www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

রতন - রত্ন

কিগো হারুদা এমন গোমড়া মুখ করে বসে কেন ? ওদিকে তো আরও এক বাঙালি নোবেল পেলো ।
চা এর কাপ এ একটা চুমুক দিয়ে খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই হারুদা উত্তর দিলেন, তা রতন তোমার তাতে কোন চুলটি ছেঁড়া গেল ? আগের একটি তো চুরি গিয়েছে , সামলে রাখার ক্ষমতা নেই , এ ব্যাটা তো বুদ্ধিমান তাই চলে গিয়েছেন বিদেশে ।
রতন ক্যাবলা মুখ করে হাসতে হাসতে বললো , একজন বাঙালি নোবেল পেয়েছে , বাঙালি হিসেবে গর্ব হবে না ? তুমি এমন কেন বলছো ? তোমার গর্ব হচ্ছে না ?
না , হচ্ছেনা । একটু রাগ এর স্বরেই হারুদা বললেন ।
এক চুমুকে অবশিষ্ট চা টুকু শেষ করে , চা এর কাপ আর খবরের কাগজ বেঞ্চ এর উপর রেখে হারুদা হাঁটা দিলেন বড় রাস্তার মোড় এর দিকে ।
রতন হা করে চেয়ে রইলো হারুদার দিকে আর বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলো , আজব খিটকেল লোক মাইরি।
অদূরে হাঁটতে থাকা হারুদার কানে কথাটা পৌছালো ।
ফিরে এসে রতনের সামনে দাঁড়ালো , রতনের আপাদমস্তক একবার নিরক্ষন করে হারুদা বললো
তোর হাতে উল্কি দিয়ে লেখা "I LOVE U RITA ", একটা জিন্স পড়েছিস হাঁটুর কাছের কাপড় কেউ যেন খাবলা মেরে নিয়ে গেছে , মাথার চুল কানের দু পাশে ছোট করে ছাটা আর মাঝখানে যেন কাক এর বাসা, সামনের কয়েকটা আবার পান এ দেওয়া খয়েরের মতো রং করেছিস ।
এরপর তুই নিজেকে বাঙালি বলে আর বাঙালির নোবেল পাওয়া নিয়ে গর্ব করিস , তোর মতো বাঙালির যদি বাংলা আর বাঙালি নিয়ে গর্ব এই পরিমানে বৃদ্ধি পায়, তবে বাঙালির কাঙালি হতে বেশিদিন লাগবে না ।
ড: হিরণ্ময় চ্যাটার্জী , ছোট খাটো রোগা চেহারা , পাড়ায় ডাকনাম হারুদা । যেহেতু শিক্ষিত সেহেতু পাড়ার সকলে হারুদা কে একটু আলাদা নজরেই দেখে।সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামায় প্রতিদিন সকালে পাড়ার সত্যদার চা এর দোকানে ঘন্টা খানেকের জন্য তাঁর দর্শন মেলে। বছর ৪৫ এর হারুদা সাহিত্যপ্রেমী হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে করেননি । এই ব্যাপার টা আমাকে বেশ ভাবায়। যতদূর আমি জানি রোমান্টিকতা সাহিত্যের বিশেষ অঙ্গ আর নারী তাঁর অনেকখানি জুড়ে আধিপত্য বিস্তার করে রয়েছে । তাহলে কি হারুদা রোমান্টিক নয় ?




এই বিষয়ে বলা বাহুল্য এতক্ষন ধরে যে আমি বর্তমান , সেই আমি হলাম শ্রী যুক্ত অভয় গাঙ্গুলি, পেশায় একজন চাকুরীজীবি তবে, সরকারি নই।কোনোমতে স্নাতক পাশ করার পর কম্পিউটার কিছুটা শিখে এখন কলকাতার একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। পরিবারে বাবা, মা ,ছোট বোন এবং আমি ।অবসর সময়ে দু একখানি বই পড়তে ভালোবাসি তবে,পড়ার চেয়ে সমালোচনায় আমি বেশি আগ্রহী । বিয়ে এখনো করিনি । এর চেয়ে বেশি পরিচয় আশাকরি এই মুহূর্তে নিষ্প্রয়োজন ।
হারুদা এবং রতনের এই ঘটনার সময় আমিও চায়ের দোকানে উপস্থিত । হারুদা চলে যাওয়ার পর রতন আমার পাশে এসে বসলো । কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকার পর সত্য দা কে এক কাপ চা আর একটা FLAKE এর জন্য হ্যাক দিলো । আমি তখন খবরের কাগজে NRC নিয়ে রাজনৈতিক পারদের উচ্চতা বিশ্লেষণে মনোনিবেশ করেছি ।
চা এর কাপ এ একটা চুমুক দিয়ে সিগারেট টা ধরিয়ে একটা টান দিয়ে রতন বললো - আচ্ছা অভয় দা , তাহলে কি ৭৩ এর আগের কাগজপত্র যাদের নেই, তাদের কে কি সত্যি সত্যিই দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে ?
আমি - হারুদা কে চটিয়ে ভাগিয়ে দিলি , তবে কি এবার আমার পালা ?
রতন - আরে না , তুমি এমন করে কেন বলছো ? হারুদা শিক্ষিত মানুষ , তবে উনি একটু অন্য ধরণের তো , আমাদের এখনকার এসব স্টাইল এর ব্যাপার উনি বুঝবেন না । তুমিই বোলো,এসব ই তো এখন চলছে ,একটু স্টাইলিশ জামা কাপড় পড়বো, চুলে কালার করবো । হারুদা একটু সেকেলে লোক।
আমি - তো তুই এসব কথা হারুদার সামনে কেন বলিস নি ? ভয় পাস ?
রতন - রতন সামন্ত কাউকে ভয় পায় না , হারুদা কে সম্মান করি তাই তর্কে গেলাম না ।
আমি - তোকে অমন করে অপমান করলো , দেখে তো আমার ই খারাপ লাগছিলো , নেহাত তুই কিছু বলিস নি তাই আমি ও চেপে গেলাম । যদি বলিস তো এখন চল হারুদার বাড়িতে , দেখি তোর কত সাহস !
রতন - চলো তাহলে ।

চা শেষ করে সিগারেটে টা মাটিতে জুতোর তলায় পিষে রতন চললো আমার সাথে হারুদার বাড়ির উদ্দেশে ।





দো তলা বাড়ি , হারুদা এবং তার কাজের লোক বলাই দুজন মানুষ থাকে এতো বড় বাড়িতে , বাড়ির সামনে একপাশে ছোট ফল ফুল গাছের বাগান , আর একপাশে একটা কালো রং এর টাটা নেক্সান দাঁড়ানো ।
কলিং বেল টিপতেই হারুদা ভিতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে -
অভয় , কি ব্যাপার
আমি- একটু দরকার ছিল তোমার সাথে ।



হারুদা - রতন , কিছু মনে করিস না চা এর দোকানের ব্যাপার টা নিয়ে , আসলে সকাল থেকে আমার মাথাটা বিভিন্ন কারণে একটু গরম ছিল ।
রতন - আরে না না , মনে করবো কেন? তুমি গুরুজন মানুষ বলতেই পারো , আর তুমি তো ভুল কিছু বলোনি।
আমি একবার রতনের দিকে তাকাতেই রতন মাথাটা নিচু করে নিলো
হারুদা- রতন ভিতরে এসে বস , অভয় এসো, ভিতরে এসে বসে কথা বলি ।

বসার ঘরের চারিদিকে কাঠের আলমারি ভর্তি বই , এককোনে একটি টেবিল চেয়ার ,মাঝে দুটি সোফা আর তাঁর সামনে একটি ছোট কাচএর টেবিল । আমি আর রতন সোফা তে গিয়ে বসলাম ।এর আগে রতন বা আমি কেউই হারুদার ঘরে ঢুকিনি ।
রতন- এই সব বই কি তুমি পড়ো, হারুদা ?
হারুদা টেবিলের সামনে রাখা চেয়ার টা টেনে বসে একটু মুচকি হেসে বললো -
অভয় , বলো কি ব্যাপার , আর রতন তোকে আবার বলছি কিছু মনে করিস না ।




আমি - না , মানে রতন বলছিলো যে এসব ই তো এখনকার স্টাইল , তুমি সেকেলে লোক তুমি এসব বুঝবে না ।
মুহূর্তে রতনের মুখ টা কেমন বিমর্ষ হয়ে গেলো ,কাচুমাচু হয়ে কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না ।
হারুদা- না , আসলে ব্যাপার টা সেটা নয় । সমস্যা টা হলো কি জানো অভয় ,একটা দূরত্ব তৈরী হয়েছে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ এবং অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে । আর দূরত্ব টা দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে , এটা সমগ্র ভারত ব্যাপী বিশেষত আমাদের বাঙালি দের মধ্যে একটু বেশি । যে কোনো সমাজের উন্নতি তখনি সাধিত হয় যখন শিক্ষিত মানুষেরা তাদের শিক্ষা সমাজের সমস্ত মহলে ছড়িয়ে দেয় । বই পরে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব তবে জ্ঞান নিয়ে যদি বাস্তবিক চর্চা না হয় , তাহলে জ্ঞান আবদ্ধ হয়ে পরে , বিকাশ হয় না ।
রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর তাঁর " রথের রশি " তে বলেছেন -

"ওদের মাথা ছিল অত্যন্ত উঁচু ,
মহাকালের রথের চূড়ার দিকেই ছিল ওদের দৃষ্টি -
নিচের দিকে নামলো না চোখ ,
রথের দড়ি টাকেই করলো তুচ্ছ ।
মানুষের সঙ্গে মানুষকে বাঁধে যে-বাঁধন তাকে ওরা মানে নি ।
রাগী বাঁধন আজ উন্মত্ত হয়ে লেজ আচড়াচ্ছে -
দেবে ওদের হাড় গুড়িয়ে ।।।।।।।।"

যে জ্ঞান এর এতো অহংকার তাঁর মূল উদ্দেশ্য না জেনেই যে ওরা জ্ঞানী ।যে দূরত্ব আজ তৈরী হয়েছে কয়েকশো বছরের রাজত্বে তাকে তো একদিনে ভেঙে দেওয়া যায় না ।
রতন - কি যে বলছো হারুদা , সব তো ওপর দিয়ে যাচ্ছে ।



আমি- আমাকে একটা কথা বলো হারুদা , এর থেকে মুক্তির উপায় কি ?
হারুদা- রতন তোর এই স্টাইল এর ব্যাপার টা সত্যিই আমার মতো মানুষ বুঝবে না । আসলে এই বিষয় গুলো ওপরের , যেটা প্রয়োজন সেটা হলো ভিতরের পরিবর্তন সাধন করা । অভয় , তোমাকে বলি এই অবনমন থেকে মুক্তির পথ যে কি তা আমার জানা নেই , তবে এটুকু বলতে পারি কোনো সমাজ বা জাতি কোন পথে পরিচালিত হবে তাঁর দায়িত্ব সেই জাতি বা সমাজের গণ্য মান্য ব্যক্তি গণ যথা - সাহিত্যিক,শিল্পী ,রাজনীতিবিদ,শিক্ষাবিদ সকলেই । এনারা হলেন রথের এক একটি চাকা , যার একটি চাকার অক্ষমতা রথের গতি এবং অস্তিত্ব ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট ।
একটি ছোট্ট ঘটনা বলি -
স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষের দিক , গোটা ভারতবর্ষ তখন স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে । এমন সময়ে গান্ধীজির নেতৃত্বে বিদেশী বস্ত্র বর্জনের রব উঠলো , গোটা দেশ একসাথে হল্লা করে বিদেশী জামাকাপড় পোড়াতে শুরু করলো । গান ও হলো "মা এর দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই "। এমতাবস্থায় এক দাড়ি ওয়ালা সাহিত্যিক ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ) এই ঘটনার বিরুদ্ধাচারণ করে বলে উঠলেন - এই কাজ ঠিক নয় , তুমি বিদেশী দের অত্যাচার এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারো , তবে যে গরিব ভারতীয় ব্যবসায়ী রা সেই বিদেশী জামাকাপড়ের ব্যবসা করে পেট চালাচ্ছে , তাদের ক্ষতি করতে পারো না ।
সমগ্র ভারত বাসীর বিরুদ্ধে গিয়ে সেদিন তিনি এই কথা বলেছিলেন ।সামগ্রিক বিচারে যা ঠিক মনে হয় ,শিক্ষিত মানুষ তাঁর দূরদর্শিতার দ্বারা সেই কার্যের ঠিক ভুল নির্ধারণ করতে পারে । আর তাই যতদিন পর্যন্ত শিক্ষিত বাঙালি যতদিন পর্যন্ত নিজেদের শিক্ষার অহংকার এর আবদ্ধতা থেকে মুক্ত করতে পারছে ততদিন এই বাঙালির মুক্তি নেই ।
আমার ফোন টা বেজে উঠলো ।
হ্যালো , হ্যা আসছি।
মা এর ফোন , বাজার যেতে হবে , আজ তবে উঠি হারুদা।
হারুদা- কি দরকার ছিল তাই তো বললে না অভয় ।
আমি - আজ থাক , পরে একদিন বলবো ।
হারুদা মুচকি হেসে রতন কে বললো - রতন অভিজিৎ ব্যানার্জী নোবেল পেয়েছে সেটা তে আমি ভীষণ খুশি , আরও বেশি খুশি হতাম যদি তিনি নাগরিকত্ব টা না বদলাতেন , তাঁর চেয়েও বেশি খুশি হবো যদি তুই কাল ওনার লেখা বইটির নাম বলতে পারিস ।

রতন- আচ্ছা হারুদা , আসি গো।
আমি - আসছি ।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৩০৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১১/১২/২০১৯

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast