www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

বিজয়ের মাসে স্মৃতিসৌধের পাশে

গতকাল স্মৃতিসৌধের প্রবেশদ্বার গলে যেই না লাল ইটে পা রেখেছি অমনি হাতের উপর কোমল হাতের পরশ! অনাহুত এই কোমল পরশে হৃদয়সিক্ত হলো। গোধূলীর যে হলুদাভ লাল আভা ছড়িয়ে আছে সাভারের আকাশে সেই আভার প্রতিফলন বুঝি পড়েছে তার শ্বেত শুভ্র কপোলে! আমি তন্দ্রাহারা নয় বরং দিশেহারা।

চকিতেই চোখ রাখলাম হাতের পিঠে। আহা, কী কচি লাউ ডগার বাহু, শিল্পিত আঙুল, সযত্নে ঘুরিয়ে যাচ্ছে তুলি! মুহুর্তেই স্মৃতিসৌধের ডামি হয়ে গেল আমার হাতের পৃষ্ঠদেশে। অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞাস করলাম, কী করছেন? কী করছেন? রাজকন্যার রূপ বয়ে চলা শিল্পিত তন্বী জবাব দিল, ঘাবড়াবেন না, যা করছি ভালোবেসেই করছি।

আহা! এ যে মেঘ না চাইতেই শ্রাবণ ঢল। এ ঢলে ভিজতে আমি রাজি, যতই থাকুক তীব্র শীতের ধকল। প্রবেশ পথে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যুগলের দিকে তাকিয়ে শুন্যতার যে ছায়া পড়েছিল বুকে, নিমিষেই তা উবে গেল। বরং হৃদয় জমিন পূর্ণ হল প্রেমের বর্ষাস্নাতে।

মিনিট একের মধ্যেই আমার হাতের পশ্চাৎ দেশে ফুটে ওঠলো বাংলাদেশ ও বাংলাদেশীর গর্ব জাতীয় স্মৃতিসৌধের মিনিয়েচার। তাও ভালোবেসে পাওয়া! ভাবছি, ভালোবেসে যে মানুষটা অনিন্দ্য সুন্দর এক সীলমোহর এঁকে দিয়েছে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করার মানে হয় না। তাই বলতে ইচ্ছে করছিল, চলুন একসাথে হাঁটি। মানিব্যাগের পুরুত্বজনিত জটিলতায় সাহসে আর কুলালো না। মুচকি হাসি দিয়ে যেই সামনের দিকে পা বাড়াবো অমনি ডেকে বলল, ভাইয়া আমার পেমেন্ট...

বিনা মেঘে বাজ নয়, আবীর মেঘে বাজ পড়লো। ভালোবাসাতেও পেমেন্ট! হ্যাঁ ভাইয়া, গরীব মানুষ পেমেন্টটা করে যান। আমার মুখের এবং ভেতরের অবস্থা কেমন হয়েছে তা আশা করি কিঞ্চিত হলেও বুঝতে পেরেছেন। অবশেষে দশ টাকায় কিনে নিলাম, সদ্য দেখা অর্বাচীন এক সুন্দরী তরুণীর ভালোবাসার কারুকাজ! এই ভাগ্যই বা কজনের হয়! 

যাক, এখানে সব বেচা যায়। এমনকি ভালোবাসাও। ভাবতে ভাবতে হেঁটে যাচ্ছি লাল ইটের প্যাসেজ ধরে। আসলে আমরা স্বদেশকে নয় এখনও বিদেশকেই ভালোবাসি। দুশো বছরের গোলামী এবং মোসাহেবী স্বভাবতো রক্তজাত। তা শহীদ মিনারেই হোক আর স্মৃতিস্তম্ভেই হোক। ভিড়ের মধ্যে মাথা গলিয়ে বুঝতে পারলাম শ্বেতাঙ্গ ও শর্টস পরনে কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীদ্বয়ই এই মনোযোগের আকর্ষণ। "এসব আমার নয় ভিন্ন ঠিকানা..." তাই ছুটছি স্মৃতিসৌধের পেছন দিকে। কেমন করে সাতটি স্তম্ভের সিম্ফোনি তৈরি হয়েছে, তা দেখার জন্য।

এক বন্ধু বলে, আমি নাকি ঘোরগ্রস্থ! আমারও তাই মনে হয়। এই শীতের সূর্য ডোবা সন্ধ্যায় একজন আরেকজনের উষ্ণতা নিয়ে যদি আরামবোধ করে তাহলে দোষ কোথায়! ঘোরলাগা সময়, একাকী পথিক আমি ছুটছি দিগ্বিদিক। দিগ্বিদিক হরিণ শাবকের ছুটোছুটিতে অজগরের ঘুম ভাঙলে, আমার পদচারণায় কপোত কপোতির মোহালিঙ্গন ছুটে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। তাদেরকে বেকায়দায় দেখে ফেলায় আমি বেকায়দায় পড়েছি এই প্রশ্নে যে, আমি তাদের সরি বলব কি বলব না। যদি খেঁকিয়ে ওঠে বলে, যা ভাগ ব্যাটা। ভদ্রতা খলানোর আর সময় পাইলি নাহ্।

যাক পালিয়ে বাঁচি। কিছুদূর এগুতেই স্কুল পড়ুয়া কিছু হলুদ ও লাল প্রজাপতি মার্কা কিশোরীর দেখা। চোখ টেপাটেপি দেখে নিজের দিকে তাকালাম, গেঁয়ো বা ক্ষেত ক্ষেত লাগছে নাতো! নাকি উল্টো করে টি শার্ট পরেছি! নাহ্, ভুল ভাঙল প্রজাপতি ত্রয়ের একজনের ডাকে। অ্যাই যে ভাইয়া, কয়েকটা ছবি তুলে দেবেন? "কোমল স্বরে সাধা, রা নাহি করে রাধা" কাঁপা হাতে কয়েকটা স্ন্যাপ তুলে দিয়েই হাঁটা ধরলাম। পেছন থেকে "থ্যাংকস ভাইয়া" শব্দ দুটি আমাকে ধাওয়া করছিল বলে কিনা জানি না, দ্রুতই চলে এলাম...

বুকের ভেতর এক ধরনের কম্পন। বিজয়ের মাসে স্মৃতিসৌধের পাশে দাঁড়িয়ে যদি লাজহীন প্রেমিকযুগলের লীলা দেখি আর হা হুতাশে লালা ঝরাই, তাহলে দেশের সূর্য সন্তানদের সমাধি দলে যাওয়ার মতই অবিবেচনাপূর্ণ এবং পঙ্কিল কাজ হবে। মুহুর্তেই ভেতরে এক ঘন্টা ধ্বনির আওয়াজ বাজল, যেমনটা বেজে ওঠে ঈশ্বর জাগানিয়া মন্দিরের ঘন্টা ধ্বনিতে। মনের অজান্তেই শেষবারের মতো স্মৃতিসৌধের পানে মুখ করে দাঁড়িয়ে প্রার্থনায় নিমজ্জিত হলাম। "হে প্রভু, দেশের তরে অকাতরে যারা দিয়েছে প্রাণ, তাদের তুমি দাও সম্মান। তাদের আত্মার প্রশান্তি দাও...

জানি না এখানে আসা দর্শনার্থীরা শুধুই বিকেলের অবসর যাপনের জন্যেই আসে কিনা। স্রেফ সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে এসেও এই স্মৃতির মিনারে দাঁড়িয়ে কেউ কি মনের ভুলে নিহত বীর সৈনিক ও দেশমাতৃকার প্রতি আবেগাপ্লুত  হয় কিনা সে প্রশ্নের উত্তরও আমার অজানাই। তবুও  আমার বেলায় এমনটি ঘটে, মুহুর্তেই তন্ময় হয়ে যাই ক্ষোভ ও অভিমানাঘাতে জর্জরিত দেশটার প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধায় ও আবেগময় ভালোবাসায়। আর স্বগতোক্তির মতো বলে ফেলি, হে বঙ্গমাতা ও তোমার গর্বিত সন্তান, তোমাদের তরেই আমার এই লাল সেলাম।

জিরানি, সাভার
০৮ডিসেম্বর২০১৪।
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ১৪৬৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৮/১২/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • সায়েম খান ২৬/১২/২০১৪
    সত্যিই বলেছেন, আজকাল আমরা বড় বেশী স্বার্থপর হয়ে গেছি। দেশপ্রেম বলতে আর কিছুই আমাদের মধ্যে অবশিষ্ট থাকছেনা।
  • আগে বলবেন না আমি আসতাম। সেখানে গেলে অন্য রকম একটা অনুভুতি পাই।
  • অনিরুদ্ধ বুলবুল ০৮/১২/২০১৪
    খুব সুন্দর কাব্যিকতায় মোড়ানো দেশপ্রেম ও দেহজাত প্রেমের কথা বলে গেলেন - কেবল তন্ময় হয়ে পড়ে গেলাম.....

    ধন্যবাদ। কবিকে সান্ধ্য শুভেচ্ছা -
    • সান্ধ্য শুভেচ্ছা কবি আপনাকেও।

      আক্ষেপের বিষয় হলো যে, দেশের জাতীয় কিন্তু দেশপ্রেমের দিক দিয়ে স্পর্শকাতর স্থাপনা, ভাস্কর্যও যে পাবলিক পার্ক হয়ে গেছে। তাই আলোকপাত করার একটা চেষ্টামাত্র।
      • অনিরুদ্ধ বুলবুল ০৮/১২/২০১৪
        সে চেষ্টায় আপনি সফল। ভাব শব্দ ও বাক্য বিন্যাসে লেখাটি সত্যিই অপূর্ব, আমাতে ঈর্ষা জাগায়। আপনার গল্প লেখার হাত ভাল, আমি ঐখানে একেবারেই গবেট... :)
 
Quantcast