www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ডায়েরির কথাগুলো

আমি জানি এই বাড়ির সামনে হয়তো একদিন আসতে হবে না,ওকে আর দেখতে পাবো না জানালার ধারে।কেউ আমার জন্য উঁকি দেবে না জানালা দিয়ে,বলবে না-একটু দাঁড়াও,আমি আসছি।তবু কি আমি আসা থামাতে পেরেছি,পারিনি তো।এখনো ওর গলির মুখে ঘোরাঘুরি করি,একলা বাদাম খাই,তারপর ওর কাছে যাই।ব্যাপারটার কারণ এটাই যে,ওর সামনে যাতে ভেঙ্গে না পড়ি,কান্নায় দুচোখ যাতে না ভিজে যায় তার পূর্বপ্রস্তুতি নিই এ সময়টাতে।আমার সাড়া পেয়ে ও বেরিয়ে আসে,আমার মুখ জুড়ে হাসি,হৃদয়জুড়ে আকাশসম আনন্দের জোয়ার বইতে থাকে,এটাইবা পায় কয় জনই।আমি আজ ওকে নিয়ে এমন একটা জায়গায় যাব যেখানে আমিই কোনোদিন যায়নি।আমি যখন ওর পাশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করি,আমার পিঠে ঝুলে থাকা ব্যাগটা ওজনহীন মনে হয়।ভালোবাসা অন্যসবকিছু ভুলিয়ে রাখে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।এ ভালোবাসা আমি কেমন করে ভুলব?


একটি ট্যাক্সি ভাড়া করলাম।ড্রাইভারকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।ড্রাইভার বেশ ভয় পেয়েছে আমাকে।প্রথমে যেতে চাচ্ছিল না,কড়া গলায় ধমক দিতেই ব্যাটা সমান্তরাল হলো,ভাবল-বড়টাইপের গুন্ডা আমি।এখন যা বলি তাই শোনে।বেশ মজা পাচ্ছি শাসন করে;দুর্বল মানুষেরা শাসক হলে যা হয় আর কী।রাস্তার পাশে শিরীষ গাছ,এখানেই থামতে বললাম ট্যাক্সিকে।ট্যাক্সি থেকে শোহিনীসহ নামলাম।ভাড়া মিটিয়ে শিরিষ গাছের পাশ দিয়ে জঙ্গলে ঢুকতে শুরু করেছি।শোহিনী আমার একটা হাত জাপটে ধরে আছে;এই হাত ভালোবাসা আর গভীর বিশ্বাস জানান দিচ্ছে।কিছুদূর ঢুকেই পেলাম পোড়োবাড়িটা।আশপাশের ডালপালা-লতাপাতা গজিয়ে উঠেছে বাড়িটিকে ঘিরে।কারও বসবাস নেই বোঝাই যাচ্ছে;কেমন একটা গা ছমছমে ভাব বাড়িটিকে ঘিরে।অনেকদিন আগে দেখেছি,কখনো ঢুকিনি।দেখেছিও এক আঞ্চলিক পত্রিকায়,কাটালাশ সহ।মাথার ওপর সূর্যটা গনগন করছে,বেশ আলো চারিদিক। শোহিনীকে নিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকতে চাইলাম,শোহিনী ভয় পাচ্ছে।একরকম জোর করেই ও সহ ঢুকলাম পুরোনো বাড়ির অন্দরে।সূর্যের আলো ছেড়ে আসতেই ঠাওর করতে পারছিলাম না কিছু।আবছা আলো দেখা দিল ঘরের ভিতর।শব্দহীন চারিদিক,এক অজানা ভয়ংকর বাড়ির ভিতর আমরা দুজন।ভাবছি-ও কোন সাহসে এখন আমার সাথে চলে?আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য?-এই প্রশ্নগুলো আমাকে বেশ পোড়ায়।মনের এই ভাবনাগুলো ভুতূড়ে চিন্তা আসতে দেয় না।
  

এতদিন যা হয়নি তা কি আজ হবে?তা সময়ই বলে দিবে।থমথমে পরিবেশ,গুমোট ভাব,অচেনা এক গন্ধ দুজনকে আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে।আমি তার দুহাত স্পর্শ করি,কাছে টেনে আনি,বলি,‘কী, ভয় লাগছে কেন?আমি আছি না।জানি,তোমার বিয়ে হয়ে যাবে,তারপরও এই কয়েকটা দিন তোমার সাথে থাকতে চাই,তোমাকে প্রাণভরে দেখতে চাই।কথা দিচ্ছি-বিয়ে হয়ে গেলে তোমাকে এভাবে আর দেখব না-আর দেখা করব না।অন্যের বউকে আমি দেখব কেন,তুমিই বলো।’শোহিনীকে ভুতূড়ে ঘরের একটা জায়গায় দাঁড় করাই।ভাঙ্গা জানালার আলোয় ওকে প্রতিমার মতো লাগছে।শাড়ি পড়লে হয়তো ভয় পেয়ে যেতাম দেবী মনে করে।একপলকে ওকে দেখছি,ওর কৃষ্ণকালো চুল,প্রশস্থ কপাল,মায়াবী চোখ,তুলতুলে গাল,মসৃণ নাক,লাল টুকটুকে ঠোঁট,গলা………..উঁচু বক্ষ যেন কামনা ডেকে আনছে মনে।আর দূরে থাকতে পারলাম না,কাছে গিয়ে ওড়নাটা তড়িৎ গতিতে সরিয়ে দিলাম।বক্ষ আরেকটু উন্মুক্ত হলো।ও মৃদু স্বরে বলল,কী করছ তুমি?শোহিনীর বিশ্বাস তবে ভাঙ্গতে শুরু করল।আমি ওড়নাটা ঝেঁড়ে দিলাম,মাকড়শাটা খসে পড়ল।বিষাক্ত ছিল কিনা জানি না তবে দেখে আর দূরে থাকতে পারলাম না।ওড়না ফিরিয়ে দিলাম,তবে ওর দিকে চাইলাম না,বক্ষ আবদ্ধ হলো ভয়মুক্ত ওড়না দিয়ে।ওর কৃতজ্ঞতা বাণী শুনতে ইচ্ছে করল না,তবু শুনতে হলো।ওকে বললাম‘আমার খুব ইচ্ছে ছিল তুমি এই নির্জন স্থানে আমার সামনে খাবে।আমি তোমার খাওয়ার দৃশ্য দেখব-তোমার খাওয়ার শব্দ শুনব।আমার সামনে খাও না প্লিজ।’বলে ব্যাগ থেকে খাবারের প্যাকেটটা বের করলাম।ও বলল,তুমি খাবে না? আমি বললাম তুমি খাইয়ে দিলে খাব।

 

আমাদের যখন খাওয়া চলছিল,পোড়োবাড়ির বাইরে তখন কারও পদশব্দ হচ্ছিল।আমরা লুকিয়ে রইলাম।দেখলাম ড্রাইভার বাবাজি ঘরের সামনে। কে-বলে চিৎকার দিতেই ব্যাটা কাঠ হয়ে গেল।আমরা কী করি-তা দেখার ঔৎসুক্য ব্যাটাকে পেয়েছিল,ভালোই হলো-শহরে ফিরতে আর সমস্যা হলো না। ঐ ট্যাক্সিতেই ফিরতি পথ।

 ও আমার হাত ধরে আছে।ভালোবাসা জানাচ্ছে নাকি ক্ষমা চাচ্ছে বুঝতে পারছি না।চারিদিকে সন্ধ্যের আঁধার নেমে এসেছে।ও দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আমার সর্বাঙ্গ,নিস্তব্ধ করে দেয় আমাকে,ওর চোখের জলের স্পর্শ পাই আমি।নিজেকে কোনোভাবেই ভেঙ্গে যেতে দিই না তখন।ও আমার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে,কখন যে চলে যায় বুঝতে পারি না।আমার হাঁটু কাঁপতে থাকে,দাঁড়াতে পারি না।মিনমিনিয়ে বলি,তোমাকে খুব ভালোবাসি।তুমি ছাড়া থাকব কী করে?আমার সর্বাঙ্গ ভেঙ্গে পড়ে।ভেঙ্গে পড়ি আমি।ভিজে যায় চোখ।আমি ওর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকি যতক্ষন ওর রুমে আলো দেখি।
(এতক্ষণ ধরে আমি সোহমের ডায়েরিটা পড়ছিলাম।শোহিনীকে খুব ভালোবাসত সে।আর আমি হচ্ছি সেই শোহিনীর হাজবেন্ড।শোহিনী এই ডায়েরিটা সংগ্রহ করেছিল সোহমের মেস থেকে।এরপরে আর কিছু লেখা নেই।শোহিনীকে বলতে বললে সে ঢুকড়ে কেঁদে ওঠে।আমি নিজেই সাজাতে থাকি অসমাপ্ত ডায়েরিটা।)

 সোহম মনে মনে কত কিছু ভাবে এখন।সে ভাবে-‘গরীব লোকের সেবা করাটা পুণ্যের কাজ।ডাক্তারি পাশ করে এই গরীব দেশে সেটা করার পূর্ণ সুযোগ আছে শোহিনীর।আমার উন্নত দেশে চলে যাওয়াটাই উত্তম।এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্টিস্ট হয়ে সেখানে নতুন নতুন প্রজেক্ট হাতে নিব-গ্রীনহাউস অ্যাফেক্ট দূরীকরণের।তাতে কার্বনযুক্ত ওসব দেশও উপকৃত হবে,নিজেও আয়েশ নিয়ে কাটাতে পারব।’সোহমের এসব চিন্তা শুধু শোহিনী থেকে দূরে থাকার জন্য।কিন্তু তার সব চিন্তার মাঝে শোহিনী।সোহম মেসে এসে বন্ধুদের সাথে খোশমেজাজে আলাপ করে।শোহিনীর কথা জিজ্ঞেস করলেই এটা-সেটা বুঝিয়ে দেয়। রাতে পাউরুটি খেয়ে পড়ার টেবিলে বসে।পড়া দরকার জেনেও সে শুধু বসে থাকে।বসে বসে রাত পার করে।
 পরেরদিন সকালে সে বাস স্টেশনে যাওয়ার জন্য রেডি হয়।সোহমের বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।দেখা দরকার,একটু সাথে থাকার দরকার-এতেই বাবা খুশি হবে,সোহম খুব দেরিতে বুঝতে থাকে এগুলো।পিতা-মাতা তো সন্তানের আনন্দটুকুই খোঁজে,নিজেদের জন্য কীই বা চায়।এসব ভেবে শোহিনীর কথা মনে পড়ে।সে এক ভালো লাগা অনুভব করে-শোহিনী তার মা-বাবার আনন্দ দেখছে,নিজের স্বার্থকে ভুলে।মোবাইলে রিং বাজে।সোহম রিসিভ করে।শোহিনী তড়িৎ গতিতে বলে,তুমি কোথায়?
-এইতো বাস স্টেশনে যাচ্ছি।
-আমি আসছি।ফোন কেটে যায়।কিছুক্ষণ পর আবার ফোন আসে।
-তুমি কোন বাস স্টেশনে যাচ্ছ?
-নতুন বাস স্টেশনে।
 বাস কাউন্টারে বসে আছে সোহম।অনেকে উঠে গেছে বাসে।শোহিনী আসবে,তার অপেক্ষা করছে সে।বাস ছাড়তে আর বেশি দেরি নেই।শোহিনীর মোবাইল বন্ধ।সোহম বুঝতে পারে না-সে কী করবে।সে চেয়ে আছে রাস্তার দিকে।একটি রিক্সা এসে থামে।তার থেকে নামে সোহমের এক বন্ধু।ওর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে অন্য বাস কাউন্টারে চলে যায় ঐ বন্ধুটি।শোহিনী তখনো আসছে না।সে আসে শেষ মুহূর্তে।দামি গাড়ি থেকে নেমে ছুটে আসে তার কাছে।
-তুমি কী চলে যাচ্ছ?এখুনি?
-হ্যাঁ।
-আমি একটা নতুন মোবাইল সিম নিয়েছি।আর এই খামটা ধরো।

কিছু কিছু খাম ধরলেই বোঝা যায় সেটা কিসের।সোহমও বুঝতে পারছে।দুজন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।বাস ছাড়ার হর্ণ দেয়।শোহিনীর চোখের দিকে তাকায় সে।খুব সুন্দর লাগছে তাকে।শাড়ি পরাতে আরও বেশি ভালো লাগছে।সূর্যটা খুব খারাপ,শোহিনীকে পুড়িয়ে দিচ্ছে।সোহম ব্যাগ থেকে ভাঙ্গা ছাতাটা বের করে শোহিনীর মাথার ওপর মেলে ধরে।শোহিনীর দেওয়া ছাতাটাকেও সে যত্ন করে রাখতে পারেনি।ঝড়ে ভেঙ্গে যাওয়া ছাতাটি শোহিনীকে হাতে দিয়ে সে উঠে পড়ে বাসে।বাস ছুটে যায় শোহিনী আর তার হবু দামি গাড়িকে পেছনে ফেলে।শোহিনী দাঁড়িয়ে থাকে,শুধুই শোহিনী দাঁড়িয়ে থাকে।দামি গাড়িটি এগিয়ে আসে শোহিনীর দিকে।শোহিনী তবুও দাঁড়িয়ে থাকে।সোহমের বাস অনেকদূর চলে যায়।সময় চলে যেতে থাকে-টিক টিক করে……………
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১০৩৬ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২২/০৫/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast