www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

একজন ডাক্তার প্রহরাজ ও বি এম বিড়লা হাসপাতাল

খুব ভোরে ধর্মতলায় নামলাম। আজকের ধর্মতলার মতো উপর-নীচ না। সেই সাদা-সিধে, ঔপনিবেশিক চেহারার পুরনো পুরনো ভাবমূর্তির মূর্তিমান ধর্মতলা।

টানা কি জানি না। তবে জেনে গেলাম কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই। মানুষ টানা রিক্সা। টানায় চেপেই গেলাম তালতলা। উঠেছি একটি আবাসিক হোটেলে।

লাগেজ রেখে খানিক রেস্ট। একটা ট্যাক্সি নিয়ে এরপর বিড়লা হাসপাতাল। রেজিষ্ট্রেশন, এন্ট্রি এবং হাসপাতাল কতৃৃপক্ষ ঠিক করে দিলেন কোন ডাক্তার দেখানো হবে। ওয়েটিং লাউঞ্জে অপেক্ষ করছি। এক লোক এলেন পুরোহিতের মতো। মন্ত্র পড়ছেন বিড়লা সাহেবের প্রতিকৃতির সামনে, তারপর ধূপ-ধুনো।

জটিল রোগীদের জন্য বিশেষ চিকিৎসার হাসপাতাল। মন সবারই নরম। আমারও। অাব্বাকে নিয়ে গেছি। প্রায় দুই বছর তিনি অসুস্থ। কিছু খেতে পারেন না। যা খান বমি হয়ে যায়। খাদ্যেও অরুচি। ফলে ক্রমশঃ স্বাস্থ্যহানি, অপুষ্টি আক্রান্ত, দুর্বল ও প্রায় কঙ্কালসার হয়ে গেছেন।

দীর্ঘ পথ ক্লান্তি হোক বা অসুস্থতার কারণেই হোক, তিনি মাঝে মাঝেই বমি করতে যাচ্ছেন বাথরূমে। আমি ছায়াসঙ্গী। বমিতে পানি ভিন্ন কিছুই নেই। তবু ভিতর থেকে বিবমিষা উঠছে। সময় যেন কাটে না।

প্রতীক্ষার পালা শেষ। আমাদের ডাক পড়ল। আমাদের ডাক্তারের নাম ড. তরুণ কে প্রহরাজ। বনেদী গোছের ডাক্তার। সোনার চেইন ও ব্রেসলেট পরে আছেন। তিনি রোগের সবিস্তার জিজ্ঞাসা করলেন। আব্বা বলছেন। কথার মাঝেই তার বমি বমি ভাব হচ্ছে। ডাক্তার একটু বিব্রত বোধ করে দেখিয়ে দিলেন বেসিন। তার চেম্বারের একপাশে দেয়ালে বেসিন স্থাপিত। সাথে হ্যান্ড ওয়াশ, টাওয়েল্, টিস্যু। আব্বা বমি করতে গেলেন, বমি বমি ভাব হচ্ছে, কিন্তু বমি হচ্ছে না। একটু পরে ফিরে এসে ডাক্তারের কাছে বসলেন। ডাক্তার বললেন, আপনার তো বমি হচ্ছে না। আব্বার তখন কথা বলার মত অবস্থা নেই। হাঁপাচ্ছেন। তিনি কিছু টেস্ট করতে দিলেন। আমরা বেরিয়ে এলাম।

টেস্ট হলো। আরো কয়েকদিন হাসপাতালে নিয়মিত যাতায়াত করলাম। থাকি হোটেলে, হাসপাতালের সময়ানুযায়ী যাই আর আসি, চলছে টেষ্ট। তালতলার হোটেলে থাকি। আব্বা যতটা খাওয়া দাওয়া করেন তার চেয়ে বেশি বমি করেন। বালতি ভরতি বমি ফেলছি প্রতিদিন। শরীর ক্রমশঃ আরো অধোগতির দিকে যাচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ হয় না। চিকিৎসাও শুরু হয় না। ঔষধও প্রায় বন্ধ। দুই একটা চলছে।

শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম ডাক্তারের সঙ্গে আবার কথা বলি, অন্ততঃ কিছু ঔষধ যেন দেন। হাসপাতালে যোগাযোগ করে এ্যপয়েন্টমেন্ট করলাম। ডাক্তারের সময় নেই। যা হোক, তিনি শেষতক সময় দিলেন বিকেল তিন কি চারটার দিকে। সময় গুলিয়ে গেছে। আমরা আবার ডাক্তারের চেম্বারে। আব্বা কন্টিনিউয়াস বমি করছেন। বমির মধ্যে পানি ও পিত্তরস ভিন্ন আর কিছু নেই। ডাক্তার এই দৃশ্য তীর্যক চোখে দেখে শেষতক বলে ফেললেন, ‘‘এটা আপনার সাইকোলোজিক্যাল প্রব্লেম। কই বমিতে তো কিছু আসছে না। আপনি মনে করছেন বমি হবে, তাই হচ্ছে।’’ আমি অবাক! আব্বা তার চেয়ে বেশি অবাক। তাঁকে বলা হলো, টেম্পোরারিলি কিছু ঔষধ লিখে দিন, রোগীর অবস্থা তো ডেটোরিয়েট করেছে। তিনি কিছু ঔষধ লিখে দিলেন। যা দিলেন তা এ জীবনে অনেক খেয়েছেন এ রোগী। তিনি দু’দিন পর আবারো দেখা করতে বললেন। আমরা বেরিয়ে এলাম। কিন্তু ততক্ষণে আব্বা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। সেদিন বিকেলেই আবার ধর্মতলা। রাতে বাসে রওনা হলাম বাড়ীর উদ্দেশ্যে।

আব্বাকে আমি আটকাতে পারিনি। বলেছিলাম, আর দুটা দিন কষ্ট করে হলেও থাকো। কিন্তু ডাক্তারের কথায় আব্বার আস্থা নষ্ট হয়েছে। আব্বার ক্রনিক সমস্যাটি যে ডাক্তার সাইকোলোজিক্যাল সমস্যা বলে খাটো করে দেখতে পারেন বা উড়িয়ে দিতে পারেন বা বাস্তবে রোগই অাইডেনটিফাই করতে পারেন না, তার উপর আব্বার আস্থা নষ্ট হবে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। আব্বার কথা, মারা গেলে নিজের বাসায় গিয়ে মারা যাবো। আমরা সে রাতেই ফিরে এসেছিলাম। সালটা ছিল ১৯৯৭।

আমার আব্বা আমাদের ছেড়ে গেছেন ২০০৫ সালে। তাঁর ছিল সিএলডিই বা ক্রনিক লিভার ডিজিজ। যেটা আরো অনেক পরে ২০০৩ সাল নাগাদ উদঘাটিত হয়। আমি কোনদিন বি এম বিড়লা হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট/সেন্টার এবং ডাক্তার তরুণ কে প্রহরাজের চিকিৎসা বা চিকিৎসা বিদ্যার কথা ভুলব না।

আরশাদ:alien:আপনালয়:বিনোদ কক্ষ
০৯ নভেম্বর ২০১৫, সোমবার;ঢাকা।
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ৮০৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৯/১১/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

 
Quantcast