www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সাবিনা চলেই যাচ্ছে

সাবিনা কাল সকালে বর্ডার পাস হয়ে ইন্ডিয়ায় চলে যাবে। আজ রাতটা এই অল্পপরিচিত লোকটার সাথে কোনো একটা অপরিচিত জায়গায় থাকবে। তারপর সকাল হলেই বিজিবি, বিএসএফ এর চোখে নিজেকে আড়াল করে চলে যাবে কুচবিহার; তার একান্ত আপন ঠিকানায়। এই জীবনে কোনোদিন হয়তো আর ফেরা হবেনা এই পোড়াদেশে।

হ্যাঁ, নদীর ধারে মাথায় করে নুড়ি পাথর টানার কাজ করা কুচবিহারের মেয়ে দিনমজুর সাবিনার কথা বলছি। সে গত তিন বছর আগে বাংলাদেশের ছেলে সোহেলের ভরসার হাতে হাত রেখে সব ছেড়ে চলে এসেছিলো এদেশে।

সোহেল তখন সেখানকার একটা কনস্ট্রাকশনে রাজমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতো। সেখানে সাবিনাও তখন মাথায় করে সুড়কি টানার কাজ করতো। আর তাদের পরিচয়টাও সেখানেই। তারপর আস্তে আস্তে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠে তাদের মধ্যে। দেখাদেখি, কথাবার্তা, কাজ শেষে সন্ধ্যায় নদীর ধারে ঘুরতে যাওয়া; এভাবে কেটে গেলো দু'মাস। এদিকে কনস্ট্রাকশনের কাজ শেষ তাই সোহেল দেশে ফিরে আসবে। কিন্তু তাদের চলাফেরাগুলো এতোদিনে প্রণয়ে রূপ নিয়ে নিয়েছে। সেজন্যে সাবিনা গোপনে সোহেলের সাথে বাংলাদেশে চলে আসে।

দেশে এসে সোহেল সাবিনাকে নিয়ে বাড়িতে উঠতে পারেনি তাই তাকে বিয়ে করে ঢাকার পাশেই সাভারের দিকে একটা ছোট রুম ভাড়া নিয়েছে। তার পাশের একটা গার্মেন্টসে দু'জনই চাকরিও নিয়েছে। বেশ সুখী-সুখী সময় কাটাচ্ছে তাদের ছোট সংসারটা। সাবিনার ভাঙাচোরা জীবনেও এমন একরাশ সুখ চলে আসবে তা সে আগে কোনোদিন ভেবেছিলো কিনা জানিনা।

তারপর তাদের সংসারের বয়স যখন দু'বছর তখন হঠাৎ একদিন রক্তের মানুষদের জন্য সাবিনার বুকটা হুঁ-হুঁ করে কেঁদে উঠলো। সে সোহেলকে একদিন বলে ফেললো তার মনের কথাটা,
'আমারে একদিন একটু দেশে নিয়া যাইবা?'
'তোরে না আগেই কইসি, কোনোদিন দেশে যাওয়ার কথা কইবিনা।'
'মা'ডার লাইগা মনডা খুব পুড়তাসে গো। যাও না একটু নিয়া, দুইদিন থাইকাই চইলা আইমু।'
'এই কথা আর শুনতাম চাইনা, দেশে যদি যাইতে চাস তাইলে একেবার যাইতে হইবো।'

তারপর থেকে সাবিনা তার মনের দহনের কথা আর বলেনা। কিন্তু ততোদিনে তবুও তার জীবনে নেমে আসলো দুঃখ আর অবিরত নির্যাতন। সম্মুখে ভেসে উঠতে লাগলো তার সমস্ত ভুলত্রুটি। সোহেল প্রতিরাতেই তাকে মারধর করতো আর সে তখন সোহেলের পায়ে ধরে পড়ে থাকতো। এসবের কারণ সাবিনা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেনা। শুধু কি তার দেশে যাওয়ার কথা বলা নাকি অন্যকিছু?

তার কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন সাবিনা জানতে পারলো, সোহেল নাকি তার গার্মেন্টসের ফিনিশিং সেকশনের এক মেয়ের সাথে প্রেম করছে। এসব কথা সোহেলকে বলায় তার ভাগ্যে নেমে আসলো আরও অন্ধকার এক মেঘমালা; যার নিচে শুধু দুর্দশা ছাড়া আর কিছুই নেই।

এভাবে চলতে থাকলে একসময় সাবিনা হাল ছেড়ে দেয়। সে সিদ্ধান্ত নেয় এই সংসার, এই মানুষ আর এই পোড়াদেশ ছেড়ে চলে যাবে তার আপন দেশে। সেজন্যে সে অনেকের কাছে গিয়েছে কিন্তু কোথাও সাহায্য পায়নি। ততোদিনে সোহেলের সাথে তার তালাকও হয়ে গেছে। তারপর একদিন একজন এগিয়ে আসলো। তিনি তাকে বর্ডারের কাছাকাছি নিয়ে যেতে চাইলেন। সাবিনার তখনও কোনো পিছুটান ছিলো কিনা জানিনা তবুও সে একবুক অনিশ্চয়তা সাথে নিয়েই সেই লোকের সাথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

যতোদূর জানি, আজকেই তাদের যাওয়ার কথা। আজ রাতে, কাল সকালে কিংবা তারও পরে সাবিনার ভাগ্যে কী আছে জানিনা। শুধু প্রার্থনা এইটুকু যে, সাবিনা ভালো থাকুক।

এখন কথা হচ্ছে, আমরা মানে ফেমিনিস্টরা নারীর অধিকার নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। অবাধে চলাফেরার অধিকার দিচ্ছি, কর্মক্ষেত্রে সম-অধিকার দিচ্ছি, রাস্তায় গাড়ি চালানো কিংবা সিনেমা হলে একা সিনেমা দেখার অধিকার দিচ্ছি; সব ঠিক আছে। কিন্তু প্রতিদিন কতো শত সাবিনা এই পোড়া দেশে পড়ে আছে অথবা তাদের কেউ কেউ ক্লান্ত মন নিয়ে বর্ডার পাস হয়ে পুরোনো ঠিকানায় কিংবা শেষ ঠিকানায় চলে যাচ্ছে; সেসবের হিসেবটাই শুধু রাখা হচ্ছেনা। কী অদ্ভুত!
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ৬১৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৫/০৭/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • এবিষয়গুলো খুবই সংবেদনশীল।এগুলো আমাদের পোড়ায়...
 
Quantcast