www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ছাপা গল্পঃ ইনভাইটেশান কার্ড

(ইনভাইটেশন কার্ড
================
টেবিলের উপর একটা ইনভাইটেশন কার্ড রাখা আছে। ঘুম থেকে ওঠেই যে খবরটা পেয়েছি তা বহু প্রত্যাশিত অপ্রত্যাশিত খবর। ফ্রেশরুম থেকে বের হয়ে টেবিলে আর গেলাম না। এক ফালি ব্রেড হাতে নিয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। সূর্যের তেজটা যে কীরূপ হবে তা এই সকালবেলায় জানান দিচ্ছে। দুটো শালিক এসে জানলার সামনের জায়গাটাতে হাঁটছে। বাড়ির দেয়ালটা একটু দূরে। দেয়াল এবং বিল্ডিংয়ের মাঝখানের জায়গাটায় আরেকটা বিল্ডিং উঠবে সে সুযোগ নেই। সে কারণে হয়ত মালিক ফেলে রেখেছে। সদ্য নির্মাণ কাজ শেষ হওয়া দালানের ইট সুরকি, সিমেন্ট-বালির শক্ত কাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গর্তে বৃষ্টির পানি জমে রয়েছে। একটা বড় ব্যাঙ তার ধোড় ফুলিয়ে অনবরত ডাকছে। আমার চোখ শালিক জোড়ার দিকে। আচ্ছা শালিক কি জোড়া বেঁধে চলে সব সময়? আমি যতবার যতখানে শালিক দেখেছি বেজোড় সংখ্যায় দেখিনি কখনো!

রীতিমতো একেবারে শেষ সময়ে এসে টিচার্স রুমে ঢুকেছি। রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখি পপিকে দেখলাম চক ডাস্টার হাতে ক্লাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে আমাকে জিজ্ঞেস করল, "দেরী কেন?" এক গ্লাস পানি খেয়ে আমার চেয়ারটায় বসলাম। দেয়াল ঘড়িতে তখন নয়টা বেজে পাঁচ। আজ আমার প্রথম ক্লাস দ্বিতীয় পিরিয়ডে, সে কথা মনেই ছিল না। যাক, চেয়ারে হেলান দিয়ে পত্রিকা খুললাম। সকালের ঘটনাটা আমাকে যে অস্থির করে রাখছে, সে অস্থিরতা কাটানোর চেষ্টা করছি। প্রতিদিনের খুন, রাহাজানি, ছিনতাই, গুম -অপহরণ ছাড়া আর বিশেষ কীই বা আছে খবরের কাগজে? পত্রিকা ভাঁজ করে টেবিলের উপর রেখে উদাসভাবে তাকিয়ে আছি টিচার্স রুমের সাদা দেয়ালে টানানো বঙ্গবন্ধুর ছবির দিকে। মঈন সাহেব আর রোজী ম্যাম কী কথাবার্তা বলছে তা বুঝা যাচ্ছে না। তবে মঈন সাহেবের থেকে থেকে হাসির শব্দ আমাকে ঘাড় ফেরাতে বাধ্য করছে।

দ্বিতীয় পিরিয়ডে ক্লাস টেনের ইংরেজি প্রথম পত্র ক্লাস। আনসীন কমপ্রিহেনশান- তাজমহল; সম্রাট শাহজাহান এবং মমতাজের প্রেমের সাক্ষী! ইদানীং কালের ছেলেমেয়েরা বেশ বেয়াড়া। স্যারদেরকে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করতে সিদ্ধহস্ত। তৃতীয় সাড়ির কোণার বেঞ্চে বসা একছেলে প্রশ্ন করল, "স্যার, মমতাজ বেগম সম্রাট শাহজানের কয় নম্বর স্ত্রী আছিল?" ধমকের সুরে ছাত্রটাকে থামিয়ে দিলাম, "পড়াচ্ছি তাজমহল, তুমি মমতাজ শাহজাহানের কয় নম্বর স্ত্রী ছিল তা জিজ্ঞেস করছো কেন?" আসলে ইংরেজি আমার অনার্সের বিষয় হলেও ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত সায়েন্স ছিলাম। সুতরাং ইতিহাস সম্বন্ধে আমার খুব বেশী ধারণা নেই। তাই ব্যর্থতা ঢাকার কৌশল হিসেবে ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিলাম। আমার ধারণা সকল শিক্ষকই তাদের ব্যর্থতা ঢাকতে এ ধরণের কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে। পয়তাল্লিশ মিনিট সময়টা আমার কাছে অনেক দীর্ঘ মনে হচ্ছে। ক্লাস শেষ হল।

বেশ আয়েসি ভঙ্গিতেই মোবাইল টিপছে পপি। ও আমার সহপাঠী ছিল এখন "পাঠী" বাদ দিয়ে "কর্মী" হয়েছে। সে সূত্রে বন্ধুত্বটা আরো গভীর হয়েছে। কিছুটা হালকা হতেই তার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসলাম। মোবাইলের পর্দা থেকে মুখ উঠিয়ে জিজ্ঞেস করল, "কি? এমন দেখাচ্ছে কেন তোমায়?" আমি হাতটা এমনিতেই মুটিবদ্ধ করে তার দিকে তাকালাম। ও জিজ্ঞেস করল, "কিছু বলতে চাও?" আমি শুধু জিজ্ঞেস করলাম, "ইনভাইটেশন কার্ডটা কি পেয়েছো?" প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার "হুম" শব্দটা বসে শোনার মত সময় হল না। ঘন্টা পড়ে গেছে। পরের ক্লাসে ছুটতে হবে।

২,
বিকেল বেলার সময়টা আমাদের মাঠে বসে, স্মৃতিস্তম্ভে আড্ডা মেরে কেটে যেত। অপূর্ব, কনক, রবিন, বিধান সবাই মিলে আড্ডা মারতাম। মাঝে মধ্যে পপি কিংবা তানিয়া এসে জুটতো। এর মধ্যে ছায়াসঙ্গীর মতো যে ছিল সে মৃন্ময়ী। আসলে মৃন্ময়ীর সাথে বন্ধুত্বটা কিন্তু অনার্স বা ইন্টারমিডিয়েট লাইফের নয়। একেবারে ক্লাস সিক্স থেকে আমাদের একসাথে পড়াশুনা।
যত বড় হতে থাকলাম ততই বন্ধুত্বটা গাঢ় হলো। তারপর বন্ধুত্বটাও শেষ হলো। শুরু হলো নতুন সম্পর্কের। প্রতিজ্ঞা, দায়বদ্ধতা। নতুন নতুন শব্দে সম্পর্কটা বেশ ভারী করে তোলল। ও খালেদা জিয়া মহিলা হোস্টেলে থাকতো। আমি ওসমান গণিতে। ক্লাসের অবসরেই আড্ডা, বাদাম ভাঙা। ওর ডিপার্টমেন্ট যেমন আমাকে চিনত আমার ডিপার্টমেন্টেও ওর সম্বন্ধে ভালই জানতো। যেহেতু রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইংরেজি বিভাগ খুব দূরে নয়।

আমি দেখেছি, অনেকদিন পর যদি কোন বাড়ি কিংবা ওঠান ঝেড়ে মোছে সাফ করা হয় তখন তা নতুনের মত লাগে। সে অনুভূতিটাই অন্য রকম। কথায় কথায় মৃন্ময়ী একদিন বলল, "আচ্ছা আমাদের বন্ধুত্বটাকে কি আরেকটু স্থায়ী ও মজবুত করা যায় না?" আমি বললাম, "করা যায়। সিমেন্ট বালির মিশ্রণটা ঠিক হলেই হয় আর কি!" "ঠাট্টা করবি না, উত্তর দে "

সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় না। চোখের চাহনি, হৃদয়ের অনুভব- এগুলোই ভালবাসা প্রকাশে যথেষ্ট। তো এভাবেই শুরু…

সারাদিন চ্যাট হতো, কথা হতো, ইষ্টিকুটুম, গাঙচিল, ফুড ক্যাসেল, কাঁঠাল চত্বর সব কিছুকেই নতুনভাবে, নতুন রূপে চিনতে শুরু করলাম। বন্ধুরাও বিষয়টা জানল। তারপর ওর বড় ভাই, ভাবী জানল। আমার আপুরা জানল। তারপর "জানাজানি" হল। আসলে সুখের দিনগুলো ক্ষণস্থায়ী হয় নাকি সুখময় সময়ে ঘড়ির কাঁটা দ্রুত চলে সে বিষয়ে আমার ব্যাপক কৌতুহল।

হঠাৎ করেই মৃন্ময়ীর মোবাইল ফোন জব্দ করা হল। অনেক চাপ সহ্য করতে হল। বড় ভাই, বড় আপুরা শাসাতে শুরু করল। আমার জন্য মৃন্ময়ীকে নজরবন্দি থাকতে হচ্ছে ভাবতেই নিজেকে ঘৃণীত মনে হল। এক সময় আমিই নিজে থেকে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম।

হঠাৎ একদিন আমার হোস্টেলে এসে মৃন্ময়ী আমার হাত চেপে ধরে বলল, "আমার একটা কথা রাখবি?" "কী কথা?" আমি ভীত সন্ত্রস্ত ভাবে তার চোখের দিকে তাকালাম। দেখলাম, অল্প কয়েকদিনে তার চোখ কোঠরাগত হয়ে গেছে, চোখের নিচে কালি পড়েছে। স্বাস্থ্যের এমন বেহাল অবস্থা হয়েছে যে দেখে মনে হল, যেন সদ্য টাইফয়েড জ্বর থেকে সেরে ওঠেছে। একবার ওর ভীষন টাইফয়েড জ্বর হয়েছিল। জ্বরে তার এরকম অবস্থা হয়েছিল যে, তাকে মুরগি বলে ক্ষেপাতাম। তার কী রাগ! সেদিন আর ওর জ্বলজ্বল করা কোঠরাগত চোখের দিকে তাকিয়ে নির্মম কৌতুক করতে পারিনি বরং চোখ ফেটে জল এসেছিল। আমার দুহাত তার মুঠোবন্ধি করে বাজ পড়ার মত শব্দ করে বলল, "চল, পালিয়ে যাই।" আমার শরীরে একটা তীব্র শীতের স্রোত বইয়ে গল। নির্বাক কিছু মুহুর্ত পেরুবার পরে আর্তনাদের সুরে বলেছিলাম, "নাহ, সে হবার নয়"। আমি বুঝতে পারলাম আমার হাত ধরা তার মুঠোবন্ধি হাত নিমিষেই নিস্তেজ কিন্তু এক ঝটিকায় সরে গেল।

তারপর ওকে আটকানোর জন্য আর কোন শিকল পরাতে হয় নি। হোস্টেল থেকে কখন বের হয় কখন ফিরে সে হিসেব করার জন্য তক্কে তক্কে থাকতে হয় নি। আমিও মধ্যবিত্ত জীবন বাস্তবতার যাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকলাম; আব্বা প্যারালাইসড, আম্মার হাঁপানি। সংসারের হাল ধরা এবং নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম করেই ক্লান্ত। অনেক কষ্টে ফাইনাল ইয়ারে একটা চাকরী জুটিয়ে নিয়েছি।

বেশ কয়েকদিন আগে শুনেছি, সে শহর ছেড়ে ঢাকায় চলে গেছে। কোন একটা ফার্মে চাকুরী জুটিয়ে নিয়েছে। রেজাল্ট হয়ে গেছে; আর সুযোগ নাই। এবার আর পরিবারের জোর খাটাতে হল না। আমিও কোন একটা স্থায়ী চাকরী বন্দোবস্তের ধান্দায় আছি।

৩,
অনেক চেষ্টা করেও খুলতে পারি নি সেই ইনভাইটেশন কার্ড। তবে জানি আজ মৃন্ময়ীর বিয়ে। কিছুক্ষণ আগেই পপি ফোন করেছে, "রেডি থেকো, আমি আসছি।" উদাস ভাবে জানালার দিকে তাকিয়ে আছি। আজ সকালে বৃষ্টি হয়েছে। আকাশের মেঘ এখনও সরে নি। মেঘলা আকাশ। আজ রোজকার মত শালিকজোড়া ওঠানে আসে নি।

দরজায় কড়া নাড়ছে। এই সময়ে আর কেউ আসার কথা না। পপিই তাহলে
এসেছে। মৃন্ময়ী আমাকে কিছু বলে নি। কাজের বুয়ার কাছে ইনভাইটেশন কার্ডটা দিয়ে গিয়েছিল। আমার সামনা সামনি হতে তার ভাল লাগে না। তাই কলেজে, ক্যাম্পাসে কেউ কারও ছায়া মাড়াই নি। মৃন্ময়ী পপিকে রিকুয়েস্ট করে গেছে, "তোর বন্ধুকে আমার বিয়েতে দেখতে পেলে খুব খুশি হব।"

অতি কষ্টে টেবিল থেকে ইনভাইটেশন কার্ডটা হাতে নিলাম যেমনিভাবে একটা মেয়ে ব্যাথা পাবে জেনেও নাক- কান ফুটো করে। ওদিকে ডোরবেলে শব্দ হচ্ছে তো হচ্ছেই।

ভাবছি, মৃন্ময়ীর বিয়েতে যাবো কি যাবো না।)
*******

প্রকাশঃ সৃষ্টি বর্ষা সংখ্যা, নন্দিতা প্রকাশ
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৪৫১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৭/১১/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • রেনেসাঁ সাহা ০৬/১২/২০১৪
    খুব সুন্দর। তবে আপনার এর থেকে ভাল গল্প আছে অনেক। আপনার কাছ থেকে তাই আশাটা বেশী। অনেকেঈ হয়ত আপনাকে বলে, আপনি অনেক বড় গল্পকার হবেন, আমি মনে করি, আপনার এতদিনে অনেক বড় গল্পকার হওয়া উচিত ছিল। অনেক সাফল্য আপনার প্রাপ্য। ওয়েবসাইটের পাতায় আটকে থাকবেন না,
  • অনিরুদ্ধ বুলবুল ৩০/১১/২০১৪
    পাঠককে মুগ্ধ করার মত - ভাব ভাষা বর্ণনা আবহ সর্বোপরি রচনাশৈলী অসাধারণ....

    শুভেচ্ছা কবি
  • আমিন চৌধুরী ২৭/১১/২০১৪
    আবহটা অসাধারণ...
  • ২৭/১১/২০১৪
    বেশ ভালো প্রেমের গল্প ।
 
Quantcast