www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আড্ডা

আড্ডা কথাটা শুনতে কানে কেমন যেন লাগে। যেমন শয়তানের আড্ডা, বদমায়েশের আড্ডাখানা। কিন্তু শুধু আড্ডাকে কেউ খারাপ বলতে পারবেনা। ভাল মানুষের কর্মের অবসরে একত্রে মিলিত হয় কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে সময় কাটানোকালীন সাহিত্য-সংস্কৃতি রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দিক ধর্মীয় বিষয়ে সহজ সরল ভাবে তাত্বিক আলোচনা চলে তাকে সাহিত্যের ভাষায় আড্ডা বলে।
এই লেখার প্রারম্ভেয় বলতে হয় আড্ডা হল ব্লেডের মত। তাই বলছিলাম ব্লেড শুধু সৌন্দর্য বিধানে দাড়ি কাটার কাজে ব্যবহৃত হয় না, তা আবার জীবন ধ্বংসের নিমিত্তভাগী নাড়ী কাটার কাজে ব্যবহৃত হয়। আড্ডার তদ্রুপ ব্যবহার ভেদে আড্ডার রকম ফের হয়ে থাকে।
আড্ডা হল সেই একজন গুণী ব্যক্তিকে ঘিরে তার কিছু গুণমুগ্ধ ভক্ত-অনুরক্ত শিষ্য সাগরেদ পরিবেষ্টিত অবস্থায় নির্মল, বিমলানন্দ জ্ঞানসহ সকল বিষয়ে চটুল-চটজলদি উপস্থপনা, কিছু রসিকের রসত্বের তাত্বিক সমালোচনা যা শুনে উচ্ছল প্রানের উন্মাদনায় সকলে প্রাণভরে অম্লমধুর তিতোতিক্ত, পাকা মরিচের শিশানো অনুভূতিতে ভরা মুহুর্তের অনুকরনে উপভোগ করে। আড্ডা কিন্তু কোন শিক্ষালয় কিংম্বা প্রাচীন কালের গৃহ গুহু নয়, নয় কোন মক্তব হুজুর খানা। নাগরিক জীবনে মানুষ যখন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে হাপিয়ে পড়ে তখনি মানষিক বিশ্রামের প্রয়োজনে মানুষ আড্ডায় যোগদান করে এবং সুন্দর সর্বাঙ্গীন স্বার্থকভাবে সময় কাটিয়ে পরিবর্তিতে কর্মের সমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়ার প্রেরণা ফিরে পান।
প্রায় সব জায়গায় আড্ডা স্থান নির্ধারন করা হয়। তবে বেশির ভাগ টি স্টল, কফি হাউজ কোন উদার মানুষের সহয়তায়, কখনো কখনো চায়ের দোকানে আবার হোমিও প্যাথিক ডাক্তারের চেম্বারেও হয়। কি নেই আড্ডায়? আছে রাজনীতির কচড়া, সাহিত্যের কচকচানি, ধর্মীয় বকবকানি, সংগীতের ছয়রাগ, ছত্রিশ রাগিনীর খবর। সিনেমার গরম খবরের ছিঃনেমা’র কাহিনী। আছে কৌতুকের ছিংটিং ছটের ভেল্কীর অশ্বের বল্গাহীন উদ্দমতা, আরো আছে ডিবেটিং এবং যদ্ধংদেহীর আবহ সৃষ্টির প্রয়াস।
আড্ডার সাথে আমার সৌর জগতের তুলনা করতে ইচ্ছা হয়। সূর্যকে ঘিরে যেমন গ্রহ, উপগ্রহ একত্রে নিজস্ব কক্ষপথে অবস্থান করে ঠিক যেন মেলা বসিয়ে দেয়। তেমনি একজন জ্ঞানবৃদ্ধ বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ সবজান্তা সর্বকর্মে পারদর্শী এক কথায় হরফুন মৌলাকে ঘিরে আড্ডার অনির্ধারিত সভাকে উজ্জল আভায় উদ্ভাসিত করে তোলে। এই হরফুন মৌলা হতে পারে রাজনীতিবিদ, হতে পারে তুখোড় সাহিত্যিক, হতে পারে আধ্যাতিক শক্তিতে শক্তিমান,ধার্মিক সৃজন মহাত্মা হতে পারে বৌদ্ধ ভিক্ষুক, হতে পারে সুফী দরবেশ মাওলানা মৌলবী। বাংলায় সেরা আড্ডাবাজ বিদ্রোহের অনল ঝরানোর অঙ্গীবীণার কবি বাঙ্গালা-বাঙ্গালীর নয়ন মণি সর্বজন প্রিয় দুখু মিয়া। তিনি বললেন মৌলবীদের মৌ-লোভী। মৌ মানে মধু আর লোভী মানে আসক্ত। যিনি খোদায়ী প্রেমের ফল্গুধারাকে নিজ অন্তরে জোয়ার রূপে প্রবাহমান করেন। এই মহব্বতের জোশকে বলা হয়েছে মধু। আর যিনি উক্ত মধুর লোভী তিনি একজন মহান জ্ঞানী ভক্ত। তিনি কিন্তু একাকি এই মধু উপভোগ করতে পারেনা। তিনি তার কিছু অনুরক্ত তার নিজস্ব অনুসারীকে বিতরন করেন আড্ডার মাধ্যমে সেই মধু। মিষ্টি তৈরী করতে যেমন লাগে ভিয়েন, লুচি পরাটো তৈরীতে লাগে ময়াম, চিনি রাখতে লাগে বয়াম, তেমনি সাহিত্যিকদের সাহিত্য পরিচর্যার জন্য রয়েছে আড্ডা। আড্ডার মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে বড় বড় সাহিত্যকর্ম। এই আড্ডার গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলা সাহিত্যের অপরাজেয় প্রায় সর্ব সাহিত্যিকদের সর্ব শ্রেষ্ঠ ভ্রমণ বিষয়ক জ্বীনী গ্রন্থ শ্রী কান্তের রচনায় উপকরন উপজীব্য যাকে মাল ম্যাটেরিয়াল বলে তা যোগাড় করেছিলেন আড্ডার ম্যাধমে। শ্রীকান্তের শ্রেষ্ঠতর চরিত্র “ইন্দ্রনাথ” আড্ডারই ফসল। শরৎচন্দ্র মহাশয় তিনি এক কাঠমিস্ত্রির দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতেন আর কাঠমিস্ত্রির জীবনের দুঃসাহসিক ঘটনাবলী শুনতেন আর তার রূপন্তরিত রূপই হল ইন্দ্রনাধ চরিত্র। তাহলে বুঝুন আড্ডা কাকে বলে। আড্ডা অনেক এ্যারিষ্টক্রাট বিজ্ঞ মানব নরপুঙ্গবেরা খুব ঘৃণার চোখে দেখছেন। বিশ্বকবি যাদের নবীন নামক কবিতায় যাদের বলেছেন-ঐ যে প্রবীন ঐ’যে পরম পাকা চক্ষুবর্ণ দু’টি ডানায় ঢাকা”এই পরম পাকা বিজ্ঞজনের আড্ডায় মোটেই পছন্দ করেন না। পরম পাকাদের রায়ে এবং অনুরোধে সক্রেটিস যিনি আড্ডার মাধ্যমে দার্শনিক তত্ব ছাড়াতেন। যুব সমাজকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছেন এই অযুহাতে দার্শনিক সক্রেটিসকে হেমালোক পানে হত্যা করলেন। অবশ্য প্রধান পাকাদের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়। এই লেখার প্রারম্ভে ব্লেডের ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। দাড়ি না কেটে নাড়ী কেটে ব্লেডের তদ্রুপ আড্ডায় কিছু কুফল রয়েছে। একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে। সেখানে কয়েকটি শব্দ অর্থাৎ গাড্ডা মানে চপটাঘাত, গাড্ডু মানে শূণ্য জিরো, লাড্ডু মানে পস্তানো খারাপ। খেলে পস্তাবে না খেলেও পস্তাবে। তাহলে লাড্ডু আর হেরি মানে হেরিকেন। তাতে বাঁশ হাতে হেরিকেন। তাই ছাত্ররা আড্ডা থেকে ৫’শ হাত দূরে যাবে দরকার হলে ঘোড়ার পিছে এবং পুলিশের সামনে যাবে কিন্তু আড্ডায় যাবেনা। তাদের আড্ডায় যাওয়ার অবকাশ কোথায়? তারা জীবন গঠনে বেশী, বেশী করে সময়ের এ টু জেড পড়বে। পড়বে, পড়বে এবং পড়বে। লেখার শেষ সিঁড়িতে দাড়িয়ে বলতে চাই প্রয়োজনবোধে আড্ডার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে যোদ্ধা-বোদ্ধাদের জীবনের জন্য জীবন ও জীবিকার নান্দনিক কারনে যারা রেকর্ড প্লেয়ার মান্না দে শোনেন তাদের নিশ্চয় কর্ণ গোচরীভূত হয়েছে। সেই বিখ্যাত গানটি- “কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেল গুলো সেই”। আড্ডাকে বাঁচাতে জীবনকে সাজাতে আসুন অবসর মুহুর্ত গুলো সোনালী মুহুর্তের মুর্ত প্রকাশ ঘটায়। আড্ডার মাধ্যমে অনিয়মিত- অনিবার্য, অলিখিত সিলেবাস, আনন্দিত, অবলীলায়- অমলিন, অসাধারন অঘটন- ঘটনায় কাঁচা সোনার উজ্জলতায় উচ্ছলতায় জ্ঞান বিদ্যাকে অন্তরের ভান্ডারে সঞ্চয় করতে নির্ভেজাল সর্বাঙ্গীন সুন্দর আড্ডাবাজ হয়ে উঠি।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ১৪৫৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৩/০৪/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast