www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মেঘের নিচে পাহাড় দেশে

“ মেঘের নিচে পাহাড় দেশে ’’

যান্ত্রিক জীবন থেকে একটু দূরে গিয়ে নিজেকে রিফ্রেশ করতে কার না মন চায়? আমারও মাঝে মাঝে খোলা আকাশের নিচে, সবুজ প্রকৃতির মাঝে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে খুব ইচ্ছে হয় , পারিনা ! আমিতো নেশায় - পেশায় ,যে জালে জড়িয়ে পরেছি,এ জাল কেটে বের হতে চাইলেই কোন কোন সময় সুযোগের অভাবে বের হওয়া যায় না ।

সুযোগ এলো ! কিন্তু সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন, ডিসেম্বর মাস আমার স্কুলের ভর্তির সময় । এ সময়ে আমি না থাকলে অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে । তাই কী করবো ভেবে পাচ্ছিনা । দু’ নৌকায় পা দিয়ে ভাবতে লাগলাম ,যে নৌকা ভারী হবে সেটায় চড়ে বসবো ,তাই হলো ।আমানের পীঁড়াপিড়িতে রাঙামাটি বরকল যেতে রাজি হয়ে গেলাম । বরকলে আলাউদ্দিনের পোস্টিং হয়েছে জোন কমান্ডার হিসেবে । ২৬/১২/১৫ ইং রাতে আমরা শ্যামলী পরিবহনে ঢাকা থেকে রাঙামাটির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । আমাদের সঙ্গী সফর ৫জনআমি,আমান,সম্পা,আশিক, অনিম । সারারাত বাসের ঝাকুনি খেতে খেতে শরীরের অবস্থা মোটামুটি কাহিল ।

ভোর ৫টার দিকে আমাদের বাসটা রাঙ্গামাটি পাহাড়ী এলাকায় ঢুকলো । এঁকেবেকে কুয়াশায় মোড়ানো রাস্তার দুই ধারের পাহাড়গুলো।গাড়ীর সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা । হেলপার গাড়ীর সামনে বসে বারবার গামছা দিয়ে গ্লাসের কুয়াসা মুছে দিচ্ছে । একটু ভয় ভয় লাগছিল । যদি উল্টো দিক থেকে কোন গাড়ী আসে তা হলে রক্ষা নাই । সংঘর্ষ অনিবার্য । একটা গাড়ীর শব্দও পেলাম না । শুধু আমাদের গাড়ীটা এঁকেবেঁকে চলছে অসহায়ের মতো । গাড়ীটা ধীর গতিতে যেতে যেতে রাঙ্গামাটি পৌঁছালো, সকাল ৭ টা ৫ মিনিটে । লোকজন একজন একজন করে নামতে লাগলো । আমরা বসে আছি । এর মধ্যে বিজিবির লোক বাসে উঠে আমাদের কথা ড্রাইভারের কাছে জানতে চাইলো । ড্রাইভার উচ্চস্বরে বললো, বিজিবির লোক কারা আছেন ? তাদের নিতে এসেছে ,নেমে আসুন । আমরা বাক্স পেটরা নিয়ে নেমে এসে বিজিবির গাড়ীতে উঠে বসলাম । উঁচুনিঁচু রাস্তায় গাড়ী চলতে চলতে হঠাৎ গাড়ীর গতিতে একটু আরামদায়ক পরিবর্তন লক্ষ করলাম । গাড়ী সুন্দর মসৃন রোড দিয়ে ন্বিঃশব্দে চলছে । জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি রাঙ্গামাটি ক্যান্টনমেন্ট এরিয়াতে নিয়ে এসেছে । ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া মানে সবারই জানা , ঝকঝকে তকতকে অনন্য সুন্দর এক বিশাল এরিয়া । অপূর্ব সৌন্দর্য্যে ঘেরা বৃক্ষলতা বেষ্টিত পাহাড়ী এলাকার মধ্যদিয়ে মসৃন সড়কে চলতে চলতে সকাল ৮টার দিকে পার্ক করলো । গাড়ী থেকে নেমে আমরা পাহাড়ী সৌন্দর্য দেখতে কিছুক্ষন ঘোরাফেরা করে রেস্ট হাউজে গেলাম । রেস্ট হাউজ বিজিবির অধিনায়কদের জন্য ।

আমাদের জন্য মামুন টেলিফোনে নাস্তার অর্ডার দিয়েছে । নাস্তা খাওয়ার জন্য আমাদের ডাকা হলো । দোতালায় রেস্ট হাউজ ডাইনিং হলে । একই টেবিলে ৫০ জন লোক এক সাথে বসে খেতে পারবে । বসে পড়লাম আমরা নাস্তার টেবিলে । এতো অল্প সময়ের মধ্যে পরোটা ,সবজী আর ডিম ভাজা । সারা রাতের ক্লান্তির পর অসম্ভব সুস্বাদু খেতে লাগলো । এতো সুন্দর করে পরোটা বানিয়েছে । এর কৌশল জানতে চাইলাম । পরোটা তৈরীর মেকার একের পর এক পদ্ধতি বলে দিল। মেকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম । প্রাকৃতিক সুন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য । যে দিকে চোখ যায় শুধু উঁচুনিঁচু পাহাড় । আমরা অপরুপ দৃশ্য দেখতে দেখতে যেতে লাগলাম । পেছনে তাকাতেই দেখি দুজন বিজিবি সৈনিক আমাদের পিছনে পিছনে আসছে । আমরা যদি হারিয়ে যাই !

আঁকাবাঁকা রাস্তার দুপাশে সোনা রোদ মাখা পাহাড় আরো রুপালি রুপ ধারন করছে । হীমেল হাওয়ায় একটু একটু শীত শীত লাগছে । শীতে হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌঁছে গেলাম হ্যালিপ্যাডে। হ্যালিপ্যাড তৈরী করেছে পাহাড় কেটে । হ্যালিপ্যাডে দাঁড়িয়ে আমরা মিশকালো মসৃন পাহাড়ী পথের দু’ধারে চোখ জুড়ানো প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে থাকি । চারদিকে সবুজের সমারোহ । পাহাড় গুলো মাথা উচিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে । হ্যালিপ্যাডের গায়ে জড়ানো আছে সবুজ চাদর ।

মামুন বার বার ফোন করে আমাদের খোঁজ খবর নিচ্ছে । বেশী কুয়াশার কারনে আমাদের নীতে আসতে পারছে না । তাই আমরা রাঙ্গামাটি দেখার বেশি সময় পেলাম । সকাল ১০টার দিকে মামুন এলো । বিজিবির গাড়ী করে আমাদের রাঙ্গামাটির দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখালো । আমাদের সাথে ড্রাইভার ছাড়াও দুইজন (২) সৈনিক সর্বক্ষন আছে । আমরা চাকমাদের ড্রেস কিনলাম । অনিম হাতির দাঁতের শোপিছ কিনলো । আরো টুকিটাকি কিছু কেনাকাটা করে আমরা নদীর ঘাটে পৌছেগেলাম । চোখ জুড়িয়ে গেল । আহা! প্রকৃতি কত সুন্দর । নদীর পাড় জুড়ে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে এক একটি পাহাড় । আবহাওয়া অনেক চমৎকার ছিল । নির্মেঘ নীলাকাশে উজ্জল সূর্য কিরণ দিচ্ছিল ।

আমরা স্পীটবোটে উঠে বসলাম । মামুন ও কয়েকজন সৈনিক আমাদের গার্ড দিয়ে নিয়ে চললো বরকলের উদ্দেশ্যে । নদীর দু’ধারে অপূর্ব সৌন্দর্য্যের হাতছানি । আর চমৎকার ঘন নাম না জানা অসংখ্য বৃক্ষরাশি ।

কর্ণফুলি নদীর নাম শুনেছি ,কোনদিন চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি । তবে এসব জায়গা যে না দেখেছে তার বাংলার প্রাকৃতিক রুপ বৈচিত্র অদেখাই রয়ে গেছে।

স্পীটবোট তার নিজস্ব গতীতে চলছে । আমরা নদীর দুই ধারের অফুরন্ত সৌন্দর্য্যরে লীলাভুমি দেখতে দেখতে হারিয়ে যাচ্ছি কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ের সবুজের সমারোহে । শীতের দিনে পাহাড়ের সবুজ রং কুয়াশায় মোড়ানো । আমরা নদী পথ বেশ উপভোগ করছি ।প্রত্যেকের হাতে ক্যামেরা, কেউ ভিডিও কেউবা ক্লীক ক্লীক ছবি তুলেই যাচ্ছে । উঁচুনিঁচু পাহাড় এর কোন শেষ নেই । নদীর পানি নীরব ,শান্ত । চলন্ত স্পীটবোট ঢেউয়ে কর্ণফুলি কল কল শব্দে এগিয়ে যাচ্ছে ।

স্বচ্ছ নীল জলরাশি আর দু’ধারের অপরুপ সৌন্দর্র্যে আমাদের কাছে এক দূর্লভ আর্কষন । আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের সৌন্দর্য্যে আমরা মুগ্ধ হয়ে, ভাষাহীন দৃষ্টিতে, কয়েক হাজার ফুট ওপর থেকে নেমে আসা ঝরনার দৃশ্য আমাদের নয়ন জুড়য়িে দিচ্ছে। নদীর স্বচ্ছ হিমেল পানি , উঁচু পাহাড়ের গহীন অরন্য ও সুনসান নীরবতা... আমাদের মন প্রান প্রকৃতির প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকে । পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলা ঝরনা,দূর থেকে দেখলে মনে হবে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড় । পাহাড়ের গায়ে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘরাশি । কোন কোন জায়গায় দেখা যাচ্ছে নদীটির চৌরাস্তা , আমার ভয় ভয় লাগছিল । কোন রাস্তায় যাবে ? ভুল হবে না তো! না, বোট চালক তার গন্তেব্যের দিকেই ছুটতে লাগলো। যে দিকে তাকাই সে দিকেই পাহাড় । যতদূর চোখ যায় কেবল পাহাড়ের বিস্তীর্ন মানচিত্র ।

আমাদের যাত্রা পথে ছোট একটা দ্বীপ চোখে পড়লো । আমাদের বোটটা দ্বীপের কোল ঘেষে যেতে লাগলো । পুরো দ্বীপটা জুড়ে শুকরের দল নির্ভয়ে স্বগর্বে ঘুরে বেড়াচ্ছে । বইয়ে পড়েছি পান কৌড়ির কথা । কিন্তু পানির উপর দিয়ে এরা দ্রুত গতিতে হাঁটতে পারে তা জানা ছিল না । ওদের হাঁটা দেখে মনে হলো সমতল ভূমিতে পানকৌড়িগুলো দৌঁড়ের প্রতিযোগিতায় নেমেছে । আবার কেউ কেউ ডুব দিয়ে অর্নিদষ্টি সময়ের জন্য হারিয়ে যাচ্ছে । কতক্ষন পানির নিচে থাকবে তা সেই জানে ।

নানান বৈচিত্রময় দৃশ্য দেখতে দেখতে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে বেশী দেরী নেই ,বুঝতে পারলাম বোট ঘাটে সারিবদ্ধভাবে বিজিবি সৈন্যরা লে: কর্নেল আলাউদ্দিন আল মামুনকে গার্ড অব অনার জানিয়ে , সেই সাথে আমাদেরর স্ব- সম্মানে বোট থেকে নামতে সহযোগিতা করলো । মামুনের এতো সম্মান দেখে আনন্দে বুকটা ভরে গেল । আমার আলাউদ্দিন এতো সম্মানিত ব্যাক্তি !! প্রান ভরে দোয়া করলাম । আল্লাহ তুমি ওকে আরো অনেক বড় কর ,ওর মংগল কর । মামুন ওর বাসাটা আঙ্গুল দিয়ে দেখালো । বাসাটা দেখতে চোখ কপালে তুলে ,ঘাড় উচিয়ে দেখতে হলো ।পাহাড় কেটে ছোট ছোট সিঁড়ি তৈরী করা হয়েছে । সেই সিঁড়ি দিয়ে আমরা উঠতে লাগলাম ।

১৩০ টা ধাপ পার করে আলাউদ্দিনের বাসার সামনে উপস্থিত হয়ে অথিতি আপায়নের নতুন কৌশল দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম। তানিয়া,তৌসিফ,মাহির,আয়শা,সবাই আমাদের রিসিভ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে । ওদের সাথে ২৫/২৬ বছরের একটি ছেলে একটা ট্রেতে করে ছোট ছোট টাওয়াল ভেজানো এবং সেটা এতো সুন্দর করে মোড়ানো! দেখে মনে হচ্ছে এটা কনো খাবার হবে, যখন প্রত্যেকের হাতে একটা করে ধরিয়ে দিল , হাতে নিতেই বোঝা গেল, জার্নির ক্লান্তি দূর করতে ভেজা টাওয়াল হাতে দেওয়া হয়েছে । আমরা সবাই ভেজা টাওয়াল দিয়ে হাত মুখ মুছে গোল ঘরে বসে পড়লাম । ৫ মিনিটের মধ্যে এসে গেল ,স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাসে হালকা ঘোলা পানি । পান করে বুঝতে পারলাম ডাবের পানি ।

তানিয়ার আতিথিয়তার কথা বলে শেষ করা যাবে না । অতীব মিষ্টি হাসি দিয়ে আমাদেরকে স্বাগতম জানিয়ে বললো , আপনাদের আসতে কোন কষ্ট হয়নিতো ? তানিয়ার আন্তরিকতা দেখে আমরা মুগ্ধ হলাম। আর হৃদয় জুড়ানো স্নিগ্ধ হাওয়ায় আমাদের দেহমনকে পরিতৃপ্তিতে ভরিয়ে দিল ।

সবাই ক্লান্তি দূর করতে করতে দুপুরের খাবার খেতে একটু বিলম্ব হলো। রেষ্ট হাউজ ডাইনিং হলে আমাদের খাবারের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো । যেতেই চোখে পড়লো খোদাই করে লেখা “মায়ানীড়’’ তার মানে রেষ্ট হাউজ ডাইনিং হলের নাম “মায়ানীড়’’ । আমরা মায়ানীড়ে প্রবেশ করলাম । খাবারের মেনু দেখে আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম । হরেক রকমের তরকারী,থরে থরে সাজিয়ে রেখেছে । আর দেরী না করে তৃপ্তি সহকারে সুস্বাদু তরকারী আর খেজুর গুরের পায়েস খেয়ে নিলাম ।

খাবার পর আমরা গোল ঘরে আরাম করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে খোশ গল্প শুরু করলাম । গল্প করতে করতে কখন যে গোধূলির হালকা আলো অদৃশ্য হয়ে রাত নেমে এসেছে তা টেরই পাইনি । এক এক করে সবাই চলে গেছে ,আমরা তিন ভাই বোন, কথার ডালি নিয়ে দূর অতীতে হারিয়ে গেলাম । ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা শব্দ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ফেলছিল । আমাদের কথা শেষ হচ্ছে না ।

ছোট আয়শা ,আয়শার বয়স ৩ বছর , বার বার আমাদের ডাকছে । ওর ডাকে আমাদের সংবিৎ ফিরে এলো । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ১২ টা পার হয়ে গেছে ।

মামুন যে বাংলোতে থাকে তার নাম ’’ মায়ামী ’’ বাংলোটি আ¤্রােকাননে ঘেরা । ডাইনিং হল থেকে বের হয়ে সরু রাস্তার দুই ধারে গাঁদা ফুলের হলুদ রংয়ে বাংলোর সৌন্দর্য্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে । দক্ষিন দিকে থোকা থোকা লিচু গাছ । আর আকাশ ছোঁয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ঘেরা পাহাড়। পাহাড়ের সবুজ রং কুয়াশায় মোড়ানো । দূর থেকে মনে হয় আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড় । পাহাড়ের গায়ে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘরাশি ।

বাড়ীর উত্তর পাশে আম গাছ লাগানো । ঢাকাতে শীত মৌসুমে গাছের পাতা ধূলার প্রলেপে মোড়ানো থাকে । বরকলের গাছগুলো ধূলাহীন।এমন পরিবেশে শ্বাস-প্রঃশ্বাসে থাকে ফুরফুরে ভাব । বাংলোর প্রবেশ দ্বারে খোদাই করে লেখা “মায়াবী’’ তার নিচে লেখা অধিনায়কের বাস ভবন ।

উত্তর পাশে আরো আছে পাখিদের বাসা । সেখানে বাস করছে নানা জাতের পাখি । সারাক্ষন পাখির কিচির মিচির শব্দ । এ এক দূলর্ভ আর্কষন । এক কথায় রুপকথার সৌন্দর্যে ছেয়ে আছে বাংলোটি ।

রাতে খাবারের পর আমি ,আমান ,সম্পা গেলাম আরো ৫০টি সিড়ি বেয়ে আরেকটি বাংলোতে ঘুমাতে । তার নাম “মধুচন্দ্রীমা’’ ।সুন্দর সু-সজ্জিত পরিপাটি আসবাব ও বিছানাপত্র । আমি বসে থাকতে পাছিলাম না । ঘুমে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল । ঘুমিয়ে পড়লাম ।

শেষ রাতের দিকে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল । শীতে সারা শরীর কাঁপছে। বুঝতে পারলাম ,আমি গরম কাপড়হীন । তারাতাড়ি গায়ে লেপটা জড়িয়ে ভাবনায় পড়ে গেলাম । শীতের দিনে বৃষ্টি হলে আমাদের বেড়ানোটা কষ্টদায়ক হয়ে যাবে । বিছানা ছেড়ে উঠে ওজু করে ফজরের নামাজ আদায় করলাম । বৃষ্টির দৃশ্য দেখার জন্য দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে কুয়াশায় ভেজা ঝিরঝিরে হাওয়া ঢুকে পড়লো রুমের মধ্যে । বৃষ্টি নয়, বিন্দু বিন্দু শিশির গাছের পাতায় জমে তা বৃষ্টির মতো পড়ছে। বেরিয়ে পড়লাম শিশির ভেজা মেঠো পথে। শীতের সকালে পাহাড় গুলো কুয়াশাচ্ছন্ন । পুরো পাহাড়গুলো কুয়াশায় ঢাকা । পাহাড়ের কোলজুড়ে রয়েছে কুয়াশার বিছানা ।

সবাই সকালের নাস্তা খাওয়ার জন্য গোলঘরে একত্রিত হলাম। প্রথমে দেওয়া হলো সুস্বাদু সুরভিত নরম খিচুড়ী , আর দেশী মুরগীর ডিম ভুনা । খিচুড়ী করা হয়েছে বিন্নি ধানের চাল দিয়ে । তার প্রতি দানা শুভ্র তুষারের মতো । অনেক তৃপ্তি সহকারে খেতে খেতে দেখি দুধে ভেজানো চিতই পিঠা । খাওয়া শেষে প্রত্যেকে এক মগ করে কফি । খাওয়ার আর পেটে কোন জায়গা নেই । তানিয়ার আতিথেয়তার জুড়ি নেই । সে কোন কথাই শুনতে চায়না , খেতেই হবে ।

খাওয়া শেষে আমাদের বরকল ঘুরে দেখার জন্য তানিয়া প্রস্তাব করল কোথায় যাবেন ? আমি বললাম,বরকলের কলেজটা দেখে আসি । মাহির বলতে লাগলো ফুপি অতদূর উঠতে পারবে না । তানিয়া সাহস যোগাতে লাগলো । তানিয়া বিজিবির দুই তিন জন সৈন্য আমাদের সাথে যেতে বললো । সৈন্যরা তাদের অস্ত্র নিয়ে আমাদের সাথে যেতে প্রস্তুত হলো । আমাদের সফর সঙ্গী হলো ১১ জন । আবহাওয়া অনেক চমৎকার ছিল। নির্মেঘ নীলাকাশে প্রখর সূর্যের তাপ অনুভব করছিলাম । শুষ্ক মৌসুম, দূর্গম পথ ,আমরা হেঁটেই চলছি । যাত্রা পথ আমাদের দূর্গম ও কষ্টসাধ্য তবু আমরা পিছ্পা হচ্ছি না । হেঁটেই চলছি । পাহাড় ,আকাশ,নদী ও ঝরনা এখানে মিলেমিশে একাকার । পাহাড়ি রাস্তা উচু নিচু ,রাস্তার দু’ধারে নাম না জানা অসংখ্য বন ফুল ফুটে বৃক্ষরাশিকে সুসজ্জিত করে রেখেছে । আমরা হেঁটেই চলছি । পা আর চলছে না । মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার চলার চেষ্টা করছি । তানিয়া গাছের ডাল ভেঙ্গে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিল । লাঠিতে ভর করে হাঁটতে একটু কষ্ট কম হতে লাগলো ।তানিয়ার বুদ্ধির প্রসংসা করে ধন্যবাদ জানালাম । পাহাড়ের সবুজ রং আমাদের মনকে রাঙ্গিয়ে তুললো। উঁচুনিঁচু পাহাড়ি পথ। পথে পথে ছোট ছোট যুম ঘর।তাতে বাস করে উপজাতি আদি -বাসিরা ।
বাসা থেকে বের হতে প্রত্যেকে শীতের কাপড় পরে বের হয়েছি । পাহাড়ের চূড়া বেয়ে নামা সকালের নির্মল সোনালী রোদে আমাদের গরম ধরিয়ে দিল । সোয়েটার খুলে হাতে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম । গভীর অরন্যের মধ্যে সরু কাঁচা রাস্তা , জনমানবের কনো বালাই নাই । সৈনিকরা তাদের অস্ত্র হাতে বীরদর্পে এগিয়ে চলেছে । দূর্গম রাস্তা ওদের কাছে কিছুই মনে হচ্ছে না । প্রায় ১ ঘন্টার মতো হেঁটে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছালাম । উঁচুনিঁচু পাহাড় বেষ্টিত বরকল রাগীব রাবেয়া কলেজ । কলেজটির জায়গাটা দূর্গম ও নির্জন । কলেজ বন্ধ
থাকায় আমরা ভেতরে কিছুই দেখতে পারলাম না । কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকাতেই মনে হচ্ছে, মাছ ধরা নৌকাগুলো ছোট ছোট পিঁপড়ার মতো ধীর পায়ে হেঁেট চলছে । আর পাহাড়ের সবুজাভ চূড়ায় তুলার মতো মেঘরাশি গুলোভেসে বেড়াচ্ছে । সেই সঙ্গে কয়েক হাজার ফুট ওপর থেকে নেমে আসা ঝরনার দৃশ্য সবার মন জুড়িয়ে দিচ্ছে ।

আমরা ফেরার পথে আদিবাসিদের সাথে ছবি তুললাম । ওদের ছোট ছোট মাটির ঘরগুলো সুন্দরমাটির প্রলেপ দেওয়া । ঘরে কোন দামী আসবাব নেই । আছে একটি বিছানা , কয়েকটি থালাবাটি । একটা ব্যাপার আমার অবাক লাগছিল । ওরা যখন আমাদের সাথে কথা বলে ,তখন স্পষ্ট বাংলা বলে । নিজেরা যখন কথা বলে ওদের ভাষায় অবলিলায় বলতে থাকে । ওদের বেশভূষায় জানিয়ে দিল ওরা কতটা অভাবী । অভাব সারাক্ষন তাঁড়িয়ে বেড়াচ্ছে । মেয়েরা পিঠে ভারী বোঝা নিয়ে আয়ের উদ্দেশ্যে পাহাড়ী পথ বেয়ে ওঠা নামা করছে ।

তানিয়া আমাদের নদীপথ ভ্রমনের প্রস্তাব করলো । আমরা বোট নৌকায় নদীতে ভ্রমনের জন্য প্রস্তুত হলাম । তানিয়া ফোন করে নৌকার ব্যাবস্থা করে ফেললো । আমরা নৌকায় উঠে বসলাম । আমাদের সাথে কয়েকজন সৈনিক উঠে বসলো । আমাদের নৌকাটা ধীরগতিতে কলকল শব্দে চলতে লাগলো ।

নদীর স্বচ্ছ হিমেল পানি,উচু পাহাড়ে গহিন অরণ্য আমাদের মুগ্ধ করে তুললো । আসিক,অনিম নৌকার সামনে বসেছে । আমরা সবাই ভেতর ছইয়ের মধ্যে বসেছি। আমি লোভ সামলাতে না পেরে ওদের কাছে গিয়ে বসলাম । শীতের রোদ ভালো লাগতে লাগতে মাথাটা গরম হয়ে উঠছিল। তাই শাড়ীর আচলটা মাথায় টেনে দিয়ে নীল আকাশটার সাদা মেঘের ভেসে বেড়ানো দেখতে লাগলাম । অন্যদিকে ঘন সবুজ পাহাড়ী গাছ। বন থেকে ভেসে আসছে নাম না জানা পাখির কূজন ।

নীল জলরাশি আর চারধারের হলুদ সবুজের অর্পূব সৌন্দর্য আমাদের নৌ ভ্রমনকে আনন্দে মুখরিত করে তুললো ।নৌকা যতই এগুচ্ছে পাহাড় আর নদীর মিলনকে আমাদের কাছে অসাধারন ভাললাগা শুরু করলো । এ ভাল লাগা প্রকাশ করতে পারছি না । শুধু অনুভব করছি । নৌকায় বসে মাথা উঁচু করে পাহাড়ের লীলাভূমি এতো অপূর্ব যে,বলতে গিয়েও থেমে যাচ্ছি । কোথাও কোথাও মাটির ধস্ নামায় ঝুলছে কালো কুচকুচে রাশিরাশি ঘাসের শিকড় । কোথাও কোথাও মনে হচ্ছে স্কেল দিয়ে মাটির গায়ে দাগ টেনে দিয়েছে। বোঝা যাচ্ছে এক একটা দাগ এক একটা মাটির স্তর ।

নৌকাটা যে দিকে যাচ্ছে সে দিকেই অর্পূব সৌন্দর্য্যূের হাতছানি। আর চমৎকার ঘন সবুজ নাম না জানা অসংখ্য বৃক্ষরাশি । ছোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা হারিয়ে গেলাম ,পাহাড়ের পাদদেশে সবুজরঙ্গা নদীর মধ্যে । ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় আদিবাসি মেয়েরা চলাফেরা করছে । কেউ কেউ ধান রোপন করছে। আদিবাসি মেয়েদের পোশাকের কথা আমরা সবাই জানি ।

দুপুরের খাবারের জন্য আমরা ডাইনিং হলে উপস্থিত হলাম। মিললো চমৎকার রুপালি মাছের ফিসকারী, কয়েক পদের মাছ, পাবদা, বোয়াল, চেলা । ঘন লাল ঝোলের প্রলেপ। ছোট মাছের চচ্চড়।ি সদ্য নদী থেকে ধরে এনেছে। স্বাদের কথা আর নাইবা বললাম। শুনলে মুখে পানি এসে যাবে।

খাওয়া শেষে আবার গোল ঘরে এসে বসলাম । বিকেল বেলার রোদ পাহাড়ের গায়ে পরে কুয়াশাকে তাঁড়িয়ে দিয়েছে । শেষ বেলার সূর্য কিরণ নদীর পানিতে পড়ায় মনে হচ্ছে অগনিত তাঁরা পানিতে জ্বলছে নিভছে ।
সোনালী সূর্য বিদায় বেলায় বকের ঝাকগুলো নীড়ে ফিরছে। নদীর উপর দিয়ে ,পানি ছুঁইছুঁই। বুঝতে পারলাম না এর কারন কি । আরো উপর দিয়েও তো যেতে পারতো ! গোল ঘরে বসে বসে দেখছি। সন্ধ্যা নামলো দিনের কিছু আলো পাহাড়ের বিস্তৃত আকাশে ঘোরাফেরা করছে। দেখতে অপূর্ব লাগছে।

শীতকাল পাতাঝরা একটি গাছ গোল ঘরের সামনে অসহায়ের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। চিনতে পারলাম না । গাছটার নাম কি । গাছটার পাতা, ফুল,ফল কিছুই নেই । তবু তার সৌন্দর্য্যরে কমতি নেই । অন্ধকার নেমে আসতে আসতেই চোখে পড়লো পাহাড় ঘেঁষা জোছনা । জোছনার আলোয় আলোকিত হলো পাহাড়ি জনপদ । আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি তাঁরায় তাঁরায় ঘেরা পূর্নিমার চাঁদ উঠেছে । পূর্নিমার চাঁদের আলো মনকে আরো রাঙিয়ে তুললো । বেরিয়ে পড়লাম আমি,তানিয়া, সম্পা । অনেকক্ষন তিনজন হাঁটলাম । জোছনার ধবধবে আলোয় নদীর পানি ,পাহাড়ের সবুজ,অপূর্ব শোভা ছড়াচ্ছে। হাজারও তাঁরার দল সবুজ পাহাড়ের আকাশে ঝলমল করছে । এতো সৌন্দর্য্যরে বর্ণনা খুব লিখতে ইচ্ছে করছে । ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বের করে লিখতে বসলাম । লিখতে গিয়ে থমকে গেলাম । এতো সৌন্দর্য্যরে বর্ননা আমার মতো মানুষ কী লিখতে পারবে ? কাগজ কলম রেখে দিয়ে ঘুমিয়ে পরলাম ।
পাখির কিচির মিচির শব্দ জানিয়ে দিল ,ভোর হয়েছে। উঠে ফজরের নামাজ পড়ে ,দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লাম । শিশির ভেজা ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভোরের সূর্যের উকিঝুকি দেখছি।কুয়াশায় অসপষ্টতা কাটতে না কাটতেই সূর্যের আলো কর্ণফুলি নদীর অথৈ জলরাশির উপর পড়ে চিকচিক করছে ।


সকালের নাস্তা সেরে সবাই মিলে মামুনের অফিস দেখতে বের হলাম । আবার সেই সিঁড়ি বেয়ে ওঠা । প্রায় ৬০৬ টা ছোট ছোট সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম । পাহাড় কেটে এতো সুন্দর অফিস করেছে! অফিসের সামনে নানা জাতের ফুলের বাগান। পাহাড়ের ওপরে বাগান মানে দক্ষ মালির কাজ । মালিকে ডেকে নাম না জানা ফুলের নামগুলো জেনে নিলাম । এও বললাম ঢাকায় ফেরার সময় কিছু কিছু ফুলের চারা আমাদের দিতে । মালি পুলকিত মনে জানালো কোন অসুবিধা নাই । যখন দরকার আমাকে বললেই হবে ।
বাগানে অনেকগুলো গোলাপ ফুটে তার সুরভী ছড়াচ্ছে চারপাশে। গোলাপ, ফুলের রানী বলেই তার সৌন্দর্যে বাগানটি আরো মনোরম দৃশ্য ধারন করেছে ।

মামুনের অফিস থেকে বের হয়ে আরো উপরে উঠতে লাগলাম। উঠতে উঠতে সবাই হাঁপিয়ে যেতে যেতে পেয়ে গেলাম আরেকটি হ্যালিপ্যাড । পুরো হ্যালিপ্যাডের চারপাশ সবুজে মোড়ানো । প্রকৃতির সবুজ র্কাপেটের উপর বসে পড়লাম সবাই । আমাদের দেখে বিজিবির সৈনিকরা এগিয়ে এসে কোন কিছু প্রয়োজন আছে কিনা জানতে চাইলো । পানি আর চা খাওয়ার প্রস্তাব করা হলো । এতো উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় মুহুর্তের মধ্যে পানি ও চায়ের ব্যবস্থা করে ফেললো । আমরা প্রকৃতির র্কাপেটের উপর বসে আরাম করে পানি ও চা পান করলাম । খোলা আকাশের নিচে ঝিরঝিরে হাওয়ায় বসে চা পান করার স্বাদ যে না খেয়েছে ,সে এ তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে।


(চলবে......)
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ৯২১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৯/০৬/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast