www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

বাবা আমার বাবা

আমি ভোরের স্বপ্নে দেখেছি তোমারে...
বৃষ্টিস্নাত স্নিগ্ধ সকাল। সবদিকে সুনসান নীরবতা । শান্তির নির্মল পরশ বয়ে যাচ্ছে যেনো চারিদিকে । ঘাসে জমে থাকা বৃষ্টির শুভ্র কণা মনে হচ্ছে এক একটি শিশির বিন্দু । ঝাউবনের সারি সারি বৃক্ষরাজির শাখা রাস্তার দু’ধারে নূয়ে আছে । বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ছে গাছের শাখা বেয়ে, কালো পীচের রাস্তা ভেজাভেজা। আমরা দু’জন হাঁটছি । আমার বাম হাত বাবার ডান করতলে লুকিয়ে রেখে ধরাধরি করে হেঁটে চলেছি । বাবার কন্ঠে ছোটবেলায় শোনা সেই জারি গান- “আয়রে সবুজ কিশোরগণ/ সবাই মিলে করি পণ/ দেশ মায়েরে গড়তে হবে/ রাখতে দেশের মান।” হঠাৎ কি হলো জানি না । বুঝে ওঠার আগে বাবা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে হেঁটে চলেছেন। আমি নির্বাক নিষ্পলক নেত্রে স্থির হয়ে আছি। আমার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। অঝোর ধারায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। কিন্তু কোঁকড়া সাদা কালো চুলের বাবার কোন অনুভুতি নেই। সেই স্বভাব সুলভ ভঙ্গিমায় ভারী চশমার ফাঁকে ফাঁকে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।ঠিক ১৯৮৬ সালের মতো (সেদিন আমরা ৫ ভাইবোন অনেক কেঁদেছি কিন্তু বাবা সাড়া দেয়নি; ছোট ভাইয়ের বয়স ২ বছর হওয়ায় সে বিষয়টি বুঝতেই পারেনি)। আমি কেঁদে কেঁদে বাবার হেঁটে যাওয়া পদ যুগলের চিহ্নগুলোতে উপুড় হয়ে চুমো দিচ্ছি । আর আমার অশ্রু ধারা বৃষ্টিভেজা সেই রাস্তায় মিলিয়ে যাচ্ছে। পূর্বদিকে ঊষার প্রথম আলোর মিষ্টি আভা উঁকি দিচ্ছে। বাবা আমার শান্ত সৌম্য পথিকের মতো দৃঢ় পদভারে চলে যাচ্ছেন। ধীরে ধীরে বাবা আমার দৃষ্টি সীমানা ছাড়িয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। ক্ষীণ থেকে ক্ষীনতর হয়ে আর চোখের দেখা পেলাম না। আমি হু হু করে কেঁদে চলেছি। হঠাৎ কেন জানি ঘুম ভেঙে গেল, চোখের নোনা জলে বালিশ ভিজে গেছে। ঘুমভাঙা ভোরে বিছানায় বসে সেকি কান্না! আমার প্রাণপ্রিয় বাবাকে দেখলাম ভোরের স্বপ্নে ...। কিছু রাত জাগা পাখি উড়ে যাচ্ছে দূরের নীল সীমান্তে । আর্তনাদ ব্যথাজর্জর বুকভরা নীল বেদনাকে সাথী করে আমার দিনটি শুরু হলো বুকভাঙা বেদনায়।

আমার বাবা আমার অহংকার...
তিনি যেন এক বিশাল বিটপি। শান্ত শ্যামল ছায়াপ্রদায়ী দয়াল বৃক্ষ । যাঁর সান্নিধ্যে সীমাহীন সুখ। ভয়হীন নির্মল নির্মোহ প্রাণ। তিনি স্নেহ পরায়ণ দায়িত্বশীল পিতা, সুহৃদ বন্ধুবৎসল ভ্রাতা, প্রেমময় স্বামী। সমাজ কল্যাণে তাঁর আত্মনিবেদন বা আত্ম্যোৎসর্গ থাকার তৃপ্তি সে এক অভিনব অনুকরণীয়। আজও মানুষের মুখে যখন বাবার প্রশংসা শুনি তখন গর্বে বুকটা ভরে উঠে। মুখ থেকে অস্পুষ্ট স্বরে বেরিয়ে আসে- বাবা, আমার বা..বা.. কেন তুমি এত আগে চলে গেলে , ওরাতো বলে তোমার আরও থাকা দরকার ছিল।” এই না থাকার শূন্যতা, ব্যথাদীর্ণ দিনগুলোর হাহাকার আমি তাঁর প্রিয় সন্তান হিসেবে আমৃত্যু আমাকে গভীর ভাবে দহন করবে। অনুভবে-অনুক্ষণে শত শত সুখদ স্মৃতি আলোড়ন তোলে হৃদয়ে।
স্মৃতির বীনায় আজও বাজে হায় কাগজের টাকা ...
হাজারো মধুময় স্মৃতি ভিড় করছে মনের মণিকোটায়। স্মৃতির বীণায় বেজে চলছে বেহাগের করুণ সুর। বেদনার কালো মেঘ ঢেকে যাচ্ছে আমার হৃদয়।কিছু স্মৃতি বাজছে মনের বীণায়। বাবা ছিলেন স্কুল মাস্টার। আমাদের গ্রামের সরকারী প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বাবা স্কুলে যাওয়ার সময় আমাকে নিয়ে যেতেন। বড় চার বোনের পর আমি ছিলাম বলে আদর একটু বেশীই পেতাম। স্কুলের সামনে একটি দোকানে প্রতিদিন বিভিন্ন জিনিস খেতাম। বাবা আমাকে একটি কাগজ দিয়ে দিতেন। আহসান ভাইয়ার দোকানে কাগজটা দিলেই জিনিস দিয়ে দিতো। কখনই কোন টাকা লাগতো না । আমি বাড়িতে এসে আম্মার সাথে গল্প করতাম দোকানে আমি কাগজ দিলেই আমাকে বিভিন্ন খাওয়ার জিনিস দিয়ে দেয় ।স্কুলে বাবার চেয়ার বসে থাকতাম, বিভিন্ন জিনিস খেতাম। এভাবেই কাটছিল সময় ।আবছা আবছা যতটুকু মনে পড়ে,বাবা আমাকে কখনো বকেন নি!হয়তোবা বকা খাওয়ার বয়স হয়নি তখন। মাঝে মাঝে বাবাকে খুব মিস করি, খু-উ-ব । ভাবতেই কেমন লাগে বলুন তো? পিতৃহারা সন্তানরাই বুঝতে পারবে আমার অনুভূতি ,আমার হৃদয়ের ছোট্ট একটা কুঠুরে দীর্ঘ ৩০ টি বছর ধরে জমে থাকা ব্যাথা ,দুঃখের এক বুক ফাঁটা আর্তনাদ । আজ আমি এক ছেলের বাবা । আমার ছোট্ট রাফিদ সোনা যখন আমাকে বাবা বাবা বলে ডাকে তখন মাঝে মাঝে মনটা উদাস হয়ে যায়। চোখের কোণায় মনের অজান্তেই জমা হয় কয়েক ফোঁটা অশ্রু। তখন বাবাকে খুব মনে পড়ে । ছেলেকে নিয়ে চলে যাই বাবার কবরের পাশে ।কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বাবা, কেমন আছো বাবা ?

ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে...
বৈপরিত্য, বিরুদ্ধ বাতাসে জীবন মাঝে মাঝে নাভিশ্বাস হয়ে ওঠে। অর্থহীন অনর্থক কলহ বিবাদে জর্জরিত হতে হতে খুঁজে ফিরি অতি নীল আকাশের স্বাদ এমন দুর্দিনে বাবার স্নেহময় পুণ্যপরশ বিশাল বিটপির শ্যামল ছায়া বড় বেশি প্রয়োজন।কবিতার ভাষায়- “...আর কোন যুদ্ধ নয়, শত্রুতার হোক অবসান/জন্ম জরা ব্যাধি মৃত্যু চির দুঃখ বিভীষিকা মাঝে/অপ্রিয় সংযোগ আর প্রিয়ের বিয়োগ ব্যথায়/ক্ষুব্ধ হই বারংবার খুঁজে ফিরি শান্তির সন্ধান..”। বাবা ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে আমাকে বুলিয়ে দাও স্নেহের পরশ।

বাবা স্পর্শ করেছি তোমারে...
বাবার স্মৃতি হিসেবে কিছুই নেই শুধু একটি চশমা ছাড়া। চশমাটাকে সযতনে রাখা অছে শো কেসে। মাঝে মাঝে চশমাটোকে ছুঁয়ে দেখি।।চশমাটাকে ছুঁয়ে দেখার মাঝে আলাদা একটা ভাল লাগা কাজ করে। মনে হয় বহু বছর পরেও আজ বাবাকে স্পর্শ করছি । বাবার স্পর্শ পাই কিন্তু আদর পাই না। নগর বাউল জেমসের মত চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে - ‘বাবা কতদিন কতদিন দেখি না তোমায়/ কেউ বলে না তোমার মতো/ কোথায় খোকা ওরে বুকে আয়/বাবা কত রাত, কত রাত দেখি না তোমায়/ কেউ বলে না মানিক কোথায় আমার/ ওরে বুকে আয়..’ ।
ভাল থেকো বাবা, ভাল থেকো.......।
বিষয়শ্রেণী: অন্যান্য
ব্লগটি ৯৮৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৭/০৬/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast