www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

শুভ রথযাত্রা - সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে।

সামগ্রিক বিচারে রথযাত্রা হলো সমাজের সামনের দিকে এগিয়ে চলার প্রতীক। সামাজিক ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা ও দায়-দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সমাজের কোনো অংশকে অপাঙ্ক্তেয় করলে, অচ্ছুত-অন্ত্যজ বলে দূরে সরিয়ে রাখলে সমাজের সামনের দিকে এগিয়ে চলার গতিও রুদ্ধ হয়ে পড়ে, সমাজ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সমাজ তার ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়। পক্ষান্তরে সমাজের উচ্চ-নীচ, ধনী-গরীব, নারী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ যদি নিশ্চিত হয়, তবেই সমাজ সামনে এগিয়ে চলে। এক কথায়, রথযাত্রা মানুষের মধ্যে একক গোষ্ঠীভাব জাগায়, সমাজের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মানুষকে সমষ্টিগতভাবে বাঁচতে উদ্বুদ্ধ করে। এই হলো রথযাত্রার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য।


বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে নিউইয়র্ক, বার্মিংহাম, ডাবলিন, বুদাপেস্ট, মেলবোর্ন, মন্ট্রিল, প্যারিস, সিঙ্গাপুর, টরেন্টো, কুয়ালালামপুর, ভেনিস প্রভৃতি শতাধিক শহরেও রথযাত্রা উদযাপিত হচ্ছে।
রথযাত্রা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব। ভারতীয় অনার্য জাতির আদি উত্সব বলেই এর প্রচলন ছিল। বৈদিক সমাজে প্রথমে এ জাতীয় কোন উৎসবের প্রচলন ছিল না। স্নানযাত্রা, দোলযাত্রা, রথযাত্রা প্রভৃতি উৎসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল সমাজের অভিজাত শ্রেণীর ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধরা। সম্রাট অশোক এসবের বিরুদ্ধে অনুশাসনও জারি করেছিলেন। কিন্তু কোন অনুশাসনই লৌকিক ধর্মের এ প্রবাহকে প্রতিহত করতে পারেনি।
গ্রিক, মিসরীয় ও ভারতীয় সভ্যতায় সপ্তাশ্ববাহী সূর্য প্রধান দেবতা এবং অন্যান্য দেবতা তারই রূপান্তর। প্রাচীন হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্র মতে, পৃথিবী সূর্যের প্রদক্ষিণের সূত্রই রথযাত্রা এবং এই রথযাত্রাই নববর্ষের ইঙ্গিত বহন করে।
ফা-হিয়েনের ভ্রমণ-বৃত্তান্তে বৈশাখী পূর্ণিমায় রথযাত্রার কথা পাওয়া যায়। নটরাজ শিবের মূর্তি নিয়ে কর্ণাটকে রথ ভ্রমণে প্রথা আছে পৌষালী পূর্ণিমার চারদিন আগে।বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন দেবদেবীর রথযাত্রার উল্লেখ আছে, যেমন: ভবিষ্যপুরাণে সূর্যদেবের রথযাত্রা, দেবীপুরাণে মহাদেবীর রথযাত্রা, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ ও ভবিষ্যোত্তরপুরাণে বিষ্ণুর রথাযাত্রা বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্ন দেবদেবীর রথযাত্রার সময়কালও বিভিন্ন; কোথাও বৈশাখ মাসে, কোথাও আষাঢ় মাসে, আবার কোথাও কার্তিক মাসে রথযাত্রার অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। তবে ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের সর্বত্র রথারোহী দেবতা হলেন প্রভু জগন্নাথ, সঙ্গে বৈমাত্রেয় ভাইবোন বলরাম ও সুভদ্রা।
ভাগবতে বলা হয়েছে-


অথ-একদা দ্বারবত্যাং বসতোঃ রামকৃষ্ণয়োঃ।


সূর্য-উপরাগঃ সুমহান-আসীৎ কল্পক্ষয়ে যথা ॥


তং জ্ঞাত্বা মনুজা রাজন্‌ পুরস্তাৎ-এব সর্বতঃ।


স্যমন্ত-পঞ্চকং ক্ষেত্রং যযুঃ শ্রেয়ঃ-বিধিৎসয়া ॥


(ভাঃ ১০/৮১/১-২)


কোন এক সময়ে, বলরাম ও কৃষ্ণ যখন দ্বারাকায় বাস করছিলেন, তখন এক মহান সূর্যগ্রহণ হয়েছিল, যা সাধারণত কল্পক্ষয়ের সময় সংঘটিত হয়ে থাকে। পূর্ব হতে এই গ্রহণের কথা অবগত হয়ে, হে রাজন্‌! পুণ্য অর্জনের জন্য ভারতবর্ষের সকল স্থান হতে বহু মনুষ্য স্যমন্তক-পঞ্চক নামক পবিত্র স্থানে গমাগত হয়েছিলেন- ‘মহত্যাং তীর্থযাত্রায়াং তত্র-আগন্‌ ভারতী প্রজাঃ’ (ভাঃ ১০/৮১/৫)।
সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে শ্রীকৃষ্ণ যখন কুরুক্ষেত্রে যান, তখন তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরাম ও ভগিনী সুভদ্রা এবং দ্বারকা থেকে অনেকেই তার সাথে গিয়েছিলেন। সেই সময় ব্রজবাসীও সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে কুরুক্ষেত্রে গিয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্রে বৃন্দাবনের গোপ-গোপীদের সাথে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ হলো। তখন ভগবান বললেন, হে প্রিয় সখীগণ, তোমরা কি এখনও আমাকে স্মরণ কর? আমার আত্মীয়বর্গের জন্য, আমার শত্রুদের বিনাশ করার দৃঢ়সঙ্কল্প নিয়ে আমি দীর্ঘদিন দূরে অবস্থান করছিলাম। তোমরা কি সম্ভবত মনে করছ যে, আমি অকৃতজ্ঞ এবং তাই আমাকে অবজ্ঞা করছ? বস্তুত ভগবানই জীবকে একত্রিত করেন এবং তারপর তাদের বিচ্ছিন্ন করেন। ঠিক যেমন বায়ু মেঘরাশি, তৃণ, তুলা এবং ধূলিকণাকে পুনরায় ছড়িয়ে দেবার জন্যই একত্রিত করে, ঠিক তেমনি স্রষ্টাও তাঁর সৃষ্ট জীবের সঙ্গে একইভাবে আচরণ করেন। আমার প্রতি ভক্তির দ্বারাই জীব অমরত্বের যোগ্যতা লাভ করে। কিন্তু তোমাদের সৌভাগ্য দ্বারা তোমরা আমার প্রতি এক বিশেষ প্রেমময়ী মনোভাব লাভ করার ফলে আমাকে প্রাপ্ত হয়েছ। হে রমণীরা, ঠিক যেমন মাটি, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ সকল ভৌতিক পদার্থের আদি ও অন্ত এবং তাদের ভিতর ও বাহির উভয় ক্ষেত্রেই বর্তমান। এইভাবে আত্মাসমূহ যখন তাদের আপন স্বরূপে অবস্থান করে, সকল সৃষ্ট বস্তু সষ্টির মূল উপাদানসমূহের মধ্যে বাস করে। জড় সৃষ্টি ও আত্মা উভয়েই অবিনশ্বর পরম ব্রহ্ম আমার থেকে প্রকাশিত হয়, তোমরা তা দর্শন কর। এইভাবে কৃষ্ণ কর্তৃক পারমার্থিক বিষয়ে শিক্ষিত হয়ে তাঁর প্রতি তাঁদের নিরন্তর ধ্যানের ফলে মিথ্যা অহঙ্কারের সকল চিহ্ন থেকে গোপীগণ মুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর প্রতি তাঁদের নিমগ্নতা দ্বারা তাঁরা তাঁকে পূর্ণরূপে হুদয়ঙ্গম করলেন। তখন ব্রজবাসী ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তার বাল্যলীলাস্থল বৃন্দাবনে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। তারা তাকে রাজবেশে দেখতে চাইলেন না। তারা শ্রীকৃষ্ণকে বৃন্দাবনে ফিরিয়ে নিয়ে ব্রজের বেশে দেখতে চাইলেন এবং তার সাহচর্য পেতে উন্মুখ হলেন। তখন ব্রজবাসী কৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রা দেবীর রথের ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে নিজেরাই রথ টানতে টানতে বৃন্দাবনে নিয়ে গিয়েছিলেন।


অনুসারীগণ অবতারবাদে বিশ্বাসী। তারা বিশ্বাস করেন, ‘যখন যখনই ধর্মে গ্লানি উপস্থিত হয়, চারদিকে অধর্মের উত্থান ঘটে; তখনই দুষ্টের দমনে, শিষ্টের পালন ও ধর্ম সংস্থাপনের জন্য ভগবান স্বয়ং যুগে যুগে অবতাররূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হন।’ (গীতা ৪/৭-৮) মহাভারতে বর্ণিত ১৮ দিনব্যাপী কুরু-পাণ্ডবের রক্তঝরা যুদ্ধ শেষে যুধিষ্ঠিরের হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনে আরোহণের পর, শ্রীকৃষ্ণের ধরাধামে আবির্ভূত হওয়ার আপাতত উদ্দেশ্য সাধিত হওয়ায়, মনুষ্যগুণাবলি সম্পন্ন শ্রীকৃষ্ণ তার ইহলৌকিক দেহ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।


একদিন শ্রীকৃষ্ণ একটি গাছের ডালে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। জরা নামক এক শিকারি ব্যাধ দূর থেকে শ্রীকৃষ্ণের লাল পা দু’টি দেখে, লাল পাখি ভ্রমে, তা শরবিদ্ধ করলে শ্রীকৃষ্ণ ডাল থেকে নিচে মাটিতে পড়ে যান। আহত শ্রীকৃষ্ণকে দেখে জরাব্যাধ হায় হায় রবে চিৎকার করতে থাকেন। শ্রীকৃষ্ণ তাকে আশ্বস্ত করে বলেন যে, এই ঘটনা পূর্ব নির্ধারিত। পূর্বের এক জনমের তাদের উভয়ের কর্মফলের কারণেই, তার (শ্রীকৃষ্ণের) জরাব্যাধের হাতে দেহ ত্যাগের ঘটনা ঘটছে। তথাপি, জরাব্যাধ বারবার অনুশোচনাপূর্বক কৃষ্ণভজনের অনুমতি প্রার্থনা করলে শ্রীকৃষ্ণ জরাব্যাধকে বলেন যে, সে যেন প্রথমে দক্ষিণে গিয়ে পরে পূর্বদিকে সমুদ্র উপক‚ল ধরে হেঁটে যায়; এভাবে গিয়ে যেখানে সমুদ্রের জলে সে (জরাব্যাধ) তার (শ্রীকৃষ্ণের) চিতার কাঠ ভেসে যেতে দেখবে, সেখানে সেই কাঠ সংগ্রহ ও প্রতিষ্ঠাপূর্বক সে যেন আরাধনার ব্যবস্থা করে। এরপর শ্রীকৃষ্ণ তার লৌকিক দেহ ত্যাগ করেন।


অতঃপর অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের মরদেহ সৎকারের জন্য দ্বারকায় না পাঠিয়ে সমুদ্র উপকুলে দাহ করার মানসে চিতায় উঠিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করেন। জরাব্যাধ শ্রীকৃষ্ণের আদেশনুসারে সমুদ্র উপকূল ধরে হাঁটতে হাঁটতে পুরীতে এসে পৌঁছেন। এদিকে জ্বলন্ত চিতায় মরদেহ সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হওয়ার পূর্বেই সমুদ্রের এক প্রচণ্ড ঢেউয়ের আঘাতে চিতার আগুন নিভে যায়। কিছু দেহাবশেষসহ চিতার কাঠ সমুদ্রের জলে ভেসে যেতে থাকে। জরাব্যাধ পুরীর কাছে সমুদ্রের জল থেকে শ্রীকৃষ্ণের দেহাবশেষসহ সেই কাঠ সংগ্রহ করে গভীর অরণ্যে সেইগুলো স্থাপনপূর্বক দারুব্রহ্ম বা জগন্নাথরূপে আরাধনা করতে থাকেন। এই জরাব্যাধই ছিলেন অরণ্যচারী শবরদের রাজা বিশ্ববসু। দেশের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের অনুরোধে বিশ্ববসু তদকর্তৃক সংগৃহীত চিতার কাঠ (শ্রীকৃষ্ণের দেহাবশেষসহ) রাজাকে দান করেন। রাজার দেব কারিগরের রূপ ধারণ করে সয়ং বিশ্বকর্মা সেই কাঠ দ্বারা মূর্তি নির্মাণের ভার গ্রহণ করেন এই শর্তে যে, মূর্তি নির্মাণকালে কেউ তাকে বিরক্ত করতে পারবে না। অনেকদিন চলে যায়, বদ্ধ নির্মাণশালা থেকে মূর্তি নির্মাণের সাড়াশব্দ না পেয়ে অধৈর্য রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন দরজা ভেঙে নির্মাণশালায় প্রবেশ করেন। মূর্তি নির্মাণে এরূপ অনাকাক্সিক্ষত, বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ায় বিশ্বাকর্মা মূর্তি নির্মাণ অসমাপ্ত (তখন পর্যন্ত মূর্তির হাত-পা-চোখ নির্মিত হয়নি) রেখেই স্থান ত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে ব্রহ্মার আদেশে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ওই অর্ধনির্মিত মূর্তির মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের অস্থি স্থাপন করে মূর্তিতে চক্ষু, দৃষ্টি এবং প্রাণের সংস্থানপূর্বক তা আরাধনার ব্যবস্থা করেন। এই মূর্তিগুলো হলো জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রা। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের পরিবর্তিত রূপই হলো প্রভু জগন্নাথ।
কিংবদন্তী অনুসারে বলা হয়— আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম রথে চড়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুণ্ডিচার বাড়ি যান (সেটাকে বলা হয় জগন্নাথের ‘মাসির বাড়ি’) এবং সাত দিন পরে সেখান থেকে আবার নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন। স্থানীয় ভাবে এটি মাসির বাড়ি যাওয়া নামে পরিচিত! রথে চড়ে ওই গমন ও প্রত্যাগমনকে (সোজা)রথ ও উল্টোরথ বলা হয়। ‘রথযাত্রা’ আবার পতিতপাবনযাত্রা, নবযাত্রা, গুণ্ডিচাযাত্রা, মহাবেদীযাত্রা, নন্দীঘোষযাত্রা নামেও পরিচিত।
রথযাত্রায় তিন বিগ্রহের জন্য তৈরি হয় তিনটি পৃথক রথ। জগন্নাথের রথের নাম ‘নন্দীঘোষ’। এছাড়াও ওই রথকে চক্রধ্বজ বা গরুড়ধ্বজও বলা হয়। জগন্নাথের রথ নন্দীঘোষ-এর উচ্চতা ৪৫ ফুট। এতে থাকে ১৮টি চাকা, প্রতিটির ব্যস ৭ ফুট। পুরো রথটি লাল-হলুদ কাপড়ে মোড়া হয়। পীত বা হলুদ রঙের কাপড় কৃষ্ণের খুব পছন্দ বলে কৃষ্ণের অন্য নাম পীতাম্বর। এবং জগন্নাথ কৃষ্ণের এক রূপ বলে জগন্নাথের রথ মোড়া হয় লাল ও হলুদ কাপড় দিয়ে। শীর্ষে তালগাছের নিশান ওড়ে তাই বলরামের রথের নাম তালধ্বজ। এর উচ্চতা ৪৪ ফুট। এতে আছে ১৬ টি চাকা, প্রতিটির ব্যস ৭ ফুট। এই রথ লাল-নীল কাপড়ে মোড়া থাকে। সুভদ্রার রথের নাম দর্পদলন। এর অর্থ হল অহংকে বধ করা। এই রথের উচ্চতা ৪৩ফুট, এতে আছে ১৪টি চাকা, যার প্রতিটির ব্যস ৭ফুট। ওই রথটি লাল-কালো কাপড়ে মোড়া থাকে। কালো শক্তি তথা দেবীমাতৃকার প্রতীক তাই ওই রং। রথের দিন প্রতিটি রথকে পঞ্চাশ গজ দড়িতে বেঁধে আলাদা আলাদা ভাবে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় গুণ্ডিচাবাড়ি। সেখানে সাত দিন বিগ্রহ তিনটি থাকে আবার উল্টোরথের দিন একই ভাবে রথে তুলে মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়।


অনেকের ধারণা- আদিতে জগন্নাথ তথা নীলমাধব ছিলেন নিম্ন বর্ণের প্রাচীন কোনো জাতি-গোষ্ঠীর, সম্ভবত অরণ্যচারী শবর জাতি-গোষ্ঠীর উপাস্য দেবতা- যারা আদিম সংস্কার ও ঐতিহ্যবশতই বিশ্বাস করতেন, ‘মৃতের অস্থি পুনঃসংযোজন করে নতুন কলেবরে গড়ে তাতে প্রাণ সঞ্চার করা যায় এবং কাঠের মূর্তির মধ্যে বৃক্ষপ্রাণ সঞ্চারিত হয়- আর রথযাত্রা ছিল কৃষির উর্বরতা তন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত এক ধরনের সার্বজনীন আনন্দোৎস; যেখানে ধনী-গরিব, উচ্চ-নীচ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অবাধ মেলামেশায় মেতে উঠতেন। কারণস্বরূপ বলা যায়, প্রথমত, এটি অনুষ্ঠিত হয় আষাঢ় মাসে, অর্থাৎ বর্ষাকালে, দ্বিতীয়ত, কৃষ্ণ ছিলেন গো-পালক এবং বলরাম ছিলেন হলধর, অর্থাৎ যিনি হল দ্বারা জমি চাষ করেন। কালক্রমে হিন্দুধর্মের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতায় নিজস্ব ঐতিহ্য উচ্চ-বর্ণের হিন্দুরা জগন্নাথ তথা নীলমাধব দেবতাকে আত্মস্থ করে নিজেদের দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। এরূপ গ্রহণের পর শুরুতে ব্রাহ্মণ-শাসিত সমাজে, শুধুমাত্র উচ্চ-বর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে রথযাত্রা সীমাবদ্ধ রাখা হয়। আর আদিতে নীলমাধব দেবতা যাদের উপাস্য দেবতা ছিলেন, সেই নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের অচ্ছুৎ অন্ত্যজ বলে রথের রশি ধরার অধিকার থেকে তাদের দীর্ঘদিন বঞ্চিত করে রাখা হয়। ষোড়শ শতকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের ফলে পুরীর রথযাত্রা এক নতুন মাত্রা লাভ করে। কথিত আছে, পুরীতে একবার রথযাত্রা উপলক্ষে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ রথে আরোহণ করিয়ে রথ যাত্রার জন্য প্রস্তুত। উচ্চ-ধমীয় হিন্দু নরনারী, রাজ-কর্মচারীবৃন্দ রথের রশি ধরে সর্বশক্তি প্রয়োগে টানছেন কিন্তু রথের চাকা অনড়। খবর পেয়ে দেশের রাজা প্রতাপ রুদ্র সপরিষদ এসে রথের রশি ধরে আকর্ষণ করতে লাগলেন; তথাপি রথের চাকা স্থির, নিশ্চল। তখন মহাপ্রভু বললেন- যে শবর বা নিম্ন বর্ণের মানুষদের তোমরা অচ্ছুত-অন্ত্যজ বলে দূরে সরিয়ে রেখেছ, তাদের রথের রশি ধরার সুযোগ দাও, তোমাদের শক্তির সঙ্গে ওদের শক্তিও যোগ কর তাহলেই রথ তার গতি ফিরে পাবে। অনেক টালবাহানার পর সমাজে পিছিয়ে থাকা অচ্ছুৎ অন্ত্যজদের রথের রশি ধরার অনুমতি মিলল। সমাজের অন্য সবার শক্তির সঙ্গে যে মুহ‚র্তে যোগ হলো তথাকথিত অন্ত্যজদের শক্তি- সবাইকে অবাক করে দেবতার রথের চাকা তখনই সশব্দে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। এত কিছুর পর, বাংলাদেশসহ বিশাল ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র রথযাত্রাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে সমাজের উচ্চবর্গীয় ও অচ্ছুৎ-অন্ত্যজ ব্যক্তিবর্গের অর্থাৎ সবার সমঅধিকার এখনো তেমন বলিষ্ঠভাবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। অনেক স্থানেই অচ্ছুৎ-অন্ত্যজদের ধর্মীয় সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে এখনো মাঝে মাঝেই আইন আদালতের আশ্রয় নিতে হয়।


শ্রী নারদপুরাণে বর্ণিত হয়েছে ‘রথে চ বামন দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে’ অর্থাৎ রথারূঢ় ভগবানকে শুধু দর্শনের মাধ্যমে জন্ম-মৃত্যুর চক্র অতিক্রম করা যায়। ভগবান শ্রী জগন্নাথ এতোই উদার যে তিনি ভক্তাভক্ত নির্বিচারে সকলকে কৃপা করতে স্বয়ং রাজপথে নাম-রূপ-গুণ কীর্তন করতে পারেন, মহাপ্রসাদ সেবনের সুযোগ পায় ভক্তগন। এই ভগবদসেবা ব্যক্তির হৃদয়ের জড় কলুষ দূরীভূত করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তার চিত্তকে আকৃষ্ট করে।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৮০৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৪/০৭/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast