www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

তিস্তার বুকে শুকিয়ে যাওয়া স্বপ্ন

কল্পনার চোখে কল্পনার শেষ নেই। হাজারো কল্পনার মালা গেঁথে সে ক্লান্ত তবু তার গাঁথা শেষ হয় না। আজ তার মনের আকাশে বসন্তের কোকিলেরা থেমে থেমে সুর তোলছে। সেখানে হাজারো ফুলের আনাগোনা, লক্ষ তারার মেলা, প্রজাপতির অবিরাম ওড়াওড়ি। একটি রূপালী চাঁদ যেন তার কল্পনার আকাশে উঁকি মারছে. চাঁদের আলোয় পাশের তিস্তা নদের পানি গুলো স্বচ্ছ ডাবের পানির মত ঝিকিমিক করছে। সে পানিতে আলো আঁধারির মাঝে একটি ডিঙি নৌকা দেখা যায়। নৌকা থেকে ভেসে আসছে ভাটিয়ালীর সুর। মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে আমি আর বাইতে পারলাম না। কল্পনা মুগ্ধ হয়ে সে গান শোনছে। এ গান তার বড় চেনা, এ সুর বড় আপন, এ গানের মানুষ তার বড় কাছের। কল্পনা লজ্জা পায়। যাহ কি ভাবছি এ এসব! এখনো বিয়েই হয়নি সে আবার কাছের হয় কিভাবে? কিন্তু তাই বলে কি স্বপ্ন দেখতে মানা আছে? কল্পনা আবার স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখতে দেখতে তার চোখে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম। ততক্ষণে তার কল্পনার আকাশের চাঁদটা ডুবে গেছে।
সোলেমানের চোখে এখনো ঘুম ঘুম ভাব। কাল সারারাত মাছ ধরেছে। তিস্তা ইদানিং কৃপণ হয়ে গেছে, আগের মত মাছ পাওয়া যায় না। গত বছর বহু ধারদেনা করে একটা নৌকা ও জাল কিনেছে। ভরা মৌসুমে মাছ না পেলে ঋণ শোধ করা কষ্ট হয়ে যাবে তার জন্য। কালাম সোলেমানের বাল্য বন্ধু। একই নৌকায় দুজনে কাজ করে। কালাম আবার ভালো গান জানে। গভীর রাতে নিস্তব্দ তিস্তার বুকে সে প্রায়ই গান ধরে। আমার সোনার ময়না পাখি কিংবা সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে। তার গানের সুর যেন তিস্তার দূ কোল জুড়ে এক গভীর ভাবের সৃষ্টি করে। দু পাড়ের বুনো ঘাস গুলো যেন তন্ময় হয়ে তার এ গান শোনে। পাশ দিয়ে ওড়ে যায় দু একটি নিশাচর পাখি। হয়ত গানের সুরে তারাও কিছুটা আমোদিত হয়ে উঠে। সোলেমানের তখন কল্পনার কথা মনে পড়ে। তিস্তার পাড়ে সবুজ পাড়ের শাড়ি পরে কল্পনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সে যেন মিটি মিটি হাসে। যেন বলতে চায়- আমারে নিবা না মাঝি লগে। সোলেমান কিছুটা হতচকিত হয়ে যায়- না মানে নাওতো আমার ছোড, তোমারে কেমনে নেই কওতো? কল্পনা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে- আর কত ছোড নাও বাইবা মাঝি এইবার একটা বড় নাও কিন? সোলেমান লজ্জা পায়। আমার ও তো সাধ হয় একটা বড় নায়ে কইরা তিস্তার বুকে তোমারে নিয়া ঘুরি কিন্তু তিস্তা কিপ্টামী করতাছে, আগের মত মাছ ও দেয় না, একটা নৌকাও কিনতে পারি না। তিস্তারে দোষ দিওনা মাঝি তিস্তারে দোষ দিওনা। আস্তে তার কন্ঠ মিলিয়ে যায়।

গত কয়েকদিন যাবত রহিম সর্দার অসুস্থ। গায়ে প্রচন্ড জ্বর। কল্পনা রহিম সর্দারের একমাত্র মেয়ে। সে দিন রাত বাবার সেবা করে যাচ্ছে। গত কাল বিকেলে লোকমান কবিরাজ এসেছিল। সে কিছু পথ্য আর জলপট্টি বেঁধে দিয়ে গেছে। রহিম সর্দার অচেতন হয়ে পড়ে আছে কিন্তু চিন্তার শেষ নেই। ঘরে মা মরা একমাত্র মেয়ে তার বিয়ের বয়স হয়ে গেছে কিন্তু অর্থাভাবে মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেনা অপর দিকে সোলেমানের সাথে তার বিয়ের কথা বার্তা চলছে কিন্তু সোলেমানের আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকায় সেও আগাতে সাহস পাচ্ছেনা। এদিকে সংসারের অবস্থা ভালো না। গত বছর অনেক ধার দেনা করে ধান লাগিয়েছিল কিন্তু ধানের দাম পড়ে যাওয়ায় তার অর্ধেক দাম ও উসূল করতে পারেনি। এ বছর আবার আশায় বুক বেঁধে আছে। সরকার কৃষকদের ধান কিনে নেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। মা মারে তোর কি অনেক কষ্ট অইতাছে?
না বাজান কোন কষ্ট অইতাছে না। মার কতা মনে পড়ে। কল্পনা ফুফিয়ে কেঁদে উঠে। তোর মায় থাকলে তোর এত কষ্ট অইতনা। কি করবি সবই কপাল। বাজান গত কাইল মায়রে আমি স্বপ্নে দেখছি। কি কইল তোর মায়? মায়ের মুকটা বড় হুগনা, আমারে কইল তোর বাবারে একটু দেইখ্যা রাহিস, মানুষটা বড় ভালা। হেরপর কি কইলরে মা? আরও জানি কিসব কইল ঘুম ভাঙনের ভুইলা গেছি। সব ভুইলা গেলি? হ বাজান। রহিম সর্দার এক দৃষ্টিতে ছোট্ট জানালা দিয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছে দু ফোটা অশ্রু।

তিস্তার সেই ভরা যৌবন এখন আর নেই। এক সময়ের স্রোতস্বিনী তিস্তার বুকে এখন বালুচর। স্টীমারের বদলে গরুর গাড়ী, নৌকার বদলে ঠেলা গাড়ী! ভারত সরকার তিস্তার বুকে বাঁধ দিয়েছে। উদ্দেশ্য পানি বিদুত্ নিমার্ণ ও অপেক্ষাকৃত শুকনা অঞ্চলে পানি সরিয়ে তাদের কৃষি কাজ চালু রাখা। উদ্দেশ্য মহত্ কিন্তু অন্যের ক্ষতি করে তা সাধন করলে তখন আর তা মহত্ থাকেনা। তিস্তা নদীতে ভারত বাংলাদেশ উভয়ের ই স্বার্থ জড়িত। আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুযায়ী স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দেশের ক্ষতি করে ভারত একতরফা ভাবে এ বাঁধ নির্মাণ করতে পারে না। কিন্তু ভারত এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক রীতি নীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে একতরফাভাবে এ বাঁধ নির্মাণ করেছে যা বাংলাদেশের স্বার্থকে মারত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং তিস্তা নদীর আশেপাশের জীব বৈচিত্র ও পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষাকালে পানির প্রচন্ড চাপ থাকায় সুইচ গেট গুলো খোলে দেওয়া হয় ফলে পানির উচ্চ প্রবাহে এ অঞ্চলে বন্যা ও নদি ভাঙনের সৃষ্টি হয় যা একধরণের মানবিক সংকটের সৃষ্টি করে। আবার শুষ্ক মৌসুমে সুইচগেট গুলো বন্ধ করে দেওয়ায় এ অঞ্চলে মরুময়তা দেখা দেয় যা সেচ কাজ, কৃষি ও মত্স্যক্ষেত্রে মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি হয় যা এদত অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। এ বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে এসে তিস্তা চুক্তি করার ব্যপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের চেয়ে ও ক্ষমতাসীন মূখ্য মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী নাকি তিস্তা এক ফোটা পানিও বাংলাদেশকে দিতে ইচ্ছুক নন ফলে ঝুলে গেল তিস্তা চুক্তি, ঝুলে গেল কোটি মানুষের ভাগ্য আর আমরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছি মোটের উপর মমতা দিদির সাথেতো অন্তত বেয়াদবি সাজেনা!
দেখতে দেখতে শুকনো মৌসুম চলে এসেছে। তিস্তার বুকে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে বালুচর। একটা সময় ছিল যখন তিস্তার বুকে সারা বছর পানির প্রবাহ থাকত। তিস্তার বুকে চলত পাল তোলা নৌকা। কত রঙের, কত ঢঙের নৌকা তার কোন ইয়ত্ত্বা নেই। নৌকায় থাকত হরেক রকম পন্য। তিস্তার বুকে সারাক্ষণ ই যেন একটা উত্সবের আমেজ লেগে থাকত। আগে প্রতিবছর ঘটা করে নৌকা বাইচ খেলার আয়োজন করা হত। গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোর এ নৌকা বাইচকে কেন্দ্র করে আনন্দের সীমা ছিলনা। তিস্তার বুকে ছিল মাছেদের অভয়ারন্য। ঝাঁকি জাল দিয়ে সামান্য একটা খেও দিলেই উঠে আসত অনেক মাছ। আশে পাশে প্রতিটি অঞ্চলে তিস্তার পানিতে ফলত সোনালি ফসল। তিস্তার তীর ছিল মাছ আর ভাতের এক বাঙালী জনপদ। এখন সময় পাল্টেছে। তিস্তার বুকে আজ কাঁদার জন্য ও কয়েক ফোটা জল নেই। নেই মাছ নেই ফসলের বাড়া। তিস্তা যেন ভাঙা মিনারের টুকরো হয়ে কালের ক্ষয়ে যাওয়া ইতিহাসে ঠাই নিয়েছে। সোলেমান তিস্তার তীরে বসে সেই অতীত ইতিহাসের ই স্মৃতি চারণ করছিল।
গত কয়েক মাস ধরে তার কোন কাজ নেই। ডিঙি নৌকা তিস্তার বালু চড়ে আটকে গেছে। মাছ ধরার জাল ঈদুরে ছিড়ে ফেলেছে। এখন তার চোখে শুধু হতাশার পদচিহ্ন। মাছ ধরা ছাড়া জীবনে কিছু শিখেনি ফলে অন্য কাজে গিয়েও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। আসলে মাছ ধরাটা শুধু তার পেশা না নেশাও বটে। যে কাছে সে আনন্দ খোঁজে পায়না সে কাজে তার মন ও টানেনা। কি করে জীবনের বাকি দিন গুলো কাটবে সে চিন্তায় সোলেমানের চোখে ঘুম নেই। হঠাত্ কার ও পদ শব্দে সোলেমানের ঘোর কাটে। কল্পনা এসেছে কলসি নিয়ে। তার মূখটা সুকনা। তিস্তার পানিতো ফুরায় যাইতাছে আর কত পানি নিবা? আমি না অয় পানি নিতে আইলাম কিন্তু তিস্তার পানে চাইয়্যা থাকলেকি তিস্তায় পানি আইস্যা পড়ব? কি করুম কল্পনা, এই গাঙ রে ভুলতে পারিনা। না ভুল্লে চলব ক্যামনে? তিস্তা কি আর আমাগো দুঃখ মুইছা দিব? তিস্তার ইতো দুঃখের শেষ নাই কল্পনা। নতুন কিছু করেন মাঝি, তিস্তার পাড়ে আর কত কাল? নতুন কিছু যে ভাবতে পারিনা। ভাবতে অইব মাঝি ভাবতে অইব। কল্পনার কন্ঠ মিলিয়ে যায়।

রহিম সর্দারের দিনকাল ভালো যাচ্ছেনা। গত বছর ধান লাগিয়ে মার খেয়েছিল কিন্তু এবার ধান লাগাতে পারছেনা। তিস্তার বুকে পানি নেই। সেচ কাজ বন্ধ। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। এমন বিরাট একটা গাঙের পানি গেল কই? মনে মনে ভাবে রহিম সর্দার। বাজান ঘরে চাউল নাই দুফারে কি রান্ধুম? কছ কি হেদিন না চাউল আনলাম? বাজান তোমার মাথা ঠিক আছে? হেই কবে চাউল আনছিলা তুমি হেদিন পাইলা কই? মারে মাথা ঠিক নাই, তিস্তায় পানি নাই, ধানের ক্ষেত ফাইট্টা চৌচির অইয়্যা গেছে, অহন আমরা কি করুমরে মা? বাজান চিন্তা কইর না, আল্লায় ই একটা ব্যবস্থা করব। হরে মা হেই ভরসায়ইতো আছি। মা তোর কাপড়া কি ছিড়া গেছে? কই নাতো বাজান? ঐ যে আচলডার কোণা দিয়া একটু ছিড়া মনে অইতাছে? এইডা কিছুনা বাজান। তুই আমারে কি বুজাবি? আমি সব বুজিরে মা, আমি সব বুজি। মাঝে মাঝে কি মনে অয় জানস? কি মনে অয় বাজান? মনে অয় তিস্তার জলে গিয়া ডুইবা মরি কিন্তু কপালডা এমন খারাপ যে তিস্তার বুকে মরণের লইগ্যাও এক ফোঁটা জল নাই। কল্পনা ফুফিয়ে কেঁদে উঠে। বাজান আমার মাতা ছুঁইয়া কসম কর এমন কতা কইব না? আমি যে বড় অধম রে মা আমি যে বড় অধম। গামছা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে রহিম সর্দার মেয়ের সামনে থেকে সরে যায়।

সোলেমানের চোখে মূখে কিছুটা উত্তেজনা। দোস্ত আমাদের আর বইসা থাকনের সময় নাই কথাটা কালামের মুখ থেকেই প্রথম ভেসে আছে। শ্যাম চরণ ও সায় দেয়- হ হ এই অন্যায় এইভাবে মাইনা নেওন যায়না। ভারত আমাগো বন্ধু তাই বইলাতো যা ইচ্ছা তাই করতে পারেনা। এই তিস্তা তো অগো একলার গাঙ না এইহানেতো আমগোও অধিকার আছে। আইজ তিস্তায় পানি নাই, মাঠঘাট সব পানির অভাবে হাহাকার করতাছে। গরুর ঘাস নাই, ধানের ক্ষেতে সেচ নাই, গাঙে জাল হালানের জায়গা নাই এমনে চলতে থাকলেতো আমরা ভাতে মরুম আমরা পানির অভাবে মরুম- কথা গুলো অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে বের হয়ে আসে শ্যামচরণের মুখ থেকে। এই গাঙের পানি কারো বাপদাদার কাইল্যা সম্পত্তি না, এই পানি হগলতের-সোলেমান দৃঢ়তার সাথে কথাগুলো বলে। জানস মাঝে মাঝে কান্দন আহে। কষ্টে বুকটা ফাইটা যায়! বাপদাদার আমল থেইক্যা তিস্তারে চিনি। এইডাতো শুধু নদী না এইডা আমগো মা। মায়ের মত কইরা এই নদি আমাগো আগলাইয়া রাখছে। আমগো পুরা জীবডাইতো এই নদীর উপর ভর কইরা। এই নদি যদি হুগায় যায় তয় আমরাও থাকুম না আমরাও থাকুম না, কাঁদছে শ্যামচরণ। তার কান্না দেখে সবার চোখ ই ভিজে উঠেছে। কালাম বলে উঠে মরতে যহন অইব ই তহন আর কা পুরুষের মতন মরুম ক্যান? দরকার অয় তিস্তার বুকে লাশ অইয়্যা যাইমু, তবু আমগো অধিকার আমরা আদায় কইরা ছাড়ুম, কি কস তোরা? হ হ তোর কথাই ঠিক যাগো অধিকার আদায়ের ক্ষমতা নাই তাগো স্বাধীনতাও নাই. চল সবাই।

মাদবর সাহেবের মেজাজ মর্জি ভালো যাচ্ছেনা। সুদের ব্যবসায় কিছুটা ভাটা পড়ছে। তিস্তায় পানি না থাকায় কৃষকরা ফসল ফলাতে পারছেনা তাই নগদ টাকায় তেমন পাওয়া যাচ্ছেনা। তার মাথায় চিন্তার শেষ নেই। তবে কিছু দালালি টালালি এখনো অব্যাহত আছে। গ্রামে ঝগড়া ঝাটি হলে অত্যন্ত সততার সাথে তিনি এসব মোকাবেলা করেন! বিনিময়ে তিনি কিছু পান। অবশ্য নিন্দুকেরা বলেন ঝগড়া ঝাটি সৃষ্টিতে মাদবরের অবদান ই বেশি।
তবুও তিনি এলাকার গুরুজন, গাঁয়ের মাথা। তাকে ছাড়া সব অচল। তিস্তার পাড় দিয়ে সে হাটছে। মাথার উপরে ছাতি ধরে আছে বিশ্বস্ত চামচা শামচু। কিরে শামচু অইডা কল্পনার বাপ রহিম সর্দার না? হ হুজুর হেইরম অইত লাগতাছে। ডাক অরে ডাক। শামচু জোরে ডাক দেয়। কি রহিম কই যাইতাছ? মাদবরসাব একটু বাজারে যাইতাছি। তোমারে ইদানিং দেহাই যায়না। সুদ আসলেতো ম্যালা টাহা জইমা গেল।
মাদবর সাব আপনে তো সবই জানেন। তিস্তায় পানি নাই, মাঠ ঘাট ফাইট্টা চৌচির. ক্ষেতে ফসল নাই কি করম কন? কিরে শামচু রহিম মিয়া এইডা কি কয় আমি কি দান বাকস খুইল্লা বইছি? হ হুজুর তো আর দান বাকস খুইল্লা বয় নাই ভালয় ভালয় সুদের টাহাডা দিয়া দেও। আসল ই দিতে পারিনা আবার সুদের টাহা দিম ক্যামনে? তয় কল্পনার লগে যদি হুজুরের একটা ব্যবস্থা...। শামচু তুই কি কইলি তরে আমি খুন করুম। ক্যান রহিম আমি কি খুবই বুড়া চুল কলব দিলেতো এহনো পঁচিশ বছরের যুবকগো লাহান দেহা যায়। মাদবর সাব আপনার শরম করেনা এইসব কতা কইতে? তোমার টাহা না দিতে পারলে শরম নাই আর আমি বিয়া করতে চাইলেই সমস্যা এইডা কোন ইনসাফের কতা অইল রহিম মিয়া? আপনের সব টাহা আমি শোধ কইরা দিমু দরকার অয় কিডনী বেচুম? অত তেজ ভালো না রহিম অত তেজ ভালোনা। রহিম দ্রুত বেগে তাদের সামনে থেকে সরে যায়। তিস্তার চর আজ লোকে লোকারণ্য। নারী পুরুষ বৃদ্ধ যুবা সবার একটাই দাবী তিস্তার বুকে পানি চাই।
এটা কোন সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন নয় কিংবা কোন বিশেষ গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় বসানোর আন্দোলন নয়। এটা অধিকার আদায়ের আন্দোলন, এই পৃথিবীতে টিকে থাকার আন্দোলন। সবার একটাই দাবী তিস্তায় পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামের এসব খেটে খাওয়া সহজ সরল মানুষগুলো রাজনীতি বুঝেনা তারা বুঝে দু বেলা
দুমুঠোখাবার সংস্থানের নিশ্চিয়তার সুযোগ। যদি কেউ এতে রাজনীতির গন্ধ খুঁজে তবে বলতে হবে এটাই আসল রাজনীতি কারণ রাজনীতির উদ্দেশ্যতো মানুষের কল্যাণ কোন বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সুবিধা আদায় নয়। স্লোগানে স্লোগানে পুরো তিস্তার
বুকে যেন নতুন জোয়ার এসেছে। কল্পনা আর সোলেমানকে ও সে মিছিলে দেখা যায়। তারা এসেছে তার স্বপ্ন যাত্রার
সহযোগী তিস্তা নদীকে রক্ষা করতে। স্লোগানের ফাঁকে সোলেমান কিছুটা সহানুভূতির সাথে কল্পনাকে শুধায়-তোমার মুখটা এমন শুকনা ক্যান? তিস্তার শুকনা বুক আমার মুখে লাগছে মাঝি। আমগো এই মিছিল কি তিস্তার বাঁধ ঢিলা করব মাঝি? হেইডা জানিনা হয়ত কোনদিন ই করব না, হয়ত তিস্তায় আর কোনদিন জল আইবনা তয় আমরা মইরা গেলে জানি কেউ কইতে না পারে তিস্তার দুঃ খ আমরা মূখ বুইজা সহ্য করছি। কে কি কইল না কইল হেইডাতে আমাগো কি আহে যায়?
কল্পনা এই যে আইজ আমরা স্লোগান দিতাছি এই স্লোগান বৃথা যাইবনা কল্পনা বৃথা যাইবনা। এই স্লোগানের প্রত্যেকটি কথা তিস্তার এই বালিতে, এই শক্ত মাটিতে, এই বাতাসে গাঁইথা থাকব। যুগ যুগ ধইরা তিস্তা পাড়ের মাইনষের জমানো ব্যাখার গান
গাইয়া যাইব। এই গান ই একদিন প্রচন্ড ঝড় তুইলা অই মরণ বাঁধ ভাইঙা দিব।সোলেমানের কন্ঠ দৃঢ়, চোখগুলো বোজা। সে যেন কোন সূদুর নীলিমায় হারিয়ে গেছে। কল্পনা সেই স্বপ্নিল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু ক্ষণের জন্য হারিয়ে ফেলে নিজেকে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তিস্তা পাড়ের বিক্ষুব্দ জনতা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সামনে এসে স্লোগান দিচ্ছে। তাদের উত্তাল স্লোগানের তীব্রতায় সবার মাঝে একটা আতংকজনক অবস্থা বিরাজ করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান কর্মকর্তা উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলায় সবাইকে নিয়ে মিটিংয়ে বসেছে। সিদ্ধান্ত
অনুযায়ী কয়েকজনকে পাঠানো হয়েছে জনগণকে বোঝাতে। উত্তাল জনতা স্বান্তনার বাণি শোনে আরো ক্ষেপে যায়। একজন
বলে উঠে- হুগনা কতায় চিড়া ভিজব না, তিস্তায় পানি কবে আইব হেইডা কন? এর উত্তর পানি উন্নয়ন বোর্ডের কারো জানা নেই। তারা নির্বাক কিন্তু তাদের নির্বাকে অবাক হয়ে জনতার বসে থাকার সময় নেই। উত্তাল জনতা জোর করে পানি উন্নয়ন
বোর্ডের ভিতরে ঢুকতে চায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের গাড়ি দেখা যায়। তারপর ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, টিয়ারসেল
বিনিময় ও ইট পাটকেল নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটে।
তিস্তা পাড়ের গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে বিরাজ করছে অজানা আতংক। সরকারী কাজে বাঁধা দেওয়ায় অজ্ঞাত সংখ্যক
লোককে আসামী করে মামলা করা হয়েছে। সে হিসেব বিচার করলে এ গ্রামের সবাই আসামী। পুরো গ্রাম প্রায় পুরুষ শুণ্য।
গ্রামের এ সহজ সরল মানুষ গুলো থানা পুলিশকে জমের মত ভয় পায় তাই প্রায় সবাই গাঁ ঢাকা দিয়েছে। রাতের গভীরতা বেড়ে গেছে। আকাশে মেঘ আছে। পূর্ণিমার চাঁদটা আলো আঁধারির মাঝে কিছুক্ষণ পর পর উঁকি দিচ্ছে। কল্পনার
চোখে ঘুম নেই। তার বাবা ভয়ে অন্য কোথায় ও চলে গেছে। একা বাড়িতে কল্পনার কিছুটা ভয় হচ্ছে। সে আকাশের
পানে তাকিয়ে আছে। আকাশের মেঘের ভাজে তবু চাঁদ মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে কিন্তু তিস্তা পাড়ের মানুষের ভাগ্যাকাশের চাঁদ উদিত হবার কোন সম্ভাবনা কল্পনা দেখতে পায়না। ভাগ্যের ময়ূর কন্ঠী নৌকা তিস্তার বালু চড়ে আটকে গেছে। কল্পনা এলাকার মাষ্টারের কাছে শোনেছে তিস্তার স্বাভাবিক পানি প্রবাহ তিন হাজার পাঁচশত কিউসেক কিন্তু বর্তমানে মাত্র চারশ
কিউসেক পানি পাওয়া যাচ্ছে। এ সমস্ত জটিল হিসাব কল্পনা বুঝে না তবে সে বুঝে তিস্তায় জল নাই। সারাদিন জাল ফেলে দশ
টাকার মাছ ও পাওয়া যায়না অথচ এক সময় তিস্তার মাছ নিয়ে এ অঞ্চলে কাড়াকাড়ি অবস্থার সৃষ্টি হত। এ সবই এখন
স্মৃতি। কল্পনা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে। হঠাত্ কারো চাপা কন্ঠ শোনা যায়। কল্পনা কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। কল্পনা ডরের কিছু নাই আমি মাঝি দরজাটা খোল। এত রাইতে, কি ব্যাপার মাঝি? আমি গ্রাম ছাইড়া পলাইতাছি. হুনলাম আমি নাকি এক নম্বর
আসামী। এইডা কি হুনাইলা মাঝি! বিদায় বেলায় তোমারে দেখতে মন চাইল তাই আইলাম। আমারে নেওন যায়না মাঝি? আমার যে নেওনের জায়গা নাই, একটা ভাঙা ঘর আছে হেইহানে অ তো থাকনের সুযোগ নাই আইজ। আমগো ভবিষতের কি অইব মাঝি? আমগো ভবিষত্ তিস্তার জলের লগে হুগায় গেছে কল্পনা হুগায় গেছে। মাঝি যদি তিস্তায় আবার জল আহে? মরা গাছে কহনো ফুল ফুডেনা কল্পনা ফুল ফুডেনা, আমি গেলাম. তুমি ভালো থাইকো? কল্পনা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে, আমি তোমার অপেক্ষায় থাকুম মাঝি, অপেক্ষায় থাকুম। কল্পনার কন্ঠ মাঝির কানে পৌঁছায় না। সে ততক্ষণে মেঘে ঢাকা চাঁদের
আড়ালে হারিয়ে গেছে।

বাংলাদেশকে বলা হয় ভাটির দেশ। প্রায় কয়েকশ নদী জালের মত সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। তাই আমরা নদী মাতৃক দেশ
হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। বাংলদেশে অভিন্ন আন্ত নদীর সংখ্যা ৫৭ টি। এর মধ্যে ৫৬ টি নদী সরাসরি ভারতের সাথে সর্ম্পকিত আরেকটি নদী হচ্ছে নাফ যেটি মায়ানমারের সাথে সর্ম্পকিত। ভারত চাচ্ছে তাদের দেশের সাথে সর্ম্পকিত
সবগুলো নদীতে বাঁধ দিতে যা আর্ন্তজাতিক নদী আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এ উদ্দেশ্যে তারা আন্তঃ নদী সংয়োগ প্রকল্প
নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যা তারা ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করছে। এটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের বিশাল অঞ্চল
স্থায়ী মরুভূমিতে পরিণত হবে এবং প্রায় তিনকোটি লোক জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে যাবে। যা এদেশের কৃষি ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ধংস করে দিবে, জীব বৈচিত্র, প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার
সুন্দরবন বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং উপকূলের বিশাল অঞ্চল লবনাক্ত পানিতে তলিয়ে যাবে ফলে ১ কোটি লোক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ অঞ্চলে ভূমিকম্পের প্রকোপ যেকোন সময়ের তুলনায় বেড়ে যাবে। মানুষের সামগ্রীক জীবন যাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সব মিলিয়ে পুরো বাংলাদেশ এক গভীর সংকটে পতিত হবে যা এক ধরনের মানবিকসংকটের সৃষ্টি করবে।
কল্পনা খুব ই দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে। তার বাবা রহিম সর্দার খুব অসুস্থ। তিস্তায় পানি নাই এ বছর ধান হয়নি বাধ্য হয়ে রহিম সর্দার ইটের খোলায় কাজ করতে গিয়েছিল। রহিম সর্দার মূলত একজন কৃষক। কৃষি কাজ ছাড়া অন্য কাজ সে জানেনা তাই ইট খোলার কাজ তার কাছে কঠিন ই মনে হয়েছে। কয়েকদিনের অমানুসিক পরিশ্রমে শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেছে সে।
কল্পনাকে আস্তে ডাকে সে। মা আমার বোধহয় যাওনের সময় অইয়্যা গেছে, কয়দিন ধইরা তোর মায়রে স্বপ্নে দেহি. হেয়
একটা পালকি নিয়া আহে আমারে পালকিতে উঠতে কয়। বাজান তুমি এইসব কি কও, তোমারে ছাড়া আমি ক্যামনে থাকুম।
রহিম সর্দার হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। আমারে মাফ কইরা দিস মা আমারে মাফ কইরা দিস। বাজান তুমি ভালো অইয়া যাইবা ভালো অইয়া যাইবা। নারে মা আমার যে ডাক আইছে, ঐ যে দেখ আসমান তন মেহমানরা আমারে নিতে আইছে দেখ
মা দেখ। কল্পনা ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠে। কান্দিসনা মা কান্দিসনা তরে আল্লায় দেখব আল্লায় দেখব। কল্পনার তা বাবার মাথার উপর মূখ গুঁজে কাঁদছে কিন্তু কোন সারা শব্দ পাচ্ছেনা। একটা সময় লক্ষ্য করে তার বাবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। কল্পনা প্রচন্ড চিত্কারে আছড়ে পরে। বাজান গো ও বাজান তুমি কতা কওনা কেন?বা...জা...ন...। তার চিত্কারতিস্তার দুই পাড়ের গরম বালুতে গিয়ে থেমে যায়।
সমাজে বয়ে যাওয়া ঘটনা প্রবাহের ও একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখা আছে। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে এটা যেমন বৈজ্ঞানিক
সূত্র দ্বারা প্রমানিত তেমনি সামাজিক বৈষম্য দ্বারা সৃষ্ট সামাজিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াগুলো ও বৈজ্ঞানিক সূত্র দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। একটি ন্যায় ভিত্তিক বা ইনসাফ পূর্ণ সমাজে কোন অপরাধ দানা বাঁধতে পারেনা। কিন্তু যখন সমাজের একটি স্তরের ভারসাম্য
বিনষ্ট হয় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে দেয়ালে পিষে মারার ব্যাবস্থা করা হয় তখন বাঁচার তাগিদেই তাদের ভিন্ন পন্থা গ্রহণ
করতে হয়। এটা যেমন শ্রীলংকার তামিল টাইগারদের বেলায় সত্য তেমনি সত্য সোমালিয়ার জল দস্যুদের বেলায়ও।
সোলেমান এখন একটা বড় ডাকাত দলের সর্দার। তার নাম সোলেমান ডাকু। কালাম ও তার সহযোগী। তিস্তার শুষ্ক বুক তাদের ডাকাতির পেশায় নামতে বাধ্য করেছে। যে হাত ব্যস্ত থাকত তিস্তার জলের মাছ ধরতে, যে হাতে ছিল বৈঠা সে হাত
আজ নিষিদ্ধ অস্ত্রে সজ্জিত। যে মন ছিল সহজ সরল সে মনে আজ নিষ্ঠুরতা খেলা করে যেখানে দয়া মায়ার কোন স্থান নেই।
সোলেমানের মাঝে মাঝে কল্পনার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে তিস্তার জল। জ্যোস্নাভেজা রাত। একটি ডিঙি নৌকা। নৌকার
মাঝে কল্পনা বসে আছে। জ্যোস্নার খানিকটা আলো তিস্তার ডাবের মত স্বচ্ছ জলে প্রতিবিম্ব হয়ে কল্পনার মুখে খেলা করছে। দূরে কোথায় ও ভাটিয়ালী সুর শোনা যাচ্ছে। কল্পনা হেসে বলে মাঝি ঐ আসমানের চান্দের আলো আর এই গান যদি কোনদিন শেষ না অইত। সোলেমান হেসে বলে আর এই ডিঙি নৌকা যদি এমনি কইরা সারাজীবন ভাইসা থাকত। তুমি চাইলেই ভাসব মাঝি। আমি তো চাই কিন্তু পাইতো না। পাইবা মাঝি পাইবা চাওয়ার মত চাও। কি যে কও কল্পনা. চাইতে কি আর কম
চাই। হঠাত্ কালামের ডাকে সোলেমানের ভাবনায় ছেদ পড়ে। সোলেমান শিগগির উঠ পুলিশ আইছে। কছ কি? হ হ
তাড়াতাডি কর দেরী করণের সময় নাই। সোলেমান তার দলবলসহ দৌড় মারে।ওদিকে পুলিশের বাঁশির তীব্র আওয়াজ
শোনা যায়।



কল্পনার চোখের সমস্ত কল্পনা আজ হারিয়ে গেছে। তার মনের অন্ধ গলিতে যে আল্পনা নিভৃতে সুর তোলত সে সুর আজ
পানসে হয়ে গেছে। পূর্ণিমার চাঁদ আজ ঝলসানো রুটি হয়ে বার বার তার কাছে ফিরে আসে। কল্পনা আজ মাদবরের বউ!
মাদবর কল্পনার বাবার বয়সী সেটা কোন ব্যাপার না বড় ব্যাপার কিছুটা নিরাপত্তা, দু বেলা দু মুঠো ভাতের নিশ্চিয়তা।
তিস্তার শুকনা বুকের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস নিলেতো আর কল্পনার পেটে খাবার জুটবেনা। খুব সংগত কারণেই তাকে বাস্তবমূখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছে। যারা প্রেমের বড় বড় সংজ্ঞা দেন তাদের সব সংজ্ঞাই একটি অসহায় নারীর অবস্থানের কাছে এসে থেমে যায়। যখন কল্পনার বাবা মারা গেল তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পাশে দাঁড়াতে কেউ
আসেনি, কেউ বলেনি আমরা আছি তোর চিন্তার কিছু নাই। এই বিশ্বসংসারের নিদারুণ ঘূর্ণিপাকে পোড় খাওয়া একটি নারীর
কাছে তখন ভাটিয়ালী গানের সুর কিংবা কবিতার ছন্দ ভালো লাগেনা সে তখন হাতের কাছের মরা খড় কুটা কে সবচেয়ে বড় গান মনে করে, সবচেয়ে বড় কবিতা মনে করে। মাদবর সাহেবের আরো তিনটি বিবি আছে তাদের সাথে কল্পনার
মানিয়ে নিতে কষ্ট হলেও সব জল্পনাকে ছুঁড়ে ফেলে তাকে হাসি মূখে সব মেনে নিতে হয়। কল্পনার মাঝে মাঝে সোলেমানের
কথা মনে পড়ে কিন্তু ভাবনাটাকে বেশি দূর আগাতে দেয়না সে। মাঝে মাঝে তিস্তার পানে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় সে। তিস্তা বুকে ধূ ধূ বালুর চর। যত দূর চোখ যায় খা খা শব্দের হাহাকার। কল্পনা কাঁদে। কল্পনায় ভেসে উঠে তিস্তার ভরা যৌবন, উচ্ছল গতিময় পানির স্রোত। বড় বড় ডিঙি নৌকাগুলি পাল তোলে স্রোতের টানে এগিয়ে যায়। মাঝিদের দারুণ ব্যাস্ততা দুই পাড়ে সবুজ ধানের সারি। কিন্তু পাশের গরুটির হাম্বা রবে কল্পনা বাস্তবে ফিরে আসে। হেসে বলে তিস্তারে আমার চোখেতো কানলে পানি হয়কিন্তু চোখেতো কান্দনেরপানিও নাই, কান্দনের পানিও নাই।

মাদবরের বাড়ি ডাকাত পড়েছে। প্রায় পনেরো বিশ জনের একটি গ্রুপ রাতের আঁধারে মাদবরের বাড়ি আক্রমন করেছে। সবার মূখ কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা। মাদবরকে বাড়ির উঠানে বাঁধা হয়েছে। ভয়ে তার মূখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছেনা।
শালারে গুলি কইরা মাইরা ফালা, শালার পেটেরতন সব সুদের টাহা বাইর কর। আমারে মা..ই..রে..ন না, আপনেরা যা চান হেইয়াই দিম। ব্যাটা কতা কম ক, ভন্ডামী অনেক করছস, আইজ তোর নিস্তার নাই। একজন বন্দুকের নলা দিয়ে তার
ভুড়িতে খোঁচা মারে। ব্যাথায় গুঙ্গিয়ে উঠে মাদবর। দলনেতা সবাইকে বাইরে দাঁড়াতে বলে ভিতরে এগিয়ে যায়।উদ্দেশ্য ঘরের মূল্যবান দ্রব্য সামগ্রী লুট করা। সে সদর দরজা দিয়ে সোজা ভিতরে ঢোকে পরে। হাতে টর্চ লাইট। লাইটের তীব্র আলোয়
পুরো ঘরটা আলোকিত হয়ে গেছে। কিছু নারী ও শিশু একপাশে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। দলনেতা সময় নষ্ট করেনা সে দ্রুত
সিন্ধুক খোলে টাকা পয়সা লুট করতে থাকে। একজন এগিয়ে এসে বলে- ওস্তাদ মাদবর হালায়তো বেশি জালাজালি করতাছে, দিমু নাকি ঠুস কইরা? বেশি জালাজালি করলেতো ঠুস ই করণ দরকার নাকি কছ? এমন সময় কেউ একজন দৌড়ে এসে দলনেতার পা দুটো জাপটে ধরে। আমার স্বামীরে মাফ কইরা দেন আমার স্বামীরে মাফ কইরা দেন। দলনেতা চমকে উঠে।
কল্পনা তুমি এইখানে! কল্পনাও চমকে উঠে। মাঝি তুমি! তুমি তাইলে ডাকাইতের সর্দার? হ কল্পনা আমি অহন
মাঝি না আমি সোলেমান ডাকু। কিন্তু এইডা কি কইলা? ঠিকই হুনছেন, আমি অহন মাদবরের বউ। সোলেমানের বুকের ভিতরটা যেন মোচড় দিয়ে উঠে, বেদনায় চোখে কোণে জমে উঠছে বিন্দুবিন্দু জল।
মাঝির বৈঠা রাইখা ডাকাতির পেশায় নামছ লজ্জা করেনা তোমার? লজ্জা শরম সব তিস্তার পানির লগে হুগায় গেছে কল্পনা হুগায় গেছে। তুমি আইজ মাদবরের বউ তোমারতো একটা ঠিকানা আছে কিন্তু আমার কোন ঠিকানা নাই, আমি ছন্ন ছাড়া, এতিম। চুরি ডাকাতি বাদ দিয়া একটা ঠিকানা কইরা লও মাঝি। তোমার লগে দেহা অওনের আগ পর্যন্ত ইচ্ছাডা ছিল, ইচ্ছা ছিল একটা নতুন ঘর বান্ধনের, মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেহি তিস্তায় জল আইছে, একটা বড় ডিঙি নৌকায় কইরা আমি আর তুমি হেই নায় ঘুরতাছি। মিথ্যা স্বপ্ন দেইখনা মাঝি, তোমার স্বপ্ন আর আমার স্বপ্ন এখন এক না, তোমার পথ আর আমার পথ এখন আলাদা, আমার স্বপ্নের বুকে অহন তিস্তার বালি চর। কল্পনা আবার নতুন কইরা সব শুরু করণ যায়না? তা আর অয়না মাঝি তা আর অয়না। ওস্তাদ পুলিশ পুরো বাড়ি ঘিরিয়া ফালাইছে, পালানের সুযোগ নাই, ধরা মনে দিতেই অইব। কল্পনা যাই তাইলে, ধরা পড়লে কপালে কি আছে জানিনা তয় তুমি ভালো আছ এইডাই আমার স্বান্তনা এইডায়ই স্বান্তনা। সোলেমানকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। মাদবর বলে - কুত্তার বাচ্চার উচিত বিচার অইছে। কিন্তু কল্পনার স্বপ্নে জমেছে আরো কিছু বালুচর। সে বালুচর ভেদ করে আবার পানি আসবে কিনা তা কল্পনার জানা নেই।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮৯৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২১/০৪/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • গল্পের প্রেক্ষাপট দারুণ। কিছু স্বগতোক্তিও আকর্ষনীয় যেমন -
    আমগো ভবিষত্ তিস্তার জলের লগে হুগায় গেছে কল্পনা হুগায় গেছে।
  • বিজয় রায় ২৭/১০/২০১৪
    বাপরে বাপরে পড়তে পড়তেই হেঁপে উঠলাম তবে পুরোটাই পড়তে পাড়িনি কিছুটা পড়লাম বেশ লাগল
  • জয়শ্রী রায় ২৭/০৫/২০১৪
    লেখাটা অনেক বড় । প্রথম দিকটা মনোযোগ দিয়ে পড়লাম । বাকিটা একটু তাড়াতাড়ি শেষ করতে হল । আপনার এই লেখাটিকে আমি একাধারে আর্থ সামাজিক গল্পও বলব আবার অন্যদিকে আর্থ সামাজিক প্রবন্ধও বলব । যাই হোক দুঃখ পেলেও আমি এখানে একটা কথা বলব আপনি কি আপনার ক্ষতি স্বীকার করে আমার উপকার করবেন ? প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সুবিধাটা দেখে । তবুও পৃথিবীতে থাকতে গেলে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং-এ আসতে হয় । দেখা যাক এর উত্তর ভবিষ্যৎ দিতে পারে কিনা । ভাল থাকুন আর শুধু গল্পে মন দিন । আপনার প্রতি রইল শুভেচ্ছা ।
  • কবি মোঃ ইকবাল ১১/০৫/২০১৪
    অনেক বড় গল্প, তাই পড়তে একটু সময় লেগেছে।
    ভালো লেগেছে।
 
Quantcast