www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সমাধি আখ্যান

না, আমি সাম্প্রদায়িক মানসিকতার লোক নই, না আমার সম্প্রদায়ের বিষয়ে কোন চুলকাণি আছে ; এমনকি হিন্দু চতুর্বণ নিয়েও তেমন কোন আগ্রহ জন্মেনি কোনদিন আমার । তবে হ্যাঁ, পরম্পরাগত ঐতিহ্য বা পারিপার্শ্বিক আচরনগত বিভেদ দেখে বা সংস্কার -কুসংস্কার ইত্যাদি নিয়ে একটা আলাদা ভাবাবেগ থাকে এবং আমারও আছে । আমার আজকের লেখাটি এ সংক্রান্ত একটা বিষয় বলে শুরুতেই কিছুটা ভূমিকা দিলাম কেননা আমাদের আজকালকার সমাজের জাতিভেদ প্রথা যতটা প্রখর ঠিক ততটাই আমাদের হিন্দুদের মধ্যে সম্প্রদায়গত বিভেদ কাজ করে । আমরা মুখে মুখে যতোই সাম্যের কথা বলি নিজের বেলায় পরোক্ষ ভাবে হলেও এই পার্থক্যটা মেনে চলার চেষ্টা করি , তর্কের খাতিরে অস্বীকার করলেও প্রত্যেকে নিজের মনকে একবার প্রশ্ন করে দেখতে পারেন, শতভাগ সত্যি হবে । যদিও কিছু ব্যতিক্রম আছে এবং কিছু কিছু অযাচিত ভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে আমরা মেনে নিতে বাধ্য হই বা কিছু কিছু আবেগের কাছে আমরা পদানত হই তবুও এটাই আমাদের সমাজ, এটাই আমাদের প্রকৃতি । যাই হোক, গল্প হলেও সত্যি সিরিজে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা লিখতে শুরু করেছি অনেক পরে, আজকের বিষয়টি অনেক আগের , আজ থেকে প্রায় কুড়ি বাইশ বছর আগে একদিন এক বাড়িতে একটা বন্ধুর মাসী’মার সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল, মাসী’মা বলছিল,
”বাবু, তোমার বোনটা তো দেখতে দেখতে বিয়ের উপযুক্ত হয়ে গেল, একটা পাত্র দেখে দাও, এবার বিয়েটা দিয়ে দিই ।“
আমি বললাম, “ঠিক আছে মাসী’মা চলার পথে অনেকেই বলে থাকেন, তা কেমন পাত্র চাই বলুন ।“
মাসী’মা অনেক কথা বলছিল, তবে যে কথাটা অন্তরে কাঁটার মতো বিঁধেছিল সেই কথাটাই এখানে বলছি,”বাবু, পাত্র যেমনই হোক তুমি ভালো ছেলেই দেখবে এ বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই, জাতেরও বালাই নেই, শুধু দেখবে দেবনাথ যেন না হয় ।“
আমি বললাম, “ মাসী’মা দেবনাথ ছাড়া কেন ?”
মাসীমা,”না , দেবনাথ ভালো না, তারা নাকি অর্দ্ধেক মুসলমান, তাই তুমি দেবনাথ ছাড়া দেখো ;”
আমি কথাটা শুনে আকাশ থেকে পরেছিলাম, এ যুগেও মানুষের ধ্যান ধারনার মধ্যে কতটা তফাৎ হতে পারে তাই ভেবে আমি অবাক হয়েছিলাম , আরোও কিছু জানার আগ্রহ থেকেই মুখ হাসি হাসি রেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কেন কেন ? দেবনাথদের অর্দ্ধেক মুসলমান বলে কেন ?”
“অত বুজি না বাপু, মুসলমানে কবর দেয় আর হিন্দুরা সমাধি করে, এর লাইগ্যাই বোধহয়”-বলেই মাসীমা একটা চওড়া হাসি দিলেন ।
প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি, আমি কিন্তু দেবনাথ সম্প্রদায়ের, যদিও আমার পদবি বা উপাধিআর অন্য সব সম্প্রদায়েও থাকতে পারে বলে অনেকেই বুজতে পারে না, আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই হয়েছে । আসীমা বুজতে পারেনি আমি যে দেবনাথ সম্প্রদায়ের, তাই এতগুলো কথা মনে খুলে বলে ফেলল, এটা বিজতে আমার বাকী ছিল না । আমার স্বল্প জ্ঞান, পড়াশোনা আর অভিজ্ঞতা দিয়ে অনেক কিছুই জানতাম, দেবনাথ সম্প্রাদায়ের উৎপত্তি, পতন, ইতিহাস, পেশা, বল্লাল সেন এর সময়ের ইতিবৃত্তান্ত একপ্রস্থ শুনিয়ে দিতে পারতাম কিন্তু কিছুই বললাম না ; কেননা প্রথমেই যে ভাবনাটা এলো সেটা হলো, অপাত্রে দান করে লাভ নেই, মাসীমাকে এসব বিষয়ে বলা ‘উলু বনে মুক্তা ছড়ানো’র মতোই হবে তদুপরি উনি যেহেতু জানেন না যে আমিও উনার শত্রু পক্ষের তাই ভুলটা ভাঙ্গাতে গেলাম না কিন্তু এটাও সত্য সেদিনের এই কথাগুলো শোনার পরে আমার মনের মধ্যে গোপনে একটা বিদ্বেষের বীজ বপন করা হয়েছিল । যাই হোক, এই অভিজ্ঞতাটুকুও আমার আজকের লেখার মুখ্য বিষয় নয় ।
বলছিলাম নিখিল’দার কথা, নাহ, আমার সেই অর্থে কোন আত্মীয় নয় তবে পরিচিত হবার পর দেবনাথের পরম্পরাগত ভাবে কোন না কোন সম্পর্ক বেড়িয়েই যায়, তেমনি নিখিল’দাও আমার একটু দুরের মেসতুতো ভাই হয়ে গেল এবং আরেক সম্পর্কে আমার পিসতুতো বোনের ননদের স্বামী । সে যাই হোক, পেশাগত কাজে প্রথম পরিচিতির পর থেকে এই লোকটার মন মানসিকতায় আমি এতটাই মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম যে, আমি নিজে থেকে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে আগ্রহী হয়েছিলাম এবং হয়েছিলাম । উনারও নিশ্চয়ই সেরকম মনোভাবে হয়ে থাকবে । নিখিল’দা একটা সরকারী অফিসের পদস্থ অফিসার সেই সঙ্গে গান-বাজনায় সমান পারদর্শী উপরন্তু উনার দয়াবান হৃদয় ও সুন্দর আচার ব্যবহারে ক্ষুদ্র পরসরে হলেও বেশ পরিচিতি ও অনেক গুণমুগ্ধ মানুষ ছিল । সেই থেকে প্রতি রবিবার বিকেল চারটা থেকে মোটামুটি রাত আটটা পর্যন্ত আমাদের নিয়মিত ভাবে এক সঙ্গে সময় কাটতোম সেটা কখনো, গল্প-আড্ডা, কখনো গানবাজনা , কখনো তাস খেলা আবার কখনো ঘুরাঘুরি করে সময় কাটতো । কিন্তু আজকে যখন এই লেখাটা লিখছি, তিনি নেই । নেই মানে বছর তিনেক আগে হঠাৎ করে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন । এই রোগে আক্রান্ত এবং উনার জীবন বৃত্তান্ত সে আরেক বিষয়, এটা নিয়ে অনেক কিছু লেখা যায় বা লেখার মতো উপকরণ আছে, অন্য কোথাও হয়তো হবে নয়তো নয় তবে আজকে সম্প্রদায়গত বিষয় নিয়ে যে অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে বসেছি সেটাই হোক এখন । কোন এক শীতের সন্ধ্যায় আমরা হরিশনগর বাজারের উপর দিয়ে নিখিল দা’র পুরোনো ঠিকানা আদর্শ কলোনীর দিকে যাচ্ছিলাম, এমন সময় একজন আটকালেন, চা না খেয়ে যাওয়া যাবে না । অগত্যা আমরা দুজনেই মোটর সাইকেল রেখে চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম । এমন সময়ে অন্য একজন নিখিল দা’কে দেখে কুশল মঙ্গল জিজ্ঞাসা করলেন এবং কথা বলতে বলতে এক সময়ে মেয়ে বিয়ের প্রসঙ্গ আসলো এবং ওই ভদ্রলোক বলে ফেললেন, “দ্যাখেন, আমি নাথ/যোগী ইতা পছন্দ করিনা, মরলে পুড়ে না তারা আবার বড় কতা কয় !” আমি নিখিল দা’র চেহারা দেখে ষ্পষ্ট বুজতে পারছিলাম, খুব রেগে গেছে । তবুও কিছু বলছেন না বা হয়তো বলার সময় আসে নি বলেই কিছু না বলে চুপচাপ চায়ে চুমুক দিলেন । আগে থেকে একটা কথা বলে রাখলে ভালো হবে, আমাদের এলাকায় মিশ্র বসতি , এখানে হিন্দু জনগোষ্ঠী ব্যপক হলেও একটা ভালো অংশ মুসলমান রয়েছে , এমনকি কিছু কিছু খ্রীষ্টান ধর্মের জনগনও এই এলাকায় বসবাস করেন বটে । আর হিন্দুদের মধ্যে মুচি-মেথর-চন্ডাল-ব্রাহ্মন-নাথ-লস্কর-শীল ইত্যাদি সহ ক্ষত্রিয়-বৈশ্য সব সম্প্রদায়ের মানুষই যুগ যুগ ধরে পাশাপাশি সুন্দর ভাবে বসবাস করে তবে ঐ যে বললাম, সম্প্রদায়গত একটা গোপন বিদ্বেষ কিন্তু থেকেই যায়, এখানেও আছে আর ইদানিং সেটা একটু বেশী মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ; বিশেষ করে নাথেদের সঙ্গে অন্য সম্প্রদায়ের কেননা সামাজিক সব লোকাচার প্রায় কাছাকাছি থাকলেও পূজার্চ্চনায় নাথেদের একটা পৃথক অস্ত্বিত্ত যেমন লক্ষ্য করা যায় তেমনি শেষকৃত্যের ক্ষেত্রেও এমনকি কিছু কিছু সংস্কারের ক্ষেত্রে হিংসা পরবশ হয়ে অন্যরা নাথেদের সঙ্গে একটা দুরত্ব তৈরী করে রাখে বটে । আমি এখানে খুব বেশী তথ্য টথ্য দিয়ে নাথ সম্প্রদায়ের সপক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলতে বসিনি তাই এই বিষয়ে আর অতিরিক্ত কিছু বলার অবকাশ নেই ।
ওই ভদ্রলোক (আমি তর্ক এড়ানোর স্বার্থে ওই ভদ্রলোকের নাম বা সম্প্রদায় এড়িয়ে গেলাম) আবার বললেন, জ্ঞ্যাতি গোষ্ঠীর কেউ মরলে আমরা এক মাস নিরামিষ খেয়ে শেষ করতে পারিনা , তারা এগারো দিনেই মা-বাপের শ্রাদ্ধ পর্যন্ত শেষ করে, তাদের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তা হয় কি করে !” – বলে একটু থামলেন, আমি একটু দূরে থাকলেও বিষয়টা আস্তে আস্তে অনুমান করলাম, সম্ভবতঃ উনার মেয়ে কোন নাথ সম্প্রদায়ের ছেলের সঙ্গে প্রনয় সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছেন, এই কারণেই এত ক্ষোভ । নিখিল দা সাধু মানুষ, এছাড়া আরোও অনেক যে সমস্ত কারনে উনি সকলের প্রিয় সেগুলো সব মিলিয়ে আমি অবাক হয়ে দেখলাম খুব শান্ত গলায় ওই ভদ্রলোককে নিখিল দা বলছেন,”অমুক দা, আমি আপনার সাথে আরোও বেশ কিছুকখন কথা বলার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আপনি যদি আপনার প্রথম কথাটির ভুল স্বীকার না করেন তবে যে আমি আর কিছু বলতে পারছি না”।
ভদ্রলোক বললেন, “কোন কথা, কোন কথা ! আমি তো কিছু ভুল বলিনি !“
নিখিল দা আবার শান্ত স্বরে বললেন “ঐ যে আপনি বললেন নাথেরা অর্দ্ধেক মুসলমান ।“
ভদ্রলোক ,”অ’ বুজছি, আপনেত যুগী, এর লাইগ্যাই গায়ে লাগছে কিন্তু আমি ত হ্যাছা কথাই কইছি, যুগীরা মানে আপনেরা ত মুসলমানের মতোই মানুষ মরলে খাদাইয়ালান, ঠিক না !”
নিখিল দা ঠান্ডা মাথায় বললেন, “ প্রথমে আপনি ভাষাটা সুন্দর করে বলতে পারেন, আমরা সমাধি করে, তারপর আপনি যদি ভুল স্বীকার না করেন তবে কিন্তু আমার কথাগুলো শোনে আপনাকে যুক্তি সম্মত উত্তর দিয়ে যেতে হবে ।“
“বলেন , বলেন দেহি আপনের কি যুক্তি, যত কথাই কন আমি কিন্তু আমার মাইয়ারে হেই ঘরে পাডাইতাম না “- ভদ্রলোক এবারে অনেকটাই উত্তেজিত, কন্ঠেও সেটা বুজা যাচ্ছিল ।
নিখিল দা তখনও শান্ত স্বরেই খুব সুন্দর ভাবে কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছেন, বললেন,
“আইচ্ছা অমুক দা, আপনের মা’তো বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহন করছে, তাইলে আপনের মা মারা গেলে কি করবেন ?”
“সমাধি করুম, তারা তো সাধু মানুষ তাদের সঙ্গে অন্যরার তুলনা করলে অইব ক্যারে “-ভদ্রলোক উত্তেজিত কন্ঠেই উত্তরটা দিল ।
নিখিল দা আবারো বললেন, “আপনাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ছোট্টা শিশু মারা গেলে কি করেনে, পুইড়ালান ?”
ভদ্রলোক বললেন, “না মোটেই না, ছোট্ট শিশু মারা গেলে পুড়নের নিয়ম নাই, এঁরা অইল নিষ্পাপ, আর নিষ্পাপ দেহ পোড়ে না ।“
এই কথাগুলো বলে ভদ্রলোকের উত্তেজনায় যে কিছুটা ভাটা পরেছে সেটা বুজা যাচ্ছিল । সেই সময়ে আমি খুব সিগারেট খেতাম, তাই ততক্ষণে আমি দুজনের আলাপ আলোচনা উপভোগ করতে করতে চা শেষ করে আমিও সিগারেট ধরালাম , তাদেরকেও দিলাম । সিগারেটে একটা জম্পেশ টান দিয়ে নিখিল দা যেন বেশ মজা পাচ্ছিল এমন ভাবেই জিজ্ঞেস আবার কথার রেশ ধরে বললো, “অমুক দা, সাধু নিষ্পাপ ওসব কিছু নয়, আমার মনে হয় আপনাদের সপ্রদায়ের ছোট্ট ছোট্ট প্রত্যেকটা শিশু নিষ্পাপ টিষ্পাপ কিছু নয়, ওরা দেবনাথের ঘরের বাচ্চা থাকে, পরে আপনাদের হয়ে যায়” বলেই একটা মুচকি হাসি দিয়ে আবার সিগারেটে টান দিলেন, ধোয়াটা মুখে রেখেই একটা বিশেষ ভঙ্গিতে আবার বললেন, “ আমার মনে হয় আপনাদের সম্প্রদায় থেকে কেউ সাধু হলেও তারা তখন দেবনাথ সম্প্রদায়ে চলে যায় ।“
ভদ্রলোকের উত্তেজনা যতটা না কমেছিল, এবারে তার থেকে কয়েকগুন বেড়ে গেছে রাগ, রাগে গজগজ করতে করতে বললেন, “এ সবের মানে কি নিখিল দা ! আপনে কি বলতে চান ?”
নিখিল দা সেই শান্ত স্বরেই বললেন, “ না, মানে আমি বলছিলাম, ছোট্ট শিশুকে যেহেতু পুড়ানোর নিয়ম নেই আবার সাধুদের ক্ষেত্রেও নাথেদের মতো সমাধি করে থাকেন, তাই বললাম , তাঁরা কি তবে তখন নাথ হয়ে যায় না !”
ভদ্রলোক অনেকটা স্তিমিত স্বরেই এবারে বললো, “আমি তো বললাম নিষ্পাপ দেহ পুড়ায় না, সাধুদের পুড়ায় না ।“
“ঠিক তাই, আমি তাই বলছিলাম, তাহলে আপনিতো এটা মানছেন যে, সমাধি করাটাও হিন্দুদের একটা রেওয়াজ তবে বিটর্ক কেন ভাই ।“ – নিখিল দা বলে শেষ করতে না করতেই সে ভদ্রলোক যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো, “তাই বলে আপনি এরকম বলবেন ?”
নিখিল দা ,”কেন নয়, আপনি মুসলমান বলতে তো একবারও দ্বিধা করেন নি ! বরঞ্চ আমি বলি কি শোনেনে, মন দিয়ে শোনেন , হিন্দুদের মধ্যে নাথ সম্প্রদায় একেবারে শুরু থেকেই অনেক উচ্চ মার্গের, এমনিতেও টাইটেলের অর্থটাতেও পেয়ে যাবেন, দেবনাথ । দেবনাথ’ মানে কি ! দেব মানে যে দেব দেবতা বা দেবাদিদেব মহাদেব, সেটাতো আর বলে বুজাতে হবে না ! আর নাথ’ মানেও যে স্বামী বা প্রভু সেটাও আপনাকে ডিকশনারি দেখিয়ে বলতে হবে না নিশ্চই , তাই দেবনাথ সম্পর্কে আপনার মনের মধ্যে যে ভুল ধারনাটা পোষে রেখেছেন, সেটাকে দুর করার জন্যই আপনাকে এই কথাগুলো বললাম ।“
“কিন্তু লোকে যে বলে আপনারা নিচু জাত !” – ভদ্রলোকের ক্ষুব্ধ অথচ নরম সুর ।
“হিন্দু সমাজের ইতিহাস ঘাটলে দেখবেন এই দেবনাথেরাই এক স্ময়ে ব্রাহ্মন ছিল, পুজা অর্চ্চনা করাতো, রাজা বল্লাল সেনের আমলের একটা দুরভিসন্ধিমূলক ঘটনার কারনে নাথেরা কালক্রমে এসব ছেড়ে দিয়ে অন্যান্য পেশায় যুক্ত হয়েছে এবং সেই পরম্পরায় আজকেও অনেকেই যেমন পৈতা ধারন করে আবার অনেকেই তেমন দৈন্য দশায় অবনত হয়েছেন, তবে রীতি-রেওয়াজ-সংস্কার এগুলোতো পাল্টায় না, তাই পাল্টায় নি ।”- নিখিল দা অনেক ক্ষণ পরে আমার দিকে তাকালেন, এই চাহনিতে তৃপ্তি আছে । উনি যে কথাগুলো বলতে পেরে মানসিক ভাবে শান্তি বা তৃপ্তি পেয়েছেন তা কিন্তু আমি বুজতে পেরেছি ।
ভদ্রলোক এবারে মাথা নাড়লেন, “হুম, বুজলাম, ইতিহাস কারোর থাইক্যা কারোর কম না, যাই হোক আমি কিন্তু আমার মাইয়াডারে তার কাছে বিয়া দিতাম না, আপনে কইয়্যা দিয়েন, আপনের জানি কিতা অয় ?”
তাহারা কে কতটা বুজল ! কি বুজল ! আমি জানিনা, তবে আমি এটা বুজতে পেরেছি, সমাজে একটা শ্রেনীর লোক আছে যারা সব বুজেও না বুজার ভান করে, আবার আরেকটা শ্রেনী আছে, তারা বুজার চেষ্টা করে না বা বুজার মত ধৈর্য্য তাদের নেই, আবেগের মাথায় যে যা বলে সেটাকেই চিরসত্য ধরে নিয়ে চলতে ভালোবাসে ।
এভাবেই বিতর্ক চলতে থাকে , চলবেও হয়ত, কিন্তু কিছু কিছু কথা আমাদের ভাবায়, ভাবতে বাধ্য করে, আর কিছু বদ্ধমূল ধারনা আমাদের অনেক সময় হিংসা বিদ্বেষের পথে ধাবিত করে । তবে আমার কিন্তু একটাই মত, আমরা সবাই মানুষ, মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যা যা করে তাই ধর্ম, সম্প্রদায়, জাতি ইত্যাদি সব কিছু মানুষের তৈরী, বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠী তাদের সুবিদার্থে ও স্বার্থে রীতি-রেওয়াজ-জাত-সম্প্রদায় তৈরী করে । আমরা যারা এযুগের সচেতন মানুষ, আমাদেরকে ভেবেচিন্তে ঠিক করতে হবে কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক এবং যুগের সাথে ও প্রয়োজনে যেমন সবকিছু পাল্টায় তেমনি কিছু কিছু সংস্কার পরম্পরাগত ভাবে ধরে রাখার যে ঐতিহ্য সেটাকেও অস্বীকার করা যায় না ।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৫৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০২/১১/২০২৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast