www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

লড়াই

'না। অগো মাইরেন না। অরা কিছু জানে না। আমারে মারেন। অগো ছাইড়া দেন।'
সেই তখন থেকে ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে কিসব বলে চলেছে সেলিম। পাশে ঘুমিয়ে থাকা খোকন ডেকে বলে, ' ও সেলিম ভাই! উঠেন। কি কন এইসব?'
সেলিম ধড়মড় করে উঠে বসে। দুঃস্বপ্ন দেখছিল। গত তিন মাসে সে অনেকবার এই স্বপ্ন দেখেছে। মিলিটারির উর্দি পরা কেউ একজন তার স্ত্রী নাসিমার উপর শারীরিক নির্যাতন করছে, আর তার এক বছর চার মাসের মেয়ে সীমাকে এক রাজাকার পানিতে চুবিয়ে মারার চেষ্টা করছে। ছেলে সবুজকে ঝুলিয়ে রেখেছে উল্টো করে। জবাই করার পর একটা পশুকে চামড়া ছাড়িয়ে যেভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়, সেভাবে।
প্রায় তিন মাস হলো সেলিম মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। দিতে বাধ্য হয়েছে। তখনও পুরোপুরি যুদ্ধ শুরু হয়নি তাদের গ্রামে। একদিন হঠাৎ কয়েক ভ্যান মিলিটারি এলো, সাথে জলপাই রঙের ট্যাংক।
গ্রামের প্রায় সমস্ত বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিল। গ্রামের মানুষ প্রাণভয়ে পালিয়ে যে যেখানে পারলো আশ্রয় নিল। সেলিম ও নাসিমার দুটি সন্তান ছিল। ছেলে সবুজ আর মেয়ে সীমা। সবুজের বয়স তখন প্রায় আড়াই বছর। সীমার এক বছর। সেলিম সবাইকে নিয়ে তাদের বাড়ির পিছনের ডোবায় আশ্রয় নিল। গ্রামের আরো অনেকেই ছিল সেখানে। প্রায় তেরো ঘণ্টা পানিতে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা। সেই হিমশীতল পানি থেকে সবাই বেঁচে ফিরলেও ছোট্ট সীমা আর ফেরেনি। এই ঘটনা সেলিমকে ভীষণভাবে তাড়িয়ে বেড়ায়। যোগ দেয় মুক্তিবাহিনীতে।
খোকন বলে, 'ভাই, এক কাজ করেন। আপনি গিয়া ভাবীর সাথে দেখা কইরা আসেন। প্রায়ই দেখি স্বপ্ন দেইখা এইরকম করেন। '
জবাবে সেলিম হ্যা সূচক মাথা নাড়ে। 'কিন্তু কমান্ডার কি যাইতে দেবে?'
'সেইটা আমি দেখমু। তারে বুঝাইলে বুঝবো। '
খোকন কমান্ডারকে বুঝিয়ে সেলিমের বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। সেলিম নাসিমার সাথে দেখা করে। সবুজকে কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। ফিরে যাওয়ার সময় আগেরবছর গ্রামের মেলায় তোলা পারিবারিক ছবিটা সাথে নিয়ে যায়।
স্বামী যুদ্ধে চলে গেলে নাসিমাও বসে থাকে না। সে চেষ্টা করে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে। বাজারের পাশে যে মিলিটারি ক্যাম্প বসেছে, সেখানে সে ঝাড়ু দেওয়ার কাজ নিয়েছে। ক্যাম্পের সব খবরাখবর মুক্তিবাহিনীর কাছে পৌঁছানো তার কাজ। তাছাড়া প্রায় রাতেই কোনো না কোনো মুক্তিযোদ্ধা তার বাড়িতে আসে বিশ্রাম নিতে কিংবা খাবারের খোঁজে। এলাকার মানুষের অনেক চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে ছেলেকে নিয়ে এভাবেই যুদ্ধের পুরোটা সময় কাটিয়ে দেয় নাসিমা।
যুদ্ধ শেষ হয়েছে। কিন্তু নাসিমার মনে এখনও তা কামানের গোলার মতো খৈ ফোটাচ্ছে। সেলিম ফিরে আসেনি। তার পঁচাগলা লাশ পাওয়া গেছে। মুখ দেখে চেনার উপায় নেই। পকেটে থাকা ছবিই নিশ্চিত করেছে তার পরিচয়।
এদিকে নাসিমা ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গ্রামের সবাই নাসিমাকে নষ্টা বলছে। টিপ্পনী কেটে বলছে, ' মিলিটারি ক্যাম্পে কাম করছে। কি কাম আমরা জানি না মনে করছে? হের স্বামী তো গণ্ডগোলেই মরছে। তয় পোয়াতি হইলো কেমনে?'
যে সমাজের সুস্থতার জন্য সেলিম জীবন দিল। সীমা জীবন দিল। নাসিমা মৃত্যুকে হাতে করে মিলিটারি ক্যাম্পে কাজ করল, সে সমাজ কি নাসিমাকে তার সবুজকে নিয়ে এই সবুজক্ষেত্রে মাথা উঁচু করে বাঁচতে দেবে না? হয়তো দেবে, যদি তাদের সব প্রশ্নের উত্তর পায়।
ঘরের দরজায় ছেলেকে নিয়ে উদাস মনে ভাবে সে। সব প্রশ্নের উত্তর হয়তো সে দিতে পারবে, তবে তা কি মেনে নেবে সবাই? যুদ্ধের তিন মাসের মাথায় রাতের আঁধারে সেলিম যে বাড়ি এসেছিল, সে কথা গ্রামবাসীকে কি করে বিশ্বাস করাবে নাসিমা?
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৩৪৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৫/১১/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast