতিহ্যের চরম পার্থক্য।এই পার্থক্যের কারণে একই দেশের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য ও অসাম্যের ভাগ্য বরণ করে নিতে হয়েছিল।
ভাষার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠি রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে উর্দুকে চাপিয়ে দেবার ঘৃণ্য অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়।১৯৪৮সালে পাকিস্তান সরকার উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে ঘোষণা দেয়।এ ঘটনা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাঝে
তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয় এবং যার ফল ছিল সুদূরপ্রসারী।এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে এবং আন্দোলন দমনে ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
১৯৫২ সালের ২১ফেব্রুয়ারি(৮ফাল্গুন ১৩৫৮ বঃ) ১৪৪ধারা অমান্য করে ছাত্রজনতা ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী ও সংগঠন রাস্তায় নেমে আসেন এবং মিছিল শুরু করেন।১৪৪ ধারা ভঙ্গের অজুহাতে পুলিশ আন্দোলনকারীদের মিছিলে গুলি বর্ষণ করে।গুলিতে ঢাকার রাজপথ তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়।পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠায় শহীদ হন রফিক, সালাম বরকত সহ আরও অনেকে।
বরকত, সালাম রফিকের শোণিত ধারায় শাণিত হয়ে বাংলার মানুষের মনে স্বাধিকার আন্দোলন তথা একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশএর মানচিত্র পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠার দৃপ্ত স্বপ্ন লালিত হতে শুরু করে বাংলার জনগণের মাঝে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধারাবাহিক বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা পাই লাল সবুজ পতাকা খচিত এক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ এবং স্বাধীন ভাবে নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার।মূলত:ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের বীজ রোপিত হয়েছিল বাঙালীদের হৃদয়ে এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভঃ-
পৃথিবীতে একমাত্র ভাষা বাংলা।যে ভাষায় কথা বলার জন্য,রক্ত ঝরাতে হয়েছে রাজপথে।এই রক্ত ঝরানোর দিনটিকে অর্থাৎ ২১ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কানাডা প্রবাসী একদল বাংলাদেশি নাগরিক"মাদার ল্যাংগুয়েজ মুভমেন্ট"নামক সংগঠনের ব্যানারে কাজ শুরু করেন।সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন জনাব রফিকুল ইসলাম।তাঁদের এ কর্মে সক্রিয় ভাবে জড়িত ছিলেন জ্যাসন মেরিন,সুসান হভগিল,ড.কেলভিন চাও,বিনতে মারটিনস,করুণা জোসি, নাজনিন ইসলাম আবদুস সালাম প্রমুখ।
তাঁদের ক্রমাগত কর্মসূচী ও গৃহীত কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতে ১৯৯৯ সালের১৭ নভেম্বর, জাতিসংঘে ইউনিসেফের এক বৈঠক বসে।সভার ১৮৮ জন সদস্যের সমর্থন নিয়ে বাংলাভাষা সেদিন আন্তর্জাতিক ভাষার স্বীকৃতি লাভ করে এবং ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে।
বাংলা ভাষার এই অনন্য প্রাপ্তিতে বাংলা ভাষাভাষি মাত্রই গর্বিত।বাংলা ভাষা কে বিশ্বের দরবারে উজ্জ্বল গৌরবে প্রতিষ্ঠা ও এর মর্যাদা ধরে রাখার জন্য আমাদের কাজ করে যেতে হবে।যেহেতু আমাদের ভাষাই একটি সমৃদ্ধ ভাষা কাজেই আমাদের বাংলিশ চর্চা করা ও বাংলিশ হওয়ার কোন প্রয়োজনই নেই।
--১৭/০২/২০১৮
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৫২৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৩/০২/২০১৯

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast