www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

জলকুমারী বনকুমারী


নদীর পাড়ে মকলুনের বাড়ি। বাপ দাদা যবে থেকে নদীকে জীবনের স্থায়ী সঙ্গী করে নিয়েছিল তবে থেকে। তখন নদীর মাঝে রাত কাটাতে হতো। জোয়ারের ভয়ে শরীর কাঁপত। ভাটা এলে নদীকে যেমন শান্ত তেমন গভীর আত্মীয় মনে হতো। নদীর জলে মাছেরা খেলা করত। কিছু কিছু মাছ খেলা ছেড়ে চলে আসত তাদের জালে। এখন ঠিক তেমনটা হয় না। নদীর ঘোলা জলে মাছ দেখা পাওয়া ভার। বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তরঙ্গিণীর বুক প্রশস্ত হয়েছে। বাড়ির উঠোনগুলো নদীর খুব কাছাকাছি এসে গেছে। বাড়ির ছোট বাচ্চাগুলো হামাগুড়ি দিলে মনে হবে এই বুঝি তারাও মাটির মতো স্রোতস্বিনীর ঢেউয়ে গা ভাসাবে। মা-বোনরা সারাক্ষণ তটস্থ থাকে তাদের ছেলে-পিলে নিয়ে। 


মকলুনের ঘরে এখনও বাচ্চা-গাচ্চা আসে নি। ঘরের বউ এখনও দিব্যি স্বাধীন। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে মকলুনকে ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে যায় সে। তবু মকলুনের নৌকার সমান্তরাল দৌঁড়ে দৌঁড়ে কখন যে ঘাস জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়ে তার ইয়ত্তা নেই। জঙ্গলের ভেতর না দেখতে পেয়ে মকলুন তেমন একটা পাত্তা দিতে চায় না। ভাবে, এ আমার বউয়ের ছল-চাতুরি। ছেলে-পিলে হলে ঠিক হয়ে যাবে। তখন তার এমন ছেলেমানুষি বন্ধ হবে। কিন্তু এমন একদিন এল, যখন মকলুন বুঝতে পারল না, এতক্ষন ধরে কেইবা লুকিয়ে থাকে? বউয়ের বুঝি আক্কেল জ্ঞান নেই। মকলুন জঙ্গলের ভেতর তাকিয়ে থাকে। মেয়েটির এলোকেশের ঘন দোলা যে আজ চোখে পড়ে না। কোথায় গেল মেয়েটি। হাক দিল বউয়ের নাম ধরে। না, কোনো সাড়া তো নেই। চিন্তারাশি বাতাসে ঢেউ জমাল। এ বড় গোমট হাওয়ার পূর্বধ্বনি। 


বাতাসে ফুলের গন্ধ নেই। নদীর জলে ভাটার নির্জনতা। আকাশ এখন জবাকুশুম লাল। আঁধার হতে তর সইছে না। দোলায় দোলায় জঙ্গলের পাতা ফিসফিস করছে, এই তো আর কিছুক্ষণ। তারপর সব শান্ত হতে আর বেশি সময় নেই। মকলুনের কপালে নদীর ঢেউ। চারপাশ দেখে জাল ফেলবে, তা আজ আর হবে না। জাল গুটিয়ে আবার জঙ্গলের গভীর মৌন স্বভাবকে তিরস্কার দিচ্ছে মনে মনে। ডিঙ্গি নৌকায় ভর দিয়ে জলের উপর ভেসে থাকা গেলেও তার মন ডুবে গেছে এলোকেশি মেয়েটির জন্য। চঞ্চল-চপলা মেঘের মতো কোমল তার চাহনি। শাড়ির আঁচল খসে পড়ে গেলে বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠে মকলুনের। এই বুকের ভেতর মকলুনের নাকমুখ মেঘের আর্দ্রতা খুঁজে ফিরে। মেঘের তর্জন গর্জন দেখে। মেঘের রঙ কত কি দেখায়, কত কী দিক বদলায়। মকলুনের মন প্রাণ হারিয়ে যায় মেঘের মতো উড়ে উড়ে। মেঘ গলে যেতে থাকে, মেঘ মিশে যায়। আকাশের বিস্তীর্ণ নীলিমা নেমে আসে ভালোবাসার স্পর্শে।


মকলুন আকাশের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠে। কোথায় গেল পাখিগুলো। পাখির ডানা আর ঝাপটে বেড়ায় না কেন। তবে কি সবাই আকাশ দেখে মৌনতা নিয়েছে। নদীর পাড় ঘেঁষে চলতে থাকা নৌকাকে জঙ্গলের কাছে ভিড়াতে শুরু করে মকলুন। ডিঙ্গি নৌকাকে কোনোরকমে বেঁধে কাদামাটি মাখা লুঙ্গির কাছা ছেড়ে ধূসর গেঞ্জি গায়ে জড়িয়ে মকলুন নৌকা থেকে নেমে যায়। জঙ্গলের ভেতর মানুষের পায়ের ছাপ বের করার চেষ্টা করে সে। কোথাও কোন ছাপ নেই। নাম না জানা কিছু লতাপাতার নির্জীবতা মকলুনের ভেতর ভয় ঢুকিয়ে দেয়। চারিদিকে একপলক চেয়েই বুঝতে পারে এই জঙ্গলে সহসা মানুষের পা পড়ে নি। তার বউটার ভয়ডর বলতে কিছু নেই। 


মকলুনের গা ছমছম করে। উঠতি গর্জন গাছের পাতাগুলো অন্ধকারে ডুবে যেতে চাইছে। অনেক রকমের জংলী গাছের মেলা এই জায়গাটিতে। মকলুনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কোথাও কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় কিনা। পা টিপে টিপে সে এগুতে থাকে। লাল রঙের একগুচ্ছ ফুল মকলুনের পায়ের নিচে মোচড় খায়। কাঁটা কাঁটা লাগতেই সে পা তুলে ফের তাকায় নিচে এ কী পড়ে আছে। কেউ তবে ফেলেছে নিশ্চয়। কাটা পায়ে রক্ত খানিকটা ঝড়ে পড়ে। মকলুন জঙ্গলের ঝড়া পাতা লতা দলে মোচড়ে এগিয়ে যায়। কোনো দিকে হোঁস যেন নেই তার। ঝুপ করে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে সারা জংগল ঘিরে। কয়েক দল পাখি ডানা ঝাপটায়। অনেকক্ষণ বাদে মকলুন খেয়াল করে, সে আর একা নয়। তার সাথে আরও কিছু পাখপাখালির সঙ্গ এই ঘন জঙ্গলে। জঙ্গল যে শেষ হতে চায় না। পাখিগুলোর শব্দ মিলিয়ে যায়। একটা মৃদু হিম ধরা হাওয়া তার ঘাড়ে এসে লাগে। মকলুনের মেরুদন্ড দিয়ে কি যেন নামতে থাকে। মকলুন হাতের মুঠো শক্ত করে বউকে জোর গলায় তার ভরাট কন্ঠে ডেকে উঠে- কদুমী, কদুমী...। মকলুনের দীর্ঘশ্বাস পড়তেই জঙ্গল নড়ে উঠে। হালুম হালুম করে তেড়ে আসে তার ভয়গুলো। মকলুন চোখ নাক হাত দিয়ে চেপে ধরে চিৎকার করে বাতাস কাঁপিয়ে তোলে- কদুমী, তুমি কোথায়? কদুমী, কদুমী...

বাতাস কাঁপা ধ্বনি শান্ত হয়ে আসে। শুনশান নীরবতা নেমে আসে চারিদিকে। অন্ধকারের বুকে আকাশের ক্যানভাসে দেখা দেয় এক অপরূপ মুখ। চাঁদের আলোয় সবকিছু স্নান করতে তোড়জোর লাগিয়ে দেয়। নদীর জলে বৈঠা চালনার মতো মকলুন গায়ের সব জোর দিয়ে গাছের ডাল ভাঙ্গতে শুরু করে। চারপাশে ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দে প্রলয় নৃত্য আরম্ভ হয়। আজকের রাত বউহারা এক জেলে জীবনের আর্তনাদ নয়তো। 



জঙ্গলের উপর আকাশ ফুঁড়ে চাঁদের আলো বিকোতে এতটুকুন কার্পণ্য নেই। কার্পণ্য সেই অদৃশ্য সৃষ্টিনির্মাতার। নদীর জলে ভেসে যাওয়া মাটির মতো তাদের জীবন। কোনো কিছু চাইতে তারা ভুলে গেছে। জালের ফাঁকে মাছ আটকাতে চায় না এখন। জালের সুতো কেটে ফেলেছে জলদেবতা। মাছগুলো বের হয়ে যায় জালের বিচ্ছিন্ন ফাঁকফোকর দিয়ে। যা উঠে তা তো মাছ নয়। তাদের মতো নির্জীব কিছু শামুক শ্রেণী। শুধু শ্বাস আছে এই মানুষগুলোর, কোনোরকমের আশ নেই। আশ ছাড়া শ্বাস নিতে শিখে গেছে তারা। বাড়ির উঠোনের দিকে নজর দিয়েছে নির্মাণশিল্পী। তাঁর যে এই মাটিটুকুনও চাই। মাটি দিয়ে শিল্প বানাতে হয়। শিল্পী যেন সেই উঠোনের মাটি দিয়ে তাঁর বিরাট অবয়ব বানাবে এবার। কেউ বাঁধা দিতে এলে তাকেই গিলে খাবে। মকলুনের বাবাকে গিলে খেয়েছে। মকলুন যখন তার মায়ের আঁচল ধরে কাঁদছিল, তার মা বলেছিল- বাজান, তোর বাবার মতো চলবি না তো। তারপর থেকে মকলুন নদীর পাড় ঘেঁষে ঘেঁষে নৌকা চালায়। 


একবার মকলুন বউয়ের জোরাজুরিতে নারীসঙ্গে তুমুল ঝড় তুলেছিল ডিঙ্গি নৌকায়। ডিঙ্গি ভেসে গেল অনেক দূর। নদীর জল ধবধবে আকাশনীলা হতেই মাছ এল; নৌকার গায়ে সপাৎ সপাৎ ধাক্কা খেল জল সমেত। ডিঙ্গি নৌকা ঘিরে মাছের মেলা বসল। মকলুনের মাছদেখা চোখ বড় বড় হয়ে গেল। জালের পর জাল ফেলতে শুরু করল সে। নৌকার তখন টলমলে অবস্থা। কদুমী সুর তুলল- বউ ছেড়ে মাছে, মাছগুলো আপনার এত আপন। আমি তবে ঝাপ দিলুম। বউ তৎক্ষণাৎ নদীর জলে গা ডুবালো। মকলুনের তখন ত্রাহী মধুসূদন। নৌকা টলটল করছে। মাছ লাফাচ্ছে। জালের ভেতর মাছের আলোড়ন। জালের ভেতর জীবন আটকে গেল। বের হতে পারল না।

মাছ নৌকা জাল রেখে মকলুন ঝাপ দিবে ভেবেছিল। জালটা তুলতে গিয়ে বাবার কথা মনে হলো। বাবা মরে গেছে, বাবার লাশের সঙ্গে এই জালটা জড়িয়ে ছিল। এই একটি জাল ছাড়া মকলুনের আর জাল কেনা হলো না। জালের ভেতর প্রাণগুলো কেমন ছটফট করছে। মকলুন নৌকার উপর বসে বসে চারপাশের জলের ঢেউ দেখছে। কদুমীর শরীর দেখতে পাচ্ছে না সে। যে কিনা গভীর জলে ডুবে যায় তাকে কে পারে ডাঙ্গায় তুলতে। বুদবুদ উঠা জলের দিকে মাছ ধরার মতো করে জাল ছাড়ে মকলুন। এবার কোনো মাছ নয়। জলকুমারী ধরা দেয় মাছের জালে। নৌকায় তুলতে গেলে নৌকা বেঁকে যায়। জলকুমারীর নিঃশব্দ চাহনি মকলুনের বুকে কাঁপন ধরায়। 

মকলুন জালের গোড়া ধরে আরেক হাতে নৌকা বাইতে শুরু করে। পাড়ে আসতে জাল ছেড়ে দেয়। জলকুমারীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে মকলুন। জালের সঙ্গে পেঁচিয়ে থাকা জলকুমারীর সারা অঙ্গে রোদের ঝলক। মকলুন ঝলকের মাঝে কাদা লেপ্টে দেয়। সারা শরীর মাটির প্রতিমার মতো সাজিয়ে পাড়ে তুলে আনে। জলকুমারীর টু শব্দটি নেই। নদীর হাওয়া মাটি শুকিয়ে দেয় অল্প সময় বাদে। জলকুমারীকে রোদে শুকিয়ে শুকিয়ে মকলুনের মনের জ্বালা মেটায়। জলকুমারীর চোখের কোণে মাটি ভিজে উঠে।


মেয়েটির স্বভাব এমন অদ্ভূত, মকলুন পেরে উঠে না। এই ঘন জঙ্গলে নিজের গা এলিয়ে দেয় সে। গাছের পাতার মতো তারও ক্লান্তি ভর করে। কখন যে চোখদুটো এক গভীর বিভোর স্বপ্নে তলিয়ে যায় এই পৃথিবীর কেউ টের পায় না। জ্যোৎস্নার আলো তার সারা গায়ে নদীর ঢেউ খেলায়, কখনও ভাটা আসে, কখনও দূর থেকে চুড়ি আর নূপুরের ধ্বনি বেজে উঠে। মকলুন অনুভব করে এক কুমারী নারীকে!


মকলুনের সারা অঙ্গে মাটির প্রলেপ মেখে দিতে থাকে এক বনকুমারী। কুমারীই বটে। জীবনসংসার নিয়ে যার কোনো ভাবনা নেই সেই তো জলকুমারী হয়, সেই তো বনকুমারী হয়। আজ তার প্রতিশোধ নেয়ার দিন। জলকুমারীর সারা অঙ্গ কাদামাখা করার পাল্টা উৎসব আজ। এই চাঁদের আলো মাটির বুকে দুটো উচ্ছ্বল প্রাণকে কখন যে এক করে দেয় কেউ জানে না। কেউ জানতে চায় না- তারা কেমন করে ভালোবাসে, কেমন করে জীবন কাটায়। নদীর জলে জোয়ার আসে। নদীর কুলকুল ধ্বনিতে এই জগতসংসার মিলিয়ে যেতে থাকে অসীমের পানে।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৬৬৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৮/০৫/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast