www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

বীরের নাতনী

অর্পিতা আমার বান্ধবী। আমরা একই ক্লাশে পড়ি। তার সাথে আমার খুব ভাব। তাদের বাড়িতে বছরে দুটো বিরাট অনুষ্ঠান হয়। একটি মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা দিবসে আরেকটি ১৬ ডিসেম্বরে মহান বিজয় দিবসে। সে আমাকে দাওয়াত করে। আমি তার বাড়িতে গিয়ে উৎসবে যোগ দেই।
অর্পিতার দাদা কাদের মাস্টার নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। ১৯৭১ সালে যখন দেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় তখন অর্পিতার দাদা চাকরি ফেলে যুদ্ধে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বাড়ি এসে তিনি তাঁর স্ত্রীকে এ কথা বললেন।
তিনি সবার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। শেষে অর্পিতার দাদিকে বলেছিলেন, `আমি যুদ্ধে গেলাম। তোমরা সাবধানে থেকো। ভয় পেয়ো না। কোন মুক্তিযোদ্ধা যদি বিপদে পড়ে আমাদের বাড়িতে আসে তবে তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করবে। আর আমি দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত বাড়ি ফিরছি না। আমি যদি না ফিরে আসি তবে মনে করবা আমি দেশের জন্য জীবন দিয়েছি। তোমরা স্বাধীন দেশে থাকবা। এর চেয়ে গৌরবের আর কিছুই নেই।'

দাদি দাদাকে ধরে অনেক কান্নাকাটি করলেন। দাদা যাবেনই। পরে দাদি দোয়া-দরূদ পড়ে দাদার সমস্ত শরীর হাতিয়ে দিয়ে `ফি আমানিল্লাহ্' বলে বিদায় দিলেন।

অর্পিতার দাদা চলে গেলেন যুদ্ধে। তারপর অনেকদিন তাঁর কোনো খবর নেই। সারাদেশে প্রচন্ড যুদ্ধ। দাদি দাদার চিন্তায় অস্থির হয়ে গেলেন। খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিলেন। নামাজ পড়ে কেঁদে কেঁদে দাদার জন্য দোয়া করতেন। দাদা আর ফিরে এলেন না।

প্রায় ৬ মাস পরে অর্পিতাদের বাড়িতে একটা লাশ নিয়ে এলো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। অর্পিতার দাদার লাশ। বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেল। মুক্তিযোদ্ধারা বললেন, `আপনারা কেউ কাঁদবেন না, তিনি পাকিস্তানিদের সাথে সামনাসামনি যুদ্ধ করে ২ জনকে গুলি করে মেরেছেন। পরে পাকবাহিনীর একটা গুলি এসে তার বুকে লাগতেই তিনি ঢলে পড়ে যান। তিনি বীরের মতো যুদ্ধ করে শক্রুকে মারতে মারতে শহীদ হয়েছেন। তিনি আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি আমাদের গর্ব। সবাই তাঁকে স্যালুট করবে।'

তারপর থেকে অর্পিতার দাদির উদ্যোগে বাড়িতে নিয়মিত অনুষ্ঠান হয়। এখন দাদার জন্য কেউ আর কাঁদে না; সবাই গর্ব করে। বছরের দুবার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কাদের মাস্টারের পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে তাদের পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়িতে এসে অনুষ্ঠান করে।
বাড়িভর্তি থাকে মানুষ। এলাকার ছেলে-মেয়ে ও বুড়োরাও আসে অনুষ্ঠানে। উঠোনে সামিয়ানা টাঙ্গানো হয়, থাকে চেয়ার টেবিল ও ফুলের টব। সাধারণ জ্ঞান ও ছোটদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কারও বিতরণ করা হয়। এলাকার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এসে অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন। সেই স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় মুক্তিযুদ্ধের কত অজানা আর ভয়ংকর সব ঘটনা।

যুদ্ধের সময় কত নির্মম ও কত বীরত্বের ঘটনা যে ঘটেছে তা তাদের মুখে শোনার পর আমি স্থির থাকতে পারি না। আমার রক্ত টগবগ করে। আমি মনে মনে বলি সারাদেশেই যদি মুক্তিযোদ্ধারা নিজের মুখে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা বলতো আর ছোটরা শুনতো তা হলে কতো উপকার হতো। কারণ, আমি মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে শুনে আমাদের স্বাধীনতা সম্পর্কে যতোটা না জেনেছি বই পড়ে ততটা জানতে পারতাম না।

বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র যেমন মানুষের কাছে বই পৌঁছে দেয় পড়ে জ্ঞানী হওয়ার জন্য তেমনি সরকার যদি মুক্তিযোদ্ধাদের পৌঁছে দিতো দেশের আনাচে-কানাচে অসংখ্য শিশুর মাঝে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনানোর জন্য তা হলে শিশুরা জানতে পারতো মুক্তিযুদ্ধের আসল ঘটনা।

আমি অর্পিতাকে বলেছি, তুমি আমাকে আর না দাওয়াত করলেও আমি প্রতিবছর তোমাদের গ্রামের বাড়ির এই অনুষ্ঠানে এসে উপস্থিত হবো। কারণ এ অনুষ্ঠানে এসে আমি অনেক কিছু জানতে পারি, শিখতে পারি। কত রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি তা যদি সবাই জানতো তা হলে আমরা দেশটাকে আরো অনেক বেশি করে ভালোবাসতে পারতাম এবং আরো উন্নতি করতে পারতাম।

আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত কাহিনী শোনার পর এখন মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনা আমার ভেতরে জ্বলজ্বল করছে। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের মূল্যবান সম্পদ। যাঁরা যুদ্ধ করে শহিদ হয়েছেন তাঁদেরকে øরণ করা ও যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁদেরকে মনে প্রাণে ভালোবাসা আমাদের উচিৎ। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের মনেপ্রাণে ভালবাসি আর শ্রদ্ধা করি। আমি অর্পিতাকেও ভীষণ ভালোবাসি। কারণ সে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতনী।

‍‌‌‌‌ "‍হৃদয়ে একাত্তুর"‍
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৯৫১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৮/১২/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • খুব ভাল লিখেছেন
  • সায়েম খান ০৯/১২/২০১৩
    আমার ব্লগে দাওয়াত রইলো।
  • সায়েম খান ০৯/১২/২০১৩
    তার ছেলেমেয়েদের কেও একইভাবে ভালবাসবেন, কারণ তারা মুক্তিযোদ্ধার বংশধর।
 
Quantcast